Ajker Patrika

জীবনের চড়াই-উতরাই

নাফিসা চৌধুরী
আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১০: ৩৫
জীবনের চড়াই-উতরাই

মোটামুটি উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম হলেও বড় চাচা আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেন যখন আমি ক্লাস টুতে পড়ি। কারণ, আমার বাবা আলাদা ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এদিকে ব্যবসায়ের সমিতির কাগজে কার্বন রেখে সই করিয়ে সেটিও চাচা তাঁর এক ছেলের নামে করে ফেলেছিলেন। সে সময় এসব করা সহজ ছিল। আর আমার চাচা নিজের বোনেরা বিপদে পড়লে তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তির অংশ অর্ধেক দামে বিক্রি করে সাহায্য করা মানুষ। বলছি ১৯৯৯ সালের কথা। এরপর আমাদের জীবনে মধ্যবিত্ত দশার সূত্রপাত হয়। এরপর থেকে কষ্ট, মায়ের অসুস্থতা, বাবার মেজাজ আর মার খেয়ে কম বয়সেই মানসিক বয়স বেড়ে যায়। বাবা-মায়ের কাছে কখনো কিছু চাইনি। পরীক্ষার ফলাফল খুব ভালো না কেন, সে জন্য মার খেয়েছি। আর অনেক সময় অকারণেই বাবা মেরেছেন। বাবা তো মারতেই পারেন! তিনি যা বলেন একবারে তা না শুনলেই সমস্যা।

আমার এ পর্যন্ত পড়াশোনার খরচ বাবা দিয়েছেন, বাকি আমার যা প্রয়োজন তা আমি টিউশনি করে জোগাড় করেছি। কলেজের প্রথম বর্ষ থেকেই টিউশনি শুরু করি। এ সময় থেকে আমার বাবার সঙ্গে ঝামেলা শুরু, মানে মতের অমিল। বাবা বলেন, ‘কিসের অভাব, খাওয়াপরা তো চলছেই, টিউশনি করলে আত্মীয়রা কী বলবে!’ আমি ছোট থেকেই কেমন যেন প্রতিবাদী, অন্যায় দেখেছি অনেক, হয়তো তাই। মায়ের লুকানো কান্নাগুলো দেখতাম, হয়তো তাই।

বাবার সঙ্গে প্রতিবাদ করে টিউশনি শুরু। এসএসসি পরীক্ষায় ‘এ প্লাস’ পাইনি তাই বাবা রেগে ছিলেন। এরপর এইচএসসিতে প্রাইভেট কলেজে নিজেই ভর্তি করিয়ে দিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পাওয়ায় একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভর্তি করিয়ে দেন। বাবাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু ভয় সবকিছু আড়াল করে রাখত।

আমার নিজের কিছু ভালো লাগা বা শখের জায়গা ছিল। আমি এক এক করে নিজের উপার্জনের টাকায় নিজের ইচ্ছেগুলো পূরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই কলেজে আবৃত্তি পরিষদে যুক্ত হয়ে লুকিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে থাকলাম। কলেজ শেষে বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত হয়েছিলাম চর্চা রাখার জন্য। ‘টিউশনি করতে যাই’ বলে এসব কথা বাসায় লুকাতাম। এরপর বেহালা বাজানো শেখা শুরু করলাম, কবিতার সঙ্গে নিজের মিউজিক নিজেই করা যাবে। আর বাসায় হেড়ে গলায় গান গেয়ে সারা জীবনই বকা শুনলাম।

কিন্তু বাবা-মা আমাদের তিন ভাইবোনকে মানুষ করতে করতে আর জীবনের এত কষ্ট পার করার মাঝে শখ বা ভালো লাগাকে হয়তো বিলাসিতাই ভাবতেন। আমার নিজ থেকে কখনো বলার সাহস হয়নি, ‘মা, আমি গান শিখতে চাই, পিয়ানো বাজাতে চাই।’ কারণ, আমি বড় মেয়ে, আমাকে কাজের দিক থেকে ছেলে হতে হবে, মা এটাই বোঝাতেন। দায়িত্ব নিতে হবে, পড়াশোনা করে চাকরি করতে হবে।

বাবা কিন্তু এসব বলতেন না। বাবা কড়া মানুষ, অত্যন্ত সৎ। বাবা বলতেন, ‘পড়াশোনা করো, টাকাপয়সা, সম্পত্তি তো দিয়ে যেতে পারব না। নিজে যেন কিছু করে খেতে পারো, ভবিষ্যতের কথা তো বলা যায় না।’ না জানিয়ে বেহালা শেখা, আবৃত্তি করা এবং টিউশনি করার অপরাধে দুই বছর বাবা কথা বলেননি। তবে শেষ পর্যন্ত আমার সফলতায় বাবা বেজায় আনন্দিত। বাবারা সব সময় সবকিছু হয়তো প্রকাশ করতে পারেন না। তাঁদেরও না-বলা কথা থাকে, থাকে নীরব কান্না।

আমাদের দেশে আমার মতো অবস্থা হয়তো আরও অনেক মেয়ের ভাগ্যেই ঘটে। অভিভাবকদের কড়া শাসন ও নজরদারি কত মেয়ের জীবন বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার হিসাব কে রাখে! তবে জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রবহমানতা আছে, স্রোতের মতো। কখনো বাধা দিলে বাঁকা পথ নেয়। যারা আমার মতো ব্যক্তিগত ইচ্ছাপূরণের কিছু শাসন মেনে, কিছু না মেনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখে, তারা হয়তো সব পাওয়ার তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত। কিন্তু কিছু পাওয়ার আনন্দটুকু সারাক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকে।

নাফিসা চৌধুরী, সংস্কৃতিকর্মী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...