Ajker Patrika

৪৭ বছরের পুরোনো দুটি মহাকাশযানের বৈজ্ঞানিক যন্ত্র বন্ধ করছে নাসা

আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৫, ১১: ৪২
১৯৭৭ সালে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ভয়েজার মহাকাশযান দুটি উৎক্ষেপণ হয়। ছবি: নাসা
১৯৭৭ সালে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ভয়েজার মহাকাশযান দুটি উৎক্ষেপণ হয়। ছবি: নাসা

পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত মহাকাশযান ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২-এর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রগুলো বন্ধ করতে যাচ্ছে নাসা। এর মাধ্যমে মহাকাশযানগুলো শক্তি সঞ্চয় করবে এবং আরও দীর্ঘদিন মিশন চালিয়ে যেতে পারবে। মহাকাশযান দুটি প্রায় ৪৭ বছর আগে পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণ করে নাসা।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ভয়েজার-১-এর কসমিক রে সাব সিস্টেম পরীক্ষা বন্ধ করার নির্দেশ পাঠিয়েছেন নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির (জেপিএল) প্রকৌশলীরা। অন্যদিকে, ২৪ মার্চ ভয়েজার-২-এর লো-এনার্জি চার্জড পার্টিকল যন্ত্র বন্ধ করা হবে। এর ফলে প্রতিটি মহাকাশযানে এখন তিনটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্র কার্যকর থাকবে।

১৯৭৭ সালে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ভয়েজার মহাকাশযান দুটি উৎক্ষেপণ করা হয়। দুটি মহাকাশযান একসঙ্গে ১০ বৈজ্ঞানিক যন্ত্র বহন করছিল। তবে, সময়ের সঙ্গে তাদের শক্তি সরবরাহ ধীরে ধীরে কমে গেছে। ভয়েজার মহাকাশযান দুটি প্লুটোনিয়ামের তাপশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করত এবং প্রতিবছর ৪ ওয়াট বিদ্যুৎশক্তি খরচ করছে।

ভয়েজার প্রকল্প ব্যবস্থাপক সুজান ডড নাসা বলেন, ‘ভয়েজাররা উৎক্ষেপণের পর থেকে মহাকাশের এক অপ্রতিরোধ্য নক্ষত্র হয়ে উঠেছে এবং আমরা চাই যেন এটি যতটা সম্ভব চলতে থাকে। তবে, বিদ্যুৎ শক্তির সরবরাহ কমে যাচ্ছে। যদি এখনই কোনো যন্ত্র বন্ধ না করা হয়, তাহলে হয়তো কয়েক মাসের মধ্যেই মিশন শেষ ঘোষণা করতে হবে।’

অজানা মহাকাশের অনুসন্ধান

ভয়েজার-১ বর্তমানে পৃথিবী থেকে ১৫ বিলিয়ন মাইল (২৫ বিলিয়ন কিলোমিটার) দূরে এবং ভয়েজার-২ ১৩ বিলিয়ন মাইল (২১ বিলিয়ন কিলোমিটার) দূরে অবস্থান করছে। তারা বর্তমানে সোলার হেলিওস্ফিয়ারি (সূর্যের পারিপার্শ্বিক চুম্বকক্ষেত্র ও কণার বলয়) থেকে বাইরে মহাশূন্যের অন্যান্য অঞ্চলে অনুসন্ধান করছে।

১৯৮০-র দশকে সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহগুলোর কাছে গিয়ে মিশনের প্রথম লক্ষ্য পূর্ণ করার পর ভয়েজার যন্ত্রগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে বিজ্ঞানীরা তাদের অজানা মহাশূন্যের পরিসরে তথ্য সংগ্রহ চালিয়ে যাচ্ছে।

২০১২ সালে ইন্টারস্টেলার স্পেস বা আন্তনক্ষত্রীয় স্থানে প্রবেশ করে ভয়েজার-১। ২০১৮ সালে একই কাজ করে ভয়েজার-২। তবে দুটি মহাকাশযানের যাত্রাপথ আলাদা ছিল। মহাকাশযান দুটি ভিন্ন পথে থাকায় এগুলো মহাশূন্যের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের অনুসন্ধানে করেছে, যা সৌরজগতের বাইরের অজানা বিশ্ব সম্পর্কে আরও মূল্যবান তথ্য প্রদান করে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভয়েজার প্রকল্পের দল একে একে যন্ত্রগুলো বন্ধ করে দিয়েছে, যাতে মহাকাশযানগুলোর যাত্রা চলতে থাকে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে নাসা ভয়েজার-২-এর প্লাজমা সায়েন্স যন্ত্র বন্ধ করে দিয়েছে। এই যন্ত্র মহাশূন্যে চার্জড পরমাণুর সংখ্যা পরিমাপ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। তবে মূলত এর অবস্থানের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর আউটপুট ডেটা সীমিত হয়ে গেছে। অপরদিকে, ভয়েজার-১-এর অভিন্ন যন্ত্রটি বহু বছর ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে। কারণ তার কার্যক্ষমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পেয়েছে।

গত সপ্তাহে, ভয়েজার-১-এর কসমিক রে সাবসিস্টেম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যা তিনটি টেলিস্কোপের সমন্বয়ে তৈরি একটি যন্ত্র ছিল। এই টেলিস্কোপগুলো মহাশূন্যে অত্যন্ত শক্তিশালী মহাজাগতিক বিকিরণ পরিমাপ এবং পর্যবেক্ষণ করত। এসব বিকিরণ আমাদের সৌরজগৎ ও সূর্য থেকে নির্গত হয়।

ভয়েজার প্রকল্পের দল এই যন্ত্রের মাধ্যমে মহাকাশযানটির তথ্য সংগ্রহ করেছিল এবং এর সাহায্যে তারা নির্দিষ্টভাবে জানতে পেরেছিল কখন এবং কোথায় ভয়েজার-১ হেলিওস্ফিয়ার (সূর্যের চুম্বকীয় বলয়) অতিক্রম করে ইন্টারস্টেলার স্পেস বা আন্তনক্ষত্রীয় স্থানে প্রবেশ করেছে।

এ মাসের শেষে ভয়েজার-২-এর লো-এনার্জি চার্জড পার্টিকল যন্ত্র বন্ধ করে দেওয়া হবে, যা সৌরজগৎ ও আমাদের গ্যালাক্সিতে আয়ন, ইলেকট্রন এবং কসমিক রে পরিমাপ করে। এই যন্ত্রের বিভিন্ন সিস্টেমে একটি টেলিস্কোপ ও ম্যাগনেটোস্ফেরিক পার্টিকল অ্যানালাইজার (চুম্বকীয় কণা পর্যবেক্ষণকারী) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যার ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ রয়েছে এবং একটি ঘূর্ণনশীল প্ল্যাটফর্ম স্টেপার মোটরের মাধ্যমে চলে।

পৃথিবীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এই মোটর ৫ লাখ ধাপ পার করে। এই পরীক্ষা নিশ্চিত করেছিল যে, ১৯৮০ সালে শনি গ্রহের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় ভয়েজার-২ সফলভাবে কাজ করবে। এখন, যখন এটি বন্ধ হবে, মোটরটি ৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন ধাপেরও বেশি সম্পন্ন করবে।

ভয়েজার প্রকল্পের বিজ্ঞানী লিন্ডা স্পিলকার বলেন, প্রতিটি মহাকাশযান এখনো অনন্য ডেটা সংগ্রহ করতে থাকবে। তবে, একটি বড় পরিবর্তন আসছে, কারণ তারা ইন্টারস্টেলার স্পেসে (আন্তনক্ষত্রীয় মহাশূন্য) দুটি ভিন্ন স্থানে একসঙ্গে একই ধরনের কণার পরিমাপ করতে পারবে না।

যতই ভয়েজার মহাকাশযানগুলোর বয়স বাড়ছে, ততই প্রকল্পের প্রকৌশলীরা নতুন এবং অপ্রত্যাশিত সমস্যাগুলোর সমাধানে আরও সৃজনশীল হয়ে উঠছেন। যেমন: যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং অনন্য ত্রুটিগুলো মোকাবিলা করা। মহাশূন্যে বিশাল দূরত্বের কারণে এসব সমস্যার সমাধান খুবই চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। তবে প্রকৌশলীরা নতুন প্রযুক্তি ও নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে তাঁদের কার্যক্ষমতা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন।

দুটি যন্ত্র বন্ধ করার পর উভয় ভয়েজার মহাকাশযান আরও একটি বছর পর্যন্ত কাজ করতে সক্ষম হবে। এরপর, প্রতি মহাকাশযানে একটি করে অতিরিক্ত যন্ত্র বন্ধ করতে হবে। ২০২৬ সালে, ভয়েজার-১-এর লো-এনার্জি চার্জড পার্টিকল যন্ত্র এবং ভয়েজার-২-এর কসমিক রে সাবসিস্টেম বন্ধ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

তবে ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২ তাদের যাত্রা চালিয়ে যাবে। কারণ তাদের প্লাজমা ওয়েভ সাবসিস্টেম এবং ম্যাগনেটোমিটার যন্ত্র চালু থাকবে। প্লাজমা ওয়েভ সাবসিস্টেম মহাশূন্যের প্লাজমা ক্ষেত্রের মধ্যে তরঙ্গ পরিমাপ করে এবং ম্যাগনেটোমিটার চুম্বকীয় ক্ষেত্রের পরিবর্তন পরিমাপ করে।

ভয়েজার প্রকল্পের বিজ্ঞানী লিন্ডা স্পিলকার বলেন, ‘উভয় ভয়েজারই কসমিক রে (মহাজাগতিক বিকিরণ), আন্তনক্ষত্রীয় প্লাজমা, আন্তনক্ষত্রীয় চুম্বকীয় ক্ষেত্র এবং আন্তনক্ষত্রীয় মাধ্যমের রেডিও তরঙ্গ সম্পর্কে অনন্য তথ্য সংগ্রহ করতে থাকবে, যার মধ্যে সূর্য থেকে ছড়ানো প্রভাবও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

নাসার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মহাকাশযানগুলো যথেষ্ট শক্তি সংরক্ষণ করতে পারবে, যাতে ২০৩০–এর দশক পর্যন্ত কমপক্ষে একটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্র চালু রাখা সম্ভব হবে। তবে তারা জানেন যে, যেকোনো নতুন চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা আসতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত ভয়েজার মহাকাশযানগুলোর যাত্রার অবসান ঘটাতে পারে।

তথ্যসূত্র: সিএনএন ও নাসা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ভারতের প্রথম জিনগতভাবে পরিবর্তিত ভেড়া এক বছরে পা দিল, কেমন আছে সে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভারতের প্রথম জিনগতভাবে পরিবর্তিত ভেড়াটি সম্প্রতি এক বছর পূর্ণ করেছে। সে ভালোই আছে বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।

ভারতশাসিত কাশ্মীরে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ভেড়াটির জন্ম হয়। এর নাম রাখা হয় তারমিম; আরবি ভাষায় যার অর্থ পরিবর্তন বা সম্পাদনা।

শ্রীনগরের শের-ই-কাশ্মীর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেড়াটিকে একটি আলাদা খাঁচায় রাখা হয়েছে। সেখানে তার সঙ্গে রয়েছে তার জিনগতভাবে অপরিবর্তিত যমজ বোনটিও।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ভেড়াটি পরিবর্তনে তারা ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। এটি ডিএনএ পরিবর্তনের একটি আধুনিক জৈবপ্রযুক্তি।

সহজভাবে বললে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কাঁচির মতো ডিএনএর এমন অংশ কেটে ফেলতে পারেন, যেগুলো দুর্বলতা বা রোগ সৃষ্টি করে।

গবেষক ড. সুহাইল মাগরে বিবিসিকে বলেন, ‘গর্ভবতী ভেড়ার শরীর থেকে আমরা বেশ কয়েকটি ভ্রূণ সংগ্রহ করি এবং একটি নির্দিষ্ট জিন–যাকে মায়োস্টাটিন জিন বলা হয়, সম্পাদনা করি। এই জিনটি পেশির বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে।’

নিষিক্ত ডিম্বাণু বা ভ্রূণগুলোকে দুই থেকে তিন দিন ল্যাবরেটরির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রাখা হয়। এরপর সেগুলো একটি স্ত্রী ভেড়ার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়, যাকে ফস্টার রিসিপিয়েন্ট বলা হয়।

ড. সুহাইল মাগরে বলেন, ‘এরপর প্রকৃতি তার কাজ করেছে। প্রায় ১৫০ দিন পর বাচ্চা জন্ম নেয়। আমাদের লক্ষ্য ছিল ভেড়ার পেশির পরিমাণ বাড়ানো। মায়োস্টাটিন জিন নিষ্ক্রিয় করার মাধ্যমে আমরা তা সফলভাবে করতে পেরেছি।’

চলতি মাসের শুরুতে তারমিম এক বছর পূর্ণ করার পর প্রকল্পটির প্রধান গবেষক ও অধ্যাপক রিয়াজ শাহ বিবিসিকে ভেড়াটির বর্তমান অবস্থা জানান।

তিনি বলেন, ‘তারমিম ভালোভাবে বেড়ে উঠছে। এর শারীরবৃত্তীয়, জৈব-রাসায়নিক ও শারীরিক সব সূচকই স্বাভাবিক রয়েছে। প্রত্যাশিতভাবে তারমিমের পেশির বৃদ্ধি তার অ-সম্পাদিত যমজ বোনের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পার্থক্য আরও বাড়তে পারে বলে আমরা মনে করি।’

অধ্যাপক শাহ বলেন, ভেড়াটির স্বাস্থ্য ও টিকে থাকার সক্ষমতা যাচাই করতে এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। কঠোর নজরদারির মধ্যে নিরাপদ পরিবেশে ভেড়াটিকে রাখা হয়েছে।

তিনি জানান, গবেষণার জন্য সরকারি অর্থায়ন পেতে তারা একটি প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিয়েছেন।

গবেষণা ও চিকিৎসার লক্ষ্যে বহু দশক ধরে ভেড়ার জিনগত পরিবর্তন এবং জিন সম্পাদনা করা হচ্ছে। নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাজ্যের ট্রেসি নামের ভেড়াটি ছিল এর বড় উদাহরণ; যা তার দুধের মাধ্যমে বিশেষ প্রোটিন তৈরি করতে পারত। বর্তমানে ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে পেশির বৃদ্ধি, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও প্রজননক্ষমতার মতো বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে।

তারমিমের জন্য ভারতের আট সদস্যের গবেষক দল টানা সাত বছর ধরে কাজ করছে।

অধ্যাপক শাহ বলেন, ‘শুরুর দিকে কিছু ব্যর্থতা ছিল। আমরা একাধিক কৌশল প্রয়োগ করেছি। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সাফল্য আসে। আমরা সাতটি আইভিএফ প্রক্রিয়া চালাই। এর মধ্যে পাঁচটি জীবিত বাচ্চা জন্ম নেয় এবং দুটি গর্ভপাত ঘটে। জিন সম্পাদনা সফল হয়েছে কেবল একটির ক্ষেত্রে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেছিলাম। এখন পুরো প্রক্রিয়াটি মানসম্মতভাবে স্থির করা গেছে। ভবিষ্যতে সাফল্যের হার অনেক বেশি হবে বলে আমি আশাবাদী।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

২০২৫ সালে যেসব ঐতিহাসিক রহস্যের সমাধান দিল বিজ্ঞান

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ডেনমার্কে সংরক্ষিত ২ হাজার বছর আগের হিয়র্টস্প্রিং নৌকা। ছবি: সংগৃহীত
ডেনমার্কে সংরক্ষিত ২ হাজার বছর আগের হিয়র্টস্প্রিং নৌকা। ছবি: সংগৃহীত

দশকের পর দশক কিংবা শতাব্দীকাল ধরে মানবসভ্যতার নানা অধ্যায়ে জমে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে বিশ্বজুড়ে এ বছর গবেষকেরা যেন গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রত্নতত্ত্ব, জেনেটিক বিজ্ঞান, মাইক্রোবায়োলজি ও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় ২০২৫ সালে উন্মোচিত হয়েছে বহু ঐতিহাসিক রহস্য।

মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানিয়েছে, প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে বিদায়ী এই বছরটিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ইস্টার আইল্যান্ডের একটি খনিতে পড়ে থাকা অসমাপ্ত পাথরের মূর্তিগুলো বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা জানতে পেরেছেন, প্রাচীন পলিনেশীয়রা কীভাবে পাহাড় কেটে ধাপে ধাপে বিশাল মোয়াই মূর্তি তৈরি করত।

এদিকে, ইতালির পম্পেই নগরীতে নতুন করে খননকাজ শুরু হওয়ার পর একটি পাথরের সিঁড়ি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা ৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ভয়াবহ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংস হওয়ার আগে শহরটি দেখতে কেমন ছিল তা জানতে সহায়তা করেছে।

পেরুর আন্দিজ পর্বতমালায় ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫ হাজার ২০০টি গর্ত নিয়েও নতুন ধারণা দিয়েছেন গবেষকেরা। এই গর্তগুলোর নির্মাতা কারা এবং কেন এগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল—ড্রোন ফুটেজ ও উদ্ভিদকণা বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে।

কিছু গবেষণা আবার নতুন প্রশ্নও উসকে দিয়েছে। যেমন—চিকিৎসা নথি না থাকায় বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জেন অস্টেনের মৃত্যুর কারণ জানতে গবেষকেরা তাঁর লেখার ভাষা ও শব্দচয়ন বিশ্লেষণ করছেন।

রহস্যময় এই মমিটির পরিচয় উদ্ঘাটন হয়েছে। ছবি: সিএনএন
রহস্যময় এই মমিটির পরিচয় উদ্ঘাটন হয়েছে। ছবি: সিএনএন

এ বছর ঐতিহাসিক বিষয়ে আলোচিত আবিষ্কারগুলোর একটি হলো, অস্ট্রিয়ার প্রত্যন্ত গির্জায় সংরক্ষিত রহস্যময় একটি মমি। ১৭০০ সাল থেকে ‘বাতাসে শুকানো যাজক’ নামে পরিচিত এই দেহটির পরিচয় দীর্ঘদিন অজানা ছিল। আধুনিক স্ক্যান ও রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে জানা গেছে, তিনি ছিলেন ফ্রাঞ্জ জাভের সিডলার ফন রোজেনেগ নামে একজন অভিজাত ব্যক্তি। পরবর্তীতে তিনি গির্জার যাজক হয়েছিলেন। গবেষকেরা তাঁর দেহ সংরক্ষণের এক অজানা পদ্ধতি ও মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণও চিহ্নিত করেছেন।

এদিকে ডেনমার্কে সংরক্ষিত হিয়র্টস্প্রিং নৌকাটির উৎস নিয়েও রহস্যের পর্দা উঠেছে। ২০০০ বছরেরও বেশি সময় আগের এই নৌকাটি অস্ত্রে ভরা ছিল, যা ইঙ্গিত দেয় এটি দ্বীপে আক্রমণ করার উদ্দেশে যোদ্ধাদের বহন করছিল। বিশ্লেষণে একটি আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। এটিকে তৎকালীন কোনো নাবিকের সরাসরি প্রমাণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রমাণ মিলেছে—অভিযাত্রী আর্নেস্ট শ্যাকলটনের জাহাজ এইচএমএস অ্যান্ডিউরেন্স ভাঙা স্টিয়ারিং নয়, বরং কাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই ডুবে গিয়েছিল।

১৪ হাজার বছর আগের এই দুটি প্রাণীকে ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়েছিল। ছবি: সিএনএন
১৪ হাজার বছর আগের এই দুটি প্রাণীকে ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়েছিল। ছবি: সিএনএন

১৪ হাজার বছর আগে বরফ যুগের ‘টুমাট পাপিজ’ নামে পরিচিত দুটি সংরক্ষিত শাবককে এত দিন গৃহপালিত কুকুর মনে করা হলেও নতুন জেনেটিক গবেষণায় জানা গেছে, এগুলো আসলে নেকড়ে শাবক ছিল এবং মানুষের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

এ ছাড়া ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযান নিয়েও নতুন তথ্য মিলেছে। সেই সময়ে নিহত ফরাসি সেনাদের দাঁতের নমুনা বিশ্লেষণ করে টাইফাসের পাশাপাশি প্যারাটাইফয়েড ও রিল্যাপসিং ফিভারের জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা ওই বাহিনীর বিপুল প্রাণহানির অন্যতম কারণ হতে পারে।

সব মিলিয়ে, ২০২৫ সাল বিজ্ঞানের হাত ধরে ইতিহাসের বহু অন্ধকার কোণ আলোকিত করেছে এবং আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে মানবসভ্যতার দীর্ঘ ও জটিল পথচলা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কক্ষপথে স্যাটেলাইট সংঘর্ষের ঝুঁকি নিয়ে বিজ্ঞানীদের ‘ক্র্যাশ ক্লক’ সতর্কতা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: নিও সায়েন্টিস্ট
ছবি: নিও সায়েন্টিস্ট

কোনো বড় ধরনের সৌরঝড় বা প্রযুক্তিগত বিপর্যয়ের কারণে যদি পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইটগুলো হঠাৎ নিজেদের গতিপথ পরিবর্তনের সক্ষমতা হারায়, তবে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ভয়াবহ সংঘর্ষ শুরু হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। নতুন এক গবেষণা বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সব স্যাটেলাইট একযোগে অচল হয়ে পড়লে প্রথম সংঘর্ষ ঘটতে সময় লাগবে গড়ে মাত্র ২.৮ দিন।

গত সাত বছরে পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইটের সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে প্রায় ৪ হাজার স্যাটেলাইট ছিল, এখন সেই সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজারে পৌঁছেছে। এই বিস্ফোরণধর্মী বৃদ্ধির পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে স্পেসএক্সের স্টারলিংক প্রকল্প। নিম্ন-পৃথিবী কক্ষপথে (৩৪০ থেকে ৫৫০ কিলোমিটার উচ্চতায়) বর্তমানে স্টারলিংকের স্যাটেলাইটই রয়েছে ৯ হাজারের বেশি।

কক্ষপথে এত বেশি স্যাটেলাইট থাকার কারণে নিয়মিত সংঘর্ষ এড়াতে ‘কলিশন অ্যাভয়ডেন্স ম্যানুভার’ বা গতিপথ পরিবর্তনের কৌশল নিতে হয়। স্পেসএক্স জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ৩১ মে পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে তারা ১ লাখ ৪৪ হাজারেরও বেশি সংঘর্ষ এড়ানোর কৌশল প্রয়োগ করেছে।

গত মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে নিও সায়েন্টিস্ট জানিয়েছে, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সারা থিয়েল ও তাঁর সহকর্মীরা স্যাটেলাইটের অবস্থানসংক্রান্ত উন্মুক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে সংঘর্ষ ঝুঁকি পরিমাপের জন্য নতুন একটি সূচক তৈরি করেছেন। এই সূচকের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ক্র্যাশ ক্লক’।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে যদি সব স্যাটেলাইট হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারাত, তবে প্রথম সংঘর্ষ হতে সময় লাগত প্রায় ১২১ দিন। কিন্তু বর্তমানে সেই সময় নেমে এসেছে মাত্র ২.৮ দিনে। এই তথ্য বিজ্ঞানীদেরও বিস্মিত করেছে।

সব স্যাটেলাইট একসঙ্গে অচল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম হলেও ২০২৪ সালের মে মাসে শক্তিশালী সৌরঝড়ে স্টারলিংক স্যাটেলাইটগুলোতে অস্বাভাবিক ঢেউয়ের মতো প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী সৌরঝড় হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন—আগামী বছরগুলোতে স্পেসএক্স, অ্যামাজন ও চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আরও হাজার হাজার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে। ফলে কক্ষপথে ভিড় আরও বাড়বে, আর ‘ক্র্যাশ ক্লক’-এর সময়সীমা আরও এগিয়ে আসবে। এই পরিস্থিতি মহাকাশ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা সামনে আনছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ইতালির পার্কে মিলল ২১ কোটি বছর আগের হাজার হাজার ডাইনোসরের পায়ের ছাপ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭: ৪৫
একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই পায়ের ছাপগুলো এক আলোকচিত্রীর চোখে ধরা পড়ে। ছবি: বিবিসি
একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই পায়ের ছাপগুলো এক আলোকচিত্রীর চোখে ধরা পড়ে। ছবি: বিবিসি

উত্তর ইতালির একটি ন্যাশনাল পার্কে ২১ কোটি বছর আগের ডাইনোসরের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। তাও আবার একটি-দুটি নয়, হাজার হাজার। এই পায়ের ছাপগুলোর কয়েকটির ব্যাস ১৫ ইঞ্চি পর্যন্ত। আর এগুলো সমান্তরাল সারিতে সাজানো। এসবের মধ্যে অনেকগুলোতে আঙুল ও নখের ছাপ স্পষ্ট বোঝা গেছে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে জানা গেছে।

ধারণা করা হচ্ছে, এই ডাইনোসরগুলো ছিল ‘প্রোসাওরোপড’ (prosauropod) প্রজাতির। এ প্রজাতির ডাইনোসরের গলা লম্বা ও মাথা ছোট এবং ধারালো নখবিশিষ্ট তৃণভোজী প্রাণী ছিল।

মিলানভিত্তিক জীবাশ্মবিদ ক্রিস্টিয়ানো ডাল সাসো বলেন, ‘কখনো কল্পনাও করিনি, আমি যে অঞ্চলে বাস করি, সেখানেই এমন এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের দেখা পাব।’

গত সেপ্টেম্বরে মিলানের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত স্টেলভিও ন্যাশনাল পার্কের একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই পায়ের ছাপগুলো একজন আলোকচিত্রীর চোখে ধরা পড়ে।

বিবিসির প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০ থেকে ২৫ কোটি বছর আগে ট্রায়াসিক যুগে এই পাহাড়ের অংশটি ছিল একটি সমুদ্র তীরবর্তী সমতল ভূমি, যা পরে আল্পাইন পর্বতমালায় রূপান্তরিত হয়।

ডাল সাসো আরও বলেন, এই জায়গা ডাইনোসরে পরিপূর্ণ ছিল; এটি একটি বিশাল বৈজ্ঞানিক সম্পদ।

ডাল সাসো আরও যোগ করেন, ডাইনোসরের দলগুলো সুশৃঙ্খলভাবে চলাচল করত এবং সেখানে আরও কিছু চিহ্ন পাওয়া গেছে, যেগুলো থেকে মনে হয়, পশুরা আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে দলবদ্ধ হয়ে বৃত্তাকারে অবস্থান নিত।

আবিষ্কারকেরা বলছেন, প্রোসাওরোপডগুলো ১০ মিটার বা ৩৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারত। তারা সাধারণত দুই পায়ে হাঁটত, তবে কিছু ক্ষেত্রে পায়ের ছাপের সামনে হাতের ছাপও পাওয়া গেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, তারা সম্ভবত মাঝেমধ্যে থেমে বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাদের সামনের পা মাটিতে রাখত।

আলোকচিত্রী এলিয়ো ডেলা ফেরেরা এই স্থান আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এই আবিষ্কার আমাদের সবার মধ্যে ভাবনার খোরাক জোগাবে এবং আমরা যেখানে বাস করি, আমাদের ঘর, আমাদের পৃথিবী, এই জায়গাগুলো সম্পর্কে আমরা কতটা কম জানি, তা বোঝায়।’

ইতালির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এলাকাটি অত্যন্ত দুর্গম এবং যাতায়াতের কোনো পথ নেই। তাই গবেষণার কাজে ড্রোনের পাশাপাশি রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।

উল্লেখ্য, আগামী বছর ইতালিতে শীতকালীন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর ডাইনোসরের পায়ের ছাপ পাওয়া স্টেলভিও ন্যাশনাল পার্কটি সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ইতালির সীমান্তবর্তী ফ্রায়েল উপত্যকায় অবস্থিত। মন্ত্রণালয় জানায়, এটি যেন অনেকটা এমন যে, স্বয়ং ইতিহাসই বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ক্রীড়া ইভেন্টকে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছে; প্রকৃতি ও ক্রীড়ার মধ্যে এক প্রতীকী সেতুবন্ধনের মাধ্যমে অতীত ও বর্তমানকে এক সুতায় গেঁথেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত