ড. তৈফুর রহমান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যখন সেখানে পড়তাম, তখন খুব আগ্রহ হতো মন্দিরটির বিষয়ে। শুনেছিলাম অনেক আগের ছোট্ট এক গ্রিক মেয়ের কবর আছে সেখানে। কেমন একটা বিষাদমাখা মায়া কাজ করত তার জন্য।
সম্প্রতি ফেসবুকের একটি পোস্টে প্রথমবারের মতো মন্দিরের অন্দর কক্ষ ও সেখানে সংরক্ষিত নয়টি অক্ষত, একটি আধভাঙা এপিটাফ এবং সমাধিফলক দেখে প্রায় ভুলে যাওয়া সেই স্মৃতি আবার মাথায় কড়া নাড়ল। এই অন্তর্জালের দুনিয়াতে তথ্য বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের এক গ্রিক কনসালট্যান্ট হেলেন আবাদজী আর জাপানি গবেষক কানদা সায়াকো—এর দুটি গবেষণাপত্রের তথ্য জোড়া লাগিয়ে একটা ছবি দাঁড় করিয়েছি—পলাশী যুদ্ধের সমসাময়িক বাংলায়, বিশেষ করে ঢাকায় গ্রিকদের আগমন, তাঁদের বাণিজ্য, পেশা, পারিবারিক-সামাজিক জীবন এবং ঢাকার বুকেই তাঁদের শেষশয্যা নিয়ে।
ঢাকায় গ্রিকদের গল্প
বাংলায় গ্রিকরা আসে ১৭৫০ সালের দিকে—আজকের গ্রিস এবং গ্রিক-অধ্যুষিত অঞ্চল, যেমন আধুনিক তুর্কি ও ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো থেকে। ভাগ্য ফেরানো ওসমানিয়া শাসন বলয় থেকে বের হওয়া, ধর্মপ্রচার ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের দিকে এরা আসতে শুরু করে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি বাংলায় ভালোভাবে আসন গেঁড়ে বসার পর। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আলেক্সিওসি (আলেক্সান্ডার) আর্গাইরি। বুলগেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী এই গ্রিক কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর কারবার ছিল বসরা আর লেভান্তে (সিরিয়া-লেবানন) অঞ্চলের সঙ্গে। ১৭৭০ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরার পথে বঙ্গোপসাগরে নিশ্চিত জাহাজডুবি থেকে বেঁচে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, কলকাতায় একটা চার্চ বানাবেন। তখন সবে কলকাতার গভর্নর হয়েছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তাঁকে গিয়ে আর্গাইরি ধরলেন চার্চ নির্মাণের অনুমতির জন্য। হেস্টিংস জানতেন, গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যবসায় উন্নতি করছে, তাই অনুমতি দিলেন। আর্গাইরি আর অন্যান্য ধনী গ্রিকরা চার্চ বানানোর তোড়জোড় শুরু করলে তিনি তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য হাজির হলেন ঢাকায়, ১৭৭১ সালে। এ থেকে অনুমান করা যায় আর্গাইরির আগমনের আগে থেকেই গ্রিক বণিকেরা ঢাকায় ডেরা বেঁধেছিল।
এই প্রস্তরখণ্ডের নিচে মিসেস সুলতানা আলেক্সান্ডার, আলেক্সান্ডারের স্ত্রীর (আলেক্সান্ডার ইস্তাম্বুলের কারিয়াকোস ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র) নশ্বর দেহাবশেষ শায়িত আছে, যিনি এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন, মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৪ বছর। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
আর্গাইরির সঙ্গে ঢাকায় আসে তাঁর ২১ বছর বয়সী বড় ছেলে পানিয়তি। ১৭৭৭ সালে আর্গাইরি মৃত্যুবরণ করেন ঢাকাতেই। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিকে পুঁজি করে ১৮ শতকের শেষার্ধে এসে এই পানিয়তি ব্যবসা বাড়িয়ে বাংলায় গ্রিক বণিক সম্প্রদায়ের প্রধান হয়ে ওঠেন। ঢাকা ও সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জে গ্রিকদের প্রধান বাণিজ্য ছিল চুন ও লবণকে ঘিরে। সিলেটের খাসিয়া-অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলে উৎকৃষ্ট মানের চুনাপাথর পাওয়া যেত (এবং এখনো যায়), যা থেকে তৈরি করা হতো চুন। সে চুন দরকার হতো বড় বড় ইমারত তৈরিতে। নৌপথে বজরায় করে সে চুনের চালান যেত নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে নদীপথে সহজেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার পদ্মা-মেঘনার সংগমস্থল দিয়ে উত্তর-পশ্চিম বা দক্ষিণ-পূর্বে নৌযাত্রা করা যেত। সে জন্য ভোলা ও চাটিগাঁ থেকে আসা লবণের বিরাট মোকাম গড়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জে।
এইখানে শায়িত আছেন ইস্তাম্বুলের জর্জ ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র থিওডোরের স্ত্রী থিওডোসিয়া। ১০ এপ্রিল ১৮০৫ সালে। তাঁর স্মৃতি অমর হোক। এই দুই নারীর সমাধিফলকেই একটা কথা আছে, যা আমাদের অবাক করে, ‘ঢাকার প্রতি তিনি ঋণী’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
চুন ও লবণ—এই দুই অতিপ্রয়োজনীয় বাণিজ্যের মূল অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ ইংরেজদের হাতে থাকলেও তাতে কলকাতার বাঙালি হিন্দু (যারা বউবাজার-বাগবাজার-বড়বাজারের ‘ভদ্দরলোক’ নামে পরিচিতি পায়), আর গ্রিকরা মিলে মোটা মুনাফা আয় করে যাচ্ছিল। এর মধ্যে গ্রিক বণিক মভ্রদি কেরিয়াকোস একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন চাটিগাঁও, আর ভোলার উৎপাদিত মোট লবণের এক-তৃতীয়াংশ। তখন এক ভোলা থেকেই বছরে ১ হাজার টনেরও বেশি লবণ আসত নারায়ণগঞ্জে। আর তাতে নিয়োজিত ছিল ১৬০টি বজরা। এই বণিকদের একজন ছিলেন নিকোলাস দিমিত্রিওস। টিএসসির সেই গ্রিক মন্দিরের ভেতরে অনেকের সঙ্গে সমাহিত আছেন সেই দিমিত্রিওসও।
বিষাদমাখা এক অর্থনীতির গল্প
টিএসসির সে মন্দিরের যে আকার ও আয়তন, তাতে করে বড়জোর এক বা দুজনের সমাধি হতে পারে। অথচ সেখানে আটটি স্মৃতিফলকে একজন করে আটজন এবং অন্য আরেকটা ফলকে একসঙ্গে তিন ভাইয়ের কথা উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এই ছোট একটি জায়গায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। এই ১১ জনের মৃত্যু কাছাকাছি সময়ে হয়নি। হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে। দুটি স্মৃতিফলকে উল্লেখিত দুই নারীর মধ্যে একটা সম্পর্ক (তাঁদের দুজনের শ্বশুর সম্ভবত দুই ভাই) অনুমান করা যায়। অন্য দুজন নারী আরেক গ্রিকের দুই স্ত্রী ও এক পরিবারের তিন ভাই। এ ছাড়া আরও চারজনের সঙ্গে একে অন্যের কোনো ধরনের আত্মীয়তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে সত্যি নয়।
মিসেস মাগদালেন, সোফিয়া জর্ডান এবং তাঁদের স্বামী মি. জোসেফ জর্ডানের (কেসারিয়া, তুর্কি থেকে আগত, নারায়ণগঞ্জের বণিক) স্মৃতির উদ্দেশে। জর্ডান ১০ ফেব্রুয়ারি ১৮১৯ সালে ৬০ বছর বয়সে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন। তাঁদের সবার স্মৃতির প্রতি অনুরাগ-আপ্লুত এই স্মারক নিবেদন করলেন তাঁদের অভাগা এতিম সন্তানেরা। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
তাহলে প্রথমে যে প্রশ্ন আসে, তাঁরা সবাই এক জায়গায় সমাহিত হলেন কীভাবে? কীভাবে তাঁদের মৃত্যুর প্রায় শতাব্দীকাল পরে এসে ঠাঁই পেলেন এই ছোট্ট সমাধি-মন্দিরে? আমরা এর উত্তর খুঁজব সমাধিফলকের গায়ে উৎকীর্ণ বাণী ও তৎকালীন বাংলায় গ্রিক বণিকদের ওপর করা গবেষণালব্ধ তথ্যের মধ্যে।
নিকোলাস দিমিত্রিওসের (জন্ম ১৭৯৭, মৃত্যু ১৮৪৩) সমাধিফলক লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। মৃত্যুর ১৬ বছর পর এসে ফলকটি উৎসর্গ করেছেন বাসিল দিমিত্রিওস। পারিবারিক নাম এক হলেও বাসিল নিজের পরিচয় দিয়েছেন নিকোলাসের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে। এই এপিটাফে একটা উর্দু কবিতা (সম্ভবত মির্জা গালিবের) ইংরেজি হরফে লেখা আছে, যার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম:
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
বোঝা যাচ্ছে নিকোলাসের কাব্যপ্রীতি ছিল, যা তাঁর বন্ধু বাসিলের অজানা ছিল না। হয়তো নিকোলাস ও বাসিল দুজনই ভারতবর্ষে, হয়তো ঢাকাতেই জন্মেছিলেন। বাল্যসখা ছিলেন। ঢাকার নবাবদের মধ্যে উর্দুর প্রচলন ছিল। সেখান থেকেই শিখেছিলেন এই ভাষা। খুব সম্ভব তাঁরা বাংলাও বলতে পারতেন, যেহেতু ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন।
দিমিত্রিওস এলিয়াসের জ্যেষ্ঠ পুত্র নিকোলাস দিমিত্রিওসের স্মৃতির উদ্দেশে। মৃত্যু ৫ মার্চ ১৮৪৩, বয়স ৪৬। তাঁর প্রিয় কবিতার ছত্র—
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু বাসিল দিমিত্রিওস এই ফলক স্থাপন করলেন ১৮৫৯ সালে। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
বন্ধুর জন্য এপিটাফের ব্যবস্থা করার এক বছরের মাথায় ১৮৬০ সালে মারা যান বাসিল দিমিত্রিওস, মাত্র ৬০ বছর বয়সে। ইংরেজি জানা বাসিল জীবনভর বিচিত্র পেশায় জড়িত ছিলেন। কমিশনারের সহকারী ছিলেন ৯ বছর, সেন্ট টমাস চার্চের (১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠিত) করণিক ছিলেন ৪০ বছর—জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আর ১০ বছর ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন ঢাকা কলেজে (১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত)। এর মানে জীবন চালানোর জন্য একসঙ্গে বেশ কিছু চাকরি করেছেন সমান্তরালে। ছাপোষা এমন একজন মানুষের বন্ধু ছিলেন ধনী বণিক নিকোলাস। সম্ভবত দুজনই সমবয়সী, একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন ও বেড়ে উঠেছেন।
প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল ফাদার নাথানিয়েলের স্মৃতিফলক। আমরা জানতে পারি, ১৭৩৬ সালে সুদূর আজিয়ান সাগরের ছোট্ট দ্বীপ সিফোনেসে জন্ম নেওয়া নাথানিয়েল শেষশয্যা নিয়েছেন ঢাকায়, ১৮১০ সালে। আমরা পুলকভরে অবগত হই যে তিনি তাঁর জন্মস্থান ও ঢাকা—দুই জায়গাকেই নিজের স্বদেশ বলে গণ্য করতেন! তিনি হয়তো ধর্ম প্রচারে এসে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বুড়িগঙ্গার ধারের এই নগরকে।
এইখানে শায়িত প্রয়াত কেসারিয়ার (তুরকিস্তান) জ্যাকব ইস্সাই লাকোবোগলাস। মৃত্যু ২২ জুন, ১৮১৯ সালে, বয়স হয়েছিল ৪৮। ওপর থেকে যিনি তাকিয়ে আছেন, হে ঈশ্বর, তাঁকে ক্ষমা করুন। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
নাথানিয়েলের চার বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন এক ব্যবসায়ী, কনস্টানটিন। তাঁর স্ত্রী এই সমাধিফলক বানান প্রয়াত সহধর্মীর জন্য—তাঁর নাম আমরা জানতে পারি না। কিন্তু তাঁর বেদনামথিত আবেগের কথা লেখা আছে মাতৃভাষা গ্রিকে।
ফিলিস্তিন থেকে আসা জোসেফ জর্ডান (১৭৫৯-১৮১৯), আর তাঁর দুই স্ত্রী মাগদালেন ও সোফিয়ার জন্য ইংরেজিতে ফলক লিখে রেখে গেছেন তাঁদের শোকগ্রস্ত সন্তানেরা। এতে অনুমান করা যায়, দ্বিতীয় প্রজন্মের গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য আর চাকরির সুবিধার্থে ইংরেজিকে তাঁদের প্রতিদিনের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
বাসিল দিমিত্রিওসের (সেন্ট থমাস চার্চের করণিক) পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে। জন্ম ১৮০০ সালে। তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ৯ বছর কমিশনের সহকারী, ১০ বছর ঢাকা কলেজের ইংরেজির শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন এবং ৪০ বছর সেন্ট থমাস চার্চে সেবা প্রদান করেছেন। ‘বিশুদ্ধ প্রাণ যাদের, তারাই তো দেখা পায় ঈশ্বরের’ (বাইবেল: ম্যাথিউ), ১৮৬০। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, সেদিন ছিল রোববার। ছুটির দিন। ঢাকা থেকে ২৫ মাইল দূরের মির্জাপুরে সেই দিন বাঘ শিকারে গিয়েছেন জন দিমিত্রিওস ইলিয়াস। সেখানেই বাঘের থাবায় তাঁর করুণ মৃত্যু হয় মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। যিনি বাঘ শিকারের মতো রোমাঞ্চকর ও দামি শখ মেটানোর ক্ষমতা রাখেন, তিনি যে ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ইংরেজিতে লেখা সে স্মৃতিপ্রস্তরে তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের কথাও বলা হয়েছে, তাঁরাও শিকারি ছিলেন। তাঁদের দেহাবশেষ একসঙ্গে করে তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁদের এক মামাতো বা খালাতো ভাই ম্যানুয়েল এই ফলকের ব্যবস্থা করেন।
এটি ফাদার নাথানিয়েলের সমাধি; পবিত্র এবং সাধু; যিনি পবিত্র এক সাধুর ন্যায় যিশুর কথা প্রচার করেছেন, তাঁর জীবনাচার এবং বাণীর মাধ্যমে। অনবদ্য এক আনন্দধাম এই ঢাকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বিতীয় সেন্ট থমাস*। তাঁর পিতৃভূমি ছিল সিফনোস (আজিয়ান সাগরের এক দ্বীপ), যেখানে তিনি ১৭৩৬ সালে প্রথম আলো দেখেছেন এবং ঢাকা—এই দুই স্থানকেই তিনি স্বদেশ বলে গণ্য করতেন। ১২ মার্চ ১৮১০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘তিনিই সুখী হন, যিনি অন্যকে ভক্তিময় সম্মান দান করেন’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮২০ সালের পর নানা কারণে ইংরেজ-কলকাতার ‘ভদ্দরলোক’ গ্রিকদের ত্রিমুখী বাণিজ্য প্রণয় আর আগের মতো থাকেনি, মুনাফাতেও টান পড়তে শুরু করে। চুন আর লবণের ব্যবসা ছেড়ে টাকাওয়ালা গ্রিকেরা জমিদারি কিনতে লাগলেন (বরিশাল অঞ্চলেও এদের একটা জমিদারি ছিল)। আর যাঁরা অতটা বিনিয়োগ করতে পারলেন না, তাঁরা ইংরেজদের সওদাগরি কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত ইংরেজ লেখক জেমস টেইলরের বই ‘A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca’ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৩৮ সালে ঢাকায় মাত্র ১২টি গ্রিক পরিবারের বসবাস ছিল। জন দিমিত্রিওস এলিয়াস আত্মীয়স্বজন সেই ১২ পরিবারের একজন হওয়ার কথা। আরও বোঝা যাচ্ছে যে গ্রিকদের ব্যবসা পড়তির দিকে থাকলেও তখন ঢাকায় অবস্থাসম্পন্ন কয়েকজন গ্রিকের বসবাস ছিল।
জর্জ মাভরোডোগ্লোর পুত্র কনস্টানটাইনের স্ত্রী, যিনি ছিলেন স্বামীপরায়ণা নারী, তাঁর চিরজাগরুক ভালোবাসার স্মারক হিসেবে এই ফলকখানি স্থাপন করেছেন। তাঁর (স্বামীর) জন্মস্থান ছিল ইস্তাম্বুল। একজন বণিক হিসেবে তিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন। ১৮০৬ সালের ২৪ জুলাই তিনি জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এই ঢাকায়। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
একই পরিবারের দুই বউ থিওডোসিয়া (মৃত্যু ১৮০৫) ও সুলতানার (জন্ম ১৭৬৬) দেহাবশেষ পাশাপাশি রাখা আছে। সুলতানা সম্ভবত অধুনা তুর্কি দেশের মেয়ে ছিলেন, শুধু নামেই তার ইঙ্গিত মেলে না, তাঁর শ্বশুর কারিয়াকোস ফিলিপ্পো নিজেও এসেছিলেন ইস্তাম্বুল থেকে। তিনি হয়তো ছেলের বিয়ের জন্য নিজের জন্মস্থানের মেয়েই খুঁজে এনেছিলেন। কেমন দেখতে ছিলেন সুলতানা? তিনি কি কখনো শাড়ি পরেছিলেন? সুলতানার মৃত্যু হয় ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে, আজ থেকে ২২২ বছর আগে, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে।
এই স্থাপনায় আরও আছে আধভাঙা এক সমাধিফলক, যার বাকি অংশ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। সেখানে আমরা দেখতে পাই, এক পিতা ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বরের কোনো এক দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন। একই সমাধিতে পরে তাঁর কন্যাকেও সমাহিত করা হয়। কন্যার জন্ম ১৮১৫ সালে। তাঁর মৃত্যুর বছর আমরা হয়তো জানতে পারব না কোনো দিনই; হয়তো পিতৃশোকাতুর মেয়েও বেশি দিন বাঁচেনি। শুধু জানব ঢাকায় বসবাসকারী এই গ্রিক পিতা এবং কন্যার শেষশয্যা হয়েছিল রমনার সবুজ গালিচার নিচে। নাম না জানা সেই মেয়ে তার বাবার কোলে শুয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে, পরম নিশ্চিন্তে।
দিমিত্রিওস এলিয়াস এস্কোয়ারের দ্বিতীয় পুত্র জন দিমিত্রিওসের পবিত্র স্মৃতির প্রতি। ১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, রবিবার ঢাকার উত্তর-পশ্চিমের মির্জাপুরে বাঘ শিকারে গিয়ে নিহত হন। এখানে তিন মহান ভাই নিকোলাস, জন ও কনস্টানটিন একসঙ্গে শায়িত হয়েছেন। এখানে যূথবদ্ধ হয়ে আছেন সাহসী শিকারি ও খেলাধুলায় পারদর্শী তিন উচ্ছল জীবন। ফলক স্থাপনায় (খালাতো/মামাতো) ভাই মানুয়েল এলিয়াস মিচো। ফলকের একদম নিচে লেখা আছে, ‘মারডক’, যা সম্ভবত কলকাতার সমাধিফলক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
যে কয়জন গ্রিকের সমাধিফলক এখানে আছে, তাঁরা একজন আরেকজনের সঙ্গে সরাসরি আত্মীয়তার সম্বন্ধে সংযুক্ত নন। তাঁদের দেহাবসান হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় দশক ধরে। অথচ তাঁরা মিললেন একই ছাদের নিচে!
১৮০০ সালের দিকে রমনা অঞ্চলে (তখন নাম ছিল সুজাতপুর) আগে থেকেই গ্রিকদের একটা সমাধি ছিল। ইংরেজরা রমনা অঞ্চলে নানা রকম স্থাপনা বানানো শুরু করলে এবং ১৮৫০ সালের পরে ঢাকায় ধনী গ্রিকদের আধিপত্য কমতে থাকলে এই সমাধি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হতে থাকে। শেষে এমন অবস্থা হয় যে এলাকার লোকজন সমাধিফলক, ইট-পাথর পর্যন্ত খুলে নিয়ে নির্মাণকাজে লাগানো শুরু করে একসময়। তাই দেখে অবশিষ্ট প্রভাবশালী গ্রিক (যাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী রাল্লি ব্রাদার্সের বংশধরেরা অন্যতম) বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের কাছে আরজি করলেন, অন্তত কিছু সমাধি, দেহাবশেষ এবং সমাধিফলক তুলে নিয়ে এসে একত্র করে একটা মন্দিরে স্থাপন করার অনুমতি দেওয়া হোক।
আধভাঙা স্মৃতিফলক: বাবা ও মেয়ের। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ ও গ্রিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯১৫ সালে তৈরি হয় টিএসসির এই সমাধি-মন্দির। ধারণা করা হয়, টিএসসির সবুজ গালিচার নিচেও শুয়ে আছেন উল্লেখিত মানুষগুলোর কেউ কেউ। এর ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এই মন্দির ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের অংশই হয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে এটির অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর সৌন্দর্য ও সৌকর্য নবায়ন হয়েছে ১৯৯৭ সালে দিল্লির গ্রিক দূতাবাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের যৌথ উদ্যোগে।
শুনতে পাচ্ছি, টিএসসি নতুন করে বিনির্মাণ করা হবে। তখন হয়তো এই সমাধি আবারও সরানো হবে। সেখানে চিরনিদ্রায় থাকা অভিবাসীরা হয়তো ভাবতে থাকবেন, তাঁদের অভিবাসনের কোনো শেষ নেই—না তাঁদের জীবদ্দশায়, না মরণের পর।
তথ্যসূত্র:
‘Glimpses of the Greek Community from the Dhaka University Gravestones’. Helen Abadzi. Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, 40, 101-116,1995
‘From Thrace to Bengal: Greek Merchants in Early Colonial Bengal’. KANDA Sayako. The Memoirs of Toyo Bunko, 77, 2019
লেখক: প্রযুক্তিবিদ, ইনফিনিয়াম ইউকে লিমিটেড, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য
*যিশুখ্রিষ্টের ১২ জন শিষ্যের একজন ছিলেন সেন্ট থমাস, যিনি প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি এক সময়ে দক্ষিণ ভারতে আসেন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য। তিনি সেখানেই দেহ রাখেন। নাথানিয়েলকে দ্বিতীয় সেন্ট থমাস বলা হচ্ছে, কেননা তিনিও সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষের এক নগর, ঢাকায় এসেছিলেন যেমন করে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এসেছিলেন আরেক ধর্মপ্রচারক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যখন সেখানে পড়তাম, তখন খুব আগ্রহ হতো মন্দিরটির বিষয়ে। শুনেছিলাম অনেক আগের ছোট্ট এক গ্রিক মেয়ের কবর আছে সেখানে। কেমন একটা বিষাদমাখা মায়া কাজ করত তার জন্য।
সম্প্রতি ফেসবুকের একটি পোস্টে প্রথমবারের মতো মন্দিরের অন্দর কক্ষ ও সেখানে সংরক্ষিত নয়টি অক্ষত, একটি আধভাঙা এপিটাফ এবং সমাধিফলক দেখে প্রায় ভুলে যাওয়া সেই স্মৃতি আবার মাথায় কড়া নাড়ল। এই অন্তর্জালের দুনিয়াতে তথ্য বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের এক গ্রিক কনসালট্যান্ট হেলেন আবাদজী আর জাপানি গবেষক কানদা সায়াকো—এর দুটি গবেষণাপত্রের তথ্য জোড়া লাগিয়ে একটা ছবি দাঁড় করিয়েছি—পলাশী যুদ্ধের সমসাময়িক বাংলায়, বিশেষ করে ঢাকায় গ্রিকদের আগমন, তাঁদের বাণিজ্য, পেশা, পারিবারিক-সামাজিক জীবন এবং ঢাকার বুকেই তাঁদের শেষশয্যা নিয়ে।
ঢাকায় গ্রিকদের গল্প
বাংলায় গ্রিকরা আসে ১৭৫০ সালের দিকে—আজকের গ্রিস এবং গ্রিক-অধ্যুষিত অঞ্চল, যেমন আধুনিক তুর্কি ও ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো থেকে। ভাগ্য ফেরানো ওসমানিয়া শাসন বলয় থেকে বের হওয়া, ধর্মপ্রচার ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের দিকে এরা আসতে শুরু করে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি বাংলায় ভালোভাবে আসন গেঁড়ে বসার পর। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আলেক্সিওসি (আলেক্সান্ডার) আর্গাইরি। বুলগেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী এই গ্রিক কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর কারবার ছিল বসরা আর লেভান্তে (সিরিয়া-লেবানন) অঞ্চলের সঙ্গে। ১৭৭০ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরার পথে বঙ্গোপসাগরে নিশ্চিত জাহাজডুবি থেকে বেঁচে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, কলকাতায় একটা চার্চ বানাবেন। তখন সবে কলকাতার গভর্নর হয়েছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তাঁকে গিয়ে আর্গাইরি ধরলেন চার্চ নির্মাণের অনুমতির জন্য। হেস্টিংস জানতেন, গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যবসায় উন্নতি করছে, তাই অনুমতি দিলেন। আর্গাইরি আর অন্যান্য ধনী গ্রিকরা চার্চ বানানোর তোড়জোড় শুরু করলে তিনি তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য হাজির হলেন ঢাকায়, ১৭৭১ সালে। এ থেকে অনুমান করা যায় আর্গাইরির আগমনের আগে থেকেই গ্রিক বণিকেরা ঢাকায় ডেরা বেঁধেছিল।
এই প্রস্তরখণ্ডের নিচে মিসেস সুলতানা আলেক্সান্ডার, আলেক্সান্ডারের স্ত্রীর (আলেক্সান্ডার ইস্তাম্বুলের কারিয়াকোস ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র) নশ্বর দেহাবশেষ শায়িত আছে, যিনি এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন, মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৪ বছর। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
আর্গাইরির সঙ্গে ঢাকায় আসে তাঁর ২১ বছর বয়সী বড় ছেলে পানিয়তি। ১৭৭৭ সালে আর্গাইরি মৃত্যুবরণ করেন ঢাকাতেই। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিকে পুঁজি করে ১৮ শতকের শেষার্ধে এসে এই পানিয়তি ব্যবসা বাড়িয়ে বাংলায় গ্রিক বণিক সম্প্রদায়ের প্রধান হয়ে ওঠেন। ঢাকা ও সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জে গ্রিকদের প্রধান বাণিজ্য ছিল চুন ও লবণকে ঘিরে। সিলেটের খাসিয়া-অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলে উৎকৃষ্ট মানের চুনাপাথর পাওয়া যেত (এবং এখনো যায়), যা থেকে তৈরি করা হতো চুন। সে চুন দরকার হতো বড় বড় ইমারত তৈরিতে। নৌপথে বজরায় করে সে চুনের চালান যেত নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে নদীপথে সহজেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার পদ্মা-মেঘনার সংগমস্থল দিয়ে উত্তর-পশ্চিম বা দক্ষিণ-পূর্বে নৌযাত্রা করা যেত। সে জন্য ভোলা ও চাটিগাঁ থেকে আসা লবণের বিরাট মোকাম গড়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জে।
এইখানে শায়িত আছেন ইস্তাম্বুলের জর্জ ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র থিওডোরের স্ত্রী থিওডোসিয়া। ১০ এপ্রিল ১৮০৫ সালে। তাঁর স্মৃতি অমর হোক। এই দুই নারীর সমাধিফলকেই একটা কথা আছে, যা আমাদের অবাক করে, ‘ঢাকার প্রতি তিনি ঋণী’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
চুন ও লবণ—এই দুই অতিপ্রয়োজনীয় বাণিজ্যের মূল অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ ইংরেজদের হাতে থাকলেও তাতে কলকাতার বাঙালি হিন্দু (যারা বউবাজার-বাগবাজার-বড়বাজারের ‘ভদ্দরলোক’ নামে পরিচিতি পায়), আর গ্রিকরা মিলে মোটা মুনাফা আয় করে যাচ্ছিল। এর মধ্যে গ্রিক বণিক মভ্রদি কেরিয়াকোস একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন চাটিগাঁও, আর ভোলার উৎপাদিত মোট লবণের এক-তৃতীয়াংশ। তখন এক ভোলা থেকেই বছরে ১ হাজার টনেরও বেশি লবণ আসত নারায়ণগঞ্জে। আর তাতে নিয়োজিত ছিল ১৬০টি বজরা। এই বণিকদের একজন ছিলেন নিকোলাস দিমিত্রিওস। টিএসসির সেই গ্রিক মন্দিরের ভেতরে অনেকের সঙ্গে সমাহিত আছেন সেই দিমিত্রিওসও।
বিষাদমাখা এক অর্থনীতির গল্প
টিএসসির সে মন্দিরের যে আকার ও আয়তন, তাতে করে বড়জোর এক বা দুজনের সমাধি হতে পারে। অথচ সেখানে আটটি স্মৃতিফলকে একজন করে আটজন এবং অন্য আরেকটা ফলকে একসঙ্গে তিন ভাইয়ের কথা উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এই ছোট একটি জায়গায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। এই ১১ জনের মৃত্যু কাছাকাছি সময়ে হয়নি। হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে। দুটি স্মৃতিফলকে উল্লেখিত দুই নারীর মধ্যে একটা সম্পর্ক (তাঁদের দুজনের শ্বশুর সম্ভবত দুই ভাই) অনুমান করা যায়। অন্য দুজন নারী আরেক গ্রিকের দুই স্ত্রী ও এক পরিবারের তিন ভাই। এ ছাড়া আরও চারজনের সঙ্গে একে অন্যের কোনো ধরনের আত্মীয়তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে সত্যি নয়।
মিসেস মাগদালেন, সোফিয়া জর্ডান এবং তাঁদের স্বামী মি. জোসেফ জর্ডানের (কেসারিয়া, তুর্কি থেকে আগত, নারায়ণগঞ্জের বণিক) স্মৃতির উদ্দেশে। জর্ডান ১০ ফেব্রুয়ারি ১৮১৯ সালে ৬০ বছর বয়সে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন। তাঁদের সবার স্মৃতির প্রতি অনুরাগ-আপ্লুত এই স্মারক নিবেদন করলেন তাঁদের অভাগা এতিম সন্তানেরা। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
তাহলে প্রথমে যে প্রশ্ন আসে, তাঁরা সবাই এক জায়গায় সমাহিত হলেন কীভাবে? কীভাবে তাঁদের মৃত্যুর প্রায় শতাব্দীকাল পরে এসে ঠাঁই পেলেন এই ছোট্ট সমাধি-মন্দিরে? আমরা এর উত্তর খুঁজব সমাধিফলকের গায়ে উৎকীর্ণ বাণী ও তৎকালীন বাংলায় গ্রিক বণিকদের ওপর করা গবেষণালব্ধ তথ্যের মধ্যে।
নিকোলাস দিমিত্রিওসের (জন্ম ১৭৯৭, মৃত্যু ১৮৪৩) সমাধিফলক লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। মৃত্যুর ১৬ বছর পর এসে ফলকটি উৎসর্গ করেছেন বাসিল দিমিত্রিওস। পারিবারিক নাম এক হলেও বাসিল নিজের পরিচয় দিয়েছেন নিকোলাসের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে। এই এপিটাফে একটা উর্দু কবিতা (সম্ভবত মির্জা গালিবের) ইংরেজি হরফে লেখা আছে, যার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম:
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
বোঝা যাচ্ছে নিকোলাসের কাব্যপ্রীতি ছিল, যা তাঁর বন্ধু বাসিলের অজানা ছিল না। হয়তো নিকোলাস ও বাসিল দুজনই ভারতবর্ষে, হয়তো ঢাকাতেই জন্মেছিলেন। বাল্যসখা ছিলেন। ঢাকার নবাবদের মধ্যে উর্দুর প্রচলন ছিল। সেখান থেকেই শিখেছিলেন এই ভাষা। খুব সম্ভব তাঁরা বাংলাও বলতে পারতেন, যেহেতু ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন।
দিমিত্রিওস এলিয়াসের জ্যেষ্ঠ পুত্র নিকোলাস দিমিত্রিওসের স্মৃতির উদ্দেশে। মৃত্যু ৫ মার্চ ১৮৪৩, বয়স ৪৬। তাঁর প্রিয় কবিতার ছত্র—
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু বাসিল দিমিত্রিওস এই ফলক স্থাপন করলেন ১৮৫৯ সালে। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
বন্ধুর জন্য এপিটাফের ব্যবস্থা করার এক বছরের মাথায় ১৮৬০ সালে মারা যান বাসিল দিমিত্রিওস, মাত্র ৬০ বছর বয়সে। ইংরেজি জানা বাসিল জীবনভর বিচিত্র পেশায় জড়িত ছিলেন। কমিশনারের সহকারী ছিলেন ৯ বছর, সেন্ট টমাস চার্চের (১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠিত) করণিক ছিলেন ৪০ বছর—জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আর ১০ বছর ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন ঢাকা কলেজে (১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত)। এর মানে জীবন চালানোর জন্য একসঙ্গে বেশ কিছু চাকরি করেছেন সমান্তরালে। ছাপোষা এমন একজন মানুষের বন্ধু ছিলেন ধনী বণিক নিকোলাস। সম্ভবত দুজনই সমবয়সী, একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন ও বেড়ে উঠেছেন।
প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল ফাদার নাথানিয়েলের স্মৃতিফলক। আমরা জানতে পারি, ১৭৩৬ সালে সুদূর আজিয়ান সাগরের ছোট্ট দ্বীপ সিফোনেসে জন্ম নেওয়া নাথানিয়েল শেষশয্যা নিয়েছেন ঢাকায়, ১৮১০ সালে। আমরা পুলকভরে অবগত হই যে তিনি তাঁর জন্মস্থান ও ঢাকা—দুই জায়গাকেই নিজের স্বদেশ বলে গণ্য করতেন! তিনি হয়তো ধর্ম প্রচারে এসে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বুড়িগঙ্গার ধারের এই নগরকে।
এইখানে শায়িত প্রয়াত কেসারিয়ার (তুরকিস্তান) জ্যাকব ইস্সাই লাকোবোগলাস। মৃত্যু ২২ জুন, ১৮১৯ সালে, বয়স হয়েছিল ৪৮। ওপর থেকে যিনি তাকিয়ে আছেন, হে ঈশ্বর, তাঁকে ক্ষমা করুন। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
নাথানিয়েলের চার বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন এক ব্যবসায়ী, কনস্টানটিন। তাঁর স্ত্রী এই সমাধিফলক বানান প্রয়াত সহধর্মীর জন্য—তাঁর নাম আমরা জানতে পারি না। কিন্তু তাঁর বেদনামথিত আবেগের কথা লেখা আছে মাতৃভাষা গ্রিকে।
ফিলিস্তিন থেকে আসা জোসেফ জর্ডান (১৭৫৯-১৮১৯), আর তাঁর দুই স্ত্রী মাগদালেন ও সোফিয়ার জন্য ইংরেজিতে ফলক লিখে রেখে গেছেন তাঁদের শোকগ্রস্ত সন্তানেরা। এতে অনুমান করা যায়, দ্বিতীয় প্রজন্মের গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য আর চাকরির সুবিধার্থে ইংরেজিকে তাঁদের প্রতিদিনের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
বাসিল দিমিত্রিওসের (সেন্ট থমাস চার্চের করণিক) পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে। জন্ম ১৮০০ সালে। তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ৯ বছর কমিশনের সহকারী, ১০ বছর ঢাকা কলেজের ইংরেজির শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন এবং ৪০ বছর সেন্ট থমাস চার্চে সেবা প্রদান করেছেন। ‘বিশুদ্ধ প্রাণ যাদের, তারাই তো দেখা পায় ঈশ্বরের’ (বাইবেল: ম্যাথিউ), ১৮৬০। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, সেদিন ছিল রোববার। ছুটির দিন। ঢাকা থেকে ২৫ মাইল দূরের মির্জাপুরে সেই দিন বাঘ শিকারে গিয়েছেন জন দিমিত্রিওস ইলিয়াস। সেখানেই বাঘের থাবায় তাঁর করুণ মৃত্যু হয় মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। যিনি বাঘ শিকারের মতো রোমাঞ্চকর ও দামি শখ মেটানোর ক্ষমতা রাখেন, তিনি যে ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ইংরেজিতে লেখা সে স্মৃতিপ্রস্তরে তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের কথাও বলা হয়েছে, তাঁরাও শিকারি ছিলেন। তাঁদের দেহাবশেষ একসঙ্গে করে তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁদের এক মামাতো বা খালাতো ভাই ম্যানুয়েল এই ফলকের ব্যবস্থা করেন।
এটি ফাদার নাথানিয়েলের সমাধি; পবিত্র এবং সাধু; যিনি পবিত্র এক সাধুর ন্যায় যিশুর কথা প্রচার করেছেন, তাঁর জীবনাচার এবং বাণীর মাধ্যমে। অনবদ্য এক আনন্দধাম এই ঢাকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বিতীয় সেন্ট থমাস*। তাঁর পিতৃভূমি ছিল সিফনোস (আজিয়ান সাগরের এক দ্বীপ), যেখানে তিনি ১৭৩৬ সালে প্রথম আলো দেখেছেন এবং ঢাকা—এই দুই স্থানকেই তিনি স্বদেশ বলে গণ্য করতেন। ১২ মার্চ ১৮১০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘তিনিই সুখী হন, যিনি অন্যকে ভক্তিময় সম্মান দান করেন’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮২০ সালের পর নানা কারণে ইংরেজ-কলকাতার ‘ভদ্দরলোক’ গ্রিকদের ত্রিমুখী বাণিজ্য প্রণয় আর আগের মতো থাকেনি, মুনাফাতেও টান পড়তে শুরু করে। চুন আর লবণের ব্যবসা ছেড়ে টাকাওয়ালা গ্রিকেরা জমিদারি কিনতে লাগলেন (বরিশাল অঞ্চলেও এদের একটা জমিদারি ছিল)। আর যাঁরা অতটা বিনিয়োগ করতে পারলেন না, তাঁরা ইংরেজদের সওদাগরি কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত ইংরেজ লেখক জেমস টেইলরের বই ‘A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca’ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৩৮ সালে ঢাকায় মাত্র ১২টি গ্রিক পরিবারের বসবাস ছিল। জন দিমিত্রিওস এলিয়াস আত্মীয়স্বজন সেই ১২ পরিবারের একজন হওয়ার কথা। আরও বোঝা যাচ্ছে যে গ্রিকদের ব্যবসা পড়তির দিকে থাকলেও তখন ঢাকায় অবস্থাসম্পন্ন কয়েকজন গ্রিকের বসবাস ছিল।
জর্জ মাভরোডোগ্লোর পুত্র কনস্টানটাইনের স্ত্রী, যিনি ছিলেন স্বামীপরায়ণা নারী, তাঁর চিরজাগরুক ভালোবাসার স্মারক হিসেবে এই ফলকখানি স্থাপন করেছেন। তাঁর (স্বামীর) জন্মস্থান ছিল ইস্তাম্বুল। একজন বণিক হিসেবে তিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন। ১৮০৬ সালের ২৪ জুলাই তিনি জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এই ঢাকায়। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
একই পরিবারের দুই বউ থিওডোসিয়া (মৃত্যু ১৮০৫) ও সুলতানার (জন্ম ১৭৬৬) দেহাবশেষ পাশাপাশি রাখা আছে। সুলতানা সম্ভবত অধুনা তুর্কি দেশের মেয়ে ছিলেন, শুধু নামেই তার ইঙ্গিত মেলে না, তাঁর শ্বশুর কারিয়াকোস ফিলিপ্পো নিজেও এসেছিলেন ইস্তাম্বুল থেকে। তিনি হয়তো ছেলের বিয়ের জন্য নিজের জন্মস্থানের মেয়েই খুঁজে এনেছিলেন। কেমন দেখতে ছিলেন সুলতানা? তিনি কি কখনো শাড়ি পরেছিলেন? সুলতানার মৃত্যু হয় ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে, আজ থেকে ২২২ বছর আগে, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে।
এই স্থাপনায় আরও আছে আধভাঙা এক সমাধিফলক, যার বাকি অংশ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। সেখানে আমরা দেখতে পাই, এক পিতা ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বরের কোনো এক দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন। একই সমাধিতে পরে তাঁর কন্যাকেও সমাহিত করা হয়। কন্যার জন্ম ১৮১৫ সালে। তাঁর মৃত্যুর বছর আমরা হয়তো জানতে পারব না কোনো দিনই; হয়তো পিতৃশোকাতুর মেয়েও বেশি দিন বাঁচেনি। শুধু জানব ঢাকায় বসবাসকারী এই গ্রিক পিতা এবং কন্যার শেষশয্যা হয়েছিল রমনার সবুজ গালিচার নিচে। নাম না জানা সেই মেয়ে তার বাবার কোলে শুয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে, পরম নিশ্চিন্তে।
দিমিত্রিওস এলিয়াস এস্কোয়ারের দ্বিতীয় পুত্র জন দিমিত্রিওসের পবিত্র স্মৃতির প্রতি। ১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, রবিবার ঢাকার উত্তর-পশ্চিমের মির্জাপুরে বাঘ শিকারে গিয়ে নিহত হন। এখানে তিন মহান ভাই নিকোলাস, জন ও কনস্টানটিন একসঙ্গে শায়িত হয়েছেন। এখানে যূথবদ্ধ হয়ে আছেন সাহসী শিকারি ও খেলাধুলায় পারদর্শী তিন উচ্ছল জীবন। ফলক স্থাপনায় (খালাতো/মামাতো) ভাই মানুয়েল এলিয়াস মিচো। ফলকের একদম নিচে লেখা আছে, ‘মারডক’, যা সম্ভবত কলকাতার সমাধিফলক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
যে কয়জন গ্রিকের সমাধিফলক এখানে আছে, তাঁরা একজন আরেকজনের সঙ্গে সরাসরি আত্মীয়তার সম্বন্ধে সংযুক্ত নন। তাঁদের দেহাবসান হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় দশক ধরে। অথচ তাঁরা মিললেন একই ছাদের নিচে!
১৮০০ সালের দিকে রমনা অঞ্চলে (তখন নাম ছিল সুজাতপুর) আগে থেকেই গ্রিকদের একটা সমাধি ছিল। ইংরেজরা রমনা অঞ্চলে নানা রকম স্থাপনা বানানো শুরু করলে এবং ১৮৫০ সালের পরে ঢাকায় ধনী গ্রিকদের আধিপত্য কমতে থাকলে এই সমাধি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হতে থাকে। শেষে এমন অবস্থা হয় যে এলাকার লোকজন সমাধিফলক, ইট-পাথর পর্যন্ত খুলে নিয়ে নির্মাণকাজে লাগানো শুরু করে একসময়। তাই দেখে অবশিষ্ট প্রভাবশালী গ্রিক (যাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী রাল্লি ব্রাদার্সের বংশধরেরা অন্যতম) বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের কাছে আরজি করলেন, অন্তত কিছু সমাধি, দেহাবশেষ এবং সমাধিফলক তুলে নিয়ে এসে একত্র করে একটা মন্দিরে স্থাপন করার অনুমতি দেওয়া হোক।
আধভাঙা স্মৃতিফলক: বাবা ও মেয়ের। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ ও গ্রিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯১৫ সালে তৈরি হয় টিএসসির এই সমাধি-মন্দির। ধারণা করা হয়, টিএসসির সবুজ গালিচার নিচেও শুয়ে আছেন উল্লেখিত মানুষগুলোর কেউ কেউ। এর ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এই মন্দির ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের অংশই হয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে এটির অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর সৌন্দর্য ও সৌকর্য নবায়ন হয়েছে ১৯৯৭ সালে দিল্লির গ্রিক দূতাবাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের যৌথ উদ্যোগে।
শুনতে পাচ্ছি, টিএসসি নতুন করে বিনির্মাণ করা হবে। তখন হয়তো এই সমাধি আবারও সরানো হবে। সেখানে চিরনিদ্রায় থাকা অভিবাসীরা হয়তো ভাবতে থাকবেন, তাঁদের অভিবাসনের কোনো শেষ নেই—না তাঁদের জীবদ্দশায়, না মরণের পর।
তথ্যসূত্র:
‘Glimpses of the Greek Community from the Dhaka University Gravestones’. Helen Abadzi. Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, 40, 101-116,1995
‘From Thrace to Bengal: Greek Merchants in Early Colonial Bengal’. KANDA Sayako. The Memoirs of Toyo Bunko, 77, 2019
লেখক: প্রযুক্তিবিদ, ইনফিনিয়াম ইউকে লিমিটেড, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য
*যিশুখ্রিষ্টের ১২ জন শিষ্যের একজন ছিলেন সেন্ট থমাস, যিনি প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি এক সময়ে দক্ষিণ ভারতে আসেন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য। তিনি সেখানেই দেহ রাখেন। নাথানিয়েলকে দ্বিতীয় সেন্ট থমাস বলা হচ্ছে, কেননা তিনিও সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষের এক নগর, ঢাকায় এসেছিলেন যেমন করে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এসেছিলেন আরেক ধর্মপ্রচারক।
ড. তৈফুর রহমান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যখন সেখানে পড়তাম, তখন খুব আগ্রহ হতো মন্দিরটির বিষয়ে। শুনেছিলাম অনেক আগের ছোট্ট এক গ্রিক মেয়ের কবর আছে সেখানে। কেমন একটা বিষাদমাখা মায়া কাজ করত তার জন্য।
সম্প্রতি ফেসবুকের একটি পোস্টে প্রথমবারের মতো মন্দিরের অন্দর কক্ষ ও সেখানে সংরক্ষিত নয়টি অক্ষত, একটি আধভাঙা এপিটাফ এবং সমাধিফলক দেখে প্রায় ভুলে যাওয়া সেই স্মৃতি আবার মাথায় কড়া নাড়ল। এই অন্তর্জালের দুনিয়াতে তথ্য বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের এক গ্রিক কনসালট্যান্ট হেলেন আবাদজী আর জাপানি গবেষক কানদা সায়াকো—এর দুটি গবেষণাপত্রের তথ্য জোড়া লাগিয়ে একটা ছবি দাঁড় করিয়েছি—পলাশী যুদ্ধের সমসাময়িক বাংলায়, বিশেষ করে ঢাকায় গ্রিকদের আগমন, তাঁদের বাণিজ্য, পেশা, পারিবারিক-সামাজিক জীবন এবং ঢাকার বুকেই তাঁদের শেষশয্যা নিয়ে।
ঢাকায় গ্রিকদের গল্প
বাংলায় গ্রিকরা আসে ১৭৫০ সালের দিকে—আজকের গ্রিস এবং গ্রিক-অধ্যুষিত অঞ্চল, যেমন আধুনিক তুর্কি ও ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো থেকে। ভাগ্য ফেরানো ওসমানিয়া শাসন বলয় থেকে বের হওয়া, ধর্মপ্রচার ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের দিকে এরা আসতে শুরু করে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি বাংলায় ভালোভাবে আসন গেঁড়ে বসার পর। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আলেক্সিওসি (আলেক্সান্ডার) আর্গাইরি। বুলগেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী এই গ্রিক কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর কারবার ছিল বসরা আর লেভান্তে (সিরিয়া-লেবানন) অঞ্চলের সঙ্গে। ১৭৭০ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরার পথে বঙ্গোপসাগরে নিশ্চিত জাহাজডুবি থেকে বেঁচে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, কলকাতায় একটা চার্চ বানাবেন। তখন সবে কলকাতার গভর্নর হয়েছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তাঁকে গিয়ে আর্গাইরি ধরলেন চার্চ নির্মাণের অনুমতির জন্য। হেস্টিংস জানতেন, গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যবসায় উন্নতি করছে, তাই অনুমতি দিলেন। আর্গাইরি আর অন্যান্য ধনী গ্রিকরা চার্চ বানানোর তোড়জোড় শুরু করলে তিনি তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য হাজির হলেন ঢাকায়, ১৭৭১ সালে। এ থেকে অনুমান করা যায় আর্গাইরির আগমনের আগে থেকেই গ্রিক বণিকেরা ঢাকায় ডেরা বেঁধেছিল।
এই প্রস্তরখণ্ডের নিচে মিসেস সুলতানা আলেক্সান্ডার, আলেক্সান্ডারের স্ত্রীর (আলেক্সান্ডার ইস্তাম্বুলের কারিয়াকোস ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র) নশ্বর দেহাবশেষ শায়িত আছে, যিনি এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন, মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৪ বছর। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
আর্গাইরির সঙ্গে ঢাকায় আসে তাঁর ২১ বছর বয়সী বড় ছেলে পানিয়তি। ১৭৭৭ সালে আর্গাইরি মৃত্যুবরণ করেন ঢাকাতেই। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিকে পুঁজি করে ১৮ শতকের শেষার্ধে এসে এই পানিয়তি ব্যবসা বাড়িয়ে বাংলায় গ্রিক বণিক সম্প্রদায়ের প্রধান হয়ে ওঠেন। ঢাকা ও সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জে গ্রিকদের প্রধান বাণিজ্য ছিল চুন ও লবণকে ঘিরে। সিলেটের খাসিয়া-অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলে উৎকৃষ্ট মানের চুনাপাথর পাওয়া যেত (এবং এখনো যায়), যা থেকে তৈরি করা হতো চুন। সে চুন দরকার হতো বড় বড় ইমারত তৈরিতে। নৌপথে বজরায় করে সে চুনের চালান যেত নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে নদীপথে সহজেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার পদ্মা-মেঘনার সংগমস্থল দিয়ে উত্তর-পশ্চিম বা দক্ষিণ-পূর্বে নৌযাত্রা করা যেত। সে জন্য ভোলা ও চাটিগাঁ থেকে আসা লবণের বিরাট মোকাম গড়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জে।
এইখানে শায়িত আছেন ইস্তাম্বুলের জর্জ ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র থিওডোরের স্ত্রী থিওডোসিয়া। ১০ এপ্রিল ১৮০৫ সালে। তাঁর স্মৃতি অমর হোক। এই দুই নারীর সমাধিফলকেই একটা কথা আছে, যা আমাদের অবাক করে, ‘ঢাকার প্রতি তিনি ঋণী’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
চুন ও লবণ—এই দুই অতিপ্রয়োজনীয় বাণিজ্যের মূল অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ ইংরেজদের হাতে থাকলেও তাতে কলকাতার বাঙালি হিন্দু (যারা বউবাজার-বাগবাজার-বড়বাজারের ‘ভদ্দরলোক’ নামে পরিচিতি পায়), আর গ্রিকরা মিলে মোটা মুনাফা আয় করে যাচ্ছিল। এর মধ্যে গ্রিক বণিক মভ্রদি কেরিয়াকোস একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন চাটিগাঁও, আর ভোলার উৎপাদিত মোট লবণের এক-তৃতীয়াংশ। তখন এক ভোলা থেকেই বছরে ১ হাজার টনেরও বেশি লবণ আসত নারায়ণগঞ্জে। আর তাতে নিয়োজিত ছিল ১৬০টি বজরা। এই বণিকদের একজন ছিলেন নিকোলাস দিমিত্রিওস। টিএসসির সেই গ্রিক মন্দিরের ভেতরে অনেকের সঙ্গে সমাহিত আছেন সেই দিমিত্রিওসও।
বিষাদমাখা এক অর্থনীতির গল্প
টিএসসির সে মন্দিরের যে আকার ও আয়তন, তাতে করে বড়জোর এক বা দুজনের সমাধি হতে পারে। অথচ সেখানে আটটি স্মৃতিফলকে একজন করে আটজন এবং অন্য আরেকটা ফলকে একসঙ্গে তিন ভাইয়ের কথা উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এই ছোট একটি জায়গায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। এই ১১ জনের মৃত্যু কাছাকাছি সময়ে হয়নি। হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে। দুটি স্মৃতিফলকে উল্লেখিত দুই নারীর মধ্যে একটা সম্পর্ক (তাঁদের দুজনের শ্বশুর সম্ভবত দুই ভাই) অনুমান করা যায়। অন্য দুজন নারী আরেক গ্রিকের দুই স্ত্রী ও এক পরিবারের তিন ভাই। এ ছাড়া আরও চারজনের সঙ্গে একে অন্যের কোনো ধরনের আত্মীয়তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে সত্যি নয়।
মিসেস মাগদালেন, সোফিয়া জর্ডান এবং তাঁদের স্বামী মি. জোসেফ জর্ডানের (কেসারিয়া, তুর্কি থেকে আগত, নারায়ণগঞ্জের বণিক) স্মৃতির উদ্দেশে। জর্ডান ১০ ফেব্রুয়ারি ১৮১৯ সালে ৬০ বছর বয়সে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন। তাঁদের সবার স্মৃতির প্রতি অনুরাগ-আপ্লুত এই স্মারক নিবেদন করলেন তাঁদের অভাগা এতিম সন্তানেরা। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
তাহলে প্রথমে যে প্রশ্ন আসে, তাঁরা সবাই এক জায়গায় সমাহিত হলেন কীভাবে? কীভাবে তাঁদের মৃত্যুর প্রায় শতাব্দীকাল পরে এসে ঠাঁই পেলেন এই ছোট্ট সমাধি-মন্দিরে? আমরা এর উত্তর খুঁজব সমাধিফলকের গায়ে উৎকীর্ণ বাণী ও তৎকালীন বাংলায় গ্রিক বণিকদের ওপর করা গবেষণালব্ধ তথ্যের মধ্যে।
নিকোলাস দিমিত্রিওসের (জন্ম ১৭৯৭, মৃত্যু ১৮৪৩) সমাধিফলক লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। মৃত্যুর ১৬ বছর পর এসে ফলকটি উৎসর্গ করেছেন বাসিল দিমিত্রিওস। পারিবারিক নাম এক হলেও বাসিল নিজের পরিচয় দিয়েছেন নিকোলাসের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে। এই এপিটাফে একটা উর্দু কবিতা (সম্ভবত মির্জা গালিবের) ইংরেজি হরফে লেখা আছে, যার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম:
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
বোঝা যাচ্ছে নিকোলাসের কাব্যপ্রীতি ছিল, যা তাঁর বন্ধু বাসিলের অজানা ছিল না। হয়তো নিকোলাস ও বাসিল দুজনই ভারতবর্ষে, হয়তো ঢাকাতেই জন্মেছিলেন। বাল্যসখা ছিলেন। ঢাকার নবাবদের মধ্যে উর্দুর প্রচলন ছিল। সেখান থেকেই শিখেছিলেন এই ভাষা। খুব সম্ভব তাঁরা বাংলাও বলতে পারতেন, যেহেতু ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন।
দিমিত্রিওস এলিয়াসের জ্যেষ্ঠ পুত্র নিকোলাস দিমিত্রিওসের স্মৃতির উদ্দেশে। মৃত্যু ৫ মার্চ ১৮৪৩, বয়স ৪৬। তাঁর প্রিয় কবিতার ছত্র—
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু বাসিল দিমিত্রিওস এই ফলক স্থাপন করলেন ১৮৫৯ সালে। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
বন্ধুর জন্য এপিটাফের ব্যবস্থা করার এক বছরের মাথায় ১৮৬০ সালে মারা যান বাসিল দিমিত্রিওস, মাত্র ৬০ বছর বয়সে। ইংরেজি জানা বাসিল জীবনভর বিচিত্র পেশায় জড়িত ছিলেন। কমিশনারের সহকারী ছিলেন ৯ বছর, সেন্ট টমাস চার্চের (১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠিত) করণিক ছিলেন ৪০ বছর—জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আর ১০ বছর ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন ঢাকা কলেজে (১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত)। এর মানে জীবন চালানোর জন্য একসঙ্গে বেশ কিছু চাকরি করেছেন সমান্তরালে। ছাপোষা এমন একজন মানুষের বন্ধু ছিলেন ধনী বণিক নিকোলাস। সম্ভবত দুজনই সমবয়সী, একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন ও বেড়ে উঠেছেন।
প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল ফাদার নাথানিয়েলের স্মৃতিফলক। আমরা জানতে পারি, ১৭৩৬ সালে সুদূর আজিয়ান সাগরের ছোট্ট দ্বীপ সিফোনেসে জন্ম নেওয়া নাথানিয়েল শেষশয্যা নিয়েছেন ঢাকায়, ১৮১০ সালে। আমরা পুলকভরে অবগত হই যে তিনি তাঁর জন্মস্থান ও ঢাকা—দুই জায়গাকেই নিজের স্বদেশ বলে গণ্য করতেন! তিনি হয়তো ধর্ম প্রচারে এসে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বুড়িগঙ্গার ধারের এই নগরকে।
এইখানে শায়িত প্রয়াত কেসারিয়ার (তুরকিস্তান) জ্যাকব ইস্সাই লাকোবোগলাস। মৃত্যু ২২ জুন, ১৮১৯ সালে, বয়স হয়েছিল ৪৮। ওপর থেকে যিনি তাকিয়ে আছেন, হে ঈশ্বর, তাঁকে ক্ষমা করুন। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
নাথানিয়েলের চার বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন এক ব্যবসায়ী, কনস্টানটিন। তাঁর স্ত্রী এই সমাধিফলক বানান প্রয়াত সহধর্মীর জন্য—তাঁর নাম আমরা জানতে পারি না। কিন্তু তাঁর বেদনামথিত আবেগের কথা লেখা আছে মাতৃভাষা গ্রিকে।
ফিলিস্তিন থেকে আসা জোসেফ জর্ডান (১৭৫৯-১৮১৯), আর তাঁর দুই স্ত্রী মাগদালেন ও সোফিয়ার জন্য ইংরেজিতে ফলক লিখে রেখে গেছেন তাঁদের শোকগ্রস্ত সন্তানেরা। এতে অনুমান করা যায়, দ্বিতীয় প্রজন্মের গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য আর চাকরির সুবিধার্থে ইংরেজিকে তাঁদের প্রতিদিনের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
বাসিল দিমিত্রিওসের (সেন্ট থমাস চার্চের করণিক) পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে। জন্ম ১৮০০ সালে। তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ৯ বছর কমিশনের সহকারী, ১০ বছর ঢাকা কলেজের ইংরেজির শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন এবং ৪০ বছর সেন্ট থমাস চার্চে সেবা প্রদান করেছেন। ‘বিশুদ্ধ প্রাণ যাদের, তারাই তো দেখা পায় ঈশ্বরের’ (বাইবেল: ম্যাথিউ), ১৮৬০। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, সেদিন ছিল রোববার। ছুটির দিন। ঢাকা থেকে ২৫ মাইল দূরের মির্জাপুরে সেই দিন বাঘ শিকারে গিয়েছেন জন দিমিত্রিওস ইলিয়াস। সেখানেই বাঘের থাবায় তাঁর করুণ মৃত্যু হয় মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। যিনি বাঘ শিকারের মতো রোমাঞ্চকর ও দামি শখ মেটানোর ক্ষমতা রাখেন, তিনি যে ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ইংরেজিতে লেখা সে স্মৃতিপ্রস্তরে তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের কথাও বলা হয়েছে, তাঁরাও শিকারি ছিলেন। তাঁদের দেহাবশেষ একসঙ্গে করে তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁদের এক মামাতো বা খালাতো ভাই ম্যানুয়েল এই ফলকের ব্যবস্থা করেন।
এটি ফাদার নাথানিয়েলের সমাধি; পবিত্র এবং সাধু; যিনি পবিত্র এক সাধুর ন্যায় যিশুর কথা প্রচার করেছেন, তাঁর জীবনাচার এবং বাণীর মাধ্যমে। অনবদ্য এক আনন্দধাম এই ঢাকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বিতীয় সেন্ট থমাস*। তাঁর পিতৃভূমি ছিল সিফনোস (আজিয়ান সাগরের এক দ্বীপ), যেখানে তিনি ১৭৩৬ সালে প্রথম আলো দেখেছেন এবং ঢাকা—এই দুই স্থানকেই তিনি স্বদেশ বলে গণ্য করতেন। ১২ মার্চ ১৮১০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘তিনিই সুখী হন, যিনি অন্যকে ভক্তিময় সম্মান দান করেন’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮২০ সালের পর নানা কারণে ইংরেজ-কলকাতার ‘ভদ্দরলোক’ গ্রিকদের ত্রিমুখী বাণিজ্য প্রণয় আর আগের মতো থাকেনি, মুনাফাতেও টান পড়তে শুরু করে। চুন আর লবণের ব্যবসা ছেড়ে টাকাওয়ালা গ্রিকেরা জমিদারি কিনতে লাগলেন (বরিশাল অঞ্চলেও এদের একটা জমিদারি ছিল)। আর যাঁরা অতটা বিনিয়োগ করতে পারলেন না, তাঁরা ইংরেজদের সওদাগরি কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত ইংরেজ লেখক জেমস টেইলরের বই ‘A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca’ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৩৮ সালে ঢাকায় মাত্র ১২টি গ্রিক পরিবারের বসবাস ছিল। জন দিমিত্রিওস এলিয়াস আত্মীয়স্বজন সেই ১২ পরিবারের একজন হওয়ার কথা। আরও বোঝা যাচ্ছে যে গ্রিকদের ব্যবসা পড়তির দিকে থাকলেও তখন ঢাকায় অবস্থাসম্পন্ন কয়েকজন গ্রিকের বসবাস ছিল।
জর্জ মাভরোডোগ্লোর পুত্র কনস্টানটাইনের স্ত্রী, যিনি ছিলেন স্বামীপরায়ণা নারী, তাঁর চিরজাগরুক ভালোবাসার স্মারক হিসেবে এই ফলকখানি স্থাপন করেছেন। তাঁর (স্বামীর) জন্মস্থান ছিল ইস্তাম্বুল। একজন বণিক হিসেবে তিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন। ১৮০৬ সালের ২৪ জুলাই তিনি জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এই ঢাকায়। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
একই পরিবারের দুই বউ থিওডোসিয়া (মৃত্যু ১৮০৫) ও সুলতানার (জন্ম ১৭৬৬) দেহাবশেষ পাশাপাশি রাখা আছে। সুলতানা সম্ভবত অধুনা তুর্কি দেশের মেয়ে ছিলেন, শুধু নামেই তার ইঙ্গিত মেলে না, তাঁর শ্বশুর কারিয়াকোস ফিলিপ্পো নিজেও এসেছিলেন ইস্তাম্বুল থেকে। তিনি হয়তো ছেলের বিয়ের জন্য নিজের জন্মস্থানের মেয়েই খুঁজে এনেছিলেন। কেমন দেখতে ছিলেন সুলতানা? তিনি কি কখনো শাড়ি পরেছিলেন? সুলতানার মৃত্যু হয় ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে, আজ থেকে ২২২ বছর আগে, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে।
এই স্থাপনায় আরও আছে আধভাঙা এক সমাধিফলক, যার বাকি অংশ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। সেখানে আমরা দেখতে পাই, এক পিতা ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বরের কোনো এক দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন। একই সমাধিতে পরে তাঁর কন্যাকেও সমাহিত করা হয়। কন্যার জন্ম ১৮১৫ সালে। তাঁর মৃত্যুর বছর আমরা হয়তো জানতে পারব না কোনো দিনই; হয়তো পিতৃশোকাতুর মেয়েও বেশি দিন বাঁচেনি। শুধু জানব ঢাকায় বসবাসকারী এই গ্রিক পিতা এবং কন্যার শেষশয্যা হয়েছিল রমনার সবুজ গালিচার নিচে। নাম না জানা সেই মেয়ে তার বাবার কোলে শুয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে, পরম নিশ্চিন্তে।
দিমিত্রিওস এলিয়াস এস্কোয়ারের দ্বিতীয় পুত্র জন দিমিত্রিওসের পবিত্র স্মৃতির প্রতি। ১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, রবিবার ঢাকার উত্তর-পশ্চিমের মির্জাপুরে বাঘ শিকারে গিয়ে নিহত হন। এখানে তিন মহান ভাই নিকোলাস, জন ও কনস্টানটিন একসঙ্গে শায়িত হয়েছেন। এখানে যূথবদ্ধ হয়ে আছেন সাহসী শিকারি ও খেলাধুলায় পারদর্শী তিন উচ্ছল জীবন। ফলক স্থাপনায় (খালাতো/মামাতো) ভাই মানুয়েল এলিয়াস মিচো। ফলকের একদম নিচে লেখা আছে, ‘মারডক’, যা সম্ভবত কলকাতার সমাধিফলক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
যে কয়জন গ্রিকের সমাধিফলক এখানে আছে, তাঁরা একজন আরেকজনের সঙ্গে সরাসরি আত্মীয়তার সম্বন্ধে সংযুক্ত নন। তাঁদের দেহাবসান হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় দশক ধরে। অথচ তাঁরা মিললেন একই ছাদের নিচে!
১৮০০ সালের দিকে রমনা অঞ্চলে (তখন নাম ছিল সুজাতপুর) আগে থেকেই গ্রিকদের একটা সমাধি ছিল। ইংরেজরা রমনা অঞ্চলে নানা রকম স্থাপনা বানানো শুরু করলে এবং ১৮৫০ সালের পরে ঢাকায় ধনী গ্রিকদের আধিপত্য কমতে থাকলে এই সমাধি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হতে থাকে। শেষে এমন অবস্থা হয় যে এলাকার লোকজন সমাধিফলক, ইট-পাথর পর্যন্ত খুলে নিয়ে নির্মাণকাজে লাগানো শুরু করে একসময়। তাই দেখে অবশিষ্ট প্রভাবশালী গ্রিক (যাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী রাল্লি ব্রাদার্সের বংশধরেরা অন্যতম) বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের কাছে আরজি করলেন, অন্তত কিছু সমাধি, দেহাবশেষ এবং সমাধিফলক তুলে নিয়ে এসে একত্র করে একটা মন্দিরে স্থাপন করার অনুমতি দেওয়া হোক।
আধভাঙা স্মৃতিফলক: বাবা ও মেয়ের। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ ও গ্রিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯১৫ সালে তৈরি হয় টিএসসির এই সমাধি-মন্দির। ধারণা করা হয়, টিএসসির সবুজ গালিচার নিচেও শুয়ে আছেন উল্লেখিত মানুষগুলোর কেউ কেউ। এর ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এই মন্দির ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের অংশই হয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে এটির অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর সৌন্দর্য ও সৌকর্য নবায়ন হয়েছে ১৯৯৭ সালে দিল্লির গ্রিক দূতাবাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের যৌথ উদ্যোগে।
শুনতে পাচ্ছি, টিএসসি নতুন করে বিনির্মাণ করা হবে। তখন হয়তো এই সমাধি আবারও সরানো হবে। সেখানে চিরনিদ্রায় থাকা অভিবাসীরা হয়তো ভাবতে থাকবেন, তাঁদের অভিবাসনের কোনো শেষ নেই—না তাঁদের জীবদ্দশায়, না মরণের পর।
তথ্যসূত্র:
‘Glimpses of the Greek Community from the Dhaka University Gravestones’. Helen Abadzi. Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, 40, 101-116,1995
‘From Thrace to Bengal: Greek Merchants in Early Colonial Bengal’. KANDA Sayako. The Memoirs of Toyo Bunko, 77, 2019
লেখক: প্রযুক্তিবিদ, ইনফিনিয়াম ইউকে লিমিটেড, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য
*যিশুখ্রিষ্টের ১২ জন শিষ্যের একজন ছিলেন সেন্ট থমাস, যিনি প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি এক সময়ে দক্ষিণ ভারতে আসেন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য। তিনি সেখানেই দেহ রাখেন। নাথানিয়েলকে দ্বিতীয় সেন্ট থমাস বলা হচ্ছে, কেননা তিনিও সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষের এক নগর, ঢাকায় এসেছিলেন যেমন করে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এসেছিলেন আরেক ধর্মপ্রচারক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যখন সেখানে পড়তাম, তখন খুব আগ্রহ হতো মন্দিরটির বিষয়ে। শুনেছিলাম অনেক আগের ছোট্ট এক গ্রিক মেয়ের কবর আছে সেখানে। কেমন একটা বিষাদমাখা মায়া কাজ করত তার জন্য।
সম্প্রতি ফেসবুকের একটি পোস্টে প্রথমবারের মতো মন্দিরের অন্দর কক্ষ ও সেখানে সংরক্ষিত নয়টি অক্ষত, একটি আধভাঙা এপিটাফ এবং সমাধিফলক দেখে প্রায় ভুলে যাওয়া সেই স্মৃতি আবার মাথায় কড়া নাড়ল। এই অন্তর্জালের দুনিয়াতে তথ্য বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের এক গ্রিক কনসালট্যান্ট হেলেন আবাদজী আর জাপানি গবেষক কানদা সায়াকো—এর দুটি গবেষণাপত্রের তথ্য জোড়া লাগিয়ে একটা ছবি দাঁড় করিয়েছি—পলাশী যুদ্ধের সমসাময়িক বাংলায়, বিশেষ করে ঢাকায় গ্রিকদের আগমন, তাঁদের বাণিজ্য, পেশা, পারিবারিক-সামাজিক জীবন এবং ঢাকার বুকেই তাঁদের শেষশয্যা নিয়ে।
ঢাকায় গ্রিকদের গল্প
বাংলায় গ্রিকরা আসে ১৭৫০ সালের দিকে—আজকের গ্রিস এবং গ্রিক-অধ্যুষিত অঞ্চল, যেমন আধুনিক তুর্কি ও ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো থেকে। ভাগ্য ফেরানো ওসমানিয়া শাসন বলয় থেকে বের হওয়া, ধর্মপ্রচার ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের দিকে এরা আসতে শুরু করে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি বাংলায় ভালোভাবে আসন গেঁড়ে বসার পর। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আলেক্সিওসি (আলেক্সান্ডার) আর্গাইরি। বুলগেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী এই গ্রিক কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর কারবার ছিল বসরা আর লেভান্তে (সিরিয়া-লেবানন) অঞ্চলের সঙ্গে। ১৭৭০ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরার পথে বঙ্গোপসাগরে নিশ্চিত জাহাজডুবি থেকে বেঁচে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, কলকাতায় একটা চার্চ বানাবেন। তখন সবে কলকাতার গভর্নর হয়েছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তাঁকে গিয়ে আর্গাইরি ধরলেন চার্চ নির্মাণের অনুমতির জন্য। হেস্টিংস জানতেন, গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যবসায় উন্নতি করছে, তাই অনুমতি দিলেন। আর্গাইরি আর অন্যান্য ধনী গ্রিকরা চার্চ বানানোর তোড়জোড় শুরু করলে তিনি তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য হাজির হলেন ঢাকায়, ১৭৭১ সালে। এ থেকে অনুমান করা যায় আর্গাইরির আগমনের আগে থেকেই গ্রিক বণিকেরা ঢাকায় ডেরা বেঁধেছিল।
এই প্রস্তরখণ্ডের নিচে মিসেস সুলতানা আলেক্সান্ডার, আলেক্সান্ডারের স্ত্রীর (আলেক্সান্ডার ইস্তাম্বুলের কারিয়াকোস ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র) নশ্বর দেহাবশেষ শায়িত আছে, যিনি এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন, মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৪ বছর। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
আর্গাইরির সঙ্গে ঢাকায় আসে তাঁর ২১ বছর বয়সী বড় ছেলে পানিয়তি। ১৭৭৭ সালে আর্গাইরি মৃত্যুবরণ করেন ঢাকাতেই। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিকে পুঁজি করে ১৮ শতকের শেষার্ধে এসে এই পানিয়তি ব্যবসা বাড়িয়ে বাংলায় গ্রিক বণিক সম্প্রদায়ের প্রধান হয়ে ওঠেন। ঢাকা ও সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জে গ্রিকদের প্রধান বাণিজ্য ছিল চুন ও লবণকে ঘিরে। সিলেটের খাসিয়া-অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলে উৎকৃষ্ট মানের চুনাপাথর পাওয়া যেত (এবং এখনো যায়), যা থেকে তৈরি করা হতো চুন। সে চুন দরকার হতো বড় বড় ইমারত তৈরিতে। নৌপথে বজরায় করে সে চুনের চালান যেত নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে নদীপথে সহজেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার পদ্মা-মেঘনার সংগমস্থল দিয়ে উত্তর-পশ্চিম বা দক্ষিণ-পূর্বে নৌযাত্রা করা যেত। সে জন্য ভোলা ও চাটিগাঁ থেকে আসা লবণের বিরাট মোকাম গড়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জে।
এইখানে শায়িত আছেন ইস্তাম্বুলের জর্জ ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র থিওডোরের স্ত্রী থিওডোসিয়া। ১০ এপ্রিল ১৮০৫ সালে। তাঁর স্মৃতি অমর হোক। এই দুই নারীর সমাধিফলকেই একটা কথা আছে, যা আমাদের অবাক করে, ‘ঢাকার প্রতি তিনি ঋণী’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
চুন ও লবণ—এই দুই অতিপ্রয়োজনীয় বাণিজ্যের মূল অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ ইংরেজদের হাতে থাকলেও তাতে কলকাতার বাঙালি হিন্দু (যারা বউবাজার-বাগবাজার-বড়বাজারের ‘ভদ্দরলোক’ নামে পরিচিতি পায়), আর গ্রিকরা মিলে মোটা মুনাফা আয় করে যাচ্ছিল। এর মধ্যে গ্রিক বণিক মভ্রদি কেরিয়াকোস একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন চাটিগাঁও, আর ভোলার উৎপাদিত মোট লবণের এক-তৃতীয়াংশ। তখন এক ভোলা থেকেই বছরে ১ হাজার টনেরও বেশি লবণ আসত নারায়ণগঞ্জে। আর তাতে নিয়োজিত ছিল ১৬০টি বজরা। এই বণিকদের একজন ছিলেন নিকোলাস দিমিত্রিওস। টিএসসির সেই গ্রিক মন্দিরের ভেতরে অনেকের সঙ্গে সমাহিত আছেন সেই দিমিত্রিওসও।
বিষাদমাখা এক অর্থনীতির গল্প
টিএসসির সে মন্দিরের যে আকার ও আয়তন, তাতে করে বড়জোর এক বা দুজনের সমাধি হতে পারে। অথচ সেখানে আটটি স্মৃতিফলকে একজন করে আটজন এবং অন্য আরেকটা ফলকে একসঙ্গে তিন ভাইয়ের কথা উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এই ছোট একটি জায়গায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। এই ১১ জনের মৃত্যু কাছাকাছি সময়ে হয়নি। হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে। দুটি স্মৃতিফলকে উল্লেখিত দুই নারীর মধ্যে একটা সম্পর্ক (তাঁদের দুজনের শ্বশুর সম্ভবত দুই ভাই) অনুমান করা যায়। অন্য দুজন নারী আরেক গ্রিকের দুই স্ত্রী ও এক পরিবারের তিন ভাই। এ ছাড়া আরও চারজনের সঙ্গে একে অন্যের কোনো ধরনের আত্মীয়তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে সত্যি নয়।
মিসেস মাগদালেন, সোফিয়া জর্ডান এবং তাঁদের স্বামী মি. জোসেফ জর্ডানের (কেসারিয়া, তুর্কি থেকে আগত, নারায়ণগঞ্জের বণিক) স্মৃতির উদ্দেশে। জর্ডান ১০ ফেব্রুয়ারি ১৮১৯ সালে ৬০ বছর বয়সে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন। তাঁদের সবার স্মৃতির প্রতি অনুরাগ-আপ্লুত এই স্মারক নিবেদন করলেন তাঁদের অভাগা এতিম সন্তানেরা। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
তাহলে প্রথমে যে প্রশ্ন আসে, তাঁরা সবাই এক জায়গায় সমাহিত হলেন কীভাবে? কীভাবে তাঁদের মৃত্যুর প্রায় শতাব্দীকাল পরে এসে ঠাঁই পেলেন এই ছোট্ট সমাধি-মন্দিরে? আমরা এর উত্তর খুঁজব সমাধিফলকের গায়ে উৎকীর্ণ বাণী ও তৎকালীন বাংলায় গ্রিক বণিকদের ওপর করা গবেষণালব্ধ তথ্যের মধ্যে।
নিকোলাস দিমিত্রিওসের (জন্ম ১৭৯৭, মৃত্যু ১৮৪৩) সমাধিফলক লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। মৃত্যুর ১৬ বছর পর এসে ফলকটি উৎসর্গ করেছেন বাসিল দিমিত্রিওস। পারিবারিক নাম এক হলেও বাসিল নিজের পরিচয় দিয়েছেন নিকোলাসের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে। এই এপিটাফে একটা উর্দু কবিতা (সম্ভবত মির্জা গালিবের) ইংরেজি হরফে লেখা আছে, যার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম:
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
বোঝা যাচ্ছে নিকোলাসের কাব্যপ্রীতি ছিল, যা তাঁর বন্ধু বাসিলের অজানা ছিল না। হয়তো নিকোলাস ও বাসিল দুজনই ভারতবর্ষে, হয়তো ঢাকাতেই জন্মেছিলেন। বাল্যসখা ছিলেন। ঢাকার নবাবদের মধ্যে উর্দুর প্রচলন ছিল। সেখান থেকেই শিখেছিলেন এই ভাষা। খুব সম্ভব তাঁরা বাংলাও বলতে পারতেন, যেহেতু ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন।
দিমিত্রিওস এলিয়াসের জ্যেষ্ঠ পুত্র নিকোলাস দিমিত্রিওসের স্মৃতির উদ্দেশে। মৃত্যু ৫ মার্চ ১৮৪৩, বয়স ৪৬। তাঁর প্রিয় কবিতার ছত্র—
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু বাসিল দিমিত্রিওস এই ফলক স্থাপন করলেন ১৮৫৯ সালে। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
বন্ধুর জন্য এপিটাফের ব্যবস্থা করার এক বছরের মাথায় ১৮৬০ সালে মারা যান বাসিল দিমিত্রিওস, মাত্র ৬০ বছর বয়সে। ইংরেজি জানা বাসিল জীবনভর বিচিত্র পেশায় জড়িত ছিলেন। কমিশনারের সহকারী ছিলেন ৯ বছর, সেন্ট টমাস চার্চের (১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠিত) করণিক ছিলেন ৪০ বছর—জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আর ১০ বছর ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন ঢাকা কলেজে (১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত)। এর মানে জীবন চালানোর জন্য একসঙ্গে বেশ কিছু চাকরি করেছেন সমান্তরালে। ছাপোষা এমন একজন মানুষের বন্ধু ছিলেন ধনী বণিক নিকোলাস। সম্ভবত দুজনই সমবয়সী, একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন ও বেড়ে উঠেছেন।
প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল ফাদার নাথানিয়েলের স্মৃতিফলক। আমরা জানতে পারি, ১৭৩৬ সালে সুদূর আজিয়ান সাগরের ছোট্ট দ্বীপ সিফোনেসে জন্ম নেওয়া নাথানিয়েল শেষশয্যা নিয়েছেন ঢাকায়, ১৮১০ সালে। আমরা পুলকভরে অবগত হই যে তিনি তাঁর জন্মস্থান ও ঢাকা—দুই জায়গাকেই নিজের স্বদেশ বলে গণ্য করতেন! তিনি হয়তো ধর্ম প্রচারে এসে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বুড়িগঙ্গার ধারের এই নগরকে।
এইখানে শায়িত প্রয়াত কেসারিয়ার (তুরকিস্তান) জ্যাকব ইস্সাই লাকোবোগলাস। মৃত্যু ২২ জুন, ১৮১৯ সালে, বয়স হয়েছিল ৪৮। ওপর থেকে যিনি তাকিয়ে আছেন, হে ঈশ্বর, তাঁকে ক্ষমা করুন। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
নাথানিয়েলের চার বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন এক ব্যবসায়ী, কনস্টানটিন। তাঁর স্ত্রী এই সমাধিফলক বানান প্রয়াত সহধর্মীর জন্য—তাঁর নাম আমরা জানতে পারি না। কিন্তু তাঁর বেদনামথিত আবেগের কথা লেখা আছে মাতৃভাষা গ্রিকে।
ফিলিস্তিন থেকে আসা জোসেফ জর্ডান (১৭৫৯-১৮১৯), আর তাঁর দুই স্ত্রী মাগদালেন ও সোফিয়ার জন্য ইংরেজিতে ফলক লিখে রেখে গেছেন তাঁদের শোকগ্রস্ত সন্তানেরা। এতে অনুমান করা যায়, দ্বিতীয় প্রজন্মের গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য আর চাকরির সুবিধার্থে ইংরেজিকে তাঁদের প্রতিদিনের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
বাসিল দিমিত্রিওসের (সেন্ট থমাস চার্চের করণিক) পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে। জন্ম ১৮০০ সালে। তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ৯ বছর কমিশনের সহকারী, ১০ বছর ঢাকা কলেজের ইংরেজির শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন এবং ৪০ বছর সেন্ট থমাস চার্চে সেবা প্রদান করেছেন। ‘বিশুদ্ধ প্রাণ যাদের, তারাই তো দেখা পায় ঈশ্বরের’ (বাইবেল: ম্যাথিউ), ১৮৬০। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, সেদিন ছিল রোববার। ছুটির দিন। ঢাকা থেকে ২৫ মাইল দূরের মির্জাপুরে সেই দিন বাঘ শিকারে গিয়েছেন জন দিমিত্রিওস ইলিয়াস। সেখানেই বাঘের থাবায় তাঁর করুণ মৃত্যু হয় মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। যিনি বাঘ শিকারের মতো রোমাঞ্চকর ও দামি শখ মেটানোর ক্ষমতা রাখেন, তিনি যে ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ইংরেজিতে লেখা সে স্মৃতিপ্রস্তরে তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের কথাও বলা হয়েছে, তাঁরাও শিকারি ছিলেন। তাঁদের দেহাবশেষ একসঙ্গে করে তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁদের এক মামাতো বা খালাতো ভাই ম্যানুয়েল এই ফলকের ব্যবস্থা করেন।
এটি ফাদার নাথানিয়েলের সমাধি; পবিত্র এবং সাধু; যিনি পবিত্র এক সাধুর ন্যায় যিশুর কথা প্রচার করেছেন, তাঁর জীবনাচার এবং বাণীর মাধ্যমে। অনবদ্য এক আনন্দধাম এই ঢাকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বিতীয় সেন্ট থমাস*। তাঁর পিতৃভূমি ছিল সিফনোস (আজিয়ান সাগরের এক দ্বীপ), যেখানে তিনি ১৭৩৬ সালে প্রথম আলো দেখেছেন এবং ঢাকা—এই দুই স্থানকেই তিনি স্বদেশ বলে গণ্য করতেন। ১২ মার্চ ১৮১০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘তিনিই সুখী হন, যিনি অন্যকে ভক্তিময় সম্মান দান করেন’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮২০ সালের পর নানা কারণে ইংরেজ-কলকাতার ‘ভদ্দরলোক’ গ্রিকদের ত্রিমুখী বাণিজ্য প্রণয় আর আগের মতো থাকেনি, মুনাফাতেও টান পড়তে শুরু করে। চুন আর লবণের ব্যবসা ছেড়ে টাকাওয়ালা গ্রিকেরা জমিদারি কিনতে লাগলেন (বরিশাল অঞ্চলেও এদের একটা জমিদারি ছিল)। আর যাঁরা অতটা বিনিয়োগ করতে পারলেন না, তাঁরা ইংরেজদের সওদাগরি কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত ইংরেজ লেখক জেমস টেইলরের বই ‘A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca’ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৩৮ সালে ঢাকায় মাত্র ১২টি গ্রিক পরিবারের বসবাস ছিল। জন দিমিত্রিওস এলিয়াস আত্মীয়স্বজন সেই ১২ পরিবারের একজন হওয়ার কথা। আরও বোঝা যাচ্ছে যে গ্রিকদের ব্যবসা পড়তির দিকে থাকলেও তখন ঢাকায় অবস্থাসম্পন্ন কয়েকজন গ্রিকের বসবাস ছিল।
জর্জ মাভরোডোগ্লোর পুত্র কনস্টানটাইনের স্ত্রী, যিনি ছিলেন স্বামীপরায়ণা নারী, তাঁর চিরজাগরুক ভালোবাসার স্মারক হিসেবে এই ফলকখানি স্থাপন করেছেন। তাঁর (স্বামীর) জন্মস্থান ছিল ইস্তাম্বুল। একজন বণিক হিসেবে তিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন। ১৮০৬ সালের ২৪ জুলাই তিনি জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এই ঢাকায়। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
একই পরিবারের দুই বউ থিওডোসিয়া (মৃত্যু ১৮০৫) ও সুলতানার (জন্ম ১৭৬৬) দেহাবশেষ পাশাপাশি রাখা আছে। সুলতানা সম্ভবত অধুনা তুর্কি দেশের মেয়ে ছিলেন, শুধু নামেই তার ইঙ্গিত মেলে না, তাঁর শ্বশুর কারিয়াকোস ফিলিপ্পো নিজেও এসেছিলেন ইস্তাম্বুল থেকে। তিনি হয়তো ছেলের বিয়ের জন্য নিজের জন্মস্থানের মেয়েই খুঁজে এনেছিলেন। কেমন দেখতে ছিলেন সুলতানা? তিনি কি কখনো শাড়ি পরেছিলেন? সুলতানার মৃত্যু হয় ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে, আজ থেকে ২২২ বছর আগে, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে।
এই স্থাপনায় আরও আছে আধভাঙা এক সমাধিফলক, যার বাকি অংশ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। সেখানে আমরা দেখতে পাই, এক পিতা ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বরের কোনো এক দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন। একই সমাধিতে পরে তাঁর কন্যাকেও সমাহিত করা হয়। কন্যার জন্ম ১৮১৫ সালে। তাঁর মৃত্যুর বছর আমরা হয়তো জানতে পারব না কোনো দিনই; হয়তো পিতৃশোকাতুর মেয়েও বেশি দিন বাঁচেনি। শুধু জানব ঢাকায় বসবাসকারী এই গ্রিক পিতা এবং কন্যার শেষশয্যা হয়েছিল রমনার সবুজ গালিচার নিচে। নাম না জানা সেই মেয়ে তার বাবার কোলে শুয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে, পরম নিশ্চিন্তে।
দিমিত্রিওস এলিয়াস এস্কোয়ারের দ্বিতীয় পুত্র জন দিমিত্রিওসের পবিত্র স্মৃতির প্রতি। ১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, রবিবার ঢাকার উত্তর-পশ্চিমের মির্জাপুরে বাঘ শিকারে গিয়ে নিহত হন। এখানে তিন মহান ভাই নিকোলাস, জন ও কনস্টানটিন একসঙ্গে শায়িত হয়েছেন। এখানে যূথবদ্ধ হয়ে আছেন সাহসী শিকারি ও খেলাধুলায় পারদর্শী তিন উচ্ছল জীবন। ফলক স্থাপনায় (খালাতো/মামাতো) ভাই মানুয়েল এলিয়াস মিচো। ফলকের একদম নিচে লেখা আছে, ‘মারডক’, যা সম্ভবত কলকাতার সমাধিফলক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
যে কয়জন গ্রিকের সমাধিফলক এখানে আছে, তাঁরা একজন আরেকজনের সঙ্গে সরাসরি আত্মীয়তার সম্বন্ধে সংযুক্ত নন। তাঁদের দেহাবসান হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় দশক ধরে। অথচ তাঁরা মিললেন একই ছাদের নিচে!
১৮০০ সালের দিকে রমনা অঞ্চলে (তখন নাম ছিল সুজাতপুর) আগে থেকেই গ্রিকদের একটা সমাধি ছিল। ইংরেজরা রমনা অঞ্চলে নানা রকম স্থাপনা বানানো শুরু করলে এবং ১৮৫০ সালের পরে ঢাকায় ধনী গ্রিকদের আধিপত্য কমতে থাকলে এই সমাধি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হতে থাকে। শেষে এমন অবস্থা হয় যে এলাকার লোকজন সমাধিফলক, ইট-পাথর পর্যন্ত খুলে নিয়ে নির্মাণকাজে লাগানো শুরু করে একসময়। তাই দেখে অবশিষ্ট প্রভাবশালী গ্রিক (যাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী রাল্লি ব্রাদার্সের বংশধরেরা অন্যতম) বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের কাছে আরজি করলেন, অন্তত কিছু সমাধি, দেহাবশেষ এবং সমাধিফলক তুলে নিয়ে এসে একত্র করে একটা মন্দিরে স্থাপন করার অনুমতি দেওয়া হোক।
আধভাঙা স্মৃতিফলক: বাবা ও মেয়ের। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ ও গ্রিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯১৫ সালে তৈরি হয় টিএসসির এই সমাধি-মন্দির। ধারণা করা হয়, টিএসসির সবুজ গালিচার নিচেও শুয়ে আছেন উল্লেখিত মানুষগুলোর কেউ কেউ। এর ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এই মন্দির ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের অংশই হয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে এটির অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর সৌন্দর্য ও সৌকর্য নবায়ন হয়েছে ১৯৯৭ সালে দিল্লির গ্রিক দূতাবাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের যৌথ উদ্যোগে।
শুনতে পাচ্ছি, টিএসসি নতুন করে বিনির্মাণ করা হবে। তখন হয়তো এই সমাধি আবারও সরানো হবে। সেখানে চিরনিদ্রায় থাকা অভিবাসীরা হয়তো ভাবতে থাকবেন, তাঁদের অভিবাসনের কোনো শেষ নেই—না তাঁদের জীবদ্দশায়, না মরণের পর।
তথ্যসূত্র:
‘Glimpses of the Greek Community from the Dhaka University Gravestones’. Helen Abadzi. Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, 40, 101-116,1995
‘From Thrace to Bengal: Greek Merchants in Early Colonial Bengal’. KANDA Sayako. The Memoirs of Toyo Bunko, 77, 2019
লেখক: প্রযুক্তিবিদ, ইনফিনিয়াম ইউকে লিমিটেড, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য
*যিশুখ্রিষ্টের ১২ জন শিষ্যের একজন ছিলেন সেন্ট থমাস, যিনি প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি এক সময়ে দক্ষিণ ভারতে আসেন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য। তিনি সেখানেই দেহ রাখেন। নাথানিয়েলকে দ্বিতীয় সেন্ট থমাস বলা হচ্ছে, কেননা তিনিও সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষের এক নগর, ঢাকায় এসেছিলেন যেমন করে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এসেছিলেন আরেক ধর্মপ্রচারক।

...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
৮ ঘণ্টা আগে
ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়
৪ দিন আগে
উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান।
৪ দিন আগে
ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লকের বধ্যভূমিটি ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি’ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর ও বিহারিরা এখানে বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করত। মিরপুর খালের পাশে এক নির্জন এলাকায় দুটি পয়োনিষ্কাশন ট্যাংকের ওপর ছিল একটি পরিত্যক্ত পাম্পহাউস।
৪ দিন আগেসম্পাদকীয়

...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
এগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে বলে মনে করি না। কিন্তু বর্তমানে এটা কী হচ্ছে? যদি বলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তাহলে সেই না এগোনোর কারণটা কী, তা নিয়ে কেন অর্থপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে না? আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন আকারেই উত্থাপন করছি। আমাদের অর্জন অনেক। আজ আমাদের গার্মেন্টসশিল্প বিশ্বে তৃতীয়। আমরা খুব দ্রুত দ্বিতীয় বা প্রথমের কাতারে চলে যাব। আমাদের লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। প্রতিবছর কৃষির উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এসবের পরেও কী হচ্ছে? বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
... পাকিস্তানিদের কথা আর কী বলব! আক্ষরিক অর্থেই তারা তখন আমাদের পা ধরেছিল। ‘তোমরা এদের ছেড়ে দাও, আমরা নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে এদের বিচার করব।’ ১৯৫ জনকে আমরা চিহ্নিত করি তখন। বঙ্গবন্ধু তখন রাশিয়াতে ছিলেন, তারা সেখানে বঙ্গবন্ধুর কাছে লোক পাঠিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেছে, ‘আপনারা যদি এ বিচার করেন তাহলে ভুট্টোর কল্লা থাকবে না। আমাদের কাছে ফেরত দিন, আমরা এদের বিচার করব।’ এটা সে সময় ‘লন্ডন টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। একেবারে তারা আন্ডারটেকিং দিয়েছে, ‘ছেড়ে দিন, আমরা বিচার করব। আর কোনো সাক্ষী লাগলে তোমাদের ডেকে পাঠানো হবে।’ শিল্পকলা একাডেমির যে বিল্ডিং ভেঙে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে, ওই বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিল স্টেটমেন্টগুলো। এগুলো কী হয়েছে, কে গুম করেছে, আমি জানি না। এর মধ্যে অনেক সরকার এসেছে, গেছে। তবে আমরা খুব পরিশ্রম করেই এগুলো সংগ্রহ করেছিলাম।
সূত্র: শারমিনুর নাহার কর্তৃক ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ; ‘সময় সমাজ ও রাজনীতির ভাষ্য’, পৃষ্ঠা: ৩১-৩২।

...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
এগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে বলে মনে করি না। কিন্তু বর্তমানে এটা কী হচ্ছে? যদি বলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তাহলে সেই না এগোনোর কারণটা কী, তা নিয়ে কেন অর্থপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে না? আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন আকারেই উত্থাপন করছি। আমাদের অর্জন অনেক। আজ আমাদের গার্মেন্টসশিল্প বিশ্বে তৃতীয়। আমরা খুব দ্রুত দ্বিতীয় বা প্রথমের কাতারে চলে যাব। আমাদের লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। প্রতিবছর কৃষির উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এসবের পরেও কী হচ্ছে? বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
... পাকিস্তানিদের কথা আর কী বলব! আক্ষরিক অর্থেই তারা তখন আমাদের পা ধরেছিল। ‘তোমরা এদের ছেড়ে দাও, আমরা নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে এদের বিচার করব।’ ১৯৫ জনকে আমরা চিহ্নিত করি তখন। বঙ্গবন্ধু তখন রাশিয়াতে ছিলেন, তারা সেখানে বঙ্গবন্ধুর কাছে লোক পাঠিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেছে, ‘আপনারা যদি এ বিচার করেন তাহলে ভুট্টোর কল্লা থাকবে না। আমাদের কাছে ফেরত দিন, আমরা এদের বিচার করব।’ এটা সে সময় ‘লন্ডন টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। একেবারে তারা আন্ডারটেকিং দিয়েছে, ‘ছেড়ে দিন, আমরা বিচার করব। আর কোনো সাক্ষী লাগলে তোমাদের ডেকে পাঠানো হবে।’ শিল্পকলা একাডেমির যে বিল্ডিং ভেঙে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে, ওই বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিল স্টেটমেন্টগুলো। এগুলো কী হয়েছে, কে গুম করেছে, আমি জানি না। এর মধ্যে অনেক সরকার এসেছে, গেছে। তবে আমরা খুব পরিশ্রম করেই এগুলো সংগ্রহ করেছিলাম।
সূত্র: শারমিনুর নাহার কর্তৃক ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ; ‘সময় সমাজ ও রাজনীতির ভাষ্য’, পৃষ্ঠা: ৩১-৩২।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। এই স্থাপনায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে স
০৮ মার্চ ২০২২
ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়
৪ দিন আগে
উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান।
৪ দিন আগে
ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লকের বধ্যভূমিটি ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি’ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর ও বিহারিরা এখানে বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করত। মিরপুর খালের পাশে এক নির্জন এলাকায় দুটি পয়োনিষ্কাশন ট্যাংকের ওপর ছিল একটি পরিত্যক্ত পাম্পহাউস।
৪ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়েছে।
অক্সফোর্ড জানিয়েছে, চলতি বছর ‘রেজ বেইট’ শব্দের ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, মানুষ এখন আগের চেয়ে দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম প্রভাবিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ও মুহূর্তের মধ্যে রাগ, ক্ষোভ ও বিভাজন তৈরি করছে—যা মূলত এনগেজমেন্ট বাড়ানোর কৌশল।
‘রেজ বেইট’ সব সময় যে বিপজ্জনক হবে, এমন নয়। কখনো এটি হতে পারে অদ্ভুত কোনো রেসিপি বা এমন ভিডিও যেখানে কেউ নিজের পোষা প্রাণী বা পরিবারের সদস্যকে মজার ছলে বিরক্ত করছে। তবে রাজনীতি ও জনপরিসরেও এখন এটি শক্তিশালী হাতিয়ার। কারণ প্ররোচিত ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার ঢেউ অনেক সময়ই রাজনৈতিক প্রচারণাকে আরও উসকে দেয়।
শুধু অক্সফোর্ড নয়, প্রায় সব বড় অভিধানই এবার ইন্টারনেট-সম্পর্কিত শব্দকেই ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। এবার কলিন্স ডিকশনারির বেছে নেওয়া শব্দটি হলো ‘ভয়েস কোডিং’। যেখানে এআই ব্যবহার করে মানুষের ভাষাকে কম্পিউটার কোডে রূপান্তর করা হয়। অন্যদিকে ক্যামব্রিজ ডিকশনারি বেছে নিয়েছে ‘প্যারাসোশ্যাল’ শব্দটি, যা অনলাইনে অপরিচিত কারও সঙ্গে গড়ে ওঠা একতরফা সম্পর্ককে নির্দেশ করে।
গত বছর (২০২৪) অক্সফোর্ড বেছে নিয়েছিল ‘ব্রেইন রট’ শব্দটি, যা ছিল মূলত অবিরাম স্ক্রলিংয়ে মানসিক ক্লান্তির রূপকার্থ। অক্সফোর্ড ল্যাংগুয়েজেসের প্রেসিডেন্ট ক্যাসপার গ্র্যাথওহলের মতে, ‘রেজ বেইট’ এবং ‘ব্রেন রট’—দুটি শব্দই দেখায় কীভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের চিন্তা ও আচরণকে বদলে দিচ্ছে। একটি প্ররোচিত রাগ বাড়ায়, অন্যটি সেই রাগের মধ্যেই মানুষকে আবিষ্ট রাখে।
এ বছর অক্সফোর্ড সাধারণ মানুষের ভোটে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচন করেছে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল আরও দুটি শব্দ—‘অরা ফার্মিং’ ও ‘বায়োহ্যাক’। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি করার কৌশলকে বোঝাতে ‘অরা ফার্মিং’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, আর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বাড়াতে জীবনযাপনে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘বায়োহ্যাক’।
শেষ পর্যন্ত ‘রেজ বেইট’ শব্দটিই জিতেছে—যে শব্দের মধ্য দিয়ে আজকের অনলাইন জীবনের রাগ, প্রতিক্রিয়া এবং ক্লান্তির বাস্তবতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়েছে।
অক্সফোর্ড জানিয়েছে, চলতি বছর ‘রেজ বেইট’ শব্দের ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, মানুষ এখন আগের চেয়ে দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম প্রভাবিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ও মুহূর্তের মধ্যে রাগ, ক্ষোভ ও বিভাজন তৈরি করছে—যা মূলত এনগেজমেন্ট বাড়ানোর কৌশল।
‘রেজ বেইট’ সব সময় যে বিপজ্জনক হবে, এমন নয়। কখনো এটি হতে পারে অদ্ভুত কোনো রেসিপি বা এমন ভিডিও যেখানে কেউ নিজের পোষা প্রাণী বা পরিবারের সদস্যকে মজার ছলে বিরক্ত করছে। তবে রাজনীতি ও জনপরিসরেও এখন এটি শক্তিশালী হাতিয়ার। কারণ প্ররোচিত ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার ঢেউ অনেক সময়ই রাজনৈতিক প্রচারণাকে আরও উসকে দেয়।
শুধু অক্সফোর্ড নয়, প্রায় সব বড় অভিধানই এবার ইন্টারনেট-সম্পর্কিত শব্দকেই ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। এবার কলিন্স ডিকশনারির বেছে নেওয়া শব্দটি হলো ‘ভয়েস কোডিং’। যেখানে এআই ব্যবহার করে মানুষের ভাষাকে কম্পিউটার কোডে রূপান্তর করা হয়। অন্যদিকে ক্যামব্রিজ ডিকশনারি বেছে নিয়েছে ‘প্যারাসোশ্যাল’ শব্দটি, যা অনলাইনে অপরিচিত কারও সঙ্গে গড়ে ওঠা একতরফা সম্পর্ককে নির্দেশ করে।
গত বছর (২০২৪) অক্সফোর্ড বেছে নিয়েছিল ‘ব্রেইন রট’ শব্দটি, যা ছিল মূলত অবিরাম স্ক্রলিংয়ে মানসিক ক্লান্তির রূপকার্থ। অক্সফোর্ড ল্যাংগুয়েজেসের প্রেসিডেন্ট ক্যাসপার গ্র্যাথওহলের মতে, ‘রেজ বেইট’ এবং ‘ব্রেন রট’—দুটি শব্দই দেখায় কীভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের চিন্তা ও আচরণকে বদলে দিচ্ছে। একটি প্ররোচিত রাগ বাড়ায়, অন্যটি সেই রাগের মধ্যেই মানুষকে আবিষ্ট রাখে।
এ বছর অক্সফোর্ড সাধারণ মানুষের ভোটে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচন করেছে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল আরও দুটি শব্দ—‘অরা ফার্মিং’ ও ‘বায়োহ্যাক’। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি করার কৌশলকে বোঝাতে ‘অরা ফার্মিং’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, আর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বাড়াতে জীবনযাপনে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘বায়োহ্যাক’।
শেষ পর্যন্ত ‘রেজ বেইট’ শব্দটিই জিতেছে—যে শব্দের মধ্য দিয়ে আজকের অনলাইন জীবনের রাগ, প্রতিক্রিয়া এবং ক্লান্তির বাস্তবতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। এই স্থাপনায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে স
০৮ মার্চ ২০২২
...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
৮ ঘণ্টা আগে
উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান।
৪ দিন আগে
ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লকের বধ্যভূমিটি ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি’ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর ও বিহারিরা এখানে বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করত। মিরপুর খালের পাশে এক নির্জন এলাকায় দুটি পয়োনিষ্কাশন ট্যাংকের ওপর ছিল একটি পরিত্যক্ত পাম্পহাউস।
৪ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান। সেই মর্মান্তিক ঘটনা, গারফিল্ডের জীবন ও তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে এবার নেটফ্লিক্স-এ আসছে চার পর্বের ড্রামা সিরিজ, ‘ডেথ বাই লাইটনিং’।
প্রেসিডেন্টের উত্থান ও প্রগতিশীল এজেন্ডা
১৮৮০ সালে আমেরিকা এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল। সদ্য দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর আফ্রিকান-আমেরিকানরা কি নাগরিক হিসেবে পূর্ণ অধিকার পাবেন? নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারি চাকরি বণ্টনের সেই দীর্ঘদিনের দুর্নীতিগ্রস্ত ‘পচে যাওয়ার ব্যবস্থা’ অব্যাহত থাকবে? রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে ওহাইও-এর জনপ্রিয় কংগ্রেসম্যান জেমস গারফিল্ড এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আহ্বান জানান। দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা, গৃহযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব দেখানো এই কমান্ডার নভেম্বরে দেশের ২০ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে গারফিল্ড উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল: মার্কিন নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ, লাতিন আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো এবং বিশেষত নাগরিক অধিকারের পক্ষে জোরালো সওয়াল করা। তিনি সাবেক ক্রীতদাস ফ্রেডরিক ডগলাসকে ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার রেকর্ডার অব ডিডস পদে নিযুক্ত করেন। একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের জন্য প্রথম সারির একটি কেন্দ্রীয় পদ পাওয়ার বিরল ঘটনা ছিল এটি।
হত্যার নেপথ্যে
১৮৮১ সালের ২ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসি-র রেলওয়ে স্টেশনে চার্লস এল. গুইটো নামক এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি গারফিল্ডকে গুলি করে। গুইটো তার জীবনকাল ধরে একজন ব্যর্থ আইনজীবী, সাংবাদিক, ধর্মপ্রচারক এবং ফ্রি লাভ কমিউনের সদস্য হিসেবে এক ব্যর্থ অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। তা সত্ত্বেও, তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর তাকে মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্টি করেছেন। গারফিল্ডের মনোনয়নের পর তিনি তাঁর সমর্থনের বিনিময়ে প্যারিসে গুরুত্বপূর্ণ কনস্যুলার পদ দাবি করে হোয়াইট হাউসে ধরনা করতেন। প্রেসিডেন্ট ‘প্যাট্রোনেজ সিস্টেম’-এর ঘোর বিরোধী হওয়ায় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরই গুইটো সিদ্ধান্ত নেন—গারফিল্ডকে হত্যা করে ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থারকে ক্ষমতায় আনার ‘ঈশ্বর প্রদত্ত নির্দেশ’ তাঁর ওপর বর্তেছে।
আসল খুনি কে?
লেখক ক্যান্ডিস মিলার্ড তাঁর বেস্ট সেলিং বই ডেসটিনি অব দ্য রিপাবলিক-এ তুলে ধরেছেন, গারফিল্ডের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল চিকিৎসার চরম অব্যবস্থা। ড. উইলফ্রেড ব্লিস নামক দাম্ভিক চিকিৎসক গারফিল্ডের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তিনি ব্রিটিশ সার্জন জোসেফ লিস্টার কর্তৃক প্রবর্তিত আধুনিক অ্যান্টিসেপটিক পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ব্লিস জীবাণুমুক্ত নয় এমন যন্ত্র এবং খালি হাত ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের মেরুদণ্ডের কাছে থাকা গুলিটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এর ফলে সংক্রমণ (সেপসিস) ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি, গুলি খুঁজতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত প্রারম্ভিক মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু ব্লিসের অসহযোগিতার কারণে সেটিও ব্যর্থ হয়। শট নেওয়ার প্রায় আশি দিন পর প্রেসিডেন্ট মারা যান এবং এই মৃত্যুর সম্পূর্ণ দায় ড. ব্লিসের ওপর বর্তায়।
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও গারফিল্ডকে নিউইয়র্কের প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর রোসকো কনকলিং-এর বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। কনকলিং প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক ছিলেন এবং গারফিল্ডের প্রগতিশীল ভাবধারা পছন্দ করতেন না। মাকোভস্কি বিবিসিকে জানান, এই সিরিজের মূল আকর্ষণ হলো ইতিহাসের সেই ‘যদি’ প্রশ্নটি—যদি প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি হয়তো আমেরিকার অন্যতম সেরা প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন। মাকোভস্কির মতে, ‘গারফিল্ডের অসাধারণ মেধা ছিল। তাঁকে যে আজ ইতিহাসে একটি অস্পষ্ট পাদটীকা হিসেবে স্থান দেওয়া হয়, তা এক ট্র্যাজেডি।’
অভিনেতা মাইকেল শ্যানন গারফিল্ডের ‘ঐশ্বর্য ও মর্যাদা, বিশেষ করে তাঁর শালীনতা’ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন বলে মন্তব্য করেছেন লেখক মিলার্ড।
গারফিল্ডের উত্তরাধিকার ও আইন সংস্কার
মাত্র ৪৯ বছর বয়সে গারফিল্ডের মৃত্যু পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দেয় এবং দেশজুড়ে সরকারি চাকরি সংস্কারের দাবি জোরালো হয়। জনগণের ক্ষোভের কারণেই ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থার, যিনি একসময় প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনিই ১৮৮৩ সালে ‘পেন্ডলটন অ্যাক্ট’-এ স্বাক্ষর করেন। এই আইনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ‘যোগ্যতা-ভিত্তিক’ নিয়োগের নীতি শুরু হয়, যা মার্কিন সরকারি আমলাতন্ত্রের পেশাদারি নিশ্চিত করার পথ দেখায়। এইভাবে, এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড আমেরিকার শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে এক স্থায়ী প্রগতিশীল পরিবর্তন এনে দেয়।

উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান। সেই মর্মান্তিক ঘটনা, গারফিল্ডের জীবন ও তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে এবার নেটফ্লিক্স-এ আসছে চার পর্বের ড্রামা সিরিজ, ‘ডেথ বাই লাইটনিং’।
প্রেসিডেন্টের উত্থান ও প্রগতিশীল এজেন্ডা
১৮৮০ সালে আমেরিকা এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল। সদ্য দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর আফ্রিকান-আমেরিকানরা কি নাগরিক হিসেবে পূর্ণ অধিকার পাবেন? নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারি চাকরি বণ্টনের সেই দীর্ঘদিনের দুর্নীতিগ্রস্ত ‘পচে যাওয়ার ব্যবস্থা’ অব্যাহত থাকবে? রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে ওহাইও-এর জনপ্রিয় কংগ্রেসম্যান জেমস গারফিল্ড এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আহ্বান জানান। দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা, গৃহযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব দেখানো এই কমান্ডার নভেম্বরে দেশের ২০ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে গারফিল্ড উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল: মার্কিন নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ, লাতিন আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো এবং বিশেষত নাগরিক অধিকারের পক্ষে জোরালো সওয়াল করা। তিনি সাবেক ক্রীতদাস ফ্রেডরিক ডগলাসকে ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার রেকর্ডার অব ডিডস পদে নিযুক্ত করেন। একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের জন্য প্রথম সারির একটি কেন্দ্রীয় পদ পাওয়ার বিরল ঘটনা ছিল এটি।
হত্যার নেপথ্যে
১৮৮১ সালের ২ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসি-র রেলওয়ে স্টেশনে চার্লস এল. গুইটো নামক এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি গারফিল্ডকে গুলি করে। গুইটো তার জীবনকাল ধরে একজন ব্যর্থ আইনজীবী, সাংবাদিক, ধর্মপ্রচারক এবং ফ্রি লাভ কমিউনের সদস্য হিসেবে এক ব্যর্থ অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। তা সত্ত্বেও, তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর তাকে মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্টি করেছেন। গারফিল্ডের মনোনয়নের পর তিনি তাঁর সমর্থনের বিনিময়ে প্যারিসে গুরুত্বপূর্ণ কনস্যুলার পদ দাবি করে হোয়াইট হাউসে ধরনা করতেন। প্রেসিডেন্ট ‘প্যাট্রোনেজ সিস্টেম’-এর ঘোর বিরোধী হওয়ায় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরই গুইটো সিদ্ধান্ত নেন—গারফিল্ডকে হত্যা করে ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থারকে ক্ষমতায় আনার ‘ঈশ্বর প্রদত্ত নির্দেশ’ তাঁর ওপর বর্তেছে।
আসল খুনি কে?
লেখক ক্যান্ডিস মিলার্ড তাঁর বেস্ট সেলিং বই ডেসটিনি অব দ্য রিপাবলিক-এ তুলে ধরেছেন, গারফিল্ডের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল চিকিৎসার চরম অব্যবস্থা। ড. উইলফ্রেড ব্লিস নামক দাম্ভিক চিকিৎসক গারফিল্ডের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তিনি ব্রিটিশ সার্জন জোসেফ লিস্টার কর্তৃক প্রবর্তিত আধুনিক অ্যান্টিসেপটিক পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ব্লিস জীবাণুমুক্ত নয় এমন যন্ত্র এবং খালি হাত ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের মেরুদণ্ডের কাছে থাকা গুলিটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এর ফলে সংক্রমণ (সেপসিস) ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি, গুলি খুঁজতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত প্রারম্ভিক মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু ব্লিসের অসহযোগিতার কারণে সেটিও ব্যর্থ হয়। শট নেওয়ার প্রায় আশি দিন পর প্রেসিডেন্ট মারা যান এবং এই মৃত্যুর সম্পূর্ণ দায় ড. ব্লিসের ওপর বর্তায়।
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও গারফিল্ডকে নিউইয়র্কের প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর রোসকো কনকলিং-এর বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। কনকলিং প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক ছিলেন এবং গারফিল্ডের প্রগতিশীল ভাবধারা পছন্দ করতেন না। মাকোভস্কি বিবিসিকে জানান, এই সিরিজের মূল আকর্ষণ হলো ইতিহাসের সেই ‘যদি’ প্রশ্নটি—যদি প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি হয়তো আমেরিকার অন্যতম সেরা প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন। মাকোভস্কির মতে, ‘গারফিল্ডের অসাধারণ মেধা ছিল। তাঁকে যে আজ ইতিহাসে একটি অস্পষ্ট পাদটীকা হিসেবে স্থান দেওয়া হয়, তা এক ট্র্যাজেডি।’
অভিনেতা মাইকেল শ্যানন গারফিল্ডের ‘ঐশ্বর্য ও মর্যাদা, বিশেষ করে তাঁর শালীনতা’ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন বলে মন্তব্য করেছেন লেখক মিলার্ড।
গারফিল্ডের উত্তরাধিকার ও আইন সংস্কার
মাত্র ৪৯ বছর বয়সে গারফিল্ডের মৃত্যু পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দেয় এবং দেশজুড়ে সরকারি চাকরি সংস্কারের দাবি জোরালো হয়। জনগণের ক্ষোভের কারণেই ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থার, যিনি একসময় প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনিই ১৮৮৩ সালে ‘পেন্ডলটন অ্যাক্ট’-এ স্বাক্ষর করেন। এই আইনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ‘যোগ্যতা-ভিত্তিক’ নিয়োগের নীতি শুরু হয়, যা মার্কিন সরকারি আমলাতন্ত্রের পেশাদারি নিশ্চিত করার পথ দেখায়। এইভাবে, এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড আমেরিকার শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে এক স্থায়ী প্রগতিশীল পরিবর্তন এনে দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। এই স্থাপনায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে স
০৮ মার্চ ২০২২
...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
৮ ঘণ্টা আগে
ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়
৪ দিন আগে
ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লকের বধ্যভূমিটি ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি’ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর ও বিহারিরা এখানে বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করত। মিরপুর খালের পাশে এক নির্জন এলাকায় দুটি পয়োনিষ্কাশন ট্যাংকের ওপর ছিল একটি পরিত্যক্ত পাম্পহাউস।
৪ দিন আগেসম্পাদকীয়

ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লকের বধ্যভূমিটি ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি’ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর ও বিহারিরা এখানে বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করত। মিরপুর খালের পাশে এক নির্জন এলাকায় দুটি পয়োনিষ্কাশন ট্যাংকের ওপর ছিল একটি পরিত্যক্ত পাম্পহাউস। ঘাতকেরা এ জায়গাকে বেছে নিয়েছিল বধ্যভূমি হিসেবে।
স্বাধীনতার পরপরই এই বধ্যভূমির সন্ধান যখন পাওয়া যায়, তখন প্রত্যক্ষদর্শীরা সেখানে অসংখ্য বাঙালির কঙ্কাল দেখতে পান। স্থানীয় জনগণ জল্লাদখানার পাশে সে কঙ্কালগুলো দাফন করেন। এ পাম্পহাউসের ভেতরে উঁচু এক বেদিতে লেখা ছিল ‘জল্লাদখানা’। এখানে অনেক বাঙালিকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল।
তথ্য: সংগ্রামের নোটবুক

ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লকের বধ্যভূমিটি ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি’ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর ও বিহারিরা এখানে বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করত। মিরপুর খালের পাশে এক নির্জন এলাকায় দুটি পয়োনিষ্কাশন ট্যাংকের ওপর ছিল একটি পরিত্যক্ত পাম্পহাউস। ঘাতকেরা এ জায়গাকে বেছে নিয়েছিল বধ্যভূমি হিসেবে।
স্বাধীনতার পরপরই এই বধ্যভূমির সন্ধান যখন পাওয়া যায়, তখন প্রত্যক্ষদর্শীরা সেখানে অসংখ্য বাঙালির কঙ্কাল দেখতে পান। স্থানীয় জনগণ জল্লাদখানার পাশে সে কঙ্কালগুলো দাফন করেন। এ পাম্পহাউসের ভেতরে উঁচু এক বেদিতে লেখা ছিল ‘জল্লাদখানা’। এখানে অনেক বাঙালিকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল।
তথ্য: সংগ্রামের নোটবুক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। এই স্থাপনায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে স
০৮ মার্চ ২০২২
...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
৮ ঘণ্টা আগে
ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়
৪ দিন আগে
উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান।
৪ দিন আগে