Ajker Patrika

কাজী রোজী, কণ্ঠেই যিনি মুক্তিযোদ্ধা

আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৪: ৫৫
কাজী রোজী, কণ্ঠেই যিনি মুক্তিযোদ্ধা

বাতাসে ভেজা মাটির চেনা গন্ধ। ভোরে বৃষ্টি হয়েছিল, তাই এমন ভেজা রূপে সেজেছে চারদিক। এমন দিনে বসে আড্ডাটা ভালোই জমে; তা যদি হয় কবিতা আর গানের, তবে তো কথাই নেই! আর বুকের ভেতর যদি জাগে একাত্তরের শিহরণ? সেদিন গান, কবিতা আর একাত্তরের আড্ডায় মনে হচ্ছিল এখনই রণক্ষেত্রে নেমে যাই, গুঁড়িয়ে দিই রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের! মনে হবে না কেন, সাহস আর প্রেরণা হয়ে যে সামনে ছিলেন কাজী রোজী স্বয়ং। তিনি কবি এবং আরও অনেক কিছু। বলছি ২০১৪ সালের জুন মাসের একদিনের কথা। সেদিন প্রথমবারের মতো কবির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। সাংবাদিকতার শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আমি। ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টের জন্যই ছিল সেদিনের আয়োজন। 

আজ সেই দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। না, বয়স ও বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বিচারে তাঁর চলে যাওয়াকে ‘অবেলায়’ শব্দ দিয়ে ঠিক বাঁধা যাবে না। তবে কিছু মানুষ তো থাকেন, যাঁদের প্রস্থান মাত্রই ‘অবেলার ডাক’ বলে মনে হয়। মন বিষণ্ন হয়ে যায়। আর কী আশ্চর্য, সেই প্রথম সাক্ষাতের মতো তাঁর এই চলে যাওয়া দিনও কেমন মেদুর হয়ে আছে বৃষ্টির ছাঁটে। বসন্তের এই বৃষ্টি প্রস্তুতিহীন তো বটেই। তবু প্রশ্ন জাগে, এ কী কবি কাজী রোজীর প্রস্থানকে বিশেষ করে তুলতে প্রকৃতির কোনো আয়োজনও? সে যা-ই হোক, তাঁর প্রস্থান ও প্রথম সাক্ষাতের সঙ্গে এই সময়ের এমন মিলে যাওয়া—মনকে কেমন বিষাদে ভরিয়ে দেয়। সে বিষাদে ডুব দিয়ে মনে মনে খুঁড়ে চলি স্মৃতির প্রান্তর। 

সেদিন সকালে ভেজা প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতে উপস্থিত হয়েছিলাম কাজী রোজীর ধানমন্ডির বাসায়। দেখে চিনতে পারলেন না। না চেনারই কথা। আগে কোনো দিন পরিচয় হয়নি তো! পরিচয় দিতেই খুশি হয়ে বললেন, ‘জানো, তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয় আমিও সেই তরুণ বয়সে আছি।’ 

মানুষটাকে দেখেই বোঝা যায় যে কত ঝড়-তুফানের মোকাবিলা করে কত কঠিন একটা ব্যক্তিত্ব নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। অথচ হৃদয়টা যেন একদম শিশুর মতো। অল্প সময়ের মধ্যেই এমনভাবে আপন করে নিয়েছিলেন, যেন আমি তাঁর কত দিনের চেনা বন্ধু। এর মধ্যে কিছুটা মান-অভিমানের পর্বও সেরে নিয়েছিলেন। কেননা তাঁর পরিবেশন করা নাশতা খেতে দেরি করছিলাম! 

যা হোক, গল্প শুরু করেছিলেন তাঁর জীবনের কঠোর সংগ্রাম দিয়ে। ‘জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ খেতে পারিনি, সেই থেকে আমার সংগ্রাম শুরু। আমি একাত্তরে সংগ্রাম করেছি, যুদ্ধ করেছি। কিন্তু অস্ত্র হাতে নিয়ে নয়। এ নিয়ে কিছুটা আক্ষেপ আছে। তবে আমি ছিলাম শব্দসৈনিক। স্বাধীন বাংলা বেতারে আবৃত্তি করতাম। বেলাল মাহমুদের হাত ধরেই সেখানে যাওয়া। কিছু গান, কবিতা আর নাটকও লিখেছি।’ 

এভাবে নতুন করে নিজের পরিচয় দিয়ে চলে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল স্মৃতিতে—‘যুদ্ধ শুরুর আগের কিছু কথা বলে নিই। আমরা থাকতাম মিরপুরে। আমার প্রতিবেশী ও বন্ধু ছিল মেহেরুন্নেসা। মিরপুরে ছিল বিহারিদের আস্তানা। সেখানে উর্দুভাষী অবাঙালিরা বাস করত। তারা বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করত। কারও ডিমের খাঁচা ভেঙে ফেলত, কারও পান-সিগারেটের দোকান ভেঙে ফেলত, এমনকি শিশু ও মেয়েদেরও ধরে নিয়ে যেত। আমার চোখের সামনেই ঘটত এসব ঘটনা। আগে ভেবেছিলাম এদের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করব। কিন্তু না, পরে চিন্তা করলাম এদের সঙ্গে ঠিকভাবে বসবাস হবে না। কারণ, আমরা বাঙালি, বাংলায় কথা বলি। আর ওদের ভাষা উর্দু। তখন আমরা কয়েকজন তরুণ এসবের প্রতিবাদ করতাম। আমাদের সঙ্গে বন্ধু মেহেরুন্নেসাও ছিল।’ 

সেসব স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতেই চলে এলেন অবধারিত সেই কালরাতে, যেখানে তাঁর প্রজন্মের সবাইকেই অন্তত একবার দাঁড়াতে হয় চুপচাপ, থমকে যেতে হয়, টানতে হয় দীর্ঘশ্বাস। বলতে থাকলেন, ‘২৫ মার্চ বিকেলে খবর পেলাম আমার বাসায় হামলা হবে। আমাকে মেরে ফেলা হবে। তখনো জানি না সেই রাত হতে চলেছে ভয়ংকর কালরাত। এর আগেও আমাকে বিহারিরা হত্যা করতে এসেছিল। কিন্তু পারেনি। আমাদের এক মামা ছিলেন। পাড়ার সবাই তাঁকে শহীদ মামা ডাকত। সেই শহীদ মামা আমাকে সেদিন বাঁচিয়েছিলেন। নইলে এই কাজী রোজীকে তোমরা দেখতে পেতে না।’ 

বিপদ টের পেয়ে রোজী চলে যান কলাবাগানে। বন্ধু মেহেরুন্নেসাকেও অন্য কোথাও চলে যেতে বলেছিলেন। তিনি শোনেননি। রোজী বলছেন, ‘মেহেরকেও বলেছিলাম যে এখান (মিরপুর) থেকে অন্য কোথাও চলে যাও। কিন্তু ও বলেছিল, “কোথায় যাব, আমার তো পরিবার ছেড়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ” সেদিন আমি চলে গিয়েছিলাম কলাবাগানে আমার খালার বাসায়। এর দুদিন পর ২৭ মার্চ খবর পাই মেহেরুন্নেসাকে সপরিবারে কাদের মোল্লার নির্দেশে পাকিস্তানের দোসররা জবাই করে হত্যা করেছে। আমি ওঁকে বাঁচাতে পারলাম না।’ 

কবি বন্ধু মেহেরুন্নেসার কথা বলতে বলতে কাজী রোজীর বুক থেকে বেরিয়ে আসে অবধারিত দীর্ঘশ্বাস। পরক্ষণেই চোখে মুখে সতেজ হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘আমি কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সংগ্রাম করেছি। আমি সাক্ষ্য দিয়েছি। আমি কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। ২০১১ সালে ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে বলেছি আমি এ কথা। ওরা বারবার বলেছে, আপনি তো দেখেননি। আর আমি বারবার বলেছি, হ্যাঁ আমি দেখিনি, শুনেছি। কিন্তু আমি জানি কাদের মোল্লা কী করতে পারে।’ 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার পর যখন ২০১২ সালে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, তখন বেশ হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু আশা ছাড়েননি কখনো। এ নিয়ে বলছিলেন, ‘সব টেলিভিশন চ্যানেল আর পত্রিকা আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল। আমি বলেছি, এই রায় আমার নয়, জনগণের নয়, দেশের নয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি আপিল হবে, রায় হবে। ঠিকই আপিল হয়েছে, ফাঁসির রায় হয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লৌহমানবের মতো সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন বলেই এই রায় কার্যকর হয়েছে।’ বলেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিয়েছিলেন, যেন কত বছরের ঋণ বহু কষ্টে শোধ করতে পারলেন। তার পর একটা প্রশান্তির হাসি হাসলেন। 

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে অনেক হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে কাজী রোজীকে। কিন্তু তিনি কোনো কিছুরই পরোয়া করেননি। এমনকি সরকারের কাছ থেকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও নিতে চাননি। 

২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অধিদপ্তর থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণের পর আবার ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সংসদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে যোগ দেন। অভিভূত কবি রোজী জানিয়েছিলেন, ‘আমি সংসদে যেতে পেরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।’ সংসদে তিনি বাজেট নিয়ে নিজের লেখা কবিতাও আবৃত্তি করেছেন। বললেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি আবদার করেছেন তাঁর কাছে, সব সময় যেন তিনি কবিতা লিখে যান। 

বয়সী কিন্তু তারুণ্যদীপ্ত প্রাণোচ্ছল এই মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, তিনি তখন ২১ বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিলেন। তাঁর ভাষায় বলি, ‘আমাকে দেখলে কি মনে হয় আমার ক্যানসার? আমি তো দিব্যি ভালো আছি।’ এভাবে ভালো থাকতে কেমন করে মানসিক শক্তি পাওয়া যায়, তা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে সব সময়। একা একা খারাপ লাগলে দৌড়ে পাশের বাড়িতে চলে যাবে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করবে। এর চেয়ে আর বড় ওষুধ নাই।’ তিনিও নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন সাহিত্যে আর সংসদে, কখনো প্রতিবন্ধীদের মাঝে, আবার কখনো আদিবাসীদের সঙ্গে। এটাই ছিল তাঁর ক্যানসারের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার প্রেরণা। 

আর কবি পরিচয়, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কণ্ঠে শাণিত শব্দ নিয়ে যে যুদ্ধ, তার কথা এ সবের উল্লেখ এখন তো বাতুলতা। স্বাধীন বাংলা বেতারে কবিতা আবৃত্তি করে কত শত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের সাহস জুগিয়েছেন তিনি! লিখেছেন গান, কবিতা, নাটক, আর জীবনী। কত যে লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘পথ ঘাট মানুষের নাম’, ‘নষ্ট জোয়ার’, ‘ভালোবাসার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা’, ‘মানুষের গল্প’, ‘খানিকটা গল্প তোমার’, ‘আমার পিরানের কোন মাপ নেই’, ‘লড়াই’, ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ ইত্যাদি। পেয়েছেন বহু সম্মাননা। আর ভালোবাসা, ভালোবাসা। সে ভালোবাসার জোরেই পাকিস্তানের দোসরদের শাস্তির দাবিতে সংগ্রাম করেছেন বহুদিন। বন্ধু কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যার দায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক বছর কাজ করেছেন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। যুক্ত ছিলেন ডিজেবল রাইটস গ্রুপ, সাবা, লারা, জাতীয় কবিতা পরিষদের সঙ্গে। বহু বছর কাজ করেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিবাসীদের নিয়েও। 

সেদিনের আলাপে তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘স্বপ্নের পথে বাধা আসবেই, হোঁচট খাবেই। কিন্তু কখনো মুখ থুবড়ে পড়ে যেও না। কোনো পথই সরল নয়। পথে কাঁটা থাকবেই। সেই কাঁটা সরিয়ে সরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’ এ যেন নিজের চলার পথেরই এক সারসংক্ষেপ তুলে ধরলেন তিনি মাত্র কয়েকটি শব্দে। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম এই মহিরুহের বচন-বুলি। আরও মুগ্ধ হয়ে গেলাম যখন আড্ডার শেষ মুহূর্তে এসে স্বাধীন বাংলা বেতারের এই শব্দ সৈনিকের ভরাট কণ্ঠে শুনছিলাম প্রতিবন্ধীদের নিয়ে লেখা নিজের একটি কবিতা। এখনো কানে বাজছে শেষ তিনটি বাক্য—
 ‘আমি: বাবা, রঙের শরীরে আলাদা গন্ধ থাকে। সে তো মানুষের চেয়ে কঠিন নয়! 
বাবা: তুই ঠিক বলেছিস-মানুষ ভয়াবহ কঠিন। 
আমি: আমি কঠিনেরে ভালোবাসিলাম বাবা।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আমাদের অর্জন অনেক

সম্পাদকীয়
আমাদের অর্জন অনেক

...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।

এগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে বলে মনে করি না। কিন্তু বর্তমানে এটা কী হচ্ছে? যদি বলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তাহলে সেই না এগোনোর কারণটা কী, তা নিয়ে কেন অর্থপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে না? আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন আকারেই উত্থাপন করছি। আমাদের অর্জন অনেক। আজ আমাদের গার্মেন্টসশিল্প বিশ্বে তৃতীয়। আমরা খুব দ্রুত দ্বিতীয় বা প্রথমের কাতারে চলে যাব। আমাদের লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। প্রতিবছর কৃষির উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এসবের পরেও কী হচ্ছে? বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

... পাকিস্তানিদের কথা আর কী বলব! আক্ষরিক অর্থেই তারা তখন আমাদের পা ধরেছিল। ‘তোমরা এদের ছেড়ে দাও, আমরা নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে এদের বিচার করব।’ ১৯৫ জনকে আমরা চিহ্নিত করি তখন। বঙ্গবন্ধু তখন রাশিয়াতে ছিলেন, তারা সেখানে বঙ্গবন্ধুর কাছে লোক পাঠিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেছে, ‘আপনারা যদি এ বিচার করেন তাহলে ভুট্টোর কল্লা থাকবে না। আমাদের কাছে ফেরত দিন, আমরা এদের বিচার করব।’ এটা সে সময় ‘লন্ডন টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। একেবারে তারা আন্ডারটেকিং দিয়েছে, ‘ছেড়ে দিন, আমরা বিচার করব। আর কোনো সাক্ষী লাগলে তোমাদের ডেকে পাঠানো হবে।’ শিল্পকলা একাডেমির যে বিল্ডিং ভেঙে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে, ওই বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিল স্টেটমেন্টগুলো। এগুলো কী হয়েছে, কে গুম করেছে, আমি জানি না। এর মধ্যে অনেক সরকার এসেছে, গেছে। তবে আমরা খুব পরিশ্রম করেই এগুলো সংগ্রহ করেছিলাম।

সূত্র: শারমিনুর নাহার কর্তৃক ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ; ‘সময় সমাজ ও রাজনীতির ভাষ্য’, পৃষ্ঠা: ৩১-৩২।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এবার অক্সফোর্ডের বর্ষসেরা শব্দ ‘রেজ বেইট’—এর অর্থ কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ০৮
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়েছে।

অক্সফোর্ড জানিয়েছে, চলতি বছর ‘রেজ বেইট’ শব্দের ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, মানুষ এখন আগের চেয়ে দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম প্রভাবিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ও মুহূর্তের মধ্যে রাগ, ক্ষোভ ও বিভাজন তৈরি করছে—যা মূলত এনগেজমেন্ট বাড়ানোর কৌশল।

‘রেজ বেইট’ সব সময় যে বিপজ্জনক হবে, এমন নয়। কখনো এটি হতে পারে অদ্ভুত কোনো রেসিপি বা এমন ভিডিও যেখানে কেউ নিজের পোষা প্রাণী বা পরিবারের সদস্যকে মজার ছলে বিরক্ত করছে। তবে রাজনীতি ও জনপরিসরেও এখন এটি শক্তিশালী হাতিয়ার। কারণ প্ররোচিত ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার ঢেউ অনেক সময়ই রাজনৈতিক প্রচারণাকে আরও উসকে দেয়।

শুধু অক্সফোর্ড নয়, প্রায় সব বড় অভিধানই এবার ইন্টারনেট-সম্পর্কিত শব্দকেই ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। এবার কলিন্স ডিকশনারির বেছে নেওয়া শব্দটি হলো ‘ভয়েস কোডিং’। যেখানে এআই ব্যবহার করে মানুষের ভাষাকে কম্পিউটার কোডে রূপান্তর করা হয়। অন্যদিকে ক্যামব্রিজ ডিকশনারি বেছে নিয়েছে ‘প্যারাসোশ্যাল’ শব্দটি, যা অনলাইনে অপরিচিত কারও সঙ্গে গড়ে ওঠা একতরফা সম্পর্ককে নির্দেশ করে।

গত বছর (২০২৪) অক্সফোর্ড বেছে নিয়েছিল ‘ব্রেইন রট’ শব্দটি, যা ছিল মূলত অবিরাম স্ক্রলিংয়ে মানসিক ক্লান্তির রূপকার্থ। অক্সফোর্ড ল্যাংগুয়েজেসের প্রেসিডেন্ট ক্যাসপার গ্র্যাথওহলের মতে, ‘রেজ বেইট’ এবং ‘ব্রেন রট’—দুটি শব্দই দেখায় কীভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের চিন্তা ও আচরণকে বদলে দিচ্ছে। একটি প্ররোচিত রাগ বাড়ায়, অন্যটি সেই রাগের মধ্যেই মানুষকে আবিষ্ট রাখে।

এ বছর অক্সফোর্ড সাধারণ মানুষের ভোটে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচন করেছে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল আরও দুটি শব্দ—‘অরা ফার্মিং’ ও ‘বায়োহ্যাক’। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি করার কৌশলকে বোঝাতে ‘অরা ফার্মিং’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, আর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বাড়াতে জীবনযাপনে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘বায়োহ্যাক’।

শেষ পর্যন্ত ‘রেজ বেইট’ শব্দটিই জিতেছে—যে শব্দের মধ্য দিয়ে আজকের অনলাইন জীবনের রাগ, প্রতিক্রিয়া এবং ক্লান্তির বাস্তবতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

রাষ্ট্রীয় সংস্কার করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড। ছবি: ব্রিটানিকা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড। ছবি: ব্রিটানিকা

উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান। সেই মর্মান্তিক ঘটনা, গারফিল্ডের জীবন ও তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে এবার নেটফ্লিক্স-এ আসছে চার পর্বের ড্রামা সিরিজ, ‘ডেথ বাই লাইটনিং’।

প্রেসিডেন্টের উত্থান ও প্রগতিশীল এজেন্ডা

১৮৮০ সালে আমেরিকা এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল। সদ্য দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর আফ্রিকান-আমেরিকানরা কি নাগরিক হিসেবে পূর্ণ অধিকার পাবেন? নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারি চাকরি বণ্টনের সেই দীর্ঘদিনের দুর্নীতিগ্রস্ত ‘পচে যাওয়ার ব্যবস্থা’ অব্যাহত থাকবে? রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে ওহাইও-এর জনপ্রিয় কংগ্রেসম্যান জেমস গারফিল্ড এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আহ্বান জানান। দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা, গৃহযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব দেখানো এই কমান্ডার নভেম্বরে দেশের ২০ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে গারফিল্ড উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল: মার্কিন নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ, লাতিন আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো এবং বিশেষত নাগরিক অধিকারের পক্ষে জোরালো সওয়াল করা। তিনি সাবেক ক্রীতদাস ফ্রেডরিক ডগলাসকে ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার রেকর্ডার অব ডিডস পদে নিযুক্ত করেন। একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের জন্য প্রথম সারির একটি কেন্দ্রীয় পদ পাওয়ার বিরল ঘটনা ছিল এটি।

হত্যার নেপথ্যে

১৮৮১ সালের ২ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসি-র রেলওয়ে স্টেশনে চার্লস এল. গুইটো নামক এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি গারফিল্ডকে গুলি করে। গুইটো তার জীবনকাল ধরে একজন ব্যর্থ আইনজীবী, সাংবাদিক, ধর্মপ্রচারক এবং ফ্রি লাভ কমিউনের সদস্য হিসেবে এক ব্যর্থ অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। তা সত্ত্বেও, তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর তাকে মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্টি করেছেন। গারফিল্ডের মনোনয়নের পর তিনি তাঁর সমর্থনের বিনিময়ে প্যারিসে গুরুত্বপূর্ণ কনস্যুলার পদ দাবি করে হোয়াইট হাউসে ধরনা করতেন। প্রেসিডেন্ট ‘প্যাট্রোনেজ সিস্টেম’-এর ঘোর বিরোধী হওয়ায় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরই গুইটো সিদ্ধান্ত নেন—গারফিল্ডকে হত্যা করে ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থারকে ক্ষমতায় আনার ‘ঈশ্বর প্রদত্ত নির্দেশ’ তাঁর ওপর বর্তেছে।

আসল খুনি কে?

লেখক ক্যান্ডিস মিলার্ড তাঁর বেস্ট সেলিং বই ডেসটিনি অব দ্য রিপাবলিক-এ তুলে ধরেছেন, গারফিল্ডের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল চিকিৎসার চরম অব্যবস্থা। ড. উইলফ্রেড ব্লিস নামক দাম্ভিক চিকিৎসক গারফিল্ডের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তিনি ব্রিটিশ সার্জন জোসেফ লিস্টার কর্তৃক প্রবর্তিত আধুনিক অ্যান্টিসেপটিক পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ব্লিস জীবাণুমুক্ত নয় এমন যন্ত্র এবং খালি হাত ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের মেরুদণ্ডের কাছে থাকা গুলিটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এর ফলে সংক্রমণ (সেপসিস) ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি, গুলি খুঁজতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত প্রারম্ভিক মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু ব্লিসের অসহযোগিতার কারণে সেটিও ব্যর্থ হয়। শট নেওয়ার প্রায় আশি দিন পর প্রেসিডেন্ট মারা যান এবং এই মৃত্যুর সম্পূর্ণ দায় ড. ব্লিসের ওপর বর্তায়।

রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও গারফিল্ডকে নিউইয়র্কের প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর রোসকো কনকলিং-এর বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। কনকলিং প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক ছিলেন এবং গারফিল্ডের প্রগতিশীল ভাবধারা পছন্দ করতেন না। মাকোভস্কি বিবিসিকে জানান, এই সিরিজের মূল আকর্ষণ হলো ইতিহাসের সেই ‘যদি’ প্রশ্নটি—যদি প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি হয়তো আমেরিকার অন্যতম সেরা প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন। মাকোভস্কির মতে, ‘গারফিল্ডের অসাধারণ মেধা ছিল। তাঁকে যে আজ ইতিহাসে একটি অস্পষ্ট পাদটীকা হিসেবে স্থান দেওয়া হয়, তা এক ট্র্যাজেডি।’

অভিনেতা মাইকেল শ্যানন গারফিল্ডের ‘ঐশ্বর্য ও মর্যাদা, বিশেষ করে তাঁর শালীনতা’ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন বলে মন্তব্য করেছেন লেখক মিলার্ড।

গারফিল্ডের উত্তরাধিকার ও আইন সংস্কার

মাত্র ৪৯ বছর বয়সে গারফিল্ডের মৃত্যু পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দেয় এবং দেশজুড়ে সরকারি চাকরি সংস্কারের দাবি জোরালো হয়। জনগণের ক্ষোভের কারণেই ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থার, যিনি একসময় প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনিই ১৮৮৩ সালে ‘পেন্ডলটন অ্যাক্ট’-এ স্বাক্ষর করেন। এই আইনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ‘যোগ্যতা-ভিত্তিক’ নিয়োগের নীতি শুরু হয়, যা মার্কিন সরকারি আমলাতন্ত্রের পেশাদারি নিশ্চিত করার পথ দেখায়। এইভাবে, এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড আমেরিকার শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে এক স্থায়ী প্রগতিশীল পরিবর্তন এনে দেয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জল্লাদখানা বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
জল্লাদখানা বধ্যভূমি

ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লকের বধ্যভূমিটি ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি’ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর ও বিহারিরা এখানে বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করত। মিরপুর খালের পাশে এক নির্জন এলাকায় দুটি পয়োনিষ্কাশন ট্যাংকের ওপর ছিল একটি পরিত্যক্ত পাম্পহাউস। ঘাতকেরা এ জায়গাকে বেছে নিয়েছিল বধ্যভূমি হিসেবে।

স্বাধীনতার পরপরই এই বধ্যভূমির সন্ধান যখন পাওয়া যায়, তখন প্রত্যক্ষদর্শীরা সেখানে অসংখ্য বাঙালির কঙ্কাল দেখতে পান। স্থানীয় জনগণ জল্লাদখানার পাশে সে কঙ্কালগুলো দাফন করেন। এ পাম্পহাউসের ভেতরে উঁচু এক বেদিতে লেখা ছিল ‘জল্লাদখানা’। এখানে অনেক বাঙালিকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল।

তথ্য: সংগ্রামের নোটবুক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত