Ajker Patrika

ভিড়ের দুই প্রান্তে থেকেও কথা বলা যাবে একান্তে, প্রযুক্তি উদ্ভাবন জাপানি বিজ্ঞানীদের

আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৫, ১২: ২০
এই প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা ব্যক্তির কাছে অডিও পাঠানো যাবে। ছবি: ফ্রি পিক
এই প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা ব্যক্তির কাছে অডিও পাঠানো যাবে। ছবি: ফ্রি পিক

কাউকে বিরক্ত না করে একা একা গান বা পডকাস্ট শোনার জন্য হেডফোন বা ইয়ারবাড ব্যবহার করেন অনেকেই। তবে মাঝে মাঝে এগুলো পরতে অস্বস্তি হতে পারে। সেই সঙ্গে এমন পরিস্থিতিও থাকতে পারে, যেখানে আপনি চান না তৃতীয় কোনো পক্ষ আপনার কথোপকথন শুনুক। এখন নতুন এক গবেষণায় এমন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা শব্দকে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ, প্রযুক্তিটি এমন একটি শব্দ তৈরি করতে পারে, যা শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় শোনা যাবে এবং আশপাশে কেউ শুনতে পাবে না। এর জন্য প্রয়োজনে শব্দের গতিপথও পরিবর্তন করা সম্ভব।

এই প্রযুক্তি বিনোদন, যোগাযোগ ও স্প্যাশিয়াল অডিও অভিজ্ঞতায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শব্দ কী

শব্দ হলো একটি কম্পন যা বায়ু বা অন্য কোনো মাধ্যম দিয়ে তরঙ্গ আকারে স্থানান্তরিত হয়। বায়ু বা অন্য কোনো মাধ্যমের অণুগুলো সংকুচিত ও সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে শব্দ তরঙ্গ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এই গতিপথটি সরলরৈখিক।

শব্দ কম্পনের তরঙ্গই পিচ নির্ধারণ করে। নিম্ন কম্পাঙ্কের শব্দ, যেমন: বেস ড্রাম, গভীর শোনা যায়। আর উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ, যেমন: শিস বা বাঁশি তীক্ষ্ণ শোনায়।

শব্দকে শুধু একটি নির্দিষ্ট জায়গায় শ্রবণযোগ্য করে তোলাটা কঠিন। কারণ শব্দতরঙ্গ উৎপত্তিস্থল থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনাকে ডিফ্যাকশন বলে। এই প্রভাবটি সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য হয় নিম্ন কম্পাঙ্কের শব্দের ক্ষেত্রে। কারণ এ ধরনের শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড় হয়। এর ফলে, শব্দকে নির্দিষ্ট অঞ্চলে আটকে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

সামান্য কিছু অডিও প্রযুক্তি, যেমন: প্যারামেট্রিক অ্যারে লাউডস্পিকার নির্দিষ্ট দিকে লক্ষ্য করে শব্দ তরঙ্গ পাঠাতে পারে। তবে, এই প্রযুক্তিগুলো এমন শব্দ তৈরি করে যা তরঙ্গের পুরো গতিপথে শোনা যায়।

২০ হার্টজের কম বা ২০ কিলোহার্টজের বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ মানুষ শুনতে পারে না। ২০ হার্টজের কম কম্পাঙ্কের শব্দকে বলে শ্রবণেতর শব্দ, আর ২০ কিলোহার্টজের বেশি কম্পাঙ্কের শব্দকে বলি শ্রবণোত্তর শব্দ।

নতুন প্রযুক্তি এবং ‘অডিও এনক্লেভস’

গবেষকেরা এমন একটি কৌশল উদ্ভাবন করেছেন, যা শব্দকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যেন তা নির্দিষ্ট স্থানেই শুধু বাজে। উৎপত্তিস্থল থেকে গতিপথে এই শব্দ থাকে একেবারে নীরব। এটি সম্ভব হয়েছে ‘সেল্ফ-বেন্ডিং আলট্রাসাউন্ড বিমস’ এবং ‘ননলিনিয়ার অ্যাকুস্টিকস’ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে।

আলট্রাসাউন্ড হলো—সেই ধরনের শব্দ তরঙ্গ যেগুলো মানুষের শ্রবণ পরিসরের ওপরে (২০ কিলোহার্টজের বেশি) হয়। এই শব্দ তরঙ্গগুলো বায়ুর মধ্য দিয়ে চলতে পারে, তবে মানুষ সেগুলো শুনতে পারে না। এই আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গ অনেক বস্তুকে ভেদ করতে পারে এবং বস্তুর সঙ্গে অনন্য উপায়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। তাই এটি মেডিকেল ইমেজিং এবং বহু শিল্প ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

এই আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানে শব্দকে পৌঁছাতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। এই কৌশলে শব্দকে নীরবে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা যায় এবং প্রয়োজন মতো শ্রবণযোগ্য করে তোলা যায়।

সাধারণত, একাধিক শব্দ তরঙ্গ সরল রৈখিকভাবে মিলিত হতে পারে, তখন বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের একক তরঙ্গে পরিণত হয়। এটিকে বলে সুপারপজিশন বা উপরিপাতন। তবে, যখন শব্দ তরঙ্গগুলো যথেষ্ট তীব্র হয়, অর্থাৎ এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হয় এবং কম্পাঙ্ক বেশি হয়, তখন এরা ‘অরৈখিক’ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। এর ফলে নতুন কম্পাঙ্কের শব্দতরঙ্গ তৈরি হয়।

এই কাজটি করতে গবেষকেরা দুটি আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গ ব্যবহার করেছেন, যেগুলোর কম্পাঙ্ক আলাদা এবং মানুষ শুনতে পারে না। কিন্তু যখন এই দুটি তরঙ্গ বায়ুতে পরস্পরকে ছেদ করে, তখন অরৈখিক প্রভাবের কারণে এরা একটি নতুন শব্দ তরঙ্গ তৈরি করে, যা শ্রবণযোগ্য কম্পাঙ্কে পরিণত হয় এবং শুধু ছেদ বিন্দুর ওই স্থানেই শোনা যায়। গবেষণায় এমন আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গ ডিজাইন করা হয় যা নিজে থেকেই বেঁকে যেতে পারে।

সাধারণভাবে, যতক্ষণ না কিছু বাধাগ্রস্ত বা প্রতিফলিত করে ততক্ষণ শব্দ তরঙ্গ সরল পথে চলে। তবে, ‘অ্যাকুস্টিক মেটাসারফেস’ (বিশেষ ধরনের উপকরণ যা শব্দ তরঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করে) ব্যবহার করে আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গগুলোকে এমনভাবে আকৃতি দেওয়া হয়, যাতে সেগুলো চলার পথে বেঁকে যায়।

যেমন: একটি অপটিক্যাল লেন্স আলোকে বাঁকিয়ে দেয়, যাকে আলোর প্রতিসরণ বলে, ঠিক তেমনি ‘অ্যাকুস্টিক মেটাসারফেস’ শব্দ তরঙ্গের পথ পরিবর্তন করে। আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গগুলোর ফেজ (ধ্বনি তরঙ্গের দশা) সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এমনভাবে গতিপথ বাঁকিয়ে দেওয়া হয় যে, উৎস ও শ্রোতার মধ্যবর্তী বাধা পেরিয়ে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে পারে।

এর পেছনে মূল ঘটনা হলো—ডিফারেন্স ফ্রিকোয়েন্সি জেনারেশন। যখন দুটি আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গ, যেমন: ৪০ কিলোহার্টজ এবং ৩৯ দশমিক ৫ কিলোহার্টজ, একে অপরকে ছেদ করে, তখন এরা তাদের কম্পাঙ্কের মধ্যে পার্থক্যের সমান কম্পাঙ্কের একটি নতুন শব্দ তরঙ্গ তৈরি করে। এই শব্দতরঙ্গ দশমিক ৫ কিলোহার্টজ বা ৫০০ হার্টজ, যা মানুষের শ্রবণ পরিসরের মধ্যে পড়ে। তবে শব্দটি শুধু সেই জায়গায় শোনা যায় যেখানে দুটি তরঙ্গ একে অপরকে ছেদ করে। সেই ছেদ অঞ্চলের বাইরে, আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গগুলো মানুষের শ্রবণযোগ্য থাকে না।

অর্থাৎ এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা ব্যক্তির কাছে অডিও পাঠানো যাবে। মধ্যবর্তী স্থানের কেউ শুনতে পাবে না। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যেও দুজন ব্যক্তি একান্তে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারবেন।

অডিও এনক্লেভস তৈরি করার সক্ষমতা অনেক সম্ভাবনাময় প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, জাদুঘরগুলো দর্শকদের জন্য আলাদা অডিও গাইড সরবরাহ করতে পারবে, আবার পাঠাগারে অন্যদের বিরক্ত না করে অডিও বুক শোনা যাবে।

এ ছাড়া গাড়িতে লাউডস্পিকার বাজিয়ে গান শোনার দরকার হবে না। ফলে সঠিকভাবে নির্দেশনা শুনতে চালককে সমস্যায় পড়তে হবে না। অফিস এবং সামরিক ক্ষেত্রে গোপন কথোপকথনের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা তৈরি করা যাবে।

এ ছাড়া, অডিও এনক্লেভস এমনভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে, যা নির্দিষ্ট অঞ্চলে শব্দদূষণ দূর করবে এবং কর্মক্ষেত্রে বা শহরের নির্দিষ্ট অঞ্চলে শান্ত পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে কর্মী বা নাগরিকেরা আরও মনোনিবেশ করে কাজ করতে পারবে।

তবে এই প্রযুক্তি খুব শিগগিরই জনসাধারণের জন্য ব্যবহারের উপযোগী হবে না। ননলিনিয়ার ডিস্টরশন শব্দের গুণগত মানকে প্রভাবিত করতে পারে। এ ছাড়া খরচও একটি বড় সমস্যা। কারণ আলট্রাসাউন্ডকে শ্রবণযোগ্য শব্দে রূপান্তর করতে উচ্চক্ষমতার ডিভাইস লাগবে, এতে প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হতে পারে।

এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যাকুস্টিক বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক জিয়াক্সিন ঝং পেন এবং অ্যাকুস্টিক বিভাগের অধ্যাপক ইউন ঝিং।

তথ্যসূত্র: জাপান টুডে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কক্ষপথে স্যাটেলাইট সংঘর্ষের ঝুঁকি নিয়ে বিজ্ঞানীদের ‘ক্র্যাশ ক্লক’ সতর্কতা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: নিও সায়েন্টিস্ট
ছবি: নিও সায়েন্টিস্ট

কোনো বড় ধরনের সৌরঝড় বা প্রযুক্তিগত বিপর্যয়ের কারণে যদি পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইটগুলো হঠাৎ নিজেদের গতিপথ পরিবর্তনের সক্ষমতা হারায়, তবে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ভয়াবহ সংঘর্ষ শুরু হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। নতুন এক গবেষণা বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সব স্যাটেলাইট একযোগে অচল হয়ে পড়লে প্রথম সংঘর্ষ ঘটতে সময় লাগবে গড়ে মাত্র ২.৮ দিন।

গত সাত বছরে পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইটের সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে প্রায় ৪ হাজার স্যাটেলাইট ছিল, এখন সেই সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজারে পৌঁছেছে। এই বিস্ফোরণধর্মী বৃদ্ধির পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে স্পেসএক্সের স্টারলিংক প্রকল্প। নিম্ন-পৃথিবী কক্ষপথে (৩৪০ থেকে ৫৫০ কিলোমিটার উচ্চতায়) বর্তমানে স্টারলিংকের স্যাটেলাইটই রয়েছে ৯ হাজারের বেশি।

কক্ষপথে এত বেশি স্যাটেলাইট থাকার কারণে নিয়মিত সংঘর্ষ এড়াতে ‘কলিশন অ্যাভয়ডেন্স ম্যানুভার’ বা গতিপথ পরিবর্তনের কৌশল নিতে হয়। স্পেসএক্স জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ৩১ মে পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে তারা ১ লাখ ৪৪ হাজারেরও বেশি সংঘর্ষ এড়ানোর কৌশল প্রয়োগ করেছে।

গত মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে নিও সায়েন্টিস্ট জানিয়েছে, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সারা থিয়েল ও তাঁর সহকর্মীরা স্যাটেলাইটের অবস্থানসংক্রান্ত উন্মুক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে সংঘর্ষ ঝুঁকি পরিমাপের জন্য নতুন একটি সূচক তৈরি করেছেন। এই সূচকের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ক্র্যাশ ক্লক’।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে যদি সব স্যাটেলাইট হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারাত, তবে প্রথম সংঘর্ষ হতে সময় লাগত প্রায় ১২১ দিন। কিন্তু বর্তমানে সেই সময় নেমে এসেছে মাত্র ২.৮ দিনে। এই তথ্য বিজ্ঞানীদেরও বিস্মিত করেছে।

সব স্যাটেলাইট একসঙ্গে অচল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম হলেও ২০২৪ সালের মে মাসে শক্তিশালী সৌরঝড়ে স্টারলিংক স্যাটেলাইটগুলোতে অস্বাভাবিক ঢেউয়ের মতো প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী সৌরঝড় হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন—আগামী বছরগুলোতে স্পেসএক্স, অ্যামাজন ও চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আরও হাজার হাজার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে। ফলে কক্ষপথে ভিড় আরও বাড়বে, আর ‘ক্র্যাশ ক্লক’-এর সময়সীমা আরও এগিয়ে আসবে। এই পরিস্থিতি মহাকাশ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা সামনে আনছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইতালির পার্কে মিলল ২১ কোটি বছর আগের হাজার হাজার ডাইনোসরের পায়ের ছাপ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭: ৪৫
একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই পায়ের ছাপগুলো এক আলোকচিত্রীর চোখে ধরা পড়ে। ছবি: বিবিসি
একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই পায়ের ছাপগুলো এক আলোকচিত্রীর চোখে ধরা পড়ে। ছবি: বিবিসি

উত্তর ইতালির একটি ন্যাশনাল পার্কে ২১ কোটি বছর আগের ডাইনোসরের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। তাও আবার একটি-দুটি নয়, হাজার হাজার। এই পায়ের ছাপগুলোর কয়েকটির ব্যাস ১৫ ইঞ্চি পর্যন্ত। আর এগুলো সমান্তরাল সারিতে সাজানো। এসবের মধ্যে অনেকগুলোতে আঙুল ও নখের ছাপ স্পষ্ট বোঝা গেছে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে জানা গেছে।

ধারণা করা হচ্ছে, এই ডাইনোসরগুলো ছিল ‘প্রোসাওরোপড’ (prosauropod) প্রজাতির। এ প্রজাতির ডাইনোসরের গলা লম্বা ও মাথা ছোট এবং ধারালো নখবিশিষ্ট তৃণভোজী প্রাণী ছিল।

মিলানভিত্তিক জীবাশ্মবিদ ক্রিস্টিয়ানো ডাল সাসো বলেন, ‘কখনো কল্পনাও করিনি, আমি যে অঞ্চলে বাস করি, সেখানেই এমন এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের দেখা পাব।’

গত সেপ্টেম্বরে মিলানের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত স্টেলভিও ন্যাশনাল পার্কের একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই পায়ের ছাপগুলো একজন আলোকচিত্রীর চোখে ধরা পড়ে।

বিবিসির প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০ থেকে ২৫ কোটি বছর আগে ট্রায়াসিক যুগে এই পাহাড়ের অংশটি ছিল একটি সমুদ্র তীরবর্তী সমতল ভূমি, যা পরে আল্পাইন পর্বতমালায় রূপান্তরিত হয়।

ডাল সাসো আরও বলেন, এই জায়গা ডাইনোসরে পরিপূর্ণ ছিল; এটি একটি বিশাল বৈজ্ঞানিক সম্পদ।

ডাল সাসো আরও যোগ করেন, ডাইনোসরের দলগুলো সুশৃঙ্খলভাবে চলাচল করত এবং সেখানে আরও কিছু চিহ্ন পাওয়া গেছে, যেগুলো থেকে মনে হয়, পশুরা আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে দলবদ্ধ হয়ে বৃত্তাকারে অবস্থান নিত।

আবিষ্কারকেরা বলছেন, প্রোসাওরোপডগুলো ১০ মিটার বা ৩৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারত। তারা সাধারণত দুই পায়ে হাঁটত, তবে কিছু ক্ষেত্রে পায়ের ছাপের সামনে হাতের ছাপও পাওয়া গেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, তারা সম্ভবত মাঝেমধ্যে থেমে বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাদের সামনের পা মাটিতে রাখত।

আলোকচিত্রী এলিয়ো ডেলা ফেরেরা এই স্থান আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এই আবিষ্কার আমাদের সবার মধ্যে ভাবনার খোরাক জোগাবে এবং আমরা যেখানে বাস করি, আমাদের ঘর, আমাদের পৃথিবী, এই জায়গাগুলো সম্পর্কে আমরা কতটা কম জানি, তা বোঝায়।’

ইতালির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এলাকাটি অত্যন্ত দুর্গম এবং যাতায়াতের কোনো পথ নেই। তাই গবেষণার কাজে ড্রোনের পাশাপাশি রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।

উল্লেখ্য, আগামী বছর ইতালিতে শীতকালীন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর ডাইনোসরের পায়ের ছাপ পাওয়া স্টেলভিও ন্যাশনাল পার্কটি সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ইতালির সীমান্তবর্তী ফ্রায়েল উপত্যকায় অবস্থিত। মন্ত্রণালয় জানায়, এটি যেন অনেকটা এমন যে, স্বয়ং ইতিহাসই বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ক্রীড়া ইভেন্টকে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছে; প্রকৃতি ও ক্রীড়ার মধ্যে এক প্রতীকী সেতুবন্ধনের মাধ্যমে অতীত ও বর্তমানকে এক সুতায় গেঁথেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জোট বেঁধে শিকার ধরতে ছুটছে কিলার হোয়েল ও ডলফিন, বিস্মিত বিজ্ঞানীরা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৪০
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার উপকূলে কিলার হোয়েল নামে পরিচিত অরকা ও হোয়াইট–সাইডেড ডলফিন। ছবি: ইউবিসি
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার উপকূলে কিলার হোয়েল নামে পরিচিত অরকা ও হোয়াইট–সাইডেড ডলফিন। ছবি: ইউবিসি

ব্রিটিশ কলম্বিয়ার উপকূলে একদিন। স্যামন মাছের ঝাঁক পড়িমড়ি করে ছুটতে দেখা গেল। তাদের পিছেই চোখে পড়ল কিলার হোয়েল নামে পরিচিত অরকা ও হোয়াইট–সাইডেড ডলফিনের দলকে। তাও আবার একসঙ্গে! এই দুই শিকারী প্রাণীকে জোটবেঁধে স্যামন শিকারে ছুটতে দেখে যারপরনাই বিস্মিত বিজ্ঞানীরা। শিকার একই হওয়ায় দুই শিকারী জোট বেঁধেছে বলে মনে করছেন তাঁরা।

এ নিয়ে একটি গবেষণাও প্রকাশিত হয়েছে। সায়েন্টিফিক রিপোর্টস সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, এই দুই শিকারি প্রাণীর মধ্যে হয়তো একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

গবেষকেরা বলছেন, ‘কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া উপকূলে প্যাসিফিক হোয়াইট–সাইডেড ডলফিন ও নর্দার্ন রেসিডেন্ট কিলার হোয়েলের মধ্যে এ ধরনের একটি রহস্যজনক সম্পর্ক দেখা যায়, যেখানে এই দুই সিটাসিয়ান প্রজাতিকে প্রায়ই একে অপরের কয়েক মিটারের মধ্যেই দেখা যায়।’

ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লাইবনিজ ইনস্টিটিউট ও হাকাই ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কাজ করা বিজ্ঞানীরা ড্রোন ভিডিও ও শব্দগত রেকর্ডিং সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে জানান, এই প্রথম অরকা ও ডলফিনের এভাবে খাদ্য চাহিদা পূরণে যৌথভাবে কাজ করতে দেখা গেল।

গবেষণার প্রধান লেখক সারা ফরচুন দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘স্যামন শিকারের পারদর্শিতায় শীর্ষস্থানে রয়েছে এই তিমিগুলো। তারা অত্যন্ত দক্ষ ও বিশেষায়িত শিকারি। মনে হচ্ছিল ডলফিনগুলো তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। অরকাদের এভাবে ডলফিনের অনুসরণ করতে দেখা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত আর ভীষণ রোমাঞ্চকর।’

দুই শিকারির মধ্যে সদ্য গড়ে ওঠা এই সম্পর্কের কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। একটি সম্ভাবনা হলো ক্লেপ্টোপ্যারাসিটিজম, যেখানে ডলফিনেরা অরকার শিকার ছিনিয়ে নিতে পারে।

আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে, ডলফিনেরা স্তন্যপায়ীভোজী ট্রানসিয়েন্ট কিলার হোয়েল এবং কিছুটা কম মাত্রায় বড় হাঙরের হাত থেকে সুরক্ষা পেতে এই সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

তবে সারা ফরচুনের মতে, যদি ডলফিনেরা পরজীবীর মতো আচরণ করত, তাহলে সদ্য ধরা শিকার নিয়ে সাধারণত অত্যন্ত রক্ষণশীল কিলার হোয়েলেরা এতটা শান্ত থাকত না, যেমনটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে। এতে গবেষকদের সামনে সবচেয়ে জোরালো ব্যাখ্যাটি উঠে এসেছে, এই দুই শিকারি আসলে পরস্পরকে সহযোগিতা করছে।

সারা ফরচুন আরও বলেন, ‘অরকাগুলো নিজেদের অবস্থান এমনভাবে নিচ্ছিল, যেন তারা ডলফিনদের অনুসরণ করছে। ফলে ডলফিনদেরই নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছিল। বিষয়টি আমাদের আরও গভীরভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করতে এবং আসলে কী ঘটছে তা বোঝার চেষ্টা করতে আগ্রহী করে তোলে।’

এই সহযোগিতা নিয়ে রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে, কারণ নর্দার্ন রেসিডেন্ট অরকারা মূলত স্যামন শিকারে বিশেষজ্ঞ আর হোয়াইট–সাইডেড ডলফিন সাধারণত হেরিং ও অ্যাঙ্কোভির মতো ছোট মাছ খেয়ে থাকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ফ্রান্সে সমুদ্রতলে কিংবদন্তির শহর, ৭০০০ বছর আগের বিশাল প্রাচীরের সন্ধান

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
সমুদ্রতলে ৭ হাজার বছর ধরে টিকে আছে এক বিশাল পাথুরে দেয়াল। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
সমুদ্রতলে ৭ হাজার বছর ধরে টিকে আছে এক বিশাল পাথুরে দেয়াল। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ফ্রান্সের ব্রিতানি উপকূলের কাছে সমুদ্রের গভীরে এক বিশাল পাথরের প্রাচীরের সন্ধান মিলেছে। এই প্রাচীন প্রায় ৭ হাজার বছর আগে—অর্থাৎ ৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নির্মিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফরাসি সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ধারণা করছেন, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির কারণে যে প্রস্তর যুগের সমাজ এই এলাকা থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, এই আবিষ্কার হয়তো সেই সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। সেখানে তলিয়ে যাওয়া শহরের প্রচলিত কিংবদন্তির নিদর্শনও হতে পারে এই প্রাচীর।

১২০ মিটার দীর্ঘ এই প্রাচীর ফ্রান্সের জলসীমায় পাওয়া সমুদ্রতলের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান, এটি হয়তো মাছ ধরার জন্য এক ধরনের ফাঁদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো, অথবা সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান জলস্তর থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বাঁধ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল।

প্রাচীরটি ব্রিতানির পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ইলে দে সঁ-এর উপকূলে আবিষ্কৃত হয়েছে। সমুদ্র সৈকতে জোয়ারের চিহ্ন এখনো বহন করছে এই প্রাচীর। বর্তমানে প্রাচীরটি প্রায় নয় মিটার গভীরে ডুবে আছে। দ্বীপটি আগের আকারের তুলনায় অনেকটাই ছোট হয়ে গেছে, সমুদ্রের পানিস্তর বৃদ্ধির এটি বড় প্রমাণ।

প্রাচীরটির গড় প্রস্থ প্রায় ২০ মিটার এবং উচ্চতা দুই মিটার। নিয়মিত ব্যবধানে ডুবুরিরা এর মধ্যে বড় গ্রানাইট পাথর বা মনোলিথ-এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। এগুলো দুটি সমান্তরাল রেখায় প্রাচীরের ওপরে উঁচু হয়ে আছে। মনে করা হচ্ছে, এই মনোলিথগুলোই প্রাচীরের মূল ভিত্তি হিসেবে শিলাস্তরের ওপর স্থাপন করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে স্ল্যাব ও ছোট পাথর দিয়ে তাদের ঘিরে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। যদি মাছ ধরার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহারের অনুমানটি সঠিক হয়, তাহলে বলা যায়, মনোলিথগুলোতে জোয়ারের পানি নেমে যাওয়ার সময় মাছ ধরার জাল বেঁধে রাখা হতো।

প্রাচীরটির মোট ভর প্রায় ৩ হাজার ৩০০ টন। প্রত্নতাত্ত্বিক ইভান পাইয়ার বলেন, এই বিশাল নির্মাণ একটি সুসংগঠিত সমাজের কাজ হতে পারে। মূলত শিকারি-সংগ্রাহক (হান্টার গ্যাদারার) জনগোষ্ঠী এটি নির্মাণ করেছে, যারা সম্পদের প্রাচুর্য থাকায় স্থিতিশীল জীবনযাপন শুরু করেছিল। অথবা, এটি ছিল ৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এই অঞ্চলে আসা নব্যপ্রস্তর যুগের জনগোষ্ঠীর নির্মাণ।

পাইয়ারের মতে, মনোলিথগুলো নব্যপ্রস্তর যুগের বিখ্যাত মেনহিরগুলোর চেয়েও প্রাচীন। ফলে এটি পাথর উত্তোলন, কাটা এবং পরিবহনের জ্ঞান তৎকালীন শিকারি-সংগ্রাহক সমাজ থেকে পরবর্তী নব্যপ্রস্তর যুগের কৃষকদের কাছে স্থানান্তরিত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব নটিক্যাল আর্কিওলজিতে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এই আবিষ্কার স্থানীয় ব্রেটোন কিংবদন্তিগুলোর উৎস হতে পারে। যেমন, ব্রিতানির উপকূলে অবস্থিত বে অব দোয়ারনেনেজ-এর আশপাশে ডুবে যাওয়া শহর ইশ (Ys)-এর কিংবদন্তি। গবেষকদের মতে, একটি অত্যন্ত সুসংগঠিত সমাজ দ্বারা গঠিত অঞ্চলের বিলুপ্তি মানুষের স্মৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। সমুদ্রের জলস্তর দ্রুত বৃদ্ধির ফলে মাছ ধরার কাঠামো, প্রতিরক্ষামূলক কাজ এবং বাস্তুচ্যুতির ঘটনাগুলো সম্ভবত স্থানীয় মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলেছিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত