একলব্য

ঠিক ছোট কাগজ বলব, নাকি বড় কাগজের ছোট সংস্করণ বলব—বিষয়টি বুঝে ওঠা কঠিন। ‘মননরেখা’ নামের মুদ্রিত পুস্তকখানি হাতে আসার পর সেরকমই অনুভূতি হলো। আবার ‘পুস্তক’ শব্দটি আমাদের সামনে যে চিত্রকল্প তুলে ধরে, তাতে এই শব্দও সুপ্রযুক্ত হচ্ছে কি না, সেটাও ভাববার বিষয়। শুরু থেকে জুন ২০১৯ পর্যন্ত এটি বছরে একটি বিশেষ সংখ্যা ও একটি সাধারণ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হতো। কিন্তু ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে মননরেখা পুরোপুরি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই মননরেখাকে আমরা আপাতত ‘সংকলন’ই বলি। বলতে চাইছি, কোনো বিশেষ ব্র্যাকেটে মননরেখা নামের সংকলনটিকে না বেঁধেও সেটি নিয়ে আলোচনা করা চলে, পড়া চলে, সংগ্রহে রাখা চলে।
পরিচয় আরও একটু দেওয়া দরকার। মননরেখা নামের এই সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে রংপুর থেকে। অবশ্য মুদ্রণ ও বিপণনের বড় অংশ হয় রাজধানীতে। বিষয়বৈচিত্র্য, লেখার মান—সব দিক থেকে মননরেখার বিশেষ সংখ্যা, মানে ‘বিশেষ সংখ্যা’ই। সংখ্যাগুলোর বিষয়বস্তু জানলে অনেকেই চমকে উঠবেন। মোনাজাত উদ্দিন ও বিবিধ (ডিসেম্বর ২০১৭), বাংলাদেশের উর্দু কবি নওশাদ নূরী (ডিসেম্বর ২০১৮), বাংলাদেশের নারী কবি (ডিসেম্বর ২০১৯), বাংলাদেশের উর্দু কবি আহমেদ ইলিয়াস (ডিসেম্বর ২০২০), চিলমারী বন্দর (জুন ২০২১) এবং সর্বশেষ বেহুলা (ডিসেম্বর ২০২১)।
‘মননরেখা’ নামের এই সংকলনের সম্পাদক মিজানুর রহমান নাসিম। তিনি দর্শনের ছাত্র ও শিক্ষক। পড়ান কুড়িগ্রামের চিলমারীর গোলাম হাবিব মহিলা ডিগ্রি কলেজে। তাই সর্বান্তকরণে এই সংকলনকে ‘প্রান্তিক’ তকমা দেওয়া যায় খুব সহজে। কিন্তু কেন এত শব্দ খরচ মননরেখা নামের এই সংকলনের জন্য? বিবেচনার বিষয় সেটিই।
বাংলাদেশের ছোট কাগজের ইতিহাসে অনেক প্রকাশনা আছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার সংখ্যা হাতে গোনা—সেটি সাহিত্য কিংবা যেকোনো বিষয় নিয়েই হোক না কেন। এ বিষয়ে বিস্তর আলাপ হতে পারে, তর্কবিতর্কও হতে পারে। প্রসঙ্গটি তুলে রাখা ভালো যে, স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার সংখ্যা এতই কম যে, তা কোনো দিন সামনেই আসে না। অথচ স্থানীয় ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই একটি দেশের জাতীয় ইতিহাস রচিত হয়। মননরেখা ইতিহাস রচনার সে প্রক্রিয়াকে তুড়ি মেরে সরিয়ে দিয়ে নিজের পথ খুঁজে নিয়েছে। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাগুলোর একটি মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা। গুণে ও মানে সেটিই বাংলাদেশের বিশেষ সম্পদ। ‘নিরন্তর’ নামে আরেকটি সংকলনের কথা বলা যায়। ‘ঝলক’ দেখিয়ে সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। উল্লেখ করে রাখা ভালো, আমি কোনো তুলনায় যাচ্ছি না। প্রচেষ্টার কথা বলছি। মননরেখা অনেক রাস্তার ঘোরপ্যাঁচে নিজের রাস্তা খুঁজে নেওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে আছে।
দুই.
মননরেখার ‘বেহুলা সংখ্যা’ কয়েক দিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় ৫০০ বছরের চর্চিত চরিত্র বেহুলাকে নিয়ে ২১টি ভিন্ন স্বাদের প্রবন্ধ রয়েছে এই সংকলনে। জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, শামসুর রাহমানসহ আট কবির আটটি কবিতার পুনর্মুদ্রণ, আছে শওকত আলীর ‘শুন হে লখিন্দর’ গল্পের পুনর্মুদ্রণসহ আরও তিনটি গল্প, মহাশ্বেতা দেবীর ‘বেহুলা’ গল্পের আলোচনা, বই আলোচনা দুটি এবং বেশ কিছু রঙিন ও সাদাকালো ছবি আছে সংকলনটিতে। এ ছাড়া আছে ‘বেহুলা’ সিনেমার অভিনেত্রী সুচন্দা ও ‘ফিরে এসো বেহুলা’ সিনেমার পরিচালক তানিম নূরের সাক্ষাৎকার। সংকলনটির শুরু হয়েছে হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভূপেন হাজারিকার গান দিয়ে।
সূচিপত্র দেখলেই বোঝা যায়, সম্পাদক বেহুলাকে যতভাবে, যত দৃষ্টিকোণ থেকে সম্ভব বোঝার চেষ্টা করেছেন। প্রায় ৫০০ বছর ধরে যে আখ্যান চলে আসছে বিহার থেকে বাংলা পর্যন্ত, বিভিন্ন দৃষ্টিতে সেই আখ্যানকে বিশ্লেষণ করার মতো কোনো প্রয়াস কোথাও নেই। ‘আধুনিক’ তকমার অধীনে যে সাহিত্য ও শিল্পকলার চর্চা হয়ে চলেছে আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় বসে, তাতে বেহুলা অস্পৃশ্য—যেমন দেবতাদের জগতে অস্পৃশ্য ছিল মনসা। অথচ শ পাঁচেক বছর ধরে এই একই আখ্যান বিভিন্ন পাঠে গীত ও পরিবেশিত হয়ে আসছে আমাদের সমাজে, যাকে আমরা লোকসংস্কৃতি বলি সেই ধারার গানে, নাটকে, পুঁথিতে, কবিতায় ও চিত্রশিল্পে। আর বড় অংশ লোকধর্মের আধারে। ১৯৪৭ সালে যে কারণে একটি বৃহৎ ভূখণ্ড তিন টুকরো হয়ে গেল, বেহুলার মতো অনেক কিছুর চর্চায় তার অভিঘাত অস্বীকার করা যায় না বর্তমান বাংলাদেশে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ? সেখানেও তো বেহুলা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। কারণ কী?
খুঁজে দেখলেই বোঝা যায়, এর পেছনের মূল কারণ মনসার মতো ‘উনকোটি’ বা অপ্রধান দেবতারা আসলে ক্ষমতাকাঠামোর বাইরের বলয়ের গল্প। যে ‘বত্রিশ জন-কোটি’ দেবতা বা প্রধান দেবতা, তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা সবখানেই। যেমন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ইত্যাদি ‘কোটি’ বা প্রধান দেবতারা কিন্তু সাড়ম্বরে পূজিত সবখানে। অন্যদিকে মনসা, শনি বা এ রকম অপ্রধান বা উনকোটি দেবতারা থেকে গেছেন সমাজের নিচের তলায়। কাজেই তাঁদেরও চাঁদ বেনেদের সহায়তা দরকার সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে। বেহুলার আখ্যান সে কারণে তথাকথিত ‘আধুনিক’ সাহিত্য বা শিল্পকলার ‘দণ্ডধারী’দের কাছে তেমন পাত্তা পায়নি। একুশ শতকের সিকিভাগ চলে যাওয়ার কালে মননরেখা বেহুলাকে নিয়ে একটি বিস্তারিত সংকলন তৈরির চেষ্টা করেছে সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনায় রেখেও।
এই সংখ্যার সীমাবদ্ধতা কিছু আছে। সাদা চোখে বলা যায়, (১) বেহুলা নিয়ে আলোচনা হবে আর নদীর কথা থাকবে না, সেটা মানা যায় না। নদী নিয়ে একটি লেখা থাকা উচিত ছিল। তাহলে পুরো আলোচনাটা পূর্ণতা পেত। বেহুলার আলোচনায় নদী অনুপস্থিত থাকায় সংকলনের অঙ্গহানি হয়েছে। (২) বেহুলা ও মনসার সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা নেই। কিন্তু ক্ষমতাকাঠামোর আলোকে কিংবা নারী ও পুরুষতান্ত্রিকতার আলোকে বেহুলাকে বিচার করার আলোচনা আছে। (৩) মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণের পরিচিতিমূলক একটা লেখা থাকতেই পারত। কারণ, বেহুলার আখ্যান এগুলোর মাধ্যমেই প্রচারিত হয়েছে। (৪) লেখার জন্য শব্দসংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কোনো লেখা দেড় হাজার আর কোনো লেখা তিন হাজার শব্দের হলে দৃষ্টিদূষণ তৈরি হয়। তার চেয়ে বরং মাঝামাঝি হওয়া ভালো। (৫) বুক ডিজাইনে আরেকটু যত্নবান হওয়া দরকার। প্রচ্ছদ, ইনার ডিজাইন, শব্দসংখ্যা, ফন্টের আকারসহ সবকিছু দিন শেষে বইয়েরই অংশ। এই সব মিলিয়েই একখানি দৃষ্টিনন্দন পুস্তক তৈরি হয়। আশা করব, ভবিষ্যতের মননরেখা সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হবে।
তিন.
এবার মননরেখার আগের সংখ্যাগুলো নিয়ে একটু কথা বলা যাক।
মননরেখার এই সংখ্যার আগের সংখ্যাটি ছিল চিলমারী বন্দর নিয়ে। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই/ হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে রে’ ভাওয়াইয়া গানের এই চিলমারী বন্দর যে এককালে বাণিজ্য-অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল, সে কথা কজন জানে? ভুলে যাওয়া এই বন্দরকে নতুন করে চিনিয়েছে মননরেখা (জুন, ২০২১ সংখ্যা)।
মোনাজাতউদ্দিনকে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। কিন্তু মননরেখা তাঁকে আবার খুঁজে এনেছে (ডিসেম্বর, ২০১৭)। শুধু খুঁজেই আনেনি, বিবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে মোনাজাতউদ্দিনকে চেনার চেষ্টা করেছে নতুনভাবে। এই চেষ্টা বড় একটা চোখে পড়ে না। মোনাজাতউদ্দিন রংপুরের মানুষ বলে নয়, সাংবাদিকতার ইতিহাসে দেশে একজন ‘প্রাতঃস্মরণীয়’ মানুষ তিনি। কোনো নির্দিষ্টতা দিয়ে মোনাজাতউদ্দিন ও তাঁর মানুষের গল্পকে যে ছকে বাঁধা যায় না, তাঁকে যে সাংবাদিক তকমার একরৈখিকতায় ধরা যায় না, বোঝা যায় না, সে বোধটুকু দেখিয়েছেন সম্পাদক।
জাতীয়তাবাদের একরৈখিক ধারায় নওশাদ নূরী (ডিসেম্বর, ২০১৮ সংখ্যা) ও আহমেদ ইলিয়াসকে (ডিসেম্বর, ২০২০ সংখ্যা) আমরা ভুলে গেছি বেমালুম। অথচ ‘খামোখা’ই বাস্তুচ্যুত হয়ে তাঁরা দুজনই ঘরের খোঁজ করেছেন প্রায় পুরো জীবন। অশীতিপর আহমেদ ইলিয়াস এখনো জীবিত থাকলেও নওশাদ নূরী মারা গেছেন ২০০০ সালে। এ দুই উর্দুভাষী কবিই বাংলা ভাষা ও বাঙালির জন্য কবিতা লিখেছেন, কথা বলেছেন। সে জন্য পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে পড়ে দেশ ছেড়েছেন, আবার ফিরে এসেছেন। পরিবার-স্বজন যখন তাঁদের ছেড়ে গেছেন, তখন তাঁরা এ দেশের মায়ায় পড়ে থেকে গেছেন এখানেই। মননরেখা আমাদের সেই সব গল্পই শুনিয়েছে। সেই সব ইতিহাস তুলে আনার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করেছে। এখানেই মননরেখার গুরুত্ব।

ঠিক ছোট কাগজ বলব, নাকি বড় কাগজের ছোট সংস্করণ বলব—বিষয়টি বুঝে ওঠা কঠিন। ‘মননরেখা’ নামের মুদ্রিত পুস্তকখানি হাতে আসার পর সেরকমই অনুভূতি হলো। আবার ‘পুস্তক’ শব্দটি আমাদের সামনে যে চিত্রকল্প তুলে ধরে, তাতে এই শব্দও সুপ্রযুক্ত হচ্ছে কি না, সেটাও ভাববার বিষয়। শুরু থেকে জুন ২০১৯ পর্যন্ত এটি বছরে একটি বিশেষ সংখ্যা ও একটি সাধারণ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হতো। কিন্তু ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে মননরেখা পুরোপুরি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই মননরেখাকে আমরা আপাতত ‘সংকলন’ই বলি। বলতে চাইছি, কোনো বিশেষ ব্র্যাকেটে মননরেখা নামের সংকলনটিকে না বেঁধেও সেটি নিয়ে আলোচনা করা চলে, পড়া চলে, সংগ্রহে রাখা চলে।
পরিচয় আরও একটু দেওয়া দরকার। মননরেখা নামের এই সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে রংপুর থেকে। অবশ্য মুদ্রণ ও বিপণনের বড় অংশ হয় রাজধানীতে। বিষয়বৈচিত্র্য, লেখার মান—সব দিক থেকে মননরেখার বিশেষ সংখ্যা, মানে ‘বিশেষ সংখ্যা’ই। সংখ্যাগুলোর বিষয়বস্তু জানলে অনেকেই চমকে উঠবেন। মোনাজাত উদ্দিন ও বিবিধ (ডিসেম্বর ২০১৭), বাংলাদেশের উর্দু কবি নওশাদ নূরী (ডিসেম্বর ২০১৮), বাংলাদেশের নারী কবি (ডিসেম্বর ২০১৯), বাংলাদেশের উর্দু কবি আহমেদ ইলিয়াস (ডিসেম্বর ২০২০), চিলমারী বন্দর (জুন ২০২১) এবং সর্বশেষ বেহুলা (ডিসেম্বর ২০২১)।
‘মননরেখা’ নামের এই সংকলনের সম্পাদক মিজানুর রহমান নাসিম। তিনি দর্শনের ছাত্র ও শিক্ষক। পড়ান কুড়িগ্রামের চিলমারীর গোলাম হাবিব মহিলা ডিগ্রি কলেজে। তাই সর্বান্তকরণে এই সংকলনকে ‘প্রান্তিক’ তকমা দেওয়া যায় খুব সহজে। কিন্তু কেন এত শব্দ খরচ মননরেখা নামের এই সংকলনের জন্য? বিবেচনার বিষয় সেটিই।
বাংলাদেশের ছোট কাগজের ইতিহাসে অনেক প্রকাশনা আছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার সংখ্যা হাতে গোনা—সেটি সাহিত্য কিংবা যেকোনো বিষয় নিয়েই হোক না কেন। এ বিষয়ে বিস্তর আলাপ হতে পারে, তর্কবিতর্কও হতে পারে। প্রসঙ্গটি তুলে রাখা ভালো যে, স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার সংখ্যা এতই কম যে, তা কোনো দিন সামনেই আসে না। অথচ স্থানীয় ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই একটি দেশের জাতীয় ইতিহাস রচিত হয়। মননরেখা ইতিহাস রচনার সে প্রক্রিয়াকে তুড়ি মেরে সরিয়ে দিয়ে নিজের পথ খুঁজে নিয়েছে। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাগুলোর একটি মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা। গুণে ও মানে সেটিই বাংলাদেশের বিশেষ সম্পদ। ‘নিরন্তর’ নামে আরেকটি সংকলনের কথা বলা যায়। ‘ঝলক’ দেখিয়ে সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। উল্লেখ করে রাখা ভালো, আমি কোনো তুলনায় যাচ্ছি না। প্রচেষ্টার কথা বলছি। মননরেখা অনেক রাস্তার ঘোরপ্যাঁচে নিজের রাস্তা খুঁজে নেওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে আছে।
দুই.
মননরেখার ‘বেহুলা সংখ্যা’ কয়েক দিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় ৫০০ বছরের চর্চিত চরিত্র বেহুলাকে নিয়ে ২১টি ভিন্ন স্বাদের প্রবন্ধ রয়েছে এই সংকলনে। জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, শামসুর রাহমানসহ আট কবির আটটি কবিতার পুনর্মুদ্রণ, আছে শওকত আলীর ‘শুন হে লখিন্দর’ গল্পের পুনর্মুদ্রণসহ আরও তিনটি গল্প, মহাশ্বেতা দেবীর ‘বেহুলা’ গল্পের আলোচনা, বই আলোচনা দুটি এবং বেশ কিছু রঙিন ও সাদাকালো ছবি আছে সংকলনটিতে। এ ছাড়া আছে ‘বেহুলা’ সিনেমার অভিনেত্রী সুচন্দা ও ‘ফিরে এসো বেহুলা’ সিনেমার পরিচালক তানিম নূরের সাক্ষাৎকার। সংকলনটির শুরু হয়েছে হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভূপেন হাজারিকার গান দিয়ে।
সূচিপত্র দেখলেই বোঝা যায়, সম্পাদক বেহুলাকে যতভাবে, যত দৃষ্টিকোণ থেকে সম্ভব বোঝার চেষ্টা করেছেন। প্রায় ৫০০ বছর ধরে যে আখ্যান চলে আসছে বিহার থেকে বাংলা পর্যন্ত, বিভিন্ন দৃষ্টিতে সেই আখ্যানকে বিশ্লেষণ করার মতো কোনো প্রয়াস কোথাও নেই। ‘আধুনিক’ তকমার অধীনে যে সাহিত্য ও শিল্পকলার চর্চা হয়ে চলেছে আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় বসে, তাতে বেহুলা অস্পৃশ্য—যেমন দেবতাদের জগতে অস্পৃশ্য ছিল মনসা। অথচ শ পাঁচেক বছর ধরে এই একই আখ্যান বিভিন্ন পাঠে গীত ও পরিবেশিত হয়ে আসছে আমাদের সমাজে, যাকে আমরা লোকসংস্কৃতি বলি সেই ধারার গানে, নাটকে, পুঁথিতে, কবিতায় ও চিত্রশিল্পে। আর বড় অংশ লোকধর্মের আধারে। ১৯৪৭ সালে যে কারণে একটি বৃহৎ ভূখণ্ড তিন টুকরো হয়ে গেল, বেহুলার মতো অনেক কিছুর চর্চায় তার অভিঘাত অস্বীকার করা যায় না বর্তমান বাংলাদেশে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ? সেখানেও তো বেহুলা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। কারণ কী?
খুঁজে দেখলেই বোঝা যায়, এর পেছনের মূল কারণ মনসার মতো ‘উনকোটি’ বা অপ্রধান দেবতারা আসলে ক্ষমতাকাঠামোর বাইরের বলয়ের গল্প। যে ‘বত্রিশ জন-কোটি’ দেবতা বা প্রধান দেবতা, তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা সবখানেই। যেমন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ইত্যাদি ‘কোটি’ বা প্রধান দেবতারা কিন্তু সাড়ম্বরে পূজিত সবখানে। অন্যদিকে মনসা, শনি বা এ রকম অপ্রধান বা উনকোটি দেবতারা থেকে গেছেন সমাজের নিচের তলায়। কাজেই তাঁদেরও চাঁদ বেনেদের সহায়তা দরকার সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে। বেহুলার আখ্যান সে কারণে তথাকথিত ‘আধুনিক’ সাহিত্য বা শিল্পকলার ‘দণ্ডধারী’দের কাছে তেমন পাত্তা পায়নি। একুশ শতকের সিকিভাগ চলে যাওয়ার কালে মননরেখা বেহুলাকে নিয়ে একটি বিস্তারিত সংকলন তৈরির চেষ্টা করেছে সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনায় রেখেও।
এই সংখ্যার সীমাবদ্ধতা কিছু আছে। সাদা চোখে বলা যায়, (১) বেহুলা নিয়ে আলোচনা হবে আর নদীর কথা থাকবে না, সেটা মানা যায় না। নদী নিয়ে একটি লেখা থাকা উচিত ছিল। তাহলে পুরো আলোচনাটা পূর্ণতা পেত। বেহুলার আলোচনায় নদী অনুপস্থিত থাকায় সংকলনের অঙ্গহানি হয়েছে। (২) বেহুলা ও মনসার সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা নেই। কিন্তু ক্ষমতাকাঠামোর আলোকে কিংবা নারী ও পুরুষতান্ত্রিকতার আলোকে বেহুলাকে বিচার করার আলোচনা আছে। (৩) মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণের পরিচিতিমূলক একটা লেখা থাকতেই পারত। কারণ, বেহুলার আখ্যান এগুলোর মাধ্যমেই প্রচারিত হয়েছে। (৪) লেখার জন্য শব্দসংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কোনো লেখা দেড় হাজার আর কোনো লেখা তিন হাজার শব্দের হলে দৃষ্টিদূষণ তৈরি হয়। তার চেয়ে বরং মাঝামাঝি হওয়া ভালো। (৫) বুক ডিজাইনে আরেকটু যত্নবান হওয়া দরকার। প্রচ্ছদ, ইনার ডিজাইন, শব্দসংখ্যা, ফন্টের আকারসহ সবকিছু দিন শেষে বইয়েরই অংশ। এই সব মিলিয়েই একখানি দৃষ্টিনন্দন পুস্তক তৈরি হয়। আশা করব, ভবিষ্যতের মননরেখা সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হবে।
তিন.
এবার মননরেখার আগের সংখ্যাগুলো নিয়ে একটু কথা বলা যাক।
মননরেখার এই সংখ্যার আগের সংখ্যাটি ছিল চিলমারী বন্দর নিয়ে। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই/ হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে রে’ ভাওয়াইয়া গানের এই চিলমারী বন্দর যে এককালে বাণিজ্য-অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল, সে কথা কজন জানে? ভুলে যাওয়া এই বন্দরকে নতুন করে চিনিয়েছে মননরেখা (জুন, ২০২১ সংখ্যা)।
মোনাজাতউদ্দিনকে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। কিন্তু মননরেখা তাঁকে আবার খুঁজে এনেছে (ডিসেম্বর, ২০১৭)। শুধু খুঁজেই আনেনি, বিবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে মোনাজাতউদ্দিনকে চেনার চেষ্টা করেছে নতুনভাবে। এই চেষ্টা বড় একটা চোখে পড়ে না। মোনাজাতউদ্দিন রংপুরের মানুষ বলে নয়, সাংবাদিকতার ইতিহাসে দেশে একজন ‘প্রাতঃস্মরণীয়’ মানুষ তিনি। কোনো নির্দিষ্টতা দিয়ে মোনাজাতউদ্দিন ও তাঁর মানুষের গল্পকে যে ছকে বাঁধা যায় না, তাঁকে যে সাংবাদিক তকমার একরৈখিকতায় ধরা যায় না, বোঝা যায় না, সে বোধটুকু দেখিয়েছেন সম্পাদক।
জাতীয়তাবাদের একরৈখিক ধারায় নওশাদ নূরী (ডিসেম্বর, ২০১৮ সংখ্যা) ও আহমেদ ইলিয়াসকে (ডিসেম্বর, ২০২০ সংখ্যা) আমরা ভুলে গেছি বেমালুম। অথচ ‘খামোখা’ই বাস্তুচ্যুত হয়ে তাঁরা দুজনই ঘরের খোঁজ করেছেন প্রায় পুরো জীবন। অশীতিপর আহমেদ ইলিয়াস এখনো জীবিত থাকলেও নওশাদ নূরী মারা গেছেন ২০০০ সালে। এ দুই উর্দুভাষী কবিই বাংলা ভাষা ও বাঙালির জন্য কবিতা লিখেছেন, কথা বলেছেন। সে জন্য পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে পড়ে দেশ ছেড়েছেন, আবার ফিরে এসেছেন। পরিবার-স্বজন যখন তাঁদের ছেড়ে গেছেন, তখন তাঁরা এ দেশের মায়ায় পড়ে থেকে গেছেন এখানেই। মননরেখা আমাদের সেই সব গল্পই শুনিয়েছে। সেই সব ইতিহাস তুলে আনার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করেছে। এখানেই মননরেখার গুরুত্ব।
একলব্য

ঠিক ছোট কাগজ বলব, নাকি বড় কাগজের ছোট সংস্করণ বলব—বিষয়টি বুঝে ওঠা কঠিন। ‘মননরেখা’ নামের মুদ্রিত পুস্তকখানি হাতে আসার পর সেরকমই অনুভূতি হলো। আবার ‘পুস্তক’ শব্দটি আমাদের সামনে যে চিত্রকল্প তুলে ধরে, তাতে এই শব্দও সুপ্রযুক্ত হচ্ছে কি না, সেটাও ভাববার বিষয়। শুরু থেকে জুন ২০১৯ পর্যন্ত এটি বছরে একটি বিশেষ সংখ্যা ও একটি সাধারণ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হতো। কিন্তু ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে মননরেখা পুরোপুরি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই মননরেখাকে আমরা আপাতত ‘সংকলন’ই বলি। বলতে চাইছি, কোনো বিশেষ ব্র্যাকেটে মননরেখা নামের সংকলনটিকে না বেঁধেও সেটি নিয়ে আলোচনা করা চলে, পড়া চলে, সংগ্রহে রাখা চলে।
পরিচয় আরও একটু দেওয়া দরকার। মননরেখা নামের এই সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে রংপুর থেকে। অবশ্য মুদ্রণ ও বিপণনের বড় অংশ হয় রাজধানীতে। বিষয়বৈচিত্র্য, লেখার মান—সব দিক থেকে মননরেখার বিশেষ সংখ্যা, মানে ‘বিশেষ সংখ্যা’ই। সংখ্যাগুলোর বিষয়বস্তু জানলে অনেকেই চমকে উঠবেন। মোনাজাত উদ্দিন ও বিবিধ (ডিসেম্বর ২০১৭), বাংলাদেশের উর্দু কবি নওশাদ নূরী (ডিসেম্বর ২০১৮), বাংলাদেশের নারী কবি (ডিসেম্বর ২০১৯), বাংলাদেশের উর্দু কবি আহমেদ ইলিয়াস (ডিসেম্বর ২০২০), চিলমারী বন্দর (জুন ২০২১) এবং সর্বশেষ বেহুলা (ডিসেম্বর ২০২১)।
‘মননরেখা’ নামের এই সংকলনের সম্পাদক মিজানুর রহমান নাসিম। তিনি দর্শনের ছাত্র ও শিক্ষক। পড়ান কুড়িগ্রামের চিলমারীর গোলাম হাবিব মহিলা ডিগ্রি কলেজে। তাই সর্বান্তকরণে এই সংকলনকে ‘প্রান্তিক’ তকমা দেওয়া যায় খুব সহজে। কিন্তু কেন এত শব্দ খরচ মননরেখা নামের এই সংকলনের জন্য? বিবেচনার বিষয় সেটিই।
বাংলাদেশের ছোট কাগজের ইতিহাসে অনেক প্রকাশনা আছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার সংখ্যা হাতে গোনা—সেটি সাহিত্য কিংবা যেকোনো বিষয় নিয়েই হোক না কেন। এ বিষয়ে বিস্তর আলাপ হতে পারে, তর্কবিতর্কও হতে পারে। প্রসঙ্গটি তুলে রাখা ভালো যে, স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার সংখ্যা এতই কম যে, তা কোনো দিন সামনেই আসে না। অথচ স্থানীয় ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই একটি দেশের জাতীয় ইতিহাস রচিত হয়। মননরেখা ইতিহাস রচনার সে প্রক্রিয়াকে তুড়ি মেরে সরিয়ে দিয়ে নিজের পথ খুঁজে নিয়েছে। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাগুলোর একটি মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা। গুণে ও মানে সেটিই বাংলাদেশের বিশেষ সম্পদ। ‘নিরন্তর’ নামে আরেকটি সংকলনের কথা বলা যায়। ‘ঝলক’ দেখিয়ে সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। উল্লেখ করে রাখা ভালো, আমি কোনো তুলনায় যাচ্ছি না। প্রচেষ্টার কথা বলছি। মননরেখা অনেক রাস্তার ঘোরপ্যাঁচে নিজের রাস্তা খুঁজে নেওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে আছে।
দুই.
মননরেখার ‘বেহুলা সংখ্যা’ কয়েক দিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় ৫০০ বছরের চর্চিত চরিত্র বেহুলাকে নিয়ে ২১টি ভিন্ন স্বাদের প্রবন্ধ রয়েছে এই সংকলনে। জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, শামসুর রাহমানসহ আট কবির আটটি কবিতার পুনর্মুদ্রণ, আছে শওকত আলীর ‘শুন হে লখিন্দর’ গল্পের পুনর্মুদ্রণসহ আরও তিনটি গল্প, মহাশ্বেতা দেবীর ‘বেহুলা’ গল্পের আলোচনা, বই আলোচনা দুটি এবং বেশ কিছু রঙিন ও সাদাকালো ছবি আছে সংকলনটিতে। এ ছাড়া আছে ‘বেহুলা’ সিনেমার অভিনেত্রী সুচন্দা ও ‘ফিরে এসো বেহুলা’ সিনেমার পরিচালক তানিম নূরের সাক্ষাৎকার। সংকলনটির শুরু হয়েছে হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভূপেন হাজারিকার গান দিয়ে।
সূচিপত্র দেখলেই বোঝা যায়, সম্পাদক বেহুলাকে যতভাবে, যত দৃষ্টিকোণ থেকে সম্ভব বোঝার চেষ্টা করেছেন। প্রায় ৫০০ বছর ধরে যে আখ্যান চলে আসছে বিহার থেকে বাংলা পর্যন্ত, বিভিন্ন দৃষ্টিতে সেই আখ্যানকে বিশ্লেষণ করার মতো কোনো প্রয়াস কোথাও নেই। ‘আধুনিক’ তকমার অধীনে যে সাহিত্য ও শিল্পকলার চর্চা হয়ে চলেছে আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় বসে, তাতে বেহুলা অস্পৃশ্য—যেমন দেবতাদের জগতে অস্পৃশ্য ছিল মনসা। অথচ শ পাঁচেক বছর ধরে এই একই আখ্যান বিভিন্ন পাঠে গীত ও পরিবেশিত হয়ে আসছে আমাদের সমাজে, যাকে আমরা লোকসংস্কৃতি বলি সেই ধারার গানে, নাটকে, পুঁথিতে, কবিতায় ও চিত্রশিল্পে। আর বড় অংশ লোকধর্মের আধারে। ১৯৪৭ সালে যে কারণে একটি বৃহৎ ভূখণ্ড তিন টুকরো হয়ে গেল, বেহুলার মতো অনেক কিছুর চর্চায় তার অভিঘাত অস্বীকার করা যায় না বর্তমান বাংলাদেশে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ? সেখানেও তো বেহুলা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। কারণ কী?
খুঁজে দেখলেই বোঝা যায়, এর পেছনের মূল কারণ মনসার মতো ‘উনকোটি’ বা অপ্রধান দেবতারা আসলে ক্ষমতাকাঠামোর বাইরের বলয়ের গল্প। যে ‘বত্রিশ জন-কোটি’ দেবতা বা প্রধান দেবতা, তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা সবখানেই। যেমন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ইত্যাদি ‘কোটি’ বা প্রধান দেবতারা কিন্তু সাড়ম্বরে পূজিত সবখানে। অন্যদিকে মনসা, শনি বা এ রকম অপ্রধান বা উনকোটি দেবতারা থেকে গেছেন সমাজের নিচের তলায়। কাজেই তাঁদেরও চাঁদ বেনেদের সহায়তা দরকার সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে। বেহুলার আখ্যান সে কারণে তথাকথিত ‘আধুনিক’ সাহিত্য বা শিল্পকলার ‘দণ্ডধারী’দের কাছে তেমন পাত্তা পায়নি। একুশ শতকের সিকিভাগ চলে যাওয়ার কালে মননরেখা বেহুলাকে নিয়ে একটি বিস্তারিত সংকলন তৈরির চেষ্টা করেছে সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনায় রেখেও।
এই সংখ্যার সীমাবদ্ধতা কিছু আছে। সাদা চোখে বলা যায়, (১) বেহুলা নিয়ে আলোচনা হবে আর নদীর কথা থাকবে না, সেটা মানা যায় না। নদী নিয়ে একটি লেখা থাকা উচিত ছিল। তাহলে পুরো আলোচনাটা পূর্ণতা পেত। বেহুলার আলোচনায় নদী অনুপস্থিত থাকায় সংকলনের অঙ্গহানি হয়েছে। (২) বেহুলা ও মনসার সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা নেই। কিন্তু ক্ষমতাকাঠামোর আলোকে কিংবা নারী ও পুরুষতান্ত্রিকতার আলোকে বেহুলাকে বিচার করার আলোচনা আছে। (৩) মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণের পরিচিতিমূলক একটা লেখা থাকতেই পারত। কারণ, বেহুলার আখ্যান এগুলোর মাধ্যমেই প্রচারিত হয়েছে। (৪) লেখার জন্য শব্দসংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কোনো লেখা দেড় হাজার আর কোনো লেখা তিন হাজার শব্দের হলে দৃষ্টিদূষণ তৈরি হয়। তার চেয়ে বরং মাঝামাঝি হওয়া ভালো। (৫) বুক ডিজাইনে আরেকটু যত্নবান হওয়া দরকার। প্রচ্ছদ, ইনার ডিজাইন, শব্দসংখ্যা, ফন্টের আকারসহ সবকিছু দিন শেষে বইয়েরই অংশ। এই সব মিলিয়েই একখানি দৃষ্টিনন্দন পুস্তক তৈরি হয়। আশা করব, ভবিষ্যতের মননরেখা সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হবে।
তিন.
এবার মননরেখার আগের সংখ্যাগুলো নিয়ে একটু কথা বলা যাক।
মননরেখার এই সংখ্যার আগের সংখ্যাটি ছিল চিলমারী বন্দর নিয়ে। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই/ হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে রে’ ভাওয়াইয়া গানের এই চিলমারী বন্দর যে এককালে বাণিজ্য-অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল, সে কথা কজন জানে? ভুলে যাওয়া এই বন্দরকে নতুন করে চিনিয়েছে মননরেখা (জুন, ২০২১ সংখ্যা)।
মোনাজাতউদ্দিনকে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। কিন্তু মননরেখা তাঁকে আবার খুঁজে এনেছে (ডিসেম্বর, ২০১৭)। শুধু খুঁজেই আনেনি, বিবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে মোনাজাতউদ্দিনকে চেনার চেষ্টা করেছে নতুনভাবে। এই চেষ্টা বড় একটা চোখে পড়ে না। মোনাজাতউদ্দিন রংপুরের মানুষ বলে নয়, সাংবাদিকতার ইতিহাসে দেশে একজন ‘প্রাতঃস্মরণীয়’ মানুষ তিনি। কোনো নির্দিষ্টতা দিয়ে মোনাজাতউদ্দিন ও তাঁর মানুষের গল্পকে যে ছকে বাঁধা যায় না, তাঁকে যে সাংবাদিক তকমার একরৈখিকতায় ধরা যায় না, বোঝা যায় না, সে বোধটুকু দেখিয়েছেন সম্পাদক।
জাতীয়তাবাদের একরৈখিক ধারায় নওশাদ নূরী (ডিসেম্বর, ২০১৮ সংখ্যা) ও আহমেদ ইলিয়াসকে (ডিসেম্বর, ২০২০ সংখ্যা) আমরা ভুলে গেছি বেমালুম। অথচ ‘খামোখা’ই বাস্তুচ্যুত হয়ে তাঁরা দুজনই ঘরের খোঁজ করেছেন প্রায় পুরো জীবন। অশীতিপর আহমেদ ইলিয়াস এখনো জীবিত থাকলেও নওশাদ নূরী মারা গেছেন ২০০০ সালে। এ দুই উর্দুভাষী কবিই বাংলা ভাষা ও বাঙালির জন্য কবিতা লিখেছেন, কথা বলেছেন। সে জন্য পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে পড়ে দেশ ছেড়েছেন, আবার ফিরে এসেছেন। পরিবার-স্বজন যখন তাঁদের ছেড়ে গেছেন, তখন তাঁরা এ দেশের মায়ায় পড়ে থেকে গেছেন এখানেই। মননরেখা আমাদের সেই সব গল্পই শুনিয়েছে। সেই সব ইতিহাস তুলে আনার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করেছে। এখানেই মননরেখার গুরুত্ব।

ঠিক ছোট কাগজ বলব, নাকি বড় কাগজের ছোট সংস্করণ বলব—বিষয়টি বুঝে ওঠা কঠিন। ‘মননরেখা’ নামের মুদ্রিত পুস্তকখানি হাতে আসার পর সেরকমই অনুভূতি হলো। আবার ‘পুস্তক’ শব্দটি আমাদের সামনে যে চিত্রকল্প তুলে ধরে, তাতে এই শব্দও সুপ্রযুক্ত হচ্ছে কি না, সেটাও ভাববার বিষয়। শুরু থেকে জুন ২০১৯ পর্যন্ত এটি বছরে একটি বিশেষ সংখ্যা ও একটি সাধারণ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হতো। কিন্তু ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে মননরেখা পুরোপুরি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই মননরেখাকে আমরা আপাতত ‘সংকলন’ই বলি। বলতে চাইছি, কোনো বিশেষ ব্র্যাকেটে মননরেখা নামের সংকলনটিকে না বেঁধেও সেটি নিয়ে আলোচনা করা চলে, পড়া চলে, সংগ্রহে রাখা চলে।
পরিচয় আরও একটু দেওয়া দরকার। মননরেখা নামের এই সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে রংপুর থেকে। অবশ্য মুদ্রণ ও বিপণনের বড় অংশ হয় রাজধানীতে। বিষয়বৈচিত্র্য, লেখার মান—সব দিক থেকে মননরেখার বিশেষ সংখ্যা, মানে ‘বিশেষ সংখ্যা’ই। সংখ্যাগুলোর বিষয়বস্তু জানলে অনেকেই চমকে উঠবেন। মোনাজাত উদ্দিন ও বিবিধ (ডিসেম্বর ২০১৭), বাংলাদেশের উর্দু কবি নওশাদ নূরী (ডিসেম্বর ২০১৮), বাংলাদেশের নারী কবি (ডিসেম্বর ২০১৯), বাংলাদেশের উর্দু কবি আহমেদ ইলিয়াস (ডিসেম্বর ২০২০), চিলমারী বন্দর (জুন ২০২১) এবং সর্বশেষ বেহুলা (ডিসেম্বর ২০২১)।
‘মননরেখা’ নামের এই সংকলনের সম্পাদক মিজানুর রহমান নাসিম। তিনি দর্শনের ছাত্র ও শিক্ষক। পড়ান কুড়িগ্রামের চিলমারীর গোলাম হাবিব মহিলা ডিগ্রি কলেজে। তাই সর্বান্তকরণে এই সংকলনকে ‘প্রান্তিক’ তকমা দেওয়া যায় খুব সহজে। কিন্তু কেন এত শব্দ খরচ মননরেখা নামের এই সংকলনের জন্য? বিবেচনার বিষয় সেটিই।
বাংলাদেশের ছোট কাগজের ইতিহাসে অনেক প্রকাশনা আছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার সংখ্যা হাতে গোনা—সেটি সাহিত্য কিংবা যেকোনো বিষয় নিয়েই হোক না কেন। এ বিষয়ে বিস্তর আলাপ হতে পারে, তর্কবিতর্কও হতে পারে। প্রসঙ্গটি তুলে রাখা ভালো যে, স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার সংখ্যা এতই কম যে, তা কোনো দিন সামনেই আসে না। অথচ স্থানীয় ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই একটি দেশের জাতীয় ইতিহাস রচিত হয়। মননরেখা ইতিহাস রচনার সে প্রক্রিয়াকে তুড়ি মেরে সরিয়ে দিয়ে নিজের পথ খুঁজে নিয়েছে। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাগুলোর একটি মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা। গুণে ও মানে সেটিই বাংলাদেশের বিশেষ সম্পদ। ‘নিরন্তর’ নামে আরেকটি সংকলনের কথা বলা যায়। ‘ঝলক’ দেখিয়ে সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। উল্লেখ করে রাখা ভালো, আমি কোনো তুলনায় যাচ্ছি না। প্রচেষ্টার কথা বলছি। মননরেখা অনেক রাস্তার ঘোরপ্যাঁচে নিজের রাস্তা খুঁজে নেওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে আছে।
দুই.
মননরেখার ‘বেহুলা সংখ্যা’ কয়েক দিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় ৫০০ বছরের চর্চিত চরিত্র বেহুলাকে নিয়ে ২১টি ভিন্ন স্বাদের প্রবন্ধ রয়েছে এই সংকলনে। জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, শামসুর রাহমানসহ আট কবির আটটি কবিতার পুনর্মুদ্রণ, আছে শওকত আলীর ‘শুন হে লখিন্দর’ গল্পের পুনর্মুদ্রণসহ আরও তিনটি গল্প, মহাশ্বেতা দেবীর ‘বেহুলা’ গল্পের আলোচনা, বই আলোচনা দুটি এবং বেশ কিছু রঙিন ও সাদাকালো ছবি আছে সংকলনটিতে। এ ছাড়া আছে ‘বেহুলা’ সিনেমার অভিনেত্রী সুচন্দা ও ‘ফিরে এসো বেহুলা’ সিনেমার পরিচালক তানিম নূরের সাক্ষাৎকার। সংকলনটির শুরু হয়েছে হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভূপেন হাজারিকার গান দিয়ে।
সূচিপত্র দেখলেই বোঝা যায়, সম্পাদক বেহুলাকে যতভাবে, যত দৃষ্টিকোণ থেকে সম্ভব বোঝার চেষ্টা করেছেন। প্রায় ৫০০ বছর ধরে যে আখ্যান চলে আসছে বিহার থেকে বাংলা পর্যন্ত, বিভিন্ন দৃষ্টিতে সেই আখ্যানকে বিশ্লেষণ করার মতো কোনো প্রয়াস কোথাও নেই। ‘আধুনিক’ তকমার অধীনে যে সাহিত্য ও শিল্পকলার চর্চা হয়ে চলেছে আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় বসে, তাতে বেহুলা অস্পৃশ্য—যেমন দেবতাদের জগতে অস্পৃশ্য ছিল মনসা। অথচ শ পাঁচেক বছর ধরে এই একই আখ্যান বিভিন্ন পাঠে গীত ও পরিবেশিত হয়ে আসছে আমাদের সমাজে, যাকে আমরা লোকসংস্কৃতি বলি সেই ধারার গানে, নাটকে, পুঁথিতে, কবিতায় ও চিত্রশিল্পে। আর বড় অংশ লোকধর্মের আধারে। ১৯৪৭ সালে যে কারণে একটি বৃহৎ ভূখণ্ড তিন টুকরো হয়ে গেল, বেহুলার মতো অনেক কিছুর চর্চায় তার অভিঘাত অস্বীকার করা যায় না বর্তমান বাংলাদেশে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ? সেখানেও তো বেহুলা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। কারণ কী?
খুঁজে দেখলেই বোঝা যায়, এর পেছনের মূল কারণ মনসার মতো ‘উনকোটি’ বা অপ্রধান দেবতারা আসলে ক্ষমতাকাঠামোর বাইরের বলয়ের গল্প। যে ‘বত্রিশ জন-কোটি’ দেবতা বা প্রধান দেবতা, তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা সবখানেই। যেমন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ইত্যাদি ‘কোটি’ বা প্রধান দেবতারা কিন্তু সাড়ম্বরে পূজিত সবখানে। অন্যদিকে মনসা, শনি বা এ রকম অপ্রধান বা উনকোটি দেবতারা থেকে গেছেন সমাজের নিচের তলায়। কাজেই তাঁদেরও চাঁদ বেনেদের সহায়তা দরকার সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে। বেহুলার আখ্যান সে কারণে তথাকথিত ‘আধুনিক’ সাহিত্য বা শিল্পকলার ‘দণ্ডধারী’দের কাছে তেমন পাত্তা পায়নি। একুশ শতকের সিকিভাগ চলে যাওয়ার কালে মননরেখা বেহুলাকে নিয়ে একটি বিস্তারিত সংকলন তৈরির চেষ্টা করেছে সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনায় রেখেও।
এই সংখ্যার সীমাবদ্ধতা কিছু আছে। সাদা চোখে বলা যায়, (১) বেহুলা নিয়ে আলোচনা হবে আর নদীর কথা থাকবে না, সেটা মানা যায় না। নদী নিয়ে একটি লেখা থাকা উচিত ছিল। তাহলে পুরো আলোচনাটা পূর্ণতা পেত। বেহুলার আলোচনায় নদী অনুপস্থিত থাকায় সংকলনের অঙ্গহানি হয়েছে। (২) বেহুলা ও মনসার সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা নেই। কিন্তু ক্ষমতাকাঠামোর আলোকে কিংবা নারী ও পুরুষতান্ত্রিকতার আলোকে বেহুলাকে বিচার করার আলোচনা আছে। (৩) মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণের পরিচিতিমূলক একটা লেখা থাকতেই পারত। কারণ, বেহুলার আখ্যান এগুলোর মাধ্যমেই প্রচারিত হয়েছে। (৪) লেখার জন্য শব্দসংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কোনো লেখা দেড় হাজার আর কোনো লেখা তিন হাজার শব্দের হলে দৃষ্টিদূষণ তৈরি হয়। তার চেয়ে বরং মাঝামাঝি হওয়া ভালো। (৫) বুক ডিজাইনে আরেকটু যত্নবান হওয়া দরকার। প্রচ্ছদ, ইনার ডিজাইন, শব্দসংখ্যা, ফন্টের আকারসহ সবকিছু দিন শেষে বইয়েরই অংশ। এই সব মিলিয়েই একখানি দৃষ্টিনন্দন পুস্তক তৈরি হয়। আশা করব, ভবিষ্যতের মননরেখা সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হবে।
তিন.
এবার মননরেখার আগের সংখ্যাগুলো নিয়ে একটু কথা বলা যাক।
মননরেখার এই সংখ্যার আগের সংখ্যাটি ছিল চিলমারী বন্দর নিয়ে। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই/ হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে রে’ ভাওয়াইয়া গানের এই চিলমারী বন্দর যে এককালে বাণিজ্য-অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল, সে কথা কজন জানে? ভুলে যাওয়া এই বন্দরকে নতুন করে চিনিয়েছে মননরেখা (জুন, ২০২১ সংখ্যা)।
মোনাজাতউদ্দিনকে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। কিন্তু মননরেখা তাঁকে আবার খুঁজে এনেছে (ডিসেম্বর, ২০১৭)। শুধু খুঁজেই আনেনি, বিবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে মোনাজাতউদ্দিনকে চেনার চেষ্টা করেছে নতুনভাবে। এই চেষ্টা বড় একটা চোখে পড়ে না। মোনাজাতউদ্দিন রংপুরের মানুষ বলে নয়, সাংবাদিকতার ইতিহাসে দেশে একজন ‘প্রাতঃস্মরণীয়’ মানুষ তিনি। কোনো নির্দিষ্টতা দিয়ে মোনাজাতউদ্দিন ও তাঁর মানুষের গল্পকে যে ছকে বাঁধা যায় না, তাঁকে যে সাংবাদিক তকমার একরৈখিকতায় ধরা যায় না, বোঝা যায় না, সে বোধটুকু দেখিয়েছেন সম্পাদক।
জাতীয়তাবাদের একরৈখিক ধারায় নওশাদ নূরী (ডিসেম্বর, ২০১৮ সংখ্যা) ও আহমেদ ইলিয়াসকে (ডিসেম্বর, ২০২০ সংখ্যা) আমরা ভুলে গেছি বেমালুম। অথচ ‘খামোখা’ই বাস্তুচ্যুত হয়ে তাঁরা দুজনই ঘরের খোঁজ করেছেন প্রায় পুরো জীবন। অশীতিপর আহমেদ ইলিয়াস এখনো জীবিত থাকলেও নওশাদ নূরী মারা গেছেন ২০০০ সালে। এ দুই উর্দুভাষী কবিই বাংলা ভাষা ও বাঙালির জন্য কবিতা লিখেছেন, কথা বলেছেন। সে জন্য পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে পড়ে দেশ ছেড়েছেন, আবার ফিরে এসেছেন। পরিবার-স্বজন যখন তাঁদের ছেড়ে গেছেন, তখন তাঁরা এ দেশের মায়ায় পড়ে থেকে গেছেন এখানেই। মননরেখা আমাদের সেই সব গল্পই শুনিয়েছে। সেই সব ইতিহাস তুলে আনার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করেছে। এখানেই মননরেখার গুরুত্ব।

আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
১৩ ঘণ্টা আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে মননরেখা পুরোপুরি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই রংপুর থেকে প্রকাশিত মননরেখাকে আমরা আপাতত ‘সংকলন’ই বলি। বলতে চাইছি, কোনো বিশেষ ব্র্যাকেটে মননরেখা নামের সংকলনটিকে না বেঁধেও সেটি নিয়ে আলোচনা করা চলে, পড়া চলে, সংগ্রহে রাখা চলে।
২১ ডিসেম্বর ২০২১
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে মননরেখা পুরোপুরি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই রংপুর থেকে প্রকাশিত মননরেখাকে আমরা আপাতত ‘সংকলন’ই বলি। বলতে চাইছি, কোনো বিশেষ ব্র্যাকেটে মননরেখা নামের সংকলনটিকে না বেঁধেও সেটি নিয়ে আলোচনা করা চলে, পড়া চলে, সংগ্রহে রাখা চলে।
২১ ডিসেম্বর ২০২১
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
১৩ ঘণ্টা আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে মননরেখা পুরোপুরি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই রংপুর থেকে প্রকাশিত মননরেখাকে আমরা আপাতত ‘সংকলন’ই বলি। বলতে চাইছি, কোনো বিশেষ ব্র্যাকেটে মননরেখা নামের সংকলনটিকে না বেঁধেও সেটি নিয়ে আলোচনা করা চলে, পড়া চলে, সংগ্রহে রাখা চলে।
২১ ডিসেম্বর ২০২১
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
১৩ ঘণ্টা আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে মননরেখা পুরোপুরি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই রংপুর থেকে প্রকাশিত মননরেখাকে আমরা আপাতত ‘সংকলন’ই বলি। বলতে চাইছি, কোনো বিশেষ ব্র্যাকেটে মননরেখা নামের সংকলনটিকে না বেঁধেও সেটি নিয়ে আলোচনা করা চলে, পড়া চলে, সংগ্রহে রাখা চলে।
২১ ডিসেম্বর ২০২১
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
১৩ ঘণ্টা আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে