Ajker Patrika

ইথিওপীয় ইহুদিদের জন্মনিয়ন্ত্রণে ইসরায়েলি ষড়যন্ত্র যেভাবে ফাঁস হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ জুন ২০২৫, ১৪: ৫৯
সম্মতি ছাড়াই অভিবাসী ইথিওপীয় নারীদের গর্ভনিরোধক ইনজেকশন প্রয়োগ করে ইসরায়েল। ছবি: এএফপি
সম্মতি ছাড়াই অভিবাসী ইথিওপীয় নারীদের গর্ভনিরোধক ইনজেকশন প্রয়োগ করে ইসরায়েল। ছবি: এএফপি

ইথিওপিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদিদের ব্যাপারে ইসরায়েলি সরকার বরাবরই বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছে। এমনকি কিছু ইহুদি রাব্বি মনে করেন, ইথিওপিয়ার লোকেরা প্রকৃত ইহুদি নয়। এমনকি ইথিওপিয়ার ইহুদিদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের গোপন ব্যবস্থাও নিয়েছিল ইসরায়েলি সরকার।

এক দশক আগে সম্মতি ছাড়াই অভিবাসী ইথিওপীয় নারীদের গর্ভনিরোধক ইনজেকশন প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছিল ইসরায়েল সরকারের বিরুদ্ধে। অভিবাসন আটকে যাবে—এমন ভয় দেখিয়ে ইনজেকশনটি সম্পর্কে কোনো তথ্য না দিয়েই তাঁদের সেটি গ্রহণে বাধ্য করা হয়। ব্যাপক বিতর্কের মুখে অভিযোগটি তদন্ত শুরু করে ইসরায়েলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

এ নিয়ে ২০১৩ সালে সব অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বাধ্য হয়ে ইসরায়েলের তৎকালীন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ইয়োকোভ লিৎজম্যানের নেতৃত্বে তদন্তের ঘোষণা দেওয়া হয়। যদিও আগে এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিল ইসরায়েলি সরকার।

বিষয়টি প্রথম সামনে আসে ২০১২ সালে। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, এক দশকে ইসরায়েলে বসবাসরত ইথিওপীয় নারীদের মধ্যে জন্মহার অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, হাজার হাজার ইথিওপীয় নারীকে তিন মাস অন্ত ‘ডিপো-প্রোভেরা’ নামের একটি ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে ইসরায়েলি ক্লিনিকগুলোতে। যেটি মূলত একটি গর্ভনিরোধক ইনজেকশন। দীর্ঘদিন এটি গ্রহণের ফলে নারীদের পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। ঝুঁকি তৈরি হয় বন্ধ্যত্ব এবং অস্টিওপোরোসিসের মতো রোগের।

২০১২ সালে এ নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র সম্প্রচারিত হয়। যাতে দেখানো হয়, ইথিওপিয়ার ট্রানজিট ক্যাম্পগুলোতেই নারীদের এই গর্ভনিরোধক ইনজেকশন দেওয়া শুরু হয়। তবে, এটি আসলে কী ইনজেকশন, এর ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক কিংবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানানো হয়নি কাউকেই। পরবর্তীতে তাঁরা ইসরায়েলে পৌঁছানোর পরও, চলতে থাকে এই ‘‘চিকিৎসা’। তবে এই নীতির সূচনা কে বা কারা করেছিল সেটি প্রামাণ্যচিত্রে স্পষ্ট করা হয়নি। কারণ ইসরায়েল এবং ইথিওপিয়া—কেউই এর দায় স্বীকার করতে রাজি হয়নি।

প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য ইসরায়েলে বসবাসরত ৩৫ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেন সাবা রিউবেন নামের এক নারী। সাবা নিজেও ইথিওপীয় অভিবাসী। তিনি ১৯৮৪ সাল থেকে ইসরায়েলে বসবাস করছেন। তিনি জানান, তিনি যখন সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তখনো ২৫ জন নারী গর্ভনিরোধক ইনজেকশন নিচ্ছিলেন।

ওই ২৫ জনের একজন রিউবেনকে বলেন, তিনি এত দিন জানতেন তাঁকে ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছিল। আরেক নারী রিউবেনকে জানান, যখন ট্রানজিট ক্যাম্পে পৌঁছান তখন তিনি গর্ভবর্তী ছিলেন। কিন্তু ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর সব গর্ভবর্তী নারীকে জড়ো করে জানানো হয় যে তাঁদের ডিপো প্রোভেরা দেওয়া হবে, কারণ ইসরায়েলে গিয়ে সন্তান জন্ম দেওয়া তাঁদের জন্য ‘খুবই কঠিন’ হবে।

তাঁরা ইনজেকশনটি নিতে রাজি হয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, ‘না, আমরা নিতে চাইনি। আমরা বলেছিলাম, আমরা এটা চাই না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হয়। কারণ আমাদের বলা হয়েছিল, যদি ইনজেকশন না নিই, তাহলে ইসরায়েলে অভিবাসন আটকে যাবে এবং ক্যাম্পে আর কোনো স্বাস্থ্যসেবা পাব না।’ রিউবেন জানান, শুধু ওই নারী নন, অসংখ্য নারী এমন ঘটনার শিকার।

ইথিওপীয়দের অভিযোগ—ইসরায়েলের ইথিওপীয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই এমন ঘৃণ্য পদক্ষেপ নেয় ইসরায়েল। তবে, ওই সময় এ অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে ইসরায়েল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, ‘ইসরায়েলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডিপো প্রোভেরা ইনজেকশনের ব্যবহার সব সময় নিরুৎসাহিত করে। যদি ইসরায়েলের কোথাও এ ঘটনা ঘটে থাকে, তবে তা আমাদের অবস্থানের পরিপন্থী।’

তবে, রিউবেন বলছেন, তাঁর কাছে ইথিওপিয়ার এক ক্লিনিককে লেখা ইসরায়েলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠি আছে। ওই চিঠিতে বিপুলসংখ্যক নারীকে ডিপো-প্রোভেরা প্রয়োগের জন্য ওই ক্লিনিকের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের ধন্যবাদ দিয়েছে ইসরায়েলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। চিঠিটি ২০০ সালে লেখা হয়েছিল বলে জানান তিনি।

রিউবেন ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বলছে, ইথিওপীয় নারীরা নাকি স্বেচ্ছায় এই ইনজেকশন নিচ্ছে। তবে, এটা সত্যি নয়। কারণ, ইথিওপিয়ায় বহু সন্তান থাকাকে সম্মানের মনে করা হয়। অনেক সন্তান থাকার অর্থ তিনি খুব ধনী।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটি ইসরায়েলের একটি পরিকল্পিত নীতি। বেছে বেছে নতুন আসা ইথিওপীয় অভিবাসীদের লক্ষ্যবস্তু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কারণ তারা ভালো করে হিব্রু জানে না, কর্তৃপক্ষকে অন্ধভাবে মান্য করে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এমন ঘৃণ্য কাজ করছে তারা।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেন শুধু ইথিওপীয় নারীদেরই ইসরায়েলে ডিপো-প্রোভেরা দেওয়া হচ্ছে?

জেরুজালেমের হাদাসা মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মুশিরা আবুদিয়া ওই সময় গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি যেসব ইথিওপীয় নারীর সঙ্গে দেখা করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই ডিপো-প্রোভেরা ইনজেকশন নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটি এমন এক নীতি, যার কথা কেউ স্বীকার করে না। ইসরায়েলে কেউ এই চিকিৎসার দায়িত্ব নিচ্ছে না, কিন্তু কেউ না কেউ তো অবশ্যই এটি শুরু করেছে। আর যেহেতু এই নারীরা দেশ ছাড়ার প্রস্তুতিতে ছিল, ইথিওপিয়ার স্বার্থে তাদের এই চিকিৎসা দেওয়া যুক্তিসংগত নয়।’

গত এক দশকে ইসরায়েলে গেছেন ৫০ হাজারেরও বেশি ইথিওপীয় নারী। তবে, ইসরায়েলে নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে তাঁদের। এর আগে ১৯৯৬ ইথিওপীয়দের দান করা সব রক্ত ধ্বংস করে ফেলেছিল ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। অজুহাত দিয়েছিল—এসব রক্তে মরণব্যাধি এইডসের ভাইরাস ‘এইচআইভি’ থাকতে পারে। এই ঘটনার পরই ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল হাজার হাজার ইথিওপীয় অভিবাসী।

উল্লেখ্য, ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের নির্দেশে, ১৯৮০-র দশকের শুরুর দিকে ইসরায়েলের মোসাদ গোয়েন্দা সংস্থা বেশ কয়েকটি গোপন অভিযানের মাধ্যমে সুদানের শরণার্থীশিবির থেকে প্রথম ইথিওপীয় ইহুদিদের ইসরায়েলে নিয়ে আসে।

এরপর আরও কয়েকটি অভিযান চলে এবং ১৯৯১ সালে ইথিওপিয়া থেকে আকাশপথে স্থানান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘটে।

শুরু থেকেই ইসরায়েলে ইথিওপীয় ইহুদিদের একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়াটি ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। ইথিওপীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের হার অনেক বেশি এবং তারা বৈষম্যের শিকারও হন। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

এই বৈষম্যের পেছনে শুধু গায়ের রংই নয়, ধর্মীয় গোঁড়ামিও ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে ইহুদি ধর্মীয় নেতারা নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বর্ণবাদ জারি রেখেছেন। হাসিদিক, আশকেনাজি এবং সেফারদিক—এই শব্দগুলো ইহুদি পরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।

হাসিদিক বলতে বোঝায় পূর্ব ইউরোপ থেকে উদ্ভূত একটি সুনির্দিষ্ট, কট্টর-অর্থোডক্স ইহুদি আন্দোলনের অনুসারী। অন্যদিকে, আশকেনাজি মূলত মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের এবং সেফারদিরা স্পেন, পর্তুগাল, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বংশোদ্ভূত।

ইসরায়েলের আশকেনাজি ইহুদি রাব্বিরা নিজেদের অভিজাত ও খাঁটি রক্তের ইহুদি বলে দাবি করেন। তাঁরা বাকিদের তাঁদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত নিচু বর্ণের ইহুদি বলে মনে করেন। এমনকি বিশেষ করে আরব ও আফ্রিকার ইহুদিদের তাঁরা প্রকৃত ইহুদি বলে মনে করেন না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

প্রথম দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আব্দিরাহমান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: টাইমস অব ইসরায়েল
সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আব্দিরাহমান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: টাইমস অব ইসরায়েল

সোমালিল্যান্ডকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নতুন নজির স্থাপন করেছে ইসরায়েল। এর মধ্য দিয়ে আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী ভূখণ্ডটি ৩০ বছরেরও বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো কোনো রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি পেল।

শুক্রবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, ইসরায়েল ও সোমালিল্যান্ড একটি যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। নেতানিয়াহু একে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গড়ে ওঠা ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। এই চুক্তির আওতায় দুই দেশ রাষ্ট্রদূত নিয়োগ ও পরস্পরের দেশে দূতাবাস খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শুক্রবার রাতে (২৬ ডিসেম্বর) এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে আল-জাজিরা জানিয়েছে, ১৯৯১ সালে সোমালিয়া থেকে একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও সোমালিল্যান্ড এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।

সোমালিয়া সরকার বরাবরই সোমালিল্যান্ডের স্বাধীনতাকে প্রত্যাখ্যান করে আসছে। ইসরায়েলের ঘোষণার পর সোমালিয়ার সরকার একটি জরুরি বৈঠক ডাকে। এই বৈঠক থেকে ফোনালাপে মিসর, তুরস্ক ও জিবুতির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দেশটির ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ইসরায়েলের এমন স্বীকৃতিকে জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী এবং ‘বিপজ্জনক নজির’ বলে আখ্যা দিয়েছে মিসর।

আল-জাজিরা জানিয়েছে, ভিডিও কলে সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আব্দিরাহমান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহিকে (আব্দিরাহমান সিরো) অভিনন্দন জানান নেতানিয়াহু এবং তাঁকে ইসরায়েল সফরের আমন্ত্রণ জানান। সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট একে ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ উল্লেখ করে আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার পর এই স্বীকৃতি সোমালিল্যান্ডের জন্য বড় সাফল্য হলেও এটি সোমালিয়ার ভেতরে নতুন বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাকে উসকে দিতে পারে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর রিপাবলিকান দলের কিছু প্রভাবশালী নেতা বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের সিদ্ধান্ত আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নাজিব রাজাকের ১৫ বছরের কারাদণ্ড, জটিল সমীকরণে মালয়েশিয়ার সরকার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বর্তমানে অন্য একটি মামলায় জেল খাটছেন; যার মেয়াদ ২০২৮ সালে শেষ হবে। ছবি: এএফপি
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বর্তমানে অন্য একটি মামলায় জেল খাটছেন; যার মেয়াদ ২০২৮ সালে শেষ হবে। ছবি: এএফপি

মালয়েশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থ কেলেঙ্কারি মামলায় দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আজ শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) কুয়ালালামপুর হাইকোর্টের বিচারক কলিন লরেন্স সেকুয়েরাহ এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে তাঁকে ১১ দশমিক ৪ বিলিয়ন রিঙ্গিত (প্রায় ২৮০ কোটি মার্কিন ডলার) জরিমানা করা হয়েছে।

৭২ বছর বয়সী নাজিব রাজাককে ক্ষমতার অপব্যবহারের চারটি ও অর্থ পাচারের ২১টিসহ মোট ২৫টি অভিযোগের সব কটিতেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এই রায় মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ, নাজিবের দল ইউএমএনও বর্তমান সরকারের একটি বড় অংশীদার।

পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলা রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক সেকুয়েরাহ নাজিবের আত্মপক্ষ সমর্থনের সব যুক্তি নাকচ করে দেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক দাবি করেছিলেন, ওয়ানএমডিবির কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। কিন্তু বিচারক তাঁর এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এটি বিশ্বাস করা মানে কল্পনাকে রূপকথার রাজ্যে নিয়ে যাওয়া। ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হিসেবে নাজিব মোটেও কোনো ‘অবুঝ গ্রাম্য লোক’ নন, তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান।

বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন, নাজিবের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো কোনো ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বিষয় নয়, বরং ‘কঠিন ও অকাট্য’ দালিলিক প্রমাণ বলছে তিনি নিজের ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করেছেন।

আদালত নাজিবকে ১১ দশমিক ৪ বিলিয়ন রিঙ্গিত জরিমানা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এই জরিমানা পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাঁকে অতিরিক্ত আরও ১০ বছরের জেল খাটতে হতে পারে।

আদালত ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য প্রতিটি অভিযোগে ১৫ বছর এবং অর্থ পাচারের জন্য পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন। তবে সব সাজার মেয়াদ একই সঙ্গে কার্যকর হবে, ফলে তাঁকে মোট ১৫ বছর জেল খাটতে হবে।

এদিকে নাজিব বর্তমানে অন্য একটি মামলায় জেল খাটছেন যার মেয়াদ ২০২৮ সালে শেষ হবে। নতুন এই সাজা সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে কার্যকর হবে।

তবে এই রায়ের ফলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে অস্থিরতা বাড়তে পারে। কারণ, নাজিবের দল ইউএমএনও বর্তমান সরকারের একটি বড় অংশীদার। ফলে দুর্নীতিবিরোধী ভাবমূর্তি নিয়ে ক্ষমতায় আসা আনোয়ার ইব্রাহিমের জন্য এটি একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

২০২২ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়ায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে কোনো দল বা জোটই সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন নিশ্চিত করতে না পারায়, শেষমেশ আনোয়ার ইব্রাহিমের দল পাকাতান হারাপান (পিএইচ) জোট সরকার গঠন করে। এর মধ্যে পিএইচর ৮২টি, ইউনাইটেড মালয়জ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) ২৬টি ও বারিসান ন্যাসিওনালের (বিএন) চারটি আসন নিয়ে এই জোট সরকার গঠিত হয়।

জেলখানায় থাকলেও দলের ওপর নাজিবের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এই রায়ের পর দলের ভেতর থেকে আনোয়ার ইব্রাহিমের ওপর চাপ সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদি কোনো কারণে ইউএমএনও বর্তমান জোট সরকার থেকে সরে যায়, তবে বিপাকে পড়বেন আনোয়ার ইব্রাহিম।

নাজিবের প্রধান আইনজীবী মুহাম্মদ শাফি আবদুল্লাহ জানিয়েছেন, তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আগামী সোমবার আপিল করবেন।

রায়ের পর এক বিবৃতিতে নাজিব রাজাক দেশবাসীকে শান্ত ও ধৈর্যশীল থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই লড়াই দায়িত্ব এড়ানোর জন্য নয়, বরং ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য।’ তবে এই দণ্ডাদেশের ফলে নাজিবের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের পথ কার্যত বন্ধ হয়ে গেল বলে মনে করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বারহাদ বা ওয়ানএমডিবি হলো মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রমালিকানাধীন একটি কৌশলগত উন্নয়ন সংস্থা। মূলত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এটি তৈরি হয়েছিল, কিন্তু পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকসহ সংশ্লিষ্টরা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন।

২০১৫ সালে ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারির ঘটনাটি প্রথম সামনে আসে, যা ২০১৮ সালের নির্বাচনে নাজিব রাজাকের দলের দীর্ঘ ছয় দশকের শাসনের অবসান ঘটায়। এর আগে ২০২০ সালে অন্য একটি মামলায় নাজিবকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যা পরে কমিয়ে ছয় বছর করা হয়। সাত বছর ধরে চলা এই দীর্ঘ আইনিপ্রক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিয়ে ফের উদ্বেগ জানাল ভারত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। ছবি: এএনআই
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। ছবি: এএনআই

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও ময়মনসিংহে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ফের তীব্র নিন্দা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। আজ শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) এক নিয়মিত ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশের ময়মনসিংহে ২৭ বছর বয়সী হিন্দু যুবক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার কথা উল্লেখ করে রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশে এক হিন্দু যুবককে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা আশা করি, এই জঘন্য অপরাধের হোতাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’

রণধীর জানান, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমাগত সহিংসতা ও বৈরী আচরণকে ভারত সরকার একটি ‘গভীর উদ্বেগের বিষয়’ হিসেবে দেখছে। ভারত নিয়মিত এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণও করছে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়ে দিল্লির অবস্থান পুনরায় পরিষ্কার করে মুখপাত্র বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে ভারতের অবস্থান শুরু থেকেই স্পষ্ট ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমরা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চাই এবং আমরা সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পক্ষে।’

ভারত বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় বলেও মন্তব্য করেন রণধীর জয়সওয়াল।

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে ভালুকার জামিরদিয়া এলাকার পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড কারখানায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দীপু চন্দ্র দাসকে গণপিটুনি দেয় স্থানীয় উত্তেজিত জনতা। পরে তাঁর মরদেহ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে রাত আড়াইটার দিকে অর্ধপোড়া মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়।

গত শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) বিকেলে নিহত ব্যক্তির ছোট ভাই অপু চন্দ্র দাস বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১৫০-১৬০ জনকে আসামি করে ভালুকা থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নামাজরত ফিলিস্তিনির ওপর গাড়ি চালিয়ে দিলেন ইসরায়েলি সেনা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

ইসরায়েল অধিকৃত গাজার পশ্চিম তীরে নামাজরত ফিলিস্তিনি ব্যক্তির ওপর বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছেন ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর (আইডিএফ) এক সেনা। গতকাল বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) এই রোমহর্ষক ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে।

আইডিএফ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে অভিযুক্ত সেনাকে দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়েছে বলে জানা গেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, পিঠে রাইফেল ঝোলানো এক ব্যক্তি সিভিল পোশাকে একটি এটিভি চালিয়ে এসে নামাজরত ফিলিস্তিনি ব্যক্তিকে সজোরে ধাক্কা দেন। এতে ওই ব্যক্তি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর ওই সেনাসদস্য চিৎকার করে তাঁকে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার ওই ফিলিস্তিনিকে ঘটনার পর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে তিনি বাড়িতে থাকলেও তাঁর দুই পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁর বাবা মাজিদি আবু মোখো। তিনি আরও অভিযোগ করেন, ভিডিওতে দেখা না গেলেও ওই সেনা তাঁর ছেলের চোখে ‘পিপার স্প্রে’ বা মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছিলেন।

মাজিদি আবু মোখো ফরাসি সংবাদ সংস্থা এএফপিকে জানান, আক্রমণকারী ব্যক্তি ওই এলাকার একজন কট্টরপন্থী ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী। তিনি গ্রামের কাছে একটি অবৈধ চৌকি স্থাপন করেছেন। অন্য বসতি স্থাপনকারীদের নিয়ে তিনি এখানে গবাদিপশু চরাতে আসেন, রাস্তা অবরোধ করেন এবং গ্রামবাসীদের নানাভাবে হুমকি-ধমকি দেন।

আইডিএফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি একজন রিজার্ভ সেনা ছিলেন। ঘটনার পরপরই তাঁকে সামরিক দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার ও শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে তাঁর কাছে থাকা সরকারি অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

দ্য টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সেনাকে গতকাল রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় এবং বর্তমানে তিনি পাঁচ দিনের জন্য গৃহবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। এর আগে ওই ব্যক্তি গ্রামে গুলিবর্ষণ করেছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালটি গাজার পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের (বসতি স্থাপনকারী) হামলার ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টিকারী ‘সহিংস বছর’।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত ও ২৫১ জন অপহৃত হয়। এর জবাবে ইসরায়েলের টানা দুই বছরের যুদ্ধে গাজায় এ পর্যন্ত প্রায় ৭১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অর্ধেকই নারী ও শিশু।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত