Ajker Patrika

রাজনীতির ভেতর পলিটিকস ঢুকে গেছে!

চিররঞ্জন সরকার
আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১৩: ১৯
রাজনীতির ভেতর পলিটিকস ঢুকে গেছে!

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজার মাথায় যারা কাঁঠাল ভেঙে খায়, সেই সংখ্যালঘু শোষকগোষ্ঠীর শাসক হয়ে থাকার ও অবাধ্য প্রজাকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে রাখার কলাকৌশলেরই নাম দেওয়া হয়েছে ‘রাজনীতি’। এর সঙ্গে ন্যায়নীতির কোনো দূরতম সম্পর্কও নেই।

রাজনীতি। আকারে একটি ছোট শব্দ। তবে আজকের সমাজব্যবস্থায় শব্দটি সর্বাধিক শক্তির আধার। কারণ, গোটা পৃথিবী রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। একেক রাষ্ট্রের পরিচালনব্যবস্থা একেক রকম হলেও তাদের মূল ভিত্তি রাজনীতি। রাষ্ট্র শাসন বা পরিচালনার নীতির নামই হলো রাজনীতি—ইংরেজিতে পলিটিকস। প্রাচীন রাজতন্ত্রের দিক থেকে রাজনীতি হলো রাজার নীতি। অর্থাৎ যে নীতির ভিত্তিতে রাজা তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। রাজার কাজ হলো দেশের সবার জন্য সুখ-শান্তি এবং ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করা। সেই অর্থে রাজনীতি হলো নীতিরও রাজা।

প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ মনুসংহিতায় সাম দান ভেদ দণ্ড—রাজ্যশাসনের এই চারটি উপায় বা নীতির কথা বলা হয়েছে। পরবর্তীকালে পণ্ডিত চাণক্যও এই চারটি নীতির উল্লেখ করেন। রাজনীতির পাঠে ‘সাম’ এমন একটি উপায়, যাতে শত্রুকে বশীভূত করার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে তোষণ এবং সন্ধিস্থাপনের কৌশল গ্রহণে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ‘দান’ কথার অর্থ কোনো দামি জিনিস বা স্বার্থের স্বত্ব ত্যাগ।

এটিরও চূড়ান্ত লক্ষ্য শত্রুকে বশীভূত করা। রাজনীতিতে ‘ভেদ’ কথাটি বিভেদ সৃষ্টির একটি পন্থা বা ভেদনীতি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চতুর্বিধ উপায়ের সর্বশেষটি হলো ‘দণ্ড’। এই শব্দটির তাৎপর্যগত অর্থ হলো ন্যায়দণ্ড। অর্থাৎ রাজা বা শাসক দুষ্টের দমন করে শিষ্টের পালনে ব্রতী থাকবেন। খেয়াল করে দেখুন, প্রথমোক্ত তিনটি উপায়ের ভেতরে কিছু কূটকৌশল অবশ্যই আছে, কিন্তু শেষোক্ত উপায়ে সেসব কেমন যেন নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ রাজনীতিক বা শাসককে শেষ বিচারে ন্যায়দণ্ডটাই হাতে ধরে রাখতে হবে। তার মানে, কোনো অন্যায় শাসক নিজে করবেন না, অন্যে সেটা করার চেষ্টা করলে তিনি রুখবেন এবং তাঁর অজান্তে কোনো অন্যায় ঘটে গেলে দোষীর জন্য যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা তিনি করবেন। প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্রনীতির এই যে চতুর্বিধ উপায়ের কথা বলা হয়েছে, আজকের বাংলাদেশে রাজনীতি তার সুবিধা অনুযায়ী নীতিগুলোকে আশ্রয় করে। যেমন, ভেদনীতিতেই তার সর্বাধিক আগ্রহ। বাকি তিনটি উপায়ের মধ্যে ন্যায়দণ্ড ছুঁয়ে দেখতেও যেন আলস্য তার। অন্য দুটির প্রয়োগেও ভীষণ একচক্ষু বা নিতান্তই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা চালিত হয়।

উল্লেখ্য, ‘পলিটিকস’ শব্দটি আর এককভাবে ‘রাজনীতি’ অর্থ বহন করে না। নানা ধরনের নেতিবাচক শব্দ সংযোজিত হয়েছে ‘পলিটিকস’-এর সঙ্গে। ‘পলিটিকস’ বলতে মানুষ বোঝে ‘ষড়যন্ত্র’, ‘কুটিলতা’, ‘কারসাজি’, ‘প্রতারণা’, ‘কপটতা’ ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার পলিটিকসকে ‘পলিট্রিকস’ বলে থাকেন (‘পলি’ অর্থ বহুমুখী, আর ‘ট্রিকস’ মানে কারসাজি। অর্থাৎ বহুমুখী কারসাজিই হচ্ছে পলিট্রিকস)।

অনেকেই রসিকতা করে বলেন, রাজনীতির মধ্যে পলিটিকস ঢুকে গেছে। আর গ্রামের লোকজন যাবতীয় নেতিবাচক বিষয়কে বলেন ‘পলিটিকস’। অথচ রাজনীতিবিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত অ্যারিস্টটল ‘পলিটিকস’ অর্থাৎ রাজনীতিকে সত্য, সুন্দর ও নৈতিকতার বিষয় বলে বর্ণনা করেছেন। অবশ্য পরে প্রাচ্যের কৌটিল্য (খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী) এবং পাশ্চাত্যের ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) রাজনীতি থেকে নীতিনৈতিকতাকে বিসর্জন দেন। রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য সব ধরনের ধূর্ততা, হিংস্রতা, অপকৌশল ও বিশ্বাসঘাতকতাকে তারা যুক্তিযুক্ত বলে মতামত দেন। আজ বাংলাদেশে কৌটিল্য—ম্যাকিয়াভেলি বর্ণিত রাজনীতিরই যেন মহড়া চলছে।

যাহোক, ‘পলিটিকস’ শব্দটি আমাদের সমাজে অনেক বেশি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ব্যক্তি ও সমাজে নীতি-আদর্শের বিচ্যুতির ক্ষেত্রে অনেক সময় পলিটিকস শব্দটির প্রয়োগ করা হয়। যেমন, কেউ কোথাও ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করলে বলা হয়: ‘এখানে পলিটিকস চলবে না।’ কেউ দুটি পক্ষের মধ্যে উসকানি দিলে, চালবাজি করলে সে ক্ষেত্রেও বলা হয়: ‘এখানে পলিটিকস করতে হলে বাপের নাম ভুলিয়ে দেব’ ইত্যাদি।

এখন আমাদের দেশে পলিটিকস মানে নোংরামি, ষড়যন্ত্র আর কপটতা। পলিটিকস যাঁরা করেন, সেই রাজনীতিবিদদের প্রতিও মানুষের আর তেমন আস্থা নেই। তাঁদের নিয়ে সবাই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেন। এক মহাজন বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদেরা বিশ্বের সব জায়গায় একই রকম। তাঁরা আপনাকে বিশাল সেতু বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেবেন, যেখানে হয়তোবা কোনো নদীই নেই’ অর্থাৎ নদী ছাড়াই রাজনীতিবিদেরা আপনাকে বড় বড় সেতু বানিয়ে দেবেন। অর্থাৎ তাঁরা সব সময় জনগণকে বোকা বানিয়ে রাখতে চান। আসলে একালে ‘রাজনীতি’ শব্দটির যেন অর্থবিপর্যয় ঘটে গেছে। এখন শাসক বা ‘রাজার নীতি’ই হচ্ছে রাজনীতি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজার মাথায় যারা কাঁঠাল ভেঙে খায়, সেই সংখ্যালঘু শোষকগোষ্ঠীর শাসক হয়ে থাকার ও অবাধ্য প্রজাকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে রাখার কলাকৌশলেরই নাম দেওয়া হয়েছে ‘রাজনীতি’। এর সঙ্গে ন্যায়নীতির কোনো দূরতম সম্পর্কও নেই। নীতিহীনতারই অন্য নাম হয়ে গেছে রাজনীতি। অথচ রাজনীতির প্রকৃত অর্থ হলো ‘নীতির রাজা’। নীতি মানে ন্যায়। সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে যা, তা-ই রাজনীতি।

সেই প্রথাগত রাজনীতি এখন যেন উল্টো পথে হাঁটছে। সবচেয়ে আজব ঘটনা হচ্ছে, রাজনীতিবিদেরাই একে অপরের বিরুদ্ধে ‘রাজনীতি’ করার অভিযোগ আনছেন! সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপিরা পর্যন্ত বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাজনীতি করার অভিযোগ আনছেন। খুব সামান্য, সিধেসাদা ব্যাপার নিয়েও তাঁরা নাকি রাজনীতি করতে মাঠে নেমে পড়ছেন এবং তর্জনী তুলে একে অপরকে ‘রাজনীতি করবেন না’ বলে হুংকার ছাড়ছেন। বেশ! বুঝলাম, রাজনীতি করা ভালো কিছু নয়, অন্তত তা বক্তার অনুমোদনযোগ্য নয়। রাজনীতি তো করেন না, তা হলে বক্তা-মন্ত্রী করেনটা কী! তিনি কি তাহলে রাজনীতির লোক নন?

ত্রৈলোক্যনাথ নেই বটে, তবে গল্পের গরু শুধু গাছেই নয়, সে এখন আকাশেও চরছে! আমজনতাও ‘কুম্ভীর বিভ্রাট’ গল্পের মতো হাঁ করে তা দেখছে। পেটে খিদে চাপা থাক, ঘরে বেকার বসে থাক, শিক্ষা শিকেয় তোলা থাক, দূষণ পৃথিবীর মাথা খাক, ফুটপাত চুরি যাক, মানুষ পাখির মতো পরিযায়ী হোক; এসব নিয়ে ভাবতে গেলে চলে না, এতে তো আর রাজনীতির ‘টিআরপি’ বাড়ে না। রাজনীতিবিদদের ব্যস্ত থাকতে হয় তদবির, গালি, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমানি, না জানি আরও কত মানি-আনি নিয়ে।

রাজনীতিতে এখন বক্তৃতাবাজি আছে, আত্মপ্রশংসা, আত্মপ্রচার আছে, চটকদারি কথার ফুলঝুরি আছে। আছে ধর্ম, ধর্ম অবমাননা, ফেসবুক, ট্রোল, ফিতাকাটা, দড়ি, বাঁশ। কিছু নেতাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি, দড়ি টানাটানি আছে। আছে দলবদল, ভোলবদল, শিবিরবদল, সুরবদল, পালাবদল, মালাবদল। সোনার বাংলা, কেচ্ছা-কাহিনি, গালাগাল থেকে আন্দোলন, আস্ফালন, রঙ্গমঞ্চে সবই আছে। শুধু মানুষই গায়েব। মানুষ যেন পাখা গজানো পিপীলিকা মাত্র, আলোর লোভে স্রেফ আগুনে পুড়ছে! পুড়েই চলেছে। তা পুড়ুক, সবকিছু চাপা দেওয়ার জন্য ধামা আছে, আইন আছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও আছে।
রাজনীতিতে এখন উপসর্গ-অনুসর্গহীন ঠিক অথবা বেঠিক, ন্যায় অথবা অন্যায় বলে কিছু হয় না। এখন একটা খুনের উত্তর আগের দুটো খুন, শ্লীলতাহানির উত্তর ধর্ষণ, ব্ল্যাকমানির উত্তর আরও ব্ল্যাকমানি, এদের আঁতলামির উত্তর ওদের ফাজলামি।

রাজনীতি এখন নীতির আলোকে জনগণকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা নয়! রাজনীতি মানে এখন নেতিবাচক অর্থে লাফালাফি করে চমক এবং ধমকের মহড়া। একই উন্নয়নসংগীত গেয়ে গেয়ে সবার মগজধোলাইয়ের চেষ্টা। এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে ‘দলীয় সংগীত’। যে সংগীত গাইলে দল খুশি হয়, সবাই সেই সংগীতই গায়। মোসাহেবি, চাটুকারিতা এখন জননীতি। রাজনীতির এই ‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে’ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের তুবড়িতে মজে জনতা। টেক নিউজ, ফেক নিউজে সরগরম সোশ্যাল মিডিয়া। লাইক, শেয়ার, কমেন্ট। আগে সবাই বলত, সত্যের উল্টো দিকে মিথ্যে থাকে। ইদানীং মাঝখানে অর্ধসত্য নামে বিস্ময়কর এক বিষয় এসে বিস্তর হট্টগোল বাধাচ্ছে। নৈতিকতাবাদ এবং বাস্তবতাবাদ পুরোপুরিই বাদ। শুধু রাজনীতি বললে এখন কিছু বুঝে ওঠা মুশকিল, তার সঙ্গে পলিটিকস শব্দটা লাগাতে হয়।

রাজনীতিতে পলিটিকস ঢুকে গিয়েই কি তবে এমন সর্বনাশ ঘটল? রাজনীতি কি তার অর্থের মানবদল এবং ভোলবদল সেরে রাজপথ ছেড়ে গলিপথের অন্ধকারে পথ হারাল? নাকি বহতা নদীর মতো রাজনীতিও দুটি তীর নিয়ে চলছে, এপার ভেঙে ওপার গড়ছে? রাজনীতি কি তার রাজসিংহাসন, নীতিনৈতিকতা ভেঙে ভেঙে হিংসা, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্রের পলি জমিয়ে অন্য পাড়ে সমভূমি গড়ছে? নাকি রাজনীতিতে পুরোপুরিই পলিটিকসে গায়েব হয়ে গেল?

চিররঞ্জন সরকার, গবেষক ও কলামিস্ট  

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ