Ajker Patrika

ফিতরা কেন, কার ওপর ওয়াজিব

ইসলাম ডেস্ক
ফিতরা কেন, কার ওপর ওয়াজিব

আরবি ‘সদকাতুল ফিতর’-এর অর্থ ঈদুল ফিতরের সদকা। ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করা হয় বলে একে সদকাতুল ফিতর বলা হয়। একে জাকাতুল ফিতর বা ফিতরাও বলা হয়। সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। রাসুল (সা.) ছোট-বড় নারী-পুরুষ সব মুসলমানের জন্য তা আবশ্যক করেছেন।

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (সা.) স্বাধীন-দাস ছোট-বড় নারী-পুরুষ সব মুসলমানের জন্য গম বা খেজুরের এক সা (৩ কেজি ২৭০ গ্রাম) ফিতরা আবশ্যক করে দিয়েছেন। এবং তা ঈদুল ফিতরের নামাজে যাওয়ার আগেই আদায় করার আদেশ দিয়েছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৫০৩) 

সদকাতুল ফিতর কেন দিতে হয়
যেসব কারণে সদকাতুল ফিতর দিতে হয়, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—
ক. দরিদ্রদের প্রতি সদ্ব্যবহার এবং ঈদুল ফিতরের দিনে তাদের ভিক্ষা করা থেকে বিরত রাখা। 
খ. উদারতা-বদান্যতা ও সহমর্মিতার চর্চা করা। 
গ. রোজাদারের রোজায় যেসব দুর্বলতা ও ভুল হয়, তা থেকে পবিত্র হওয়া। 
ঘ. তারাবি ও রোজার মতো নেয়ামতে ধন্য করায় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। 

সদকাতুল ফিতর কার ওপর ওয়াজিব
সদকাতুল ফিতরের নিসাব জাকাতের নিসাবের সমপরিমাণ। অর্থাৎ কারো কাছে সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে ৫২ ভরি রুপা অথবা তার সমমূল্যের নগদ অর্থ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অতিরিক্ত সম্পদ ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় বিদ্যমান থাকলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে। যাঁর ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব, তিনি নিজের পক্ষ থেকে যেমন আদায় করবেন, তেমনি নিজের অধীনদের পক্ষ থেকেও আদায় করবেন। তবে এতে জাকাতের মতো বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়। (ফাতহুল কাদির: ২ / ২৮১) 

সদকাতুল ফিতরের উপকরণ ও পরিমাণ
রাসুল (সা.)-এর যুগে মোট চারটি পণ্য দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করা হতো। খেজুর, কিশমিশ, যব ও পনির। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘আমরা এক সা পরিমাণ খাদ্য অথবা এক সা পরিমাণ যব অথবা এক সা পরিমাণ খেজুর অথবা এক সা পরিমাণ পনির অথবা এক সা পরিমাণ কিশমিশ দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম।’ (বুখারি: ১৫০৬) 

উল্লিখিত খাদ্যবস্তুর পরিবর্তে সেগুলোর কোনো একটিকে মাপকাঠি ধরে তার মূল্য আদায় করলেও তা আদায় হয়ে যাবে। মূল্যের দিক থেকে ওই খাদ্যবস্তুগুলোর মধ্যে তফাত থাকলেও সবচেয়ে কম দামের বস্তুকে মাপকাঠি ধরে যদি কেউ ফিতরা আদায় করে দেয়, তাহলেও তা আদায় হয়ে যাবে। 

বর্তমান বাজারদর হিসাবে যেহেতু গমের দামই সবচেয়ে কম, তাই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর আধা ‘সা’ গমকে মাপকাঠি ধরে ওই সময়ের বাজারদর হিসাবে তার মূল্য ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ ঘোষণা করা হয়। এ বছর তা জনপ্রতি সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬৪০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। 

তবে এর মানে এই নয় যে ধনীরাও তাদের ফিতরা ১১৫ টাকাই আদায় করবে। উত্তম হলো, নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী বেশি মূল্যের খাদ্যবস্তুকে মাপকাঠি ধরে ফিতরা আদায় করা। কেননা সদকার মূল লক্ষ্যই হলো গরিবদের প্রয়োজন পূরণ ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ। এ ছাড়া আদায়কারীর সামর্থ্যকেও বিবেচনায় রাখা উচিত, যদিও শরিয়তে সর্বনিম্ন মূল্যে ফিতরা আদায় করার দরজা খোলা রাখা হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে যব, কিশমিশ, খেজুর ও পনিরের হিসাবে ফিতরার আলাদা মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কেউ চাইলে আটার হিসাবে ফিতরা না দিয়ে উল্লিখিত জিনিসগুলোর হিসাবেও ফিতরা দিতে পারবে। 

সদকাতুল ফিতর কখন আদায় করবেন
পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম। তবে রমজান মাসেও তা আদায় করা যায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শীতকালে মুমিনের আত্মিক শিক্ষা ও নৈতিক দায়িত্ব

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ 
আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭: ৫০
শীতকালে মুমিনের আত্মিক শিক্ষা ও নৈতিক দায়িত্ব

শীতকাল কেবল আবহাওয়ার একটি পরিবর্তন নয়, বরং এটি মুমিনের শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক প্রশিক্ষণের এক বিশেষ ঋতু। প্রকৃতির এই পরিবর্তন আমাদের মহান আল্লাহর অসীম মহিমা ও শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পবিত্র কোরআনে তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের পালাবদলে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা নুর: ৪৪)

ইসলামে সুস্থতার গুরুত্ব অপরিসীম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘একজন সবল ও সুস্থ মুমিন আল্লাহর কাছে দুর্বল মুমিনের চেয়ে অধিক উত্তম ও প্রিয়।’ (সহিহ মুসলিম)। শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়ায় রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, তাই মুমিনের উচিত সতর্ক থাকা। পর্যাপ্ত উষ্ণ কাপড় পরিধান করা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, বিশুদ্ধ পানি পান এবং নিয়মিত হালকা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরকে ইবাদতের উপযোগী রাখা জরুরি।

শীতকালকে মুমিনের ইবাদতের বসন্ত বলা হয়। কেননা এ সময় দিন ছোট হওয়ায় সহজে রোজা রাখা যায় এবং রাত দীর্ঘ হওয়ায় আরামের ঘুম বিসর্জন দিয়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে তাহাজ্জুদ আদায় করা সহজ হয়।

শীতের তীব্রতায় সমাজের অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষগুলো নিদারুণ কষ্টে ভোগে। মুমিনের ইবাদত কেবল নামাজ-রোজায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং আর্তমানবতার সেবাও ইবাদতের অংশ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা যা উপার্জন করো এবং যা আমি তোমাদের জন্য জমিন থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উত্তম বস্তু ব্যয় করো।’ (সুরা বাকারা: ২৬৭)। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো অভাবী মানুষের দুঃখ দূর করবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দুঃখ দূর করে দেবেন।’ (জামে তিরমিজি)। তাই সাধ্যানুযায়ী শীতবস্ত্র ও খাদ্য দিয়ে দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের ইমানি দায়িত্ব।

শীতকাল আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, ধৈর্য, সহমর্মিতা এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির শিক্ষা দেয়। তাই প্রত্যেক মুমিনের উচিত এই ঋতুকে অবহেলায় না কাটিয়ে ইবাদত, আর্তমানবতার সেবা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সার্থক করে তোলা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আজকের নামাজের সময়সূচি: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫

ইসলাম ডেস্ক 
আজকের নামাজের সময়সূচি। ছবি: সংগৃহীত
আজকের নামাজের সময়সূচি। ছবি: সংগৃহীত

জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে এবং আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে নামাজের কোনো বিকল্প নেই। একজন মুমিনের জন্য নামাজ হলো আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যম। এটি এমন এক ইবাদত—যা আমাদের মনে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি আনে, জীবনের প্রতিটি কাজে আনে বরকত।

প্রতিদিন সময় মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আবশ্যক। তাই জেনে নেওয়া যাক আজ কোন ওয়াক্তের নামাজ কখন আদায় করতে হবে।

আজ রোববার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ইংরেজি, ০৬ পৌষ ১৪৩২ বাংলা, ২৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৭ হিজরি। ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকার নামাজের সময়সূচি তুলে ধরা হলো—

আজকের নামাজের সময়সূচি
নামাজ ওয়াক্ত শুরুওয়াক্ত শেষ
তাহাজ্জুদ ও সেহরির শেষ সময়০০: ০০০৫: ১৪ মিনিট
ফজর০৫: ১৫ মিনিট০৬: ৩৫ মিনিট
জোহর১১: ৫৭ মিনিট০৩: ৪০ মিনিট
আসর০৩: ৪১ মিনিট০৫: ১৫ মিনিট
মাগরিব০৫: ১৭ মিনিট০৬: ৩৬ মিনিট
এশা০৬: ৩৭ মিনিট০৫: ১৪ মিনিট

উল্লিখিত সময়ের সঙ্গে যেসব বিভাগের সময় যোগ-বিয়োগ করতে হবে, সেগুলো হলো:

বিয়োগ করতে হবে—
চট্টগ্রাম: ০৫ মিনিট
সিলেট: ০৬ মিনিট

যোগ করতে হবে—
খুলনা: ০৩ মিনিট
রাজশাহী: ০৭ মিনিট
রংপুর: ০৮ মিনিট
বরিশাল: ০১ মিনিট

নামাজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যেমন আমাদের দৈহিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে, তেমনই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আজকের এই নামাজের সময়সূচি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন, আল্লাহর জন্য সময় বের করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব।

আসুন, নামাজের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে তাঁর আরও কাছে নিয়ে যাই। জীবনে নিয়ে আসি ইমানের নুর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নূরানী বোর্ডের ফল প্রকাশ, পাসের হার ৯০.৩৬

ইসলাম ডেস্ক 
নূরানী বোর্ডের ফল প্রকাশ, পাসের হার ৯০.৩৬

নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড বাংলাদেশ (এনটিকিউবি) পরিচালিত তৃতীয় শ্রেণির ১৯তম সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে।

শনিবার (২০ ডিসেম্বর) বোর্ডের মোহাম্মদপুরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের শায়খুল কোরআন মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই ফল প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে অনুষ্ঠানে জুলাই যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির রুহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বোর্ডের পরিচালক মাওলানা কালিমুল্লাহ জামিল হুসাইন।

দেশের মোট ১ হাজার ১২টি কেন্দ্রে গত ২৯ নভেম্বর দেশব্যাপী একযোগে এই সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়ে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। এতে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৬৩ হাজার ৫৩২ এবং পাসের হার ৯০ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে মাওলানা কালিমুল্লাহ জামিল হুসাইন বলেন, ‘দেশব্যাপী তরুণ আলেমদের কাছে অনুরোধ করছি, একটি নীরব সাধনায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে হবে। তা হচ্ছে প্রতিটি গ্রামে-পাড়া-মহল্লায় নূরানি মাদ্রাসা, নূরানি স্কুল, নূরানি মক্তব ও ইসলামিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের প্রতিটি সন্তানের কাছে দ্বীন শেখাকে সহজ থেকে সহজতর করতে হবে।’

পরীক্ষা বাস্তবায়ন কমিটির মহাসচিব ইসমাইল বেলায়েত হুসাইন বলেন, ‘শিশুরা কাঁচা মাটির মতো। তাদের যেভাবে গড়ে তুলবেন, তারা সেভাবেই গড়ে উঠবে। আমরা দ্বীন ধর্ম ও মাতৃভূমির ভালোবাসায় সন্তানদের গড়ে তুলি। সুনাগরিক ও দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে তুলতে কাজ করে নূরানী বোর্ড।’

এদিকে অনুষ্ঠানে তরুণদের জন্য ‘শায়খুল কোরআন আল্লামা কারি বেলায়েত হুসাইন (রহ.) স্কলারশিপ’-এরও ঘোষণা দেওয়া হয়। ১০ লাখ টাকা সমমূল্যের এই স্কলারশিপ পাবেন ১০০ তরুণ। মনোনীত ১০০ তরুণ ১০ হাজার টাকা সমমূল্যের নূরানি মুয়াল্লিম প্রশিক্ষণ কোর্সটি বিনা মূল্যে করতে পারবেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা আবু বকর, মাওলানা তারেক হুসাইনসহ নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ডের কর্মকর্তা ও দায়িত্বশীলেরা।

প্রসঙ্গত, শায়খুল কোরআন আল্লামা কারি বেলায়েত হুসাইন (রহ.) প্রতিষ্ঠিত এই বোর্ডটি দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরাঞ্চলেও শিশু শিক্ষায় অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে এই ধারার হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সারা দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যে মাদ্রাসায় বেড়ে উঠেছিলেন ওসমান হাদি

কাউসার লাবীব
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ২৯
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

একটি সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারের সন্তান থেকে শুরু করে রাজপথের আপসহীন বক্তা—শরিফ ওসমান হাদির শিকড় প্রোথিত ছিল ধর্মীয় শিক্ষার গভীরে। ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার খাসমহল এলাকায় এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা প্রয়াত মাওলানা আব্দুল হাদি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ মাদ্রাসাশিক্ষক। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ওসমান হাদি ছিলেন সবার ছোট। পরিবারের প্রত্যেক সদস্য আলেম বা দ্বীনি শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত, যা ওসমান হাদির চিন্তা ও চরিত্রে এনেছিল দৃঢ় নৈতিক ভিত্তি।

তাঁর বড় ভাই মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক বরিশালের ঐতিহ্যবাহী শরফুদ্দীন আহমেদ সেন্টু জামে মসজিদের খতিব; মেজো ভাই মাওলানা ওমর ফারুক একজন ব্যবসায়ী। তাঁর তিন ভগ্নিপতিও মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ও ইমামতির সঙ্গে যুক্ত, যাঁরা স্থানীয় পর্যায়ে অত্যন্ত সম্মানিত।

ওসমান হাদির শিক্ষাজীবনের শুরু ঝালকাঠির বিখ্যাত এন এস কামিল মাদ্রাসায়। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন তুখোড় মেধাবী এবং অসাধারণ বক্তা। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার স্পৃহা তাঁর মধ্যে কাজ করত শৈশব থেকেই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে তাঁর প্রিয় মাদ্রাসার স্মৃতিচারণা করেছিলেন।

ওসমান হাদি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমাকে এটা যদি কেউ জিজ্ঞেস করে—আল্লাহ যদি আমাকে আবারও দুনিয়ায় পাঠায়, আমি কয়টা জিনিস চাইব। আমি প্রথমেই বলব—ইন্টার পর্যন্ত যে মাদ্রাসাটায় পড়েছি, সেই মাদ্রাসায় আবার আমি পড়তে চাইব। বাংলাদেশে এটা কেউ চিন্তাও করতে পারবে না যে মাদ্রাসায় রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ হয়। আমি যখন চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি; তখন ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে অনেকবার বিতর্ক, আবৃত্তি, বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে এসেছি এবং স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা মিলিয়ে আমি অনেকবার ফার্স্ট হয়েছি।’

ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা শুধু আমি না, ওই প্রতিষ্ঠানের আমার অনেক ছোট ভাই, বন্ধু জাতীয় পর্যায়ের এমন প্রচুর পুরস্কার পেত। আমাদের এমনভাবে কালচারাল নার্সিং হতো—রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, জারি, ভাটিয়ালি আমরা গাইতাম। যেহেতু মাদ্রাসা, তাই একমাত্র নৃত্যটা হতো না।’

মাদ্রাসার গণ্ডি পেরিয়ে ওসমান হাদি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে (২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ)। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেও তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে তিনি প্রাইভেট পড়িয়েছেন, সাইফুর’সসহ বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ তিনি ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা তাঁকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তাঁর সাহসী ভূমিকা এবং পরে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে টক শো ও সভা-সমাবেশে তাঁর যুক্তিপূর্ণ ও ঝাঁজালো বক্তব্য তাঁকে অনেক তরুণের আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংক এলাকায় রিকশায় যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলে আসা দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে লক্ষ্য করে খুব কাছ থেকে গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হলেও মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি। ১৮ ডিসেম্বর রাত পৌনে ১০টায় সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার মাত্র এক মাস আগে নভেম্বর মাসে ওসমান হাদি নিজের জীবনের ঝুঁকির কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন। দেশি-বিদেশি অসংখ্য নম্বর থেকে আসা প্রাণনাশের হুমকির কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছিলেন—‘জীবননাশের আশঙ্কা সত্ত্বেও ইনসাফের লড়াই থেকে আমি পিছিয়ে যাব না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত