ড. তৈফুর রহমান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যখন সেখানে পড়তাম, তখন খুব আগ্রহ হতো মন্দিরটির বিষয়ে। শুনেছিলাম অনেক আগের ছোট্ট এক গ্রিক মেয়ের কবর আছে সেখানে। কেমন একটা বিষাদমাখা মায়া কাজ করত তার জন্য।
সম্প্রতি ফেসবুকের একটি পোস্টে প্রথমবারের মতো মন্দিরের অন্দর কক্ষ ও সেখানে সংরক্ষিত নয়টি অক্ষত, একটি আধভাঙা এপিটাফ এবং সমাধিফলক দেখে প্রায় ভুলে যাওয়া সেই স্মৃতি আবার মাথায় কড়া নাড়ল। এই অন্তর্জালের দুনিয়াতে তথ্য বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের এক গ্রিক কনসালট্যান্ট হেলেন আবাদজী আর জাপানি গবেষক কানদা সায়াকো—এর দুটি গবেষণাপত্রের তথ্য জোড়া লাগিয়ে একটা ছবি দাঁড় করিয়েছি—পলাশী যুদ্ধের সমসাময়িক বাংলায়, বিশেষ করে ঢাকায় গ্রিকদের আগমন, তাঁদের বাণিজ্য, পেশা, পারিবারিক-সামাজিক জীবন এবং ঢাকার বুকেই তাঁদের শেষশয্যা নিয়ে।
ঢাকায় গ্রিকদের গল্প
বাংলায় গ্রিকরা আসে ১৭৫০ সালের দিকে—আজকের গ্রিস এবং গ্রিক-অধ্যুষিত অঞ্চল, যেমন আধুনিক তুর্কি ও ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো থেকে। ভাগ্য ফেরানো ওসমানিয়া শাসন বলয় থেকে বের হওয়া, ধর্মপ্রচার ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের দিকে এরা আসতে শুরু করে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি বাংলায় ভালোভাবে আসন গেঁড়ে বসার পর। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আলেক্সিওসি (আলেক্সান্ডার) আর্গাইরি। বুলগেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী এই গ্রিক কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর কারবার ছিল বসরা আর লেভান্তে (সিরিয়া-লেবানন) অঞ্চলের সঙ্গে। ১৭৭০ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরার পথে বঙ্গোপসাগরে নিশ্চিত জাহাজডুবি থেকে বেঁচে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, কলকাতায় একটা চার্চ বানাবেন। তখন সবে কলকাতার গভর্নর হয়েছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তাঁকে গিয়ে আর্গাইরি ধরলেন চার্চ নির্মাণের অনুমতির জন্য। হেস্টিংস জানতেন, গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যবসায় উন্নতি করছে, তাই অনুমতি দিলেন। আর্গাইরি আর অন্যান্য ধনী গ্রিকরা চার্চ বানানোর তোড়জোড় শুরু করলে তিনি তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য হাজির হলেন ঢাকায়, ১৭৭১ সালে। এ থেকে অনুমান করা যায় আর্গাইরির আগমনের আগে থেকেই গ্রিক বণিকেরা ঢাকায় ডেরা বেঁধেছিল।
এই প্রস্তরখণ্ডের নিচে মিসেস সুলতানা আলেক্সান্ডার, আলেক্সান্ডারের স্ত্রীর (আলেক্সান্ডার ইস্তাম্বুলের কারিয়াকোস ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র) নশ্বর দেহাবশেষ শায়িত আছে, যিনি এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন, মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৪ বছর। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
আর্গাইরির সঙ্গে ঢাকায় আসে তাঁর ২১ বছর বয়সী বড় ছেলে পানিয়তি। ১৭৭৭ সালে আর্গাইরি মৃত্যুবরণ করেন ঢাকাতেই। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিকে পুঁজি করে ১৮ শতকের শেষার্ধে এসে এই পানিয়তি ব্যবসা বাড়িয়ে বাংলায় গ্রিক বণিক সম্প্রদায়ের প্রধান হয়ে ওঠেন। ঢাকা ও সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জে গ্রিকদের প্রধান বাণিজ্য ছিল চুন ও লবণকে ঘিরে। সিলেটের খাসিয়া-অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলে উৎকৃষ্ট মানের চুনাপাথর পাওয়া যেত (এবং এখনো যায়), যা থেকে তৈরি করা হতো চুন। সে চুন দরকার হতো বড় বড় ইমারত তৈরিতে। নৌপথে বজরায় করে সে চুনের চালান যেত নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে নদীপথে সহজেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার পদ্মা-মেঘনার সংগমস্থল দিয়ে উত্তর-পশ্চিম বা দক্ষিণ-পূর্বে নৌযাত্রা করা যেত। সে জন্য ভোলা ও চাটিগাঁ থেকে আসা লবণের বিরাট মোকাম গড়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জে।
এইখানে শায়িত আছেন ইস্তাম্বুলের জর্জ ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র থিওডোরের স্ত্রী থিওডোসিয়া। ১০ এপ্রিল ১৮০৫ সালে। তাঁর স্মৃতি অমর হোক। এই দুই নারীর সমাধিফলকেই একটা কথা আছে, যা আমাদের অবাক করে, ‘ঢাকার প্রতি তিনি ঋণী’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
চুন ও লবণ—এই দুই অতিপ্রয়োজনীয় বাণিজ্যের মূল অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ ইংরেজদের হাতে থাকলেও তাতে কলকাতার বাঙালি হিন্দু (যারা বউবাজার-বাগবাজার-বড়বাজারের ‘ভদ্দরলোক’ নামে পরিচিতি পায়), আর গ্রিকরা মিলে মোটা মুনাফা আয় করে যাচ্ছিল। এর মধ্যে গ্রিক বণিক মভ্রদি কেরিয়াকোস একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন চাটিগাঁও, আর ভোলার উৎপাদিত মোট লবণের এক-তৃতীয়াংশ। তখন এক ভোলা থেকেই বছরে ১ হাজার টনেরও বেশি লবণ আসত নারায়ণগঞ্জে। আর তাতে নিয়োজিত ছিল ১৬০টি বজরা। এই বণিকদের একজন ছিলেন নিকোলাস দিমিত্রিওস। টিএসসির সেই গ্রিক মন্দিরের ভেতরে অনেকের সঙ্গে সমাহিত আছেন সেই দিমিত্রিওসও।
বিষাদমাখা এক অর্থনীতির গল্প
টিএসসির সে মন্দিরের যে আকার ও আয়তন, তাতে করে বড়জোর এক বা দুজনের সমাধি হতে পারে। অথচ সেখানে আটটি স্মৃতিফলকে একজন করে আটজন এবং অন্য আরেকটা ফলকে একসঙ্গে তিন ভাইয়ের কথা উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এই ছোট একটি জায়গায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। এই ১১ জনের মৃত্যু কাছাকাছি সময়ে হয়নি। হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে। দুটি স্মৃতিফলকে উল্লেখিত দুই নারীর মধ্যে একটা সম্পর্ক (তাঁদের দুজনের শ্বশুর সম্ভবত দুই ভাই) অনুমান করা যায়। অন্য দুজন নারী আরেক গ্রিকের দুই স্ত্রী ও এক পরিবারের তিন ভাই। এ ছাড়া আরও চারজনের সঙ্গে একে অন্যের কোনো ধরনের আত্মীয়তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে সত্যি নয়।
মিসেস মাগদালেন, সোফিয়া জর্ডান এবং তাঁদের স্বামী মি. জোসেফ জর্ডানের (কেসারিয়া, তুর্কি থেকে আগত, নারায়ণগঞ্জের বণিক) স্মৃতির উদ্দেশে। জর্ডান ১০ ফেব্রুয়ারি ১৮১৯ সালে ৬০ বছর বয়সে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন। তাঁদের সবার স্মৃতির প্রতি অনুরাগ-আপ্লুত এই স্মারক নিবেদন করলেন তাঁদের অভাগা এতিম সন্তানেরা। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
তাহলে প্রথমে যে প্রশ্ন আসে, তাঁরা সবাই এক জায়গায় সমাহিত হলেন কীভাবে? কীভাবে তাঁদের মৃত্যুর প্রায় শতাব্দীকাল পরে এসে ঠাঁই পেলেন এই ছোট্ট সমাধি-মন্দিরে? আমরা এর উত্তর খুঁজব সমাধিফলকের গায়ে উৎকীর্ণ বাণী ও তৎকালীন বাংলায় গ্রিক বণিকদের ওপর করা গবেষণালব্ধ তথ্যের মধ্যে।
নিকোলাস দিমিত্রিওসের (জন্ম ১৭৯৭, মৃত্যু ১৮৪৩) সমাধিফলক লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। মৃত্যুর ১৬ বছর পর এসে ফলকটি উৎসর্গ করেছেন বাসিল দিমিত্রিওস। পারিবারিক নাম এক হলেও বাসিল নিজের পরিচয় দিয়েছেন নিকোলাসের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে। এই এপিটাফে একটা উর্দু কবিতা (সম্ভবত মির্জা গালিবের) ইংরেজি হরফে লেখা আছে, যার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম:
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
বোঝা যাচ্ছে নিকোলাসের কাব্যপ্রীতি ছিল, যা তাঁর বন্ধু বাসিলের অজানা ছিল না। হয়তো নিকোলাস ও বাসিল দুজনই ভারতবর্ষে, হয়তো ঢাকাতেই জন্মেছিলেন। বাল্যসখা ছিলেন। ঢাকার নবাবদের মধ্যে উর্দুর প্রচলন ছিল। সেখান থেকেই শিখেছিলেন এই ভাষা। খুব সম্ভব তাঁরা বাংলাও বলতে পারতেন, যেহেতু ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন।
দিমিত্রিওস এলিয়াসের জ্যেষ্ঠ পুত্র নিকোলাস দিমিত্রিওসের স্মৃতির উদ্দেশে। মৃত্যু ৫ মার্চ ১৮৪৩, বয়স ৪৬। তাঁর প্রিয় কবিতার ছত্র—
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু বাসিল দিমিত্রিওস এই ফলক স্থাপন করলেন ১৮৫৯ সালে। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
বন্ধুর জন্য এপিটাফের ব্যবস্থা করার এক বছরের মাথায় ১৮৬০ সালে মারা যান বাসিল দিমিত্রিওস, মাত্র ৬০ বছর বয়সে। ইংরেজি জানা বাসিল জীবনভর বিচিত্র পেশায় জড়িত ছিলেন। কমিশনারের সহকারী ছিলেন ৯ বছর, সেন্ট টমাস চার্চের (১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠিত) করণিক ছিলেন ৪০ বছর—জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আর ১০ বছর ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন ঢাকা কলেজে (১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত)। এর মানে জীবন চালানোর জন্য একসঙ্গে বেশ কিছু চাকরি করেছেন সমান্তরালে। ছাপোষা এমন একজন মানুষের বন্ধু ছিলেন ধনী বণিক নিকোলাস। সম্ভবত দুজনই সমবয়সী, একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন ও বেড়ে উঠেছেন।
প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল ফাদার নাথানিয়েলের স্মৃতিফলক। আমরা জানতে পারি, ১৭৩৬ সালে সুদূর আজিয়ান সাগরের ছোট্ট দ্বীপ সিফোনেসে জন্ম নেওয়া নাথানিয়েল শেষশয্যা নিয়েছেন ঢাকায়, ১৮১০ সালে। আমরা পুলকভরে অবগত হই যে তিনি তাঁর জন্মস্থান ও ঢাকা—দুই জায়গাকেই নিজের স্বদেশ বলে গণ্য করতেন! তিনি হয়তো ধর্ম প্রচারে এসে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বুড়িগঙ্গার ধারের এই নগরকে।
এইখানে শায়িত প্রয়াত কেসারিয়ার (তুরকিস্তান) জ্যাকব ইস্সাই লাকোবোগলাস। মৃত্যু ২২ জুন, ১৮১৯ সালে, বয়স হয়েছিল ৪৮। ওপর থেকে যিনি তাকিয়ে আছেন, হে ঈশ্বর, তাঁকে ক্ষমা করুন। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
নাথানিয়েলের চার বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন এক ব্যবসায়ী, কনস্টানটিন। তাঁর স্ত্রী এই সমাধিফলক বানান প্রয়াত সহধর্মীর জন্য—তাঁর নাম আমরা জানতে পারি না। কিন্তু তাঁর বেদনামথিত আবেগের কথা লেখা আছে মাতৃভাষা গ্রিকে।
ফিলিস্তিন থেকে আসা জোসেফ জর্ডান (১৭৫৯-১৮১৯), আর তাঁর দুই স্ত্রী মাগদালেন ও সোফিয়ার জন্য ইংরেজিতে ফলক লিখে রেখে গেছেন তাঁদের শোকগ্রস্ত সন্তানেরা। এতে অনুমান করা যায়, দ্বিতীয় প্রজন্মের গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য আর চাকরির সুবিধার্থে ইংরেজিকে তাঁদের প্রতিদিনের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
বাসিল দিমিত্রিওসের (সেন্ট থমাস চার্চের করণিক) পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে। জন্ম ১৮০০ সালে। তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ৯ বছর কমিশনের সহকারী, ১০ বছর ঢাকা কলেজের ইংরেজির শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন এবং ৪০ বছর সেন্ট থমাস চার্চে সেবা প্রদান করেছেন। ‘বিশুদ্ধ প্রাণ যাদের, তারাই তো দেখা পায় ঈশ্বরের’ (বাইবেল: ম্যাথিউ), ১৮৬০। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, সেদিন ছিল রোববার। ছুটির দিন। ঢাকা থেকে ২৫ মাইল দূরের মির্জাপুরে সেই দিন বাঘ শিকারে গিয়েছেন জন দিমিত্রিওস ইলিয়াস। সেখানেই বাঘের থাবায় তাঁর করুণ মৃত্যু হয় মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। যিনি বাঘ শিকারের মতো রোমাঞ্চকর ও দামি শখ মেটানোর ক্ষমতা রাখেন, তিনি যে ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ইংরেজিতে লেখা সে স্মৃতিপ্রস্তরে তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের কথাও বলা হয়েছে, তাঁরাও শিকারি ছিলেন। তাঁদের দেহাবশেষ একসঙ্গে করে তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁদের এক মামাতো বা খালাতো ভাই ম্যানুয়েল এই ফলকের ব্যবস্থা করেন।
এটি ফাদার নাথানিয়েলের সমাধি; পবিত্র এবং সাধু; যিনি পবিত্র এক সাধুর ন্যায় যিশুর কথা প্রচার করেছেন, তাঁর জীবনাচার এবং বাণীর মাধ্যমে। অনবদ্য এক আনন্দধাম এই ঢাকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বিতীয় সেন্ট থমাস*। তাঁর পিতৃভূমি ছিল সিফনোস (আজিয়ান সাগরের এক দ্বীপ), যেখানে তিনি ১৭৩৬ সালে প্রথম আলো দেখেছেন এবং ঢাকা—এই দুই স্থানকেই তিনি স্বদেশ বলে গণ্য করতেন। ১২ মার্চ ১৮১০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘তিনিই সুখী হন, যিনি অন্যকে ভক্তিময় সম্মান দান করেন’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮২০ সালের পর নানা কারণে ইংরেজ-কলকাতার ‘ভদ্দরলোক’ গ্রিকদের ত্রিমুখী বাণিজ্য প্রণয় আর আগের মতো থাকেনি, মুনাফাতেও টান পড়তে শুরু করে। চুন আর লবণের ব্যবসা ছেড়ে টাকাওয়ালা গ্রিকেরা জমিদারি কিনতে লাগলেন (বরিশাল অঞ্চলেও এদের একটা জমিদারি ছিল)। আর যাঁরা অতটা বিনিয়োগ করতে পারলেন না, তাঁরা ইংরেজদের সওদাগরি কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত ইংরেজ লেখক জেমস টেইলরের বই ‘A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca’ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৩৮ সালে ঢাকায় মাত্র ১২টি গ্রিক পরিবারের বসবাস ছিল। জন দিমিত্রিওস এলিয়াস আত্মীয়স্বজন সেই ১২ পরিবারের একজন হওয়ার কথা। আরও বোঝা যাচ্ছে যে গ্রিকদের ব্যবসা পড়তির দিকে থাকলেও তখন ঢাকায় অবস্থাসম্পন্ন কয়েকজন গ্রিকের বসবাস ছিল।
জর্জ মাভরোডোগ্লোর পুত্র কনস্টানটাইনের স্ত্রী, যিনি ছিলেন স্বামীপরায়ণা নারী, তাঁর চিরজাগরুক ভালোবাসার স্মারক হিসেবে এই ফলকখানি স্থাপন করেছেন। তাঁর (স্বামীর) জন্মস্থান ছিল ইস্তাম্বুল। একজন বণিক হিসেবে তিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন। ১৮০৬ সালের ২৪ জুলাই তিনি জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এই ঢাকায়। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
একই পরিবারের দুই বউ থিওডোসিয়া (মৃত্যু ১৮০৫) ও সুলতানার (জন্ম ১৭৬৬) দেহাবশেষ পাশাপাশি রাখা আছে। সুলতানা সম্ভবত অধুনা তুর্কি দেশের মেয়ে ছিলেন, শুধু নামেই তার ইঙ্গিত মেলে না, তাঁর শ্বশুর কারিয়াকোস ফিলিপ্পো নিজেও এসেছিলেন ইস্তাম্বুল থেকে। তিনি হয়তো ছেলের বিয়ের জন্য নিজের জন্মস্থানের মেয়েই খুঁজে এনেছিলেন। কেমন দেখতে ছিলেন সুলতানা? তিনি কি কখনো শাড়ি পরেছিলেন? সুলতানার মৃত্যু হয় ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে, আজ থেকে ২২২ বছর আগে, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে।
এই স্থাপনায় আরও আছে আধভাঙা এক সমাধিফলক, যার বাকি অংশ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। সেখানে আমরা দেখতে পাই, এক পিতা ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বরের কোনো এক দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন। একই সমাধিতে পরে তাঁর কন্যাকেও সমাহিত করা হয়। কন্যার জন্ম ১৮১৫ সালে। তাঁর মৃত্যুর বছর আমরা হয়তো জানতে পারব না কোনো দিনই; হয়তো পিতৃশোকাতুর মেয়েও বেশি দিন বাঁচেনি। শুধু জানব ঢাকায় বসবাসকারী এই গ্রিক পিতা এবং কন্যার শেষশয্যা হয়েছিল রমনার সবুজ গালিচার নিচে। নাম না জানা সেই মেয়ে তার বাবার কোলে শুয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে, পরম নিশ্চিন্তে।
দিমিত্রিওস এলিয়াস এস্কোয়ারের দ্বিতীয় পুত্র জন দিমিত্রিওসের পবিত্র স্মৃতির প্রতি। ১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, রবিবার ঢাকার উত্তর-পশ্চিমের মির্জাপুরে বাঘ শিকারে গিয়ে নিহত হন। এখানে তিন মহান ভাই নিকোলাস, জন ও কনস্টানটিন একসঙ্গে শায়িত হয়েছেন। এখানে যূথবদ্ধ হয়ে আছেন সাহসী শিকারি ও খেলাধুলায় পারদর্শী তিন উচ্ছল জীবন। ফলক স্থাপনায় (খালাতো/মামাতো) ভাই মানুয়েল এলিয়াস মিচো। ফলকের একদম নিচে লেখা আছে, ‘মারডক’, যা সম্ভবত কলকাতার সমাধিফলক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
যে কয়জন গ্রিকের সমাধিফলক এখানে আছে, তাঁরা একজন আরেকজনের সঙ্গে সরাসরি আত্মীয়তার সম্বন্ধে সংযুক্ত নন। তাঁদের দেহাবসান হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় দশক ধরে। অথচ তাঁরা মিললেন একই ছাদের নিচে!
১৮০০ সালের দিকে রমনা অঞ্চলে (তখন নাম ছিল সুজাতপুর) আগে থেকেই গ্রিকদের একটা সমাধি ছিল। ইংরেজরা রমনা অঞ্চলে নানা রকম স্থাপনা বানানো শুরু করলে এবং ১৮৫০ সালের পরে ঢাকায় ধনী গ্রিকদের আধিপত্য কমতে থাকলে এই সমাধি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হতে থাকে। শেষে এমন অবস্থা হয় যে এলাকার লোকজন সমাধিফলক, ইট-পাথর পর্যন্ত খুলে নিয়ে নির্মাণকাজে লাগানো শুরু করে একসময়। তাই দেখে অবশিষ্ট প্রভাবশালী গ্রিক (যাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী রাল্লি ব্রাদার্সের বংশধরেরা অন্যতম) বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের কাছে আরজি করলেন, অন্তত কিছু সমাধি, দেহাবশেষ এবং সমাধিফলক তুলে নিয়ে এসে একত্র করে একটা মন্দিরে স্থাপন করার অনুমতি দেওয়া হোক।
আধভাঙা স্মৃতিফলক: বাবা ও মেয়ের। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ ও গ্রিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯১৫ সালে তৈরি হয় টিএসসির এই সমাধি-মন্দির। ধারণা করা হয়, টিএসসির সবুজ গালিচার নিচেও শুয়ে আছেন উল্লেখিত মানুষগুলোর কেউ কেউ। এর ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এই মন্দির ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের অংশই হয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে এটির অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর সৌন্দর্য ও সৌকর্য নবায়ন হয়েছে ১৯৯৭ সালে দিল্লির গ্রিক দূতাবাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের যৌথ উদ্যোগে।
শুনতে পাচ্ছি, টিএসসি নতুন করে বিনির্মাণ করা হবে। তখন হয়তো এই সমাধি আবারও সরানো হবে। সেখানে চিরনিদ্রায় থাকা অভিবাসীরা হয়তো ভাবতে থাকবেন, তাঁদের অভিবাসনের কোনো শেষ নেই—না তাঁদের জীবদ্দশায়, না মরণের পর।
তথ্যসূত্র:
‘Glimpses of the Greek Community from the Dhaka University Gravestones’. Helen Abadzi. Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, 40, 101-116,1995
‘From Thrace to Bengal: Greek Merchants in Early Colonial Bengal’. KANDA Sayako. The Memoirs of Toyo Bunko, 77, 2019
লেখক: প্রযুক্তিবিদ, ইনফিনিয়াম ইউকে লিমিটেড, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য
*যিশুখ্রিষ্টের ১২ জন শিষ্যের একজন ছিলেন সেন্ট থমাস, যিনি প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি এক সময়ে দক্ষিণ ভারতে আসেন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য। তিনি সেখানেই দেহ রাখেন। নাথানিয়েলকে দ্বিতীয় সেন্ট থমাস বলা হচ্ছে, কেননা তিনিও সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষের এক নগর, ঢাকায় এসেছিলেন যেমন করে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এসেছিলেন আরেক ধর্মপ্রচারক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যখন সেখানে পড়তাম, তখন খুব আগ্রহ হতো মন্দিরটির বিষয়ে। শুনেছিলাম অনেক আগের ছোট্ট এক গ্রিক মেয়ের কবর আছে সেখানে। কেমন একটা বিষাদমাখা মায়া কাজ করত তার জন্য।
সম্প্রতি ফেসবুকের একটি পোস্টে প্রথমবারের মতো মন্দিরের অন্দর কক্ষ ও সেখানে সংরক্ষিত নয়টি অক্ষত, একটি আধভাঙা এপিটাফ এবং সমাধিফলক দেখে প্রায় ভুলে যাওয়া সেই স্মৃতি আবার মাথায় কড়া নাড়ল। এই অন্তর্জালের দুনিয়াতে তথ্য বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের এক গ্রিক কনসালট্যান্ট হেলেন আবাদজী আর জাপানি গবেষক কানদা সায়াকো—এর দুটি গবেষণাপত্রের তথ্য জোড়া লাগিয়ে একটা ছবি দাঁড় করিয়েছি—পলাশী যুদ্ধের সমসাময়িক বাংলায়, বিশেষ করে ঢাকায় গ্রিকদের আগমন, তাঁদের বাণিজ্য, পেশা, পারিবারিক-সামাজিক জীবন এবং ঢাকার বুকেই তাঁদের শেষশয্যা নিয়ে।
ঢাকায় গ্রিকদের গল্প
বাংলায় গ্রিকরা আসে ১৭৫০ সালের দিকে—আজকের গ্রিস এবং গ্রিক-অধ্যুষিত অঞ্চল, যেমন আধুনিক তুর্কি ও ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো থেকে। ভাগ্য ফেরানো ওসমানিয়া শাসন বলয় থেকে বের হওয়া, ধর্মপ্রচার ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের দিকে এরা আসতে শুরু করে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি বাংলায় ভালোভাবে আসন গেঁড়ে বসার পর। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আলেক্সিওসি (আলেক্সান্ডার) আর্গাইরি। বুলগেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী এই গ্রিক কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর কারবার ছিল বসরা আর লেভান্তে (সিরিয়া-লেবানন) অঞ্চলের সঙ্গে। ১৭৭০ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরার পথে বঙ্গোপসাগরে নিশ্চিত জাহাজডুবি থেকে বেঁচে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, কলকাতায় একটা চার্চ বানাবেন। তখন সবে কলকাতার গভর্নর হয়েছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তাঁকে গিয়ে আর্গাইরি ধরলেন চার্চ নির্মাণের অনুমতির জন্য। হেস্টিংস জানতেন, গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যবসায় উন্নতি করছে, তাই অনুমতি দিলেন। আর্গাইরি আর অন্যান্য ধনী গ্রিকরা চার্চ বানানোর তোড়জোড় শুরু করলে তিনি তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য হাজির হলেন ঢাকায়, ১৭৭১ সালে। এ থেকে অনুমান করা যায় আর্গাইরির আগমনের আগে থেকেই গ্রিক বণিকেরা ঢাকায় ডেরা বেঁধেছিল।
এই প্রস্তরখণ্ডের নিচে মিসেস সুলতানা আলেক্সান্ডার, আলেক্সান্ডারের স্ত্রীর (আলেক্সান্ডার ইস্তাম্বুলের কারিয়াকোস ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র) নশ্বর দেহাবশেষ শায়িত আছে, যিনি এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন, মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৪ বছর। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
আর্গাইরির সঙ্গে ঢাকায় আসে তাঁর ২১ বছর বয়সী বড় ছেলে পানিয়তি। ১৭৭৭ সালে আর্গাইরি মৃত্যুবরণ করেন ঢাকাতেই। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিকে পুঁজি করে ১৮ শতকের শেষার্ধে এসে এই পানিয়তি ব্যবসা বাড়িয়ে বাংলায় গ্রিক বণিক সম্প্রদায়ের প্রধান হয়ে ওঠেন। ঢাকা ও সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জে গ্রিকদের প্রধান বাণিজ্য ছিল চুন ও লবণকে ঘিরে। সিলেটের খাসিয়া-অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলে উৎকৃষ্ট মানের চুনাপাথর পাওয়া যেত (এবং এখনো যায়), যা থেকে তৈরি করা হতো চুন। সে চুন দরকার হতো বড় বড় ইমারত তৈরিতে। নৌপথে বজরায় করে সে চুনের চালান যেত নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে নদীপথে সহজেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার পদ্মা-মেঘনার সংগমস্থল দিয়ে উত্তর-পশ্চিম বা দক্ষিণ-পূর্বে নৌযাত্রা করা যেত। সে জন্য ভোলা ও চাটিগাঁ থেকে আসা লবণের বিরাট মোকাম গড়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জে।
এইখানে শায়িত আছেন ইস্তাম্বুলের জর্জ ফিলিপ্পো পলিটুর পুত্র থিওডোরের স্ত্রী থিওডোসিয়া। ১০ এপ্রিল ১৮০৫ সালে। তাঁর স্মৃতি অমর হোক। এই দুই নারীর সমাধিফলকেই একটা কথা আছে, যা আমাদের অবাক করে, ‘ঢাকার প্রতি তিনি ঋণী’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
চুন ও লবণ—এই দুই অতিপ্রয়োজনীয় বাণিজ্যের মূল অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ ইংরেজদের হাতে থাকলেও তাতে কলকাতার বাঙালি হিন্দু (যারা বউবাজার-বাগবাজার-বড়বাজারের ‘ভদ্দরলোক’ নামে পরিচিতি পায়), আর গ্রিকরা মিলে মোটা মুনাফা আয় করে যাচ্ছিল। এর মধ্যে গ্রিক বণিক মভ্রদি কেরিয়াকোস একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন চাটিগাঁও, আর ভোলার উৎপাদিত মোট লবণের এক-তৃতীয়াংশ। তখন এক ভোলা থেকেই বছরে ১ হাজার টনেরও বেশি লবণ আসত নারায়ণগঞ্জে। আর তাতে নিয়োজিত ছিল ১৬০টি বজরা। এই বণিকদের একজন ছিলেন নিকোলাস দিমিত্রিওস। টিএসসির সেই গ্রিক মন্দিরের ভেতরে অনেকের সঙ্গে সমাহিত আছেন সেই দিমিত্রিওসও।
বিষাদমাখা এক অর্থনীতির গল্প
টিএসসির সে মন্দিরের যে আকার ও আয়তন, তাতে করে বড়জোর এক বা দুজনের সমাধি হতে পারে। অথচ সেখানে আটটি স্মৃতিফলকে একজন করে আটজন এবং অন্য আরেকটা ফলকে একসঙ্গে তিন ভাইয়ের কথা উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এই ছোট একটি জায়গায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। এই ১১ জনের মৃত্যু কাছাকাছি সময়ে হয়নি। হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে। দুটি স্মৃতিফলকে উল্লেখিত দুই নারীর মধ্যে একটা সম্পর্ক (তাঁদের দুজনের শ্বশুর সম্ভবত দুই ভাই) অনুমান করা যায়। অন্য দুজন নারী আরেক গ্রিকের দুই স্ত্রী ও এক পরিবারের তিন ভাই। এ ছাড়া আরও চারজনের সঙ্গে একে অন্যের কোনো ধরনের আত্মীয়তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে সত্যি নয়।
মিসেস মাগদালেন, সোফিয়া জর্ডান এবং তাঁদের স্বামী মি. জোসেফ জর্ডানের (কেসারিয়া, তুর্কি থেকে আগত, নারায়ণগঞ্জের বণিক) স্মৃতির উদ্দেশে। জর্ডান ১০ ফেব্রুয়ারি ১৮১৯ সালে ৬০ বছর বয়সে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন। তাঁদের সবার স্মৃতির প্রতি অনুরাগ-আপ্লুত এই স্মারক নিবেদন করলেন তাঁদের অভাগা এতিম সন্তানেরা। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
তাহলে প্রথমে যে প্রশ্ন আসে, তাঁরা সবাই এক জায়গায় সমাহিত হলেন কীভাবে? কীভাবে তাঁদের মৃত্যুর প্রায় শতাব্দীকাল পরে এসে ঠাঁই পেলেন এই ছোট্ট সমাধি-মন্দিরে? আমরা এর উত্তর খুঁজব সমাধিফলকের গায়ে উৎকীর্ণ বাণী ও তৎকালীন বাংলায় গ্রিক বণিকদের ওপর করা গবেষণালব্ধ তথ্যের মধ্যে।
নিকোলাস দিমিত্রিওসের (জন্ম ১৭৯৭, মৃত্যু ১৮৪৩) সমাধিফলক লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। মৃত্যুর ১৬ বছর পর এসে ফলকটি উৎসর্গ করেছেন বাসিল দিমিত্রিওস। পারিবারিক নাম এক হলেও বাসিল নিজের পরিচয় দিয়েছেন নিকোলাসের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে। এই এপিটাফে একটা উর্দু কবিতা (সম্ভবত মির্জা গালিবের) ইংরেজি হরফে লেখা আছে, যার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম:
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
বোঝা যাচ্ছে নিকোলাসের কাব্যপ্রীতি ছিল, যা তাঁর বন্ধু বাসিলের অজানা ছিল না। হয়তো নিকোলাস ও বাসিল দুজনই ভারতবর্ষে, হয়তো ঢাকাতেই জন্মেছিলেন। বাল্যসখা ছিলেন। ঢাকার নবাবদের মধ্যে উর্দুর প্রচলন ছিল। সেখান থেকেই শিখেছিলেন এই ভাষা। খুব সম্ভব তাঁরা বাংলাও বলতে পারতেন, যেহেতু ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন।
দিমিত্রিওস এলিয়াসের জ্যেষ্ঠ পুত্র নিকোলাস দিমিত্রিওসের স্মৃতির উদ্দেশে। মৃত্যু ৫ মার্চ ১৮৪৩, বয়স ৪৬। তাঁর প্রিয় কবিতার ছত্র—
‘(আমার বিদায়ে) দুনিয়ার আনন্দধারা কমবে না কিছুমাত্র,
আমাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ কেউ,
আফসোস, আমি তখন থাকব না আশপাশে।’
তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু বাসিল দিমিত্রিওস এই ফলক স্থাপন করলেন ১৮৫৯ সালে। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
বন্ধুর জন্য এপিটাফের ব্যবস্থা করার এক বছরের মাথায় ১৮৬০ সালে মারা যান বাসিল দিমিত্রিওস, মাত্র ৬০ বছর বয়সে। ইংরেজি জানা বাসিল জীবনভর বিচিত্র পেশায় জড়িত ছিলেন। কমিশনারের সহকারী ছিলেন ৯ বছর, সেন্ট টমাস চার্চের (১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠিত) করণিক ছিলেন ৪০ বছর—জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আর ১০ বছর ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন ঢাকা কলেজে (১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত)। এর মানে জীবন চালানোর জন্য একসঙ্গে বেশ কিছু চাকরি করেছেন সমান্তরালে। ছাপোষা এমন একজন মানুষের বন্ধু ছিলেন ধনী বণিক নিকোলাস। সম্ভবত দুজনই সমবয়সী, একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন ও বেড়ে উঠেছেন।
প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল ফাদার নাথানিয়েলের স্মৃতিফলক। আমরা জানতে পারি, ১৭৩৬ সালে সুদূর আজিয়ান সাগরের ছোট্ট দ্বীপ সিফোনেসে জন্ম নেওয়া নাথানিয়েল শেষশয্যা নিয়েছেন ঢাকায়, ১৮১০ সালে। আমরা পুলকভরে অবগত হই যে তিনি তাঁর জন্মস্থান ও ঢাকা—দুই জায়গাকেই নিজের স্বদেশ বলে গণ্য করতেন! তিনি হয়তো ধর্ম প্রচারে এসে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বুড়িগঙ্গার ধারের এই নগরকে।
এইখানে শায়িত প্রয়াত কেসারিয়ার (তুরকিস্তান) জ্যাকব ইস্সাই লাকোবোগলাস। মৃত্যু ২২ জুন, ১৮১৯ সালে, বয়স হয়েছিল ৪৮। ওপর থেকে যিনি তাকিয়ে আছেন, হে ঈশ্বর, তাঁকে ক্ষমা করুন। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
নাথানিয়েলের চার বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন এক ব্যবসায়ী, কনস্টানটিন। তাঁর স্ত্রী এই সমাধিফলক বানান প্রয়াত সহধর্মীর জন্য—তাঁর নাম আমরা জানতে পারি না। কিন্তু তাঁর বেদনামথিত আবেগের কথা লেখা আছে মাতৃভাষা গ্রিকে।
ফিলিস্তিন থেকে আসা জোসেফ জর্ডান (১৭৫৯-১৮১৯), আর তাঁর দুই স্ত্রী মাগদালেন ও সোফিয়ার জন্য ইংরেজিতে ফলক লিখে রেখে গেছেন তাঁদের শোকগ্রস্ত সন্তানেরা। এতে অনুমান করা যায়, দ্বিতীয় প্রজন্মের গ্রিকরা ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য আর চাকরির সুবিধার্থে ইংরেজিকে তাঁদের প্রতিদিনের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
বাসিল দিমিত্রিওসের (সেন্ট থমাস চার্চের করণিক) পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে। জন্ম ১৮০০ সালে। তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ৯ বছর কমিশনের সহকারী, ১০ বছর ঢাকা কলেজের ইংরেজির শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন এবং ৪০ বছর সেন্ট থমাস চার্চে সেবা প্রদান করেছেন। ‘বিশুদ্ধ প্রাণ যাদের, তারাই তো দেখা পায় ঈশ্বরের’ (বাইবেল: ম্যাথিউ), ১৮৬০। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, সেদিন ছিল রোববার। ছুটির দিন। ঢাকা থেকে ২৫ মাইল দূরের মির্জাপুরে সেই দিন বাঘ শিকারে গিয়েছেন জন দিমিত্রিওস ইলিয়াস। সেখানেই বাঘের থাবায় তাঁর করুণ মৃত্যু হয় মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। যিনি বাঘ শিকারের মতো রোমাঞ্চকর ও দামি শখ মেটানোর ক্ষমতা রাখেন, তিনি যে ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ইংরেজিতে লেখা সে স্মৃতিপ্রস্তরে তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের কথাও বলা হয়েছে, তাঁরাও শিকারি ছিলেন। তাঁদের দেহাবশেষ একসঙ্গে করে তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁদের এক মামাতো বা খালাতো ভাই ম্যানুয়েল এই ফলকের ব্যবস্থা করেন।
এটি ফাদার নাথানিয়েলের সমাধি; পবিত্র এবং সাধু; যিনি পবিত্র এক সাধুর ন্যায় যিশুর কথা প্রচার করেছেন, তাঁর জীবনাচার এবং বাণীর মাধ্যমে। অনবদ্য এক আনন্দধাম এই ঢাকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বিতীয় সেন্ট থমাস*। তাঁর পিতৃভূমি ছিল সিফনোস (আজিয়ান সাগরের এক দ্বীপ), যেখানে তিনি ১৭৩৬ সালে প্রথম আলো দেখেছেন এবং ঢাকা—এই দুই স্থানকেই তিনি স্বদেশ বলে গণ্য করতেন। ১২ মার্চ ১৮১০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘তিনিই সুখী হন, যিনি অন্যকে ভক্তিময় সম্মান দান করেন’। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
১৮২০ সালের পর নানা কারণে ইংরেজ-কলকাতার ‘ভদ্দরলোক’ গ্রিকদের ত্রিমুখী বাণিজ্য প্রণয় আর আগের মতো থাকেনি, মুনাফাতেও টান পড়তে শুরু করে। চুন আর লবণের ব্যবসা ছেড়ে টাকাওয়ালা গ্রিকেরা জমিদারি কিনতে লাগলেন (বরিশাল অঞ্চলেও এদের একটা জমিদারি ছিল)। আর যাঁরা অতটা বিনিয়োগ করতে পারলেন না, তাঁরা ইংরেজদের সওদাগরি কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত ইংরেজ লেখক জেমস টেইলরের বই ‘A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca’ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৩৮ সালে ঢাকায় মাত্র ১২টি গ্রিক পরিবারের বসবাস ছিল। জন দিমিত্রিওস এলিয়াস আত্মীয়স্বজন সেই ১২ পরিবারের একজন হওয়ার কথা। আরও বোঝা যাচ্ছে যে গ্রিকদের ব্যবসা পড়তির দিকে থাকলেও তখন ঢাকায় অবস্থাসম্পন্ন কয়েকজন গ্রিকের বসবাস ছিল।
জর্জ মাভরোডোগ্লোর পুত্র কনস্টানটাইনের স্ত্রী, যিনি ছিলেন স্বামীপরায়ণা নারী, তাঁর চিরজাগরুক ভালোবাসার স্মারক হিসেবে এই ফলকখানি স্থাপন করেছেন। তাঁর (স্বামীর) জন্মস্থান ছিল ইস্তাম্বুল। একজন বণিক হিসেবে তিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন। ১৮০৬ সালের ২৪ জুলাই তিনি জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এই ঢাকায়। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
একই পরিবারের দুই বউ থিওডোসিয়া (মৃত্যু ১৮০৫) ও সুলতানার (জন্ম ১৭৬৬) দেহাবশেষ পাশাপাশি রাখা আছে। সুলতানা সম্ভবত অধুনা তুর্কি দেশের মেয়ে ছিলেন, শুধু নামেই তার ইঙ্গিত মেলে না, তাঁর শ্বশুর কারিয়াকোস ফিলিপ্পো নিজেও এসেছিলেন ইস্তাম্বুল থেকে। তিনি হয়তো ছেলের বিয়ের জন্য নিজের জন্মস্থানের মেয়েই খুঁজে এনেছিলেন। কেমন দেখতে ছিলেন সুলতানা? তিনি কি কখনো শাড়ি পরেছিলেন? সুলতানার মৃত্যু হয় ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে, আজ থেকে ২২২ বছর আগে, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে।
এই স্থাপনায় আরও আছে আধভাঙা এক সমাধিফলক, যার বাকি অংশ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। সেখানে আমরা দেখতে পাই, এক পিতা ১৮৫৫ সালের ডিসেম্বরের কোনো এক দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন। একই সমাধিতে পরে তাঁর কন্যাকেও সমাহিত করা হয়। কন্যার জন্ম ১৮১৫ সালে। তাঁর মৃত্যুর বছর আমরা হয়তো জানতে পারব না কোনো দিনই; হয়তো পিতৃশোকাতুর মেয়েও বেশি দিন বাঁচেনি। শুধু জানব ঢাকায় বসবাসকারী এই গ্রিক পিতা এবং কন্যার শেষশয্যা হয়েছিল রমনার সবুজ গালিচার নিচে। নাম না জানা সেই মেয়ে তার বাবার কোলে শুয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে, পরম নিশ্চিন্তে।
দিমিত্রিওস এলিয়াস এস্কোয়ারের দ্বিতীয় পুত্র জন দিমিত্রিওসের পবিত্র স্মৃতির প্রতি। ১৮৩৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, রবিবার ঢাকার উত্তর-পশ্চিমের মির্জাপুরে বাঘ শিকারে গিয়ে নিহত হন। এখানে তিন মহান ভাই নিকোলাস, জন ও কনস্টানটিন একসঙ্গে শায়িত হয়েছেন। এখানে যূথবদ্ধ হয়ে আছেন সাহসী শিকারি ও খেলাধুলায় পারদর্শী তিন উচ্ছল জীবন। ফলক স্থাপনায় (খালাতো/মামাতো) ভাই মানুয়েল এলিয়াস মিচো। ফলকের একদম নিচে লেখা আছে, ‘মারডক’, যা সম্ভবত কলকাতার সমাধিফলক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
যে কয়জন গ্রিকের সমাধিফলক এখানে আছে, তাঁরা একজন আরেকজনের সঙ্গে সরাসরি আত্মীয়তার সম্বন্ধে সংযুক্ত নন। তাঁদের দেহাবসান হয়েছে ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় দশক ধরে। অথচ তাঁরা মিললেন একই ছাদের নিচে!
১৮০০ সালের দিকে রমনা অঞ্চলে (তখন নাম ছিল সুজাতপুর) আগে থেকেই গ্রিকদের একটা সমাধি ছিল। ইংরেজরা রমনা অঞ্চলে নানা রকম স্থাপনা বানানো শুরু করলে এবং ১৮৫০ সালের পরে ঢাকায় ধনী গ্রিকদের আধিপত্য কমতে থাকলে এই সমাধি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হতে থাকে। শেষে এমন অবস্থা হয় যে এলাকার লোকজন সমাধিফলক, ইট-পাথর পর্যন্ত খুলে নিয়ে নির্মাণকাজে লাগানো শুরু করে একসময়। তাই দেখে অবশিষ্ট প্রভাবশালী গ্রিক (যাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী রাল্লি ব্রাদার্সের বংশধরেরা অন্যতম) বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের কাছে আরজি করলেন, অন্তত কিছু সমাধি, দেহাবশেষ এবং সমাধিফলক তুলে নিয়ে এসে একত্র করে একটা মন্দিরে স্থাপন করার অনুমতি দেওয়া হোক।
আধভাঙা স্মৃতিফলক: বাবা ও মেয়ের। ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে
এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ ও গ্রিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯১৫ সালে তৈরি হয় টিএসসির এই সমাধি-মন্দির। ধারণা করা হয়, টিএসসির সবুজ গালিচার নিচেও শুয়ে আছেন উল্লেখিত মানুষগুলোর কেউ কেউ। এর ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এই মন্দির ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের অংশই হয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে এটির অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর সৌন্দর্য ও সৌকর্য নবায়ন হয়েছে ১৯৯৭ সালে দিল্লির গ্রিক দূতাবাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের যৌথ উদ্যোগে।
শুনতে পাচ্ছি, টিএসসি নতুন করে বিনির্মাণ করা হবে। তখন হয়তো এই সমাধি আবারও সরানো হবে। সেখানে চিরনিদ্রায় থাকা অভিবাসীরা হয়তো ভাবতে থাকবেন, তাঁদের অভিবাসনের কোনো শেষ নেই—না তাঁদের জীবদ্দশায়, না মরণের পর।
তথ্যসূত্র:
‘Glimpses of the Greek Community from the Dhaka University Gravestones’. Helen Abadzi. Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, 40, 101-116,1995
‘From Thrace to Bengal: Greek Merchants in Early Colonial Bengal’. KANDA Sayako. The Memoirs of Toyo Bunko, 77, 2019
লেখক: প্রযুক্তিবিদ, ইনফিনিয়াম ইউকে লিমিটেড, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য
*যিশুখ্রিষ্টের ১২ জন শিষ্যের একজন ছিলেন সেন্ট থমাস, যিনি প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি এক সময়ে দক্ষিণ ভারতে আসেন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য। তিনি সেখানেই দেহ রাখেন। নাথানিয়েলকে দ্বিতীয় সেন্ট থমাস বলা হচ্ছে, কেননা তিনিও সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষের এক নগর, ঢাকায় এসেছিলেন যেমন করে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এসেছিলেন আরেক ধর্মপ্রচারক।

আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
২ দিন আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
৪ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৫ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
১১ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। এই স্থাপনায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে স
০৮ মার্চ ২০২২
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
৪ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৫ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
১১ দিন আগেসম্পাদকীয়

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। এই স্থাপনায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে স
০৮ মার্চ ২০২২
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৫ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
১১ দিন আগেসম্পাদকীয়

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। এই স্থাপনায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে স
০৮ মার্চ ২০২২
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
২ দিন আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
৪ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
১১ দিন আগেসম্পাদকীয়

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরটায় খুব স্নিগ্ধ, ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ আছে। তার এক ধারে একটা গ্রিক সমাধি-মন্দির চারপাশের আর সব স্থাপনার চেয়ে আলাদা এক চেহারা ও পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১১০ বছর। এই স্থাপনায় মোট ১১ জনের সমাধি আছে। তাই যদি হয়, তাহলে ‘এটি একটি পারিবারিক সমাধি’—এই চালু ধারণা সর্বাংশে স
০৮ মার্চ ২০২২
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
২ দিন আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
৪ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৫ দিন আগে