Ajker Patrika

নীল জলের দ্বীপের দেশে

মুনতাসির মইন
আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২২, ১৮: ০৩
নীল জলের দ্বীপের দেশে

সাবমেরিনের পেটে বসে নীল সাগরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সাবমেরিনটা হেলেদুলে ঠিক যেন পালকির মতো চলছিল। আমি ছোটবেলায় চলে গেলাম। একসময় পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে খুব জুলভার্ন পড়তাম। তখনকার পড়া ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগ আন্ডার দ্য সি’ যেন চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। মনে হচ্ছিল, আমি নোটিলাসে বসে আছি, ক্যাপ্টেন নিমোর পাশে। হালকা থেকে গাঢ় হতে থাকল নীল। অদ্ভুত রং-বেরঙের নাম না জানা মাছ ছুটে বেড়াচ্ছে কোরাল বাগানে। চোখধাঁধানো রঙের সেই বাগান। কী সুন্দর, কী রহস্যময়! একসময় সাবমেরিন কোরাল রিফের শেষ প্রান্তে এসে পড়ল, তার নিচে গভীর খাদ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমাদের হলুদ সাবমেরিন কচুরিপানার মতো বিশাল সমুদ্রে ভাসতে লাগল। এভারেস্টের নিচে দাঁড়িয়ে যেমন গভীর শূন্যতা অনুভব করেছিলাম, এখানেও তা-ই হলো। গভীর ঘোর লেগে গেল। ছেলে ধাক্কা দিয়ে ঘোর ভাঙাল। ‘বাবা, এই মাছের নাম কী?’ আমি ফ্যালফ্যাল করে বললাম, ‘সি ফিশ!’ আজ আমাদের মালদ্বীপের দ্বিতীয় দিন। 

প্লেনের ককপিটে যখন ক্যাপ্টেন বললেন, ‘আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যে মালদ্বীপে ল্যান্ড করব’, তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্য দেখলাম। গাঢ় নীল একটি আর্টিস্ট প্লেটের মধ্যে যেন আকাশি, ফিরোজা, সাদা আর সবুজের রঙের প্রলেপ। এ রকম ছোট-বড় হাজার হাজার রঙের প্রলেপ প্লেটজুড়ে। এগুলো একেকটা দ্বীপ। ঠিক যেন রঙের মালা। কিছু কিছু পণ্ডিত মনে করেন, মালদ্বীপ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘মালা দ্বীপ’ থেকে, যার অর্থ ফুলের মালার দ্বীপ। তবে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে এই দ্বীপকে বলা হয়েছে ‘লাক্ষাদ্বীপ’ বা শত হাজার দ্বীপ। তবে মালদ্বীপে হাজারের বেশি দ্বীপ থাকলেও ১ লাখ দ্বীপ নেই। বর্তমান মালদ্বীপে ১ হাজার ১৮৪টি দ্বীপ ও ২৮টি প্রাকৃতিক অ্যাটল আছে। এর মধ্যে মাত্র ১৮৭টি দ্বীপ বসবাসের উপযোগী। 

আমাদের রিসোর্টটি ছিল এমনই এক দ্বীপে। রিসোর্টের নাম হার্ড রক হোটেল মালদ্বীপ। সাউথ মালে এটলে এটি অবস্থিত। এটল হচ্ছে দীর্ঘ বৃত্তাকার প্রবালপ্রাচীর। প্রবালপ্রাচীরের পার ঘেঁষে রিসোর্টগুলো গড়ে উঠেছে। মালে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ২০ মিনিটে স্পিডবোটে করে রিসোর্টে পৌঁছানো যায়। 

মালদ্বীপের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টটা বেশ মজার। অন্য দেশের মতো নয়। অন্য যেকোনো দেশে আমরা এয়ারপোর্টে নেমে রাস্তা মাপি আর মালদ্বীপে মাপতে হয় সমুদ্র। এয়ারপোর্টে নেমেই বিশাল সমুদ্র। রিসোর্টে যেতে চাইলে উঠে পড়তে হয় স্পিডবোটে অথবা সি প্লেনে। আমাদের রিসোর্টের সদা হাস্যোজ্জ্বল ভুবন আমাদের রিসিভ করার জন্য এসেছিল। চমৎকার ইংরেজিতে বলল, ‘ওয়েলকাম টু দ্য হ্যাভেন।’ ছোট্ট এই লাইন জীবনতৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে তুলল। কী চমৎকার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি! প্লেনের চার ঘণ্টার বিরক্তিকর ভ্রমণ শেষে গাঢ় নীল সমুদ্র যেন ইফতারের শরবতের গ্লাস। নোনা বাতাসে ঝরঝরে লাগল শরীর, নোনা স্বাদও যেন পেল জিহ্বা। স্পিডবোট চলতে শুরু করল। 

ছেলের চোখে আনন্দ আর মেয়ের চোখে উৎকণ্ঠা। কারণ, ততক্ষণে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল আমাদের স্পিডবোটে। সেটি বাম্প করতে লাগল রোলার কোস্টারের মতো। ২০ মিনিট পর শান্ত হলো স্পিডবোট। আমরা ততক্ষণে গভীর সমুদ্র থেকে রিফে পৌঁছে গেছি। ধীরে ধীরে ল্যান্ডিং জেটি চোখে পড়ল। গাঢ় নীলের পর পান্না সবুজ পানি, তার ওপর সাদা দ্বীপ। জেটি সামনে আসতেই চোখে পড়ল, রিসোর্টের সাতজন স্টাফ হাত নেড়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। তাদের দলপতি স্বর্ণকেশী রাশিয়ান আলিশা। চমৎকার হেসে সম্ভাষণ জানাল আর বলল, ‘মইন ফ্যামিলিকে পেয়ে আমরা আনন্দিত।’ মনে হচ্ছিল কত দিনের চেনা। 

সমুদ্রে ঘেরা মালদ্বীপ। রিসেপশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো কাঙ্ক্ষিত ওয়াটার বাংলোতে। আমাদের বাংলোটি স্বচ্ছ নীল পানির ওপর দুই রুমের কুঁড়েঘর। একটি মাস্টার বেডরুম আর একটি ড্রেসিং রুম। মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া একটি টেরেস। টেরেসের এক পাশে আছে সিঁড়ি, যা দিয়ে সরাসরি রিফে নেমে পড়া যায়। আর টেরেসের আরেক পাশে মোটা সাদা দড়ি দিয়ে বানানো হয়েছে বিশাল ট্রাম্পোলিন এবং তার ঠিক নিচে সমুদ্র। বাচ্চারা লাফালাফি শুরু করল ট্রাম্পোলিনে। আমরাও যোগ দিলাম তাদের সঙ্গে। আহা সে কী আনন্দ! 

আসলে নামে কুঁড়েঘর হলেও আধুনিক বসবাসের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা মেলে এই বাংলোগুলোতে। স্টার রেটিং ভেদে বাড়তে থাকে সুযোগ-সুবিধার পরিধি। কিন্তু কিছু ম্যাজিক স্টার রেটিং মানে না। এই ম্যাজিকের ম্যাজিশিয়ান হলো রিফের বাসিন্দা বেবি সার্ক, স্টিং রে, সি টার্টল আর অসংখ্য নাম না জানা রংবেরঙের মাছ। তারা ম্যাজিক দেখাতে হঠাৎ হঠাৎ চলে আসে বাংলোগুলোর ঠিক নিচে। ওপর থেকে বসে তাদের খেলাধুলা দেখতে বেশ লাগে। সহজ-স্বাভাবিকভাবে তারা ঘুরে বেড়ায় বাংলোর আশপাশে। যেন আমাদের মতো তারাও ঘুরতে এসেছে মালদ্বীপে। এ রকম মানুষের সঙ্গে প্রাণীদের সহাবস্থান দেখতে আমার বেশ লাগে। নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ তকমা লাগিয়ে অহংকার করা আমার মোটেও ভালো লাগে না। পুরো ইকোসিস্টেমে সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি থেকে ক্ষুদ্র মৌমাছিকে বাদ দিলে কয়েক বছরের মধ্যে বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়বে সবুজ পৃথিবী। তখন কী হবে চিন্তা করা যায়? 

আমরা মালদ্বীপে গিয়েছিলাম ৭ জানুয়ারি। তখন মাত্র ক্রিসমাস শেষ হয়েছে। কিন্তু রিসোর্টজুড়ে ছিল ক্রিসমাসের সাজসজ্জা আর আমেজ। গোলাপি আলোয় আলোকিত পুরো রিসোর্ট। সেদিনই ছিল তাদের ক্রিসমাস ডিনারের শেষ আয়োজন। সমুদ্রতটের সাদা বালুর ওপর বিছানো হয়েছে টেবিল। তার ওপর মোমবাতি। সাগরের মৃদুমন্দ হাওয়া তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্রাজিলিয়ান এক ব্যান্ড দল বাজিয়ে চলেছে ‘আভা মারিয়া’। করুণ আভা মারিয়া কেন যেন যিশুর লাস্ট সাপারের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। জীবনের শেষ নৈশভোজে বসেছেন যিশু তাঁর বারোজন শিষ্য নিয়ে। ভীষণ শান্ত স্বরে যিশু বললেন, ‘কাল তোমাদের মধ্যেই একজন আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, ধরিয়ে দেবে আমাকে।’ যিশুর মুখে এই কথা শুনে বারোজনের কারও মুখে ভয়, কারও আগ্রহ, কারও সন্দেহ, কারও মুখে কৌতূহল, করো মুখে ঘৃণা, কারও মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল। কী অদ্ভুত! 

এ নিয়ে একটি বিখ্যাত চিত্র আছে লেওনার্দ দ্য ভিঞ্চির, নাম ‘দ্য লাস্ট সাপার’। আঁকা হয়েছিল মিলানের সান্তা মারিয়া দেল্লে গ্র্যাছে। একবার এই ছবি দেখতে গিয়েছিলাম; কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি পনেরো মিনিটের জন্য। গির্জায় ঢোকার শেষ সময় ছয়টা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আমাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাতটা বেজে গিয়েছিল। সেই আফসোস আমার আজও গেল না! 

ক্রিসমাসের শেষ ডিনারের আয়োজনটা ছিল হুলুস্থুল রকমের। শুরুতেই এক গ্লাস শ্যাম্পেইন হাতে ধরিয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার অনিত বলল, ‘আজ ডায়েটের কথা ভুলে যাও। যা মন চায়, খাও।’ নাম না জানা অসংখ্য খাবারে পরিপূর্ণ ব্যুফে, কমলা আলাস্কান ক্র্যাব লেগ, খরগোশের নরম মাংসের ফ্রেঞ্চ টেরিন, সদ্য তোলা নীল রিফের ওয়েস্টার, চিজ হুইলে মাখানো গরম-গরম পাস্তা—আরও কত কী! অনিতের সঙ্গে খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল, মালদ্বীপের প্রথম দিকের জনবসতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তামিলরা, যারা প্রাচীন তামিলকাম থেকে এসেছিল। এই তামিলকামই বর্তমানে ভারতের তামিলনাড়ু। সেই সময় যেসব পর্যটক মালদ্বীপ ভ্রমণ করেছিল, তারা সবাই রানিশাসিত এই রাজ্যের কথা উল্লেখ করেছে। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন সাহিত্য ‘মহাবংশ’-এ মালদ্বীপকে বলা হয়েছে ‘মহিলাদ্বীপ’ বা নারীদের দ্বীপ। তার মানে বোঝা যায়, মাতৃতান্ত্রিক এক সমাজব্যবস্থা ছিল এই মালদ্বীপে। লুইস মরগানের একটি চমৎকার বই আছে, নাম ‘অ্যানশায়েন্ট সোসাইটি’। সেখানে লেখকের দাবি, আদিমকালে সব গোষ্ঠী নাকি ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কী মজার একটা ব্যাপার, মায়েদের চোখরাঙানি খেয়ে বাবারা চুপ করে বসে থাকত! এরপর সম্রাট অশোকের সময় বুদ্ধ ভিক্ষুরা গিয়ে মালদ্বীপে বসবাস শুরু করেন। তখনই বৌদ্ধধর্ম প্রসার পায়। এখনো তার প্রচুর নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক দ্বীপে। বারো শতকের দিকে মুসলিম বণিকেরা ব্যবসা করতে ভারত সাগরে এসে ঘাঁটি গাড়ে মালদ্বীপে। শুরু হয় দীর্ঘ ইসলামি যুগের। 

প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে মালদ্বীপকে বলা হয়েছে ‘লাক্ষাদ্বীপ’বা শত হাজার দ্বীপ।

গল্প শেষে বিদায় নিয়ে চলে এলাম স্বপ্নের সেই কুটিরে। বাচ্চারা কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাদের বিছানায় রেখে আমরা শুয়ে রইলাম নেটের তৈরি টেরেসের সেই ট্রাম্পোলিনে। আকাশে তখন অনন্ত নক্ষত্রবীথি। তারায় পরিপূর্ণ আকাশ। এমন আকাশের দিকে তাকিয়ে অনন্ত জীবন বেঁচে থাকার লোভ জাগে। তখন ঠিক বারোটা। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের বিয়ের বারো বছর পূর্ণ হলো। 

সকালে ঘুম ভাঙল মৃদু ঠকঠক শব্দে। উঠে দেখি ঘরে বেড়াতে এসেছে দুটো সাদা ড্রিল। ড্রিল হচ্ছে ছোট সাদা শামুক। হাঁটার সময় টালির সঙ্গে শক্ত খোলসের ঠক্করে শব্দ হচ্ছিল ঠকঠক। কিছুক্ষণ বাচ্চাদের নিয়ে শামুকদের সঙ্গে খেলে বললাম তাদের রিফে ফিরিয়ে দিতে। মালদ্বীপসহ প্রাচীন পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চলের মুদ্রা ছিল একধরনের শামুক, যা আমরা কড়ি নামে চিনি। ১৩৪৪ সালে ইবনে বতুতা মালদ্বীপে এসে দেখেছিলেন, প্রতিবছর মালদ্বীপ ৪০ জাহাজ কড়ি রপ্তানি করত। প্রশ্ন জাগে, কেমন ছিল সেই কড়ির আর্থিক মান? তখন ৪ লাখ কড়ি দিয়ে একটি সোনার দিনার পাওয়া যেত। 

এবার রিফে নামার পালা। রুমের সামনে টেরেসের সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়লাম স্বচ্ছ পানিতে। পানির তাপমাত্রা চমৎকার আরামদায়ক। কোমর পর্যন্ত পানিতে অনায়াসে হাঁটা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম। নরম বালিতে কিছুক্ষণ হাঁটার পর শরীর ভাসিয়ে দিলাম পানিতে। সাদা বালির ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য কোরাল। তার মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট রংবেরঙের মাছ। হাত দিয়ে ধরতে গেলে তারা দৌড়ে পালায়। ততক্ষণে ছেলে কোরাল সংগ্রহে নেমে পড়েছে। রংবেরঙের কোরাল সংগ্রহ করে পকেটে পুরে রাখছে। ছেলে শুনে অবাক হলো, এই কোরলগুলোরও একসময় প্রাণ ছিল। পরে বুড়ো হয়ে মরে গিয়ে তারা জমতে শুরু করে সাগরের তলদেশে। মরে যাওয়ার পর তাদের দেহের চারপাশে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের একটি পাথুরে স্তর তৈরি হয়। সেটাকেই আমরা প্রবাল বলি। এই প্রবালগুলো এভাবে লাখ লাখ বছর জমে একেকটি পাথরের আকৃতি নেয়। আর কোটি কোটি বছর জমে একটি দ্বীপ সৃষ্টি করে। কী অদ্ভুত প্রকৃতির খেয়াল! 

ওয়াটার বাংলো, হার্ড রক রিসোর্ট

ছেলেকে বললাম, ‘কোটি কোটি বছর পুরোনো এই পাথরবাগান কোনোভাবেই নষ্ট করা উচিত নয়। এরা খুবই দুর্লভ। পৃথিবীতে অল্প কিছু আছে, যার মধ্যে একটি আছে আমাদের দেশে। যাকে আমরা সেন্ট মার্টিন বলে জানি।’ সেন্ট মার্টিনের কথা বলতে বলতে মন খারাপ হয়ে গেল। দেশে এত সুন্দর একটা দ্বীপ আছে, যাকে ইচ্ছে করলেই এমন মালদ্বীপের মতো করা যেত। কিন্তু আমরা চরম অবহেলায় ফেলে রেখেছি। গুনগুন করে গাইতে লাগলাম—

জনম গেল বৃথা কাজে
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে
তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে, শক্তিদাতা
ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা। 

রিফে সাঁতার কাটতে কাটতে আমরা সাবমেরিনের প্রোগ্রাম করলাম। রিসোর্টে একটি ছোট সাবমেরিন আছে। সেটা ঠিক সাবমেরিন নয়। সাবমেরিন আকৃতির নৌকা বলা যায়। নিচের দিকে ফাঁকা একটি জায়গায় ছয়-সাতজন বসতে পারে, চারদিক স্বচ্ছ জানালা দিয়ে ঘেরা। রিফের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে এই সাবমেরিনের জুড়ি নেই। স্নোরকেলিং করে অল্প একটু জায়গা ঘুরে দেখা যেতে পারে। ভালো ডাইভিংয়ের জন্য দরকার ট্রেনিং। এই দুটোর মাঝে সাবমেরিনে ভ্রমণ ভালো সুযোগ হতে পারে। সাবমেরিনের বর্ণনা প্রথমেই একটু বলেছিলাম। কিন্তু তার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশের শব্দ আমার অভিধানে নেই। 

আমাদের রিসোর্টে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট পনেরোটি রেস্টুরেন্ট ছিল। তার মধ্যে কিছু ইন্টারন্যাশনাল চেইন রেস্টুরেন্ট। মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব তেমনি এক রেস্টুরেন্ট। আজ ডিনারের জন্য আমরা সেই রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। এই মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব এশিয়ার ছয়টি দেশে তাদের রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছে। ওয়ার্ল্ডস ফিফটি বেস্ট রেস্টুরেন্টের তালিকায় তাদের অবস্থান পঁচিশ। বড় বড় কাঁকড়াই তাদের প্রধান আকর্ষণ। তাদের প্রধান নীতি হলো, তারা হিমায়িত খাবার পরিবেশন করে না। এ জন্য তাদের বিশাল ঝামেলা পোহাতে হয়। মালদ্বীপের এই রেস্টুরেন্টে তাদের কাঁকড়াগুলো আসে প্রাইভেট প্লেনে করে, শ্রীলঙ্কা থেকে। তারপর তাদের বসবাস উপযোগী একটি চৌবাচ্চায় জ্যান্ত সংরক্ষণ করা হয় প্লেটে পরিবেশন করার আগ পর্যন্ত। ক্রেতাদের চাহিদামতো জ্যান্ত কাঁকড়া নিয়ে আসা হয় তার আকৃতি ঠিক আছে কি না, দেখানোর জন্য। এখানে প্রায় দশ আকারের কাঁকড়া পাওয়া যায়। ছোটটা আধা কেজি আর বড়টা দুই কেজি ওজনের। তারা প্রায় পাঁচ রকমভাবে কাঁকড়া রান্না করতে পারে। এর মধ্যে পিপার ক্র্যাব অসম্ভব জনপ্রিয়। 

আমরা পিপার ক্র্যাব অর্ডার করেছিলাম, সঙ্গে ছিল ক্র্যাব লিভার পাটে, এপেটাইজারে। ছোট্ট একটি বিস্কুটের ওপর এই ক্র্যাব লিভার পেস্ট জেলির মতো লাগিয়ে তার ওপরে ম্যাপেল সিরাপ দিয়ে কুট্টুস করে কামড় দিয়ে খেতে হয়। দুই কেজির বিশাল পিপার ক্র্যাব খাবার জন্য ঘাম ঝরানো জরুরি। রীতিমতো ছেনি-বাটাল নিয়ে ভাঙতে হয় ক্র্যাবের শক্ত খোল। তারপর বের হয় কাঙ্ক্ষিত সাদা মাংস। পিপার সসে ডুবিয়ে সেই মাংস মুখে পুরে অনায়াসে ভুলে যাওয়া যায় জগৎ-সংসার। ডেজার্টে ছিল নারকেলের খোলে তৈরি ফ্রেঞ্চ ক্রিম ব্রুলে। এবার ঘুম। 

টেরেসের আরেক পাশে মোটা সাদা দড়ি দিয়ে বানানো হয়েছে বিশাল ট্রাম্পোলিন এবং তার ঠিক নিচে সমুদ্র

আজ ঘুম ভাঙল বৃষ্টির শব্দে। সে কী বৃষ্টি! গতকালের ভেজা কাপড়গুলো শুকাতে দেওয়া হয়েছিল টেরেসে। সেগুলো আবার ভিজে গেল। রুমের দরজা খুলে টেরেসে গিয়ে নতুন রঙের আভা দেখলাম। সবুজ সমুদ্র আরও সবুজ দেখা যাচ্ছে আর ওপরে কালো আকাশ। সে অপরূপ ব্যাপার! সমুদ্র ভয়ংকর হতে লাগল। বাড়তে লাগল বৃষ্টির তেজ। মালদ্বীপের বৃষ্টি নাকি ভয়ংকর—একবার শুরু হলে এক সপ্তাহ। মন খারাপ হয়ে গেল। আরও দুই দিন যে থাকতে হবে! কিন্তু কিছুক্ষণ পরই মেঘ কেটে গিয়ে চমৎকার এক সূর্যের দেখা পেলাম। পুরো পরিবার নিয়ে রিফে নেমে গেলাম। গতকাল নাকি এক বিশাল মান্তা রে ঢুকেছে রিফে। 

এই প্রাণীটা বেশ মজার। এরা নাকি তেইশ ফুট পর্যন্ত চওড়া হতে পারে! অদ্ভুত দর্শনের জন্য এদের মানুষ প্রাচীনকাল থেকে ভীষণ ভয় পেত। প্রাচীনকালে নাবিকেরা বিশ্বাস করতেন যে, তারা মানুষের জন্য বিপজ্জনক এবং নোঙরে টান দিয়ে নৌকা ডোবাতে পারে। পরে যখন ডাইভিং জনপ্রিয় হয়, তখন মানুষ বুঝতে শেখে, এরা নিরীহ গোছের প্রাণী আর শুরু করে তাদের ওপর অত্যাচার। তাদের ফুলকা চায়নিজ ওষুধের এক দুর্মূল্য উপাদান। এই ফুলকার জন্য হাজার হাজার মান্তা রে প্রতি বছর মারা হয়। সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ায় গত বছরই তাদের বিপদাপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। 

দুপুরে যখন আমরা পানি থেকে উঠে খাবার খাচ্ছিলাম, তখনই দেখা মিলল সেই বিশাল কালো মান্তা রের। প্রবল দাপটে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে রিফে। মাছেদের খেলা দেখতে দেখতে বিকেল নামল। বেগুনি হয়ে উঠল আকাশ। রিফের সেই আকাশি পানি তখনো আকাশি। তবে কিছুটা কালচে। চমৎকার বেগুনি আকাশের নিচে কালচে আকাশি সমুদ্র ঠিক যেন মনভোলা এক চিত্রকরের হাতে আঁকা ছবি। প্রকৃতির এমন রূপ দেখে যেকোনো শিল্পীর মনে হতে বাধ্য, এখানে বাকি জীবন কাটালে মন্দ হতো না। সারা দিন শুধু ছবি আঁকব, ফিরব না আর যান্ত্রিক নগরে। সত্যি সত্যি এমন পাগলামি কিন্তু একজন করেছিলেন—তাঁর নাম পল গগাঁ। ফরাসি এই শিল্পী তাহিতি নামের এক দ্বীপে গিয়ে তার প্রেমে পড়ে যান। তারপর সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমৃত্যু বসবাস করতে থাকেন সেই দ্বীপে। 

মালদ্বীপের এই তটে বসে গগাঁর মনের অবস্থা টের পাচ্ছিলাম। এই ক্ষুদ্র জীবনে খুব বেশি কিছু কি দরকার? তবু ফিরে যেতে হবে কাল। মন খারাপ হয়ে গেল। আকাশে তখন তারা ফুটে উঠছে। বেগুনি থেকে গাঢ় নীল হচ্ছে পৃথিবী। 

পৃথিবী এত সুন্দর কেন?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

চ্যাপা শুঁটকির পিঠা

ফিচার ডেস্ক, ঢাকা 
চ্যাপা শুঁটকির পিঠা
চ্যাপা শুঁটকির পিঠা

শীতে বাড়িতে প্রায়ই কোনো না কোনো পিঠা তৈরি হয়। এবার একটু ভিন্ন ঘরানার পিঠা তৈরি করুন। খুব সহজে সন্ধ্যার নাশতা হিসেবে তৈরি করতে পারেন চ্যাপা শুঁটকির পিঠা। এ পিঠার রেসিপি ও ছবি পাঠিয়েছেন রন্ধনশিল্পী আফরোজা খানম মুক্তা

উপকরণ

চ্যাপা বা সিদল ১০ থেকে ১২টি, রসুন আধা কাপ, পেঁয়াজকুচি আধা কাপ, কাঁচা মরিচ ২০টি, লবণ স্বাদমতো, চালের গুঁড়া ২ কাপ, পানি পরিমাণমতো।

প্রণালি

কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন হালকা সেদ্ধ বা ভেজে পরে শুঁটকি ও লবণ দিয়ে আরও কিছু সময় ভেজে নিন। ভাজা উপকরণ পাটায় মিহি করে বাটুন। চালের গুঁড়া ও লবণ একসঙ্গে মেখে ধীরে ধীরে পানি দিয়ে রুটি মতো ডো তৈরি করুন। পরে সমান করে পুরির মতো গোল করে গর্ত বানিয়ে তার ভেতর ভর্তা ভরে হাতের তালুতে রেখে চেপে চেপে গোল পিঠা তৈরি করুন। পরে তাওয়া মিডিয়াম আঁচে গরম করে পিঠাগুলো এপিঠ-ওপিঠ করে ভাজুন তেল ছাড়া। খেয়াল রাখতে হবে, যেন ভেতরে কাঁচা না থাকে। ঠিকমতো ভেজে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে চ্যাপা শুঁটকির পিঠা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

২০২৬-এর ডায়েট রেজল্যুশন: নতুন বছর শুরু হোক টেকসই অভ্যাস নিয়ে

ফিচার ডেস্ক
ছবি: পেক্সেলস
ছবি: পেক্সেলস

নতুন বছর মানেই ডায়েট নিয়ে একগাদা জাঁকজমকপূর্ণ প্রতিজ্ঞা। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, ফেব্রুয়ারি আসার আগেই বেশির ভাগ মানুষের সেই উৎসাহের বেলুন ফুস করে ফেটে যায়। এর মূল কারণ হলো ‘ক্রাশ ডায়েট’ বা অবাস্তব লক্ষ্য। আপনার কাছে সুষম খাদ্য মানে কী। এটি কি কেবল কম খাওয়া বা ক্যালরি গণনা করা? না, এটি আপনার শরীরকে সঠিক পরিমাণে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করার একটি মাধ্যম। টেকসই স্বাস্থ্য শুরু হয় আপনার শরীরের আসলে কী প্রয়োজন, তা বোঝার মধ্য দিয়ে। এই উপলব্ধি আপনাকে খাবারের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তন আনতে এবং দীর্ঘস্থায়ী অভ্যাস তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে। তবে একটি দীর্ঘস্থায়ী ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাস কীভাবে তৈরি করতে হয়, তা হয়তো অনেকে বুঝতে পারেন না। তাই ২০২৬ সালে পা দিয়ে আপনার স্বাস্থ্যযাত্রাকে স্থায়ী করতে ডায়েট প্ল্যানে কোন ভুলগুলো করা যাবে না, তা জেনে রাখা জরুরি। এতে আপনার ডায়েট যাত্রার শুরুটা ভালো হবে।

জেন-জি ট্রেন্ড আর অন্ধ অনুকরণের ফাঁদ

বর্তমান প্রজন্মের সবচেয়ে বড় ভুল হলো তারা অন্যের দেখাদেখি হুজুগে ডায়েট শুরু করে। কোনো একটি পদ্ধতি একজনের জন্য কাজ করছে মানেই যে আপনার শরীরের জন্য তা কার্যকর হবে, এমনটা নয়। ধৈর্যহীন আর অহেতুক কৌতূহলে ঘন ঘন ডায়েট প্ল্যান বদলানো ওজন কমানোর বদলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আর মানসিক অবসাদ তৈরি করে।

ওজনের কাঁটা নয়, নজর দিন পুষ্টিতে

ওজন কমানো মানেই খাবার খাওয়া কমিয়ে দেওয়া বা ক্যালরি গণনা করা নয়। পুষ্টি বিসর্জন দিয়ে ওজন কমাতে গিয়ে অনেক সময় আমরা গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতা ডেকে আনি। ফলের রস বা ফ্যাড ডায়েটের বদলে আপনার পাতে যেন থাকে পর্যাপ্ত ফলমূল, শাকসবজি, লিন প্রোটিন এবং স্বাস্থ্যকর চর্বি। খেয়াল রাখতে হবে প্রতিদিন যেন প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান খাবারে উপস্থিত থাকে। শরীরে কোনো পুষ্টির ঘাটতি (যেমন: ভিটামিন ডি, আয়রন) আছে কি না, তা জানতে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। খাদ্যতালিকায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার বেশি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। লক্ষ্য হওয়া উচিত শরীরকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি দেওয়া, কেবল ক্যালরি কমানো নয়।

বার্ষিক নয়, মাসিক লক্ষ্য স্থির করুন

পুরো বছরের জন্য বিশাল লক্ষ্য নির্ধারণ না করে মাসিক লক্ষ্য সেট করুন। যেমন মাসে দুই কেজি কমানোর লক্ষ্য ধরুন। এটি শুনতে ছোট মনে হলেও বছরে তা ২৪ কেজি দাঁড়ায়। যা একটি চমৎকার এবং স্বাস্থ্যকর অর্জন। ছুটির দিনসহ প্রতিদিন ঘুমানোর এবং ঘুম থেকে ওঠার একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন। বেলা তিনটার পর ক্যাফেইন বা কফিজাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলার অভ্যাস করে তুলুন। ঘুমানোর আগে ২০ মিনিটের একটি রিল্যাক্সেশন বা শরীর শিথিল করার নিয়ম তৈরি করুন। অবাস্তব টার্গেট আপনাকে ব্যর্থতার অনুভূতি দেয়, যা আপনার আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে। এর চেয়ে দৈনন্দিন করা অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসকে আগে ঝেড়ে ফেলুন নিজের জীবন থেকে।

ছবি: পেক্সেলস
ছবি: পেক্সেলস

’স্মার্ট’ (SMART) ফর্মুলায় হোক লক্ষ্য নির্ধারণ

আপনার স্বাস্থ্য লক্ষ্যগুলো হতে হবে নির্দিষ্ট (Specific), পরিমাপযোগ্য (Measurable), অর্জনযোগ্য (Achievable), প্রাসঙ্গিক (Relevant) এবং সময়োপযোগী (Time-bound)। যেমন ‘আমি মেদ কমাব’ না বলে বলুন, ‘আমি প্রতিদিন ১৫ মিনিট করে হাঁটব।’ এতে আপনার মস্তিষ্কের জন্য কাজটি সহজ মনে হয়। সপ্তাহে ৫ দিন ৩০ মিনিট করে দ্রুত হাঁটার অভ্যাস করুন। ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে চিনিযুক্ত পানীয়র পরিবর্তে পানি পান করুন। শরীরের গঠন উন্নত করতে প্রতি সপ্তাহে ওয়েট ট্রেনিং করতে পারেন।

ছবি: পেক্সেলস
ছবি: পেক্সেলস

সুস্থতার চার স্তম্ভের সমন্বয়

ডায়েট মানেই শুধু খাবার আর ব্যায়াম নয়, এটি চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে:

শারীরিক স্বাস্থ্য: সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যায়াম ও বিশ্রাম।

মানসিক সুস্থতা: স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ও ডিজিটাল ডিটক্স।

পুষ্টিকর অভ্যাস: ৮০/২০ নিয়ম অনুসরণ (৮০% স্বাস্থ্যকর খাবার, ২০% প্রিয় খাবার)।

প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য: নিয়মিত চেকআপ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা।

ধৈর্যের পরীক্ষা ও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

মনে রাখবেন, জীবনযাত্রার পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ। অন্যের এক মাসের অর্জনের সঙ্গে নিজের তুলনা না করে নিজের শরীরের চাহিদা বুঝুন। বিশেষ করে মেনোপজ বা মাঝবয়সী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ডায়েট চার্টটি বিশেষায়িত হতে হবে। আপনার কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে নিজে থেকে ইন্টারনেটের ডায়েট ফলো না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শে পার্সোনালাইজড ডায়েট চার্ট তৈরি করুন। সুস্থতা কোনো গন্তব্য নয়, এটি একটি পথচলা; যা শুরু হয় আপনার প্লেটের সচেতন সিদ্ধান্ত দিয়ে। ২০২৬ সালের ডায়েট হোক প্রতিশ্রুতিমুক্ত এবং পরিকল্পনাময়। নিজেকে বঞ্চিত না করে ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি স্থায়ী অভ্যাস গড়ে তুলুন।

সূত্র: হেলথ শর্টস, মিয়ামি লেক মেডিকেল সেন্টার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোরিয়ানরা কেন কালো-সাদা পোশাকে ‘আসক্ত’

ফিচার ডেস্ক
ছবি: ফ্রিপিক
ছবি: ফ্রিপিক

সিউলে ঘুরতে এলে অনেক পর্যটক কিমচি বা কে-পপ ছাড়া আরেকটি বিষয় দেখে সবচেয়ে বেশি অবাক হন। সেটি হলো কোরিয়ানদের পোশাকের রং। রাস্তাঘাটে তাকালেই চোখে পড়ে কালো, সাদা আর ধূসর রঙের আধিক্য। পরিসংখ্যান বলছে, কোরিয়ায় পরা মোট পোশাকের ৬০ শতাংশের বেশি এই তিনটি রঙের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

পর্যটকের চোখে ‘একই রঙের শহর’

৩২ বছর বয়সী মার্কিন নাগরিক ইসাবেল স্মিথ প্রথম সিউলে এসে বিষয়টি স্পষ্টভাবে টের পান। তিনি বলেন, ‘চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, প্রায় সবাই কালো, সাদা বা ধূসর রঙের পোশাক পরেছে।’ যুক্তরাষ্ট্রে উজ্জ্বল রঙের পোশাক ও গাঢ় মেকআপে অভ্যস্ত স্মিথ সিউলের ভিড়ে নিজেকে কিছুটা বেমানান মনে করেন। শিক্ষার্থীরা তাঁর পোশাকের প্রশংসা করলেও প্রায়ই বলে, ‘এই স্টাইলটা তোমাকে ঠিক মানাচ্ছে না।’ একবার একটি নামী ব্র্যান্ডের দোকানে কমলা রঙের কানের দুল কিনতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, কোরিয়ায় সেই ডিজাইন বিক্রি হয় না। কারণ হিসেবে বিক্রয়কর্মী সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন, এই রঙের চাহিদাই নেই।

পরিসংখ্যান যা বলছে

স্মিথের অভিজ্ঞতা কোনো ব্যতিক্রম নয়। সিজে লজিস্টিকসের ‘এভরিডে লাইফ রিপোর্ট’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কোরিয়ায় পোশাকের মধ্যে কালো রঙের অংশ ৩৮ শতাংশ, সাদা ১৫ শতাংশ এবং ধূসর ৯ শতাংশ। সব মিলিয়ে একরঙের পোশাকের হার দাঁড়ায় ৬২ শতাংশ। কোরিয়ায় পোশাক নির্বাচনে এই রংগুলোর আধিপত্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তথ্য ভোক্তাদের বাস্তব পছন্দের ওপর তৈরি করা হয়েছে।

সামাজিক চাপ ও ‘মিশে যাওয়ার’ মানসিকতা

৩৪ বছর বয়সী কওন ইউন-জি জানান, তাঁর আলমারির বেশির ভাগ পোশাক সাদা, কালো ও নেভি ব্লু। একসময় লাল ডোরা দেওয়া একটি পোলো শার্ট তাঁর পছন্দ হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি নেভি রঙেরটাই কিনেছিলেন। কারণ, তাঁর ভয় ছিল, লাল রংটা হয়তো বেশি চোখে পড়বে। একদিন অফিসে হলুদ রঙের কার্ডিগান পরে যাওয়ার পর সহকর্মীদের নানা মন্তব্য তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলে। কওন বলেন, ‘কেউ আমার পোশাক নিয়ে মন্তব্য করুক সেটা চাই না। শুধু সবার সঙ্গে মিশে থাকতে চাই।’

ছবি: ফ্রিপিক
ছবি: ফ্রিপিক

একটি জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের ৪১ শতাংশ ইচ্ছাকৃতভাবে এক রঙের পোশাক বেছে নেয়; যাতে তারা আলাদা করে নজরে না পড়ে। কমিউনিটি ও দলগত মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়া সমাজে খুব আলাদা পোশাক অনেক সময় অদৃশ্য সামাজিক চাপ তৈরি করে।

সংস্কৃতির শিকড় কোথায়

বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পেছনে রয়েছে সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা। নিরপেক্ষ রং কোরিয়ান সংস্কৃতিতে বিনয়, সংযম ও সামঞ্জস্যের প্রতীক। অতীতে কোরিয়ানদের বলা হতো ‘সাদা পোশাকের মানুষ’। কারণ, ঐতিহ্যবাহী সাদা হানবক ছিল তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। সময়ের সঙ্গে সেই রুচি সাদা থেকে কালো ও ধূসর রঙেও বদলেছে। আজ এই রংগুলোকে পরিশীলন, স্থিরতা ও আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।

ছবি: ফ্রিপিক
ছবি: ফ্রিপিক

ব্যস্ত জীবনে ব্যবহারিক সুবিধা

সংস্কৃতির পাশাপাশি আধুনিক জীবনের ব্যস্ততাও এই প্রবণতাকে আরও জোরদার করেছে। ৩৩ বছর বয়সী অফিসকর্মী পার্ক নাম-জিন বলেন, ‘এক রঙের পোশাক পরতে অন্য পোশাকের সঙ্গে সহজে মেলানো যায়। সকালে তৈরি হতে সময় কম লাগে, আবার দেখতেও গোছানো লাগে।’ ফ্যাশন বিশেষজ্ঞদের মতে, কালো ও সাদা পোশাক প্রায় সব ধরনের কাপড় ও স্টাইলের সঙ্গে মানিয়ে যায়। ফলে ফ্যাশন বদলেও এগুলো দ্রুত অচল হয়ে পড়ে না। এ কারণেই কালো-সাদা টি-শার্ট সব সময় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়।

শীতের সিউল আর কালো কোট

শীতকালে সিউলের রাস্তায় তাকালেই চোখে পড়ে কালো লং-প্যাডেড জ্যাকেটের সারি। কারণও খুব সাধারণ, শীতের জ্যাকেট দামি, বারবার কেনা হয় না, আর কালো রং ময়লা সহজে ঢেকে রাখে।

একজন ফ্যাশন বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘এখানে রং মানে শুধু পোশাক নয়, এটি হলো সামঞ্জস্য। কী পরছেন, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনি চারপাশের সঙ্গে কতটা মানিয়ে চলছেন।’

সূত্র: কোরিয়া হেরাল্ড

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

মাথার ওপর মরুকরণ: কেন বিশ্বজুড়ে কমছে পুরুষের চুলের ঘনত্ব

ফিচার ডেস্ক
মাথার ওপর ঘাস কম থাকলেও যদি ভেতরে উর্বরতা থাকে, তবে জীবনটা কিন্তু মোটেও পানসে নয়। ছবি: পেক্সেলস
মাথার ওপর ঘাস কম থাকলেও যদি ভেতরে উর্বরতা থাকে, তবে জীবনটা কিন্তু মোটেও পানসে নয়। ছবি: পেক্সেলস

বাঙালি সমাজে চুল পড়া কিংবা টাক নিয়ে নানান কথা প্রচলিত আছে। কথাগুলো কৌতুকপূর্ণ হলেও আধুনিক বিশ্বের পুরুষদের জন্য এটি এক পরম দীর্ঘশ্বাসের নাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কপালে হাত বুলিয়ে যখন দেখা যায় ‘হেয়ারলাইন’ দিন দিন সীমান্তের মতো পিছু হটছে, তখন কারই বা মন ভালো থাকে? কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, আপনি একা নন। মাথার ওপর এই ‘মরুকরণ’ এখন বিশ্বজুড়ে এক মহোৎসবের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মাথার ওপর ঘাস কম থাকলেও যদি ভেতরে উর্বরতা থাকে, তবে জীবনটা কিন্তু মোটেও পানসে নয়; বরং এক চিলতে রোদ মাথায় মেখে আভিজাত্যের সঙ্গেই ঘুরে বেড়ান। কারণ, ‘টাক’ এখন বিশ্বজনীন!

স্পেন যখন টাকে চ্যাম্পিয়ন

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ‘টাক’ বা কেশহীন পুরুষের দেশ কোনটি জানেন? উত্তরটা হলো স্পেন। ২০২৪ সালের ডেটা অনুযায়ী, স্পেনের প্রায় ৪৪.৫ শতাংশ পুরুষই হয় টাক, না হয় দ্রুত চুল হারাচ্ছেন তারা। তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে ইতালি ও ফ্রান্স। ইতালিতে ৪৪.৩৭ শতাংশ পুরুষের মাথায় টাক। আর ফ্রান্সে এর সংখ্যা ৪৪.২৫ শতাংশ। ভাবা যায়! অর্ধেক দেশের পুরুষ মাথার মাঝখানে মরুভূমি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিও এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই, তারাও টপ ফাইভের মধ্যে বেশ দাপটের সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে।

পশ্চিমের দেশে হাহাকারের কারণ

গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এশিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকার তুলনায় ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে পুরুষদের মাথায় টাক পড়ার হার লক্ষণীয়ভাবে বেশি। প্রশ্ন উঠতে পারে, পশ্চিমাদের মাথায় কেন এত বাতাসের ঝাপটা? গবেষকেরা বলছেন, এর পেছনে কয়েকটা জম্পেশ কারণ আছে। প্রথম কারণ জিনতত্ত্ব। ককেশীয় বা সাদা চামড়ার পুরুষদের ডিএনএতেই নাকি চুল পড়ার একটা সহজাত প্রবণতা আছে। দ্বিতীয়ত, খাদ্যাভ্যাস। বার্গার, প্রক্রিয়াজাত মিট আর ভিটামিনের অভাব তাদের চুলের গোড়াকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে। চুল পড়া সরাসরি বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত। পশ্চিমা দেশগুলোতে (যেমন যুক্তরাজ্য) পুরুষদের গড় বয়স সাধারণত ৪০ বছর। অন্যদিকে ভারত বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা বেশি। জনসংখ্যার গড় বয়স বেশি হওয়ার কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে টাক পড়া পুরুষদের সংখ্যা বেশি দেখা যায়। সেই সঙ্গে আছে ইউরোপ-আমেরিকার অতিরিক্ত কর্মব্যস্ততা ও মানসিক চাপ। মানে, পকেটে টাকা এলেও মাথায় চুল টিকছে না। এর পেছনে কাজ করে মূলত পাঁচটি প্রধান কারণ।

জনসংখ্যার গড় বয়স বেশি হওয়ার কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে টাক পড়া পুরুষদের সংখ্যা বেশি দেখা যায়। ছবি: পেক্সেলস
জনসংখ্যার গড় বয়স বেশি হওয়ার কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে টাক পড়া পুরুষদের সংখ্যা বেশি দেখা যায়। ছবি: পেক্সেলস

এশীয়রা কি তবে নিরাপদ

মজার বিষয় হলো, আমাদের এশিয়ায় টাক পড়ার হার তুলনামূলক অনেক কম। ইন্দোনেশিয়া এই তালিকার একদম নিচে, মাত্র ২৬.৯৬ শতাংশ। ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ার পুরুষদের মাথায়ও এখনো বেশ জঙ্গল টিকে আছে। তবে এশিয়ায় টাকে চ্যাম্পিয়ন কিন্তু জাপান। ২০১১ সালের এক জরিপ বলছে, এশীয় দেশগুলোর মধ্যে জাপানিরাই সবচেয়ে বেশি চুল হারান। চীন ও ভারতেও এখন এই সমস্যা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, যদিও পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় তা এখনো নস্যি। ২০২৪ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী এশিয়ার দেশ হিসেবে তালিকায় সবার ওপরে আছে তুরস্ক। দেশটির ৪০.০৩ শতাংশ পুরুষের মাথায় টাক। এরপর আছে সৌদি আরব ৩৯.৭৫ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩৮.১ শতাংশ, জাপান ৩৫.৬৯ শতাংশ, ইরান ৩৫.০৩ শতাংশ, ভারত ৩৪.০৬ শতাংশ, পাকিস্তান ৩৩.৬৪ শতাংশ, ইসরায়েল ৩৩.৫৬ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া ৩২.২৭ শতাংশ, থাইল্যান্ড ৩০.৯৪ শতাংশ, চীন ৩০.৮১ শতাংশ, মালয়েশিয়া ২৯.২৪ শতাংশ, ফিলিপাইন ২৮ শতাংশ ও সবশেষে আছে ইন্দোনেশিয়া, ২৬.৯৬ শতাংশ।

ককেশীয় বা সাদা চামড়ার পুরুষদের ডিএনএ-তেই নাকি চুল পড়ার একটা সহজাত প্রবণতা আছে। ছবি: পেক্সেলস
ককেশীয় বা সাদা চামড়ার পুরুষদের ডিএনএ-তেই নাকি চুল পড়ার একটা সহজাত প্রবণতা আছে। ছবি: পেক্সেলস

টাক পড়ার মহৌষধি ও ঘরসংসার

টাক পড়া নিয়ে এখন আর কেউ ঘরে বসে হাপিত্যেশ করেন না। নরওয়ের পুরুষেরা যেমন টাক পড়াকে বার্ধক্যের সহজ নিয়ম হিসেবে মেনে নিয়ে ক্লিন শেভ লুকে স্টাইল করেন। আবার যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট কিংবা চুল প্রতিস্থাপনের বাজার এখন তুঙ্গে। আমাদের দেশেও এখন হরেক রকম তেলের বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি ডাক্তারদের কাছে ভিড় বাড়ছে। কেউ কেউ তো আবার রসিকতা করে বলেন, ‘মাথায় চুল নেই তো কী হয়েছে, বুদ্ধি তো সব ভেতরেই জমছে!’

টাকই যখন আভিজাত্য

চুল পড়া শুধু বংশগতি বা হরমোনের খেলা নয়, এটি এখন আমাদের জীবনযাত্রার এক আয়না। তবে স্পেন বা ইতালির মতো দেশগুলো আমাদের একটা দারুণ শিক্ষা দেয়, চুলে জঙ্গল থাকুক বা না থাকুক, আত্মবিশ্বাসটা যেন ষোলো আনা থাকে। তাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ‘চকচকে’ মাথা দেখে মন খারাপ না করে ভাবুন, বিশ্বের প্রায় ৪২ শতাংশ পুরুষই আপনার এই দলে আছেন।

সূত্র: মেডিহেয়ার, স্ট্যাটিস্টা, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত