Ajker Patrika

‘গণহত্যা’ চালিয়ে এবার সেই রোহিঙ্গাদেরই সাহায্য চাইছে জান্তা বাহিনী

আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫: ৫২
‘গণহত্যা’ চালিয়ে এবার সেই রোহিঙ্গাদেরই সাহায্য চাইছে জান্তা বাহিনী

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা রোহিঙ্গাদের ওপর আজ থেকে সাত বছর আগে ভয়াবহ ‘জাতিগত নিধন’ চালিয়েছে ক্ষমতাসীন জান্তা বাহিনী। সেই জান্তাই এবার বিদ্রোহ দমনে রোহিঙ্গাদের সহায়তা চাইছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। 

রাখাইনের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি জেনেছে, এরই মধ্যে জান্তা বাহিনী অন্তত ১০০ রোহিঙ্গাকে বাহিনীতে ভর্তি করেছে। তাঁদের একজন মোহাম্মদ (নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকৃত নাম প্রকাশ করা হয়নি)। তিনি জানান, জান্তা বাহিনীকে তিনি সব সময়ই ভয় করেছেন। কিন্তু তারপরও যেতে হয়েছে। কারণ, মোহাম্মদ যদি সেনাবাহিনী ভর্তি না হন, তবে তাঁর পরিবারের ক্ষতি করা হবে। 

মোহাম্মদের মতো আরও শতাধিক তরুণ-যুবাকে জোর করে জান্তা বাহিনীতে ভর্তি করানো হয়েছে ভয়ভীতি দেখিয়ে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আরও একাধিক রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ের কাছের যে আশ্রয় শিবিরে তাঁরা থাকেন, সেখানে প্রায় প্রতিদিন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা এসে বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য ভয় দেখিয়ে যায়। 

চরম পরিহাসের বিষয় হলো—যে রোহিঙ্গাদের জোর করে জান্তা বাহিনীতে ঢোকানো হচ্ছে, মিয়ানমারের সংবিধানে তাঁরা স্থানীয় নৃগোষ্ঠী হিসেবেই বিবেচিত না। তাদের নাগরিকত্বই অস্বীকার করা হয় এখনো দেশটিতে। এমনকি, দেশের ভেতরেও তাদের চলাচল সীমাবদ্ধ, যেতে দেওয়া হয় না দেশের বাইরেও। 

রোহিঙ্গাদের ওপর এই নির্যাতন নতুন কোনো ঘটনা নয়। ২০১২ সালে রোহিঙ্গাদের জোর করে বিভিন্ন নোংরা ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য করে। পাঁচ বছর পর, ২০১৭ সালে জান্তা বাহিনীর ‘জাতিগত নিধন অভিযানের’ কারণে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সে সময় রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর ব্যাপক আকারে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। মিয়ানমারে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার কার্যক্রম চলছে।

যে জান্তা বাহিনী একসময় রোহিঙ্গাদের জোর করে নিজ বাসভূমি ছাড়তে বাধ্য করেছে, সেই জান্তাই এবার তাদের আবার জোর করে সেনাসদস্য হিসেবে ভর্তি করছে। বিশেষ করে, স্থানীয় নৃগোষ্ঠী বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির কাছে ব্যাপক মার খাওয়ার পর এই প্রক্রিয়ার গতি বেড়েছে গেছে। 
 
আরাকান আর্মিসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছে ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণও হারাচ্ছে। একই সঙ্গে হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ সেনাও। হতাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক সেনাই আত্মসমর্পণ করছে অথবা পালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এদের বিকল্প কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, কেউই জনবিচ্ছিন্ন ও অজনপ্রিয় জান্তা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে চাইছেন না। 

এই অবস্থায় রোহিঙ্গাদের লক্ষ্যবস্তু করার কারণ একটাই, তাদের আরও এক দফায় কামানের গোলার মুখে ঠেলে দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মোহাম্মদের কথা থেকে। তিনি জানান, মাত্র দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়েই তাদের রণক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ বলেন, ‘আমার কোনো ধারণাই নেই যে আমি কেন যুদ্ধ করছি। কিন্তু তারা আমাকে রাখাইনেরই গ্রামে মানুষের ওপর গুলি চালাতে বলেছে।’

আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে টানা ১১ দিন যুদ্ধের পর মোহাম্মদদের দলে খাবারের সংকট দেখা দেয়। একপর্যায়ে তাঁদের ঘাঁটিতে আরাকান আর্মির গোলা এসে পড়লে মোহাম্মদের সামনেই অনেকেই নিহত হন। তিনি নিজেও আহত হন। পরে তাঁকে সিতওয়েতে নেওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে মোহাম্মদ আবারও তাঁর পরিবারের কাছে ফিরে যান ক্যাম্পে। তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে ফিরে আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে অনেক কেঁদেছি।’ 

মোহাম্মদের মতো আরও অনেকেই জান্তা বাহিনীতে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছেন। তবে বাহিনীর মুখপাত্র জেনারেল জাও মিন তুন রোহিঙ্গাদের সেনা হিসেবে সম্মুখ সমরে পাঠানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই। তাই আমরা কেবল তাদের নিজেদের প্রতিরক্ষার কাছে সাহায্য করতে বলেছি।’ 

কিন্তু বিবিসিকে অন্তত সাক রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, তাঁরা অন্তত ১০০ জনকে চেনেন, যাঁদের জান্তা বাহিনী জোর করে ভর্তি করেছে এবং যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছে। তাঁরা বলেছেন, জান্তা বাহিনী ও স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা গত ফেব্রুয়ারিতে আশ্রয় ক্যাম্পে এসে ঘোষণা করে, অল্পবয়সী রোহিঙ্গা পুরুষদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হবে। এ সময় তারা রোহিঙ্গাদের খাবার, বেতন ও স্থায়ী নাগরিকত্ব দেওয়ার লোভ দেখিয়েছিল। 

আরাকান আর্মি তীব্র আক্রমণের মুখে রাখাইনের আশ্রয় ক্যাম্পগুলোতে খাবার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক সরবরাহ লাইন ব্যবস্থা ধসে পড়ায় এই সংকট আরও তীব্র হয়েছে। এর বাইরে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার লোভ আরও বড় একটি ভূমিকা রেখেছে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার পেছনে। কিন্তু বাস্তবতা হলো রোহিঙ্গা পুরুষদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করার পর নাগরিকত্ব দেওয়ার স্বপ্ন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। 

নাগরিকত্ব না দিলেও জান্তা বাহিনী ক্রমান্বয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে অনবরত। তাই ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতারা বাধ্য হয়ে তুলনামূলক গরিবদের উদ্বুদ্ধ করছেন সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে। মূলত, তাদের ভয়—তরুণেরা ভর্তি না হলে তাদের বর্তমান যে আশ্রয় সেটাও কেড়ে নেওয়া হবে। 

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না দিয়ে জান্তা বাহিনীতে ভর্তি করার বিষয়টিকে বেআইনি বলে আখ্যায়িত করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা। মানবাধিকার সংগঠন ফর্টিফাই রাইটসের কর্মী ম্যাথু স্মিথ বলেন, ‘এই নিয়োগ বেআইনি ও জোরপূর্বক শ্রমের সঙ্গে তুলনীয়।’ 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের জান্তা বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান রেজিম মিয়ানমারে আবারও জাতিগত সহিংসতা উসকে দেওয়ার রাস্তা খুলে দিয়েছে। বিশেষ করে, রাখাইনে যে বৌদ্ধরা আছে, তারা দীর্ঘদিন ধরেই জান্তার সমর্থক। ২০১৭ সালে জান্তা বাহিনী যখন রোহিঙ্গা নিধনে নেমেছিল তখন রাখাইন বৌদ্ধরা তাদের সহায়তা করেছে। সেই থেকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত উত্তেজনা চলমান। 

যা-ই হোক, আরাকান আর্মি রাখাইনে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত জয়ের কাছাকাছি আছে। গোষ্ঠীটি রাখাইন রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে আসছে দীর্ঘদিন থেকেই। আরাকান আর্মি এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, রাজ্যটিতে যারা দীর্ঘদিন ধরে বাস করছে তাদের সবাইকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এমনকি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও তারা বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছে। 

কিন্তু জান্তা বাহিনীতে রোহিঙ্গা সদস্য ভর্তির বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি আরাকান আর্মি। গোষ্ঠীটির মুখপাত্র খিয়াং থুখা বিবিসিকে বলেছেন, যারা জান্তা বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সবচেয়ে ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।

জান্তা বাহিনীও বিষয়টিকে বেশ জোরেশোরেই প্রচার করছে। তবে স্থানীয় রোহিঙ্গারা বলছেন, জান্তা বাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বিদ্রোহী হিসেবে তুলে ধরে বিভাজন সৃষ্টি করতে চাইছে। রোহিঙ্গারা এখন এমন এক সেনাবাহিনীর হয়ে লড়াই করতে বাধ্য হয়েছে, যারা মিয়ানমারে তাদের বসবাসের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় না। যার ফলে রোহিঙ্গারা জাতিগত বিদ্রোহীদের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে—যারা শিগগিরই রাখাইনের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে। 

অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী শহরে বোমা ফেলল থাইল্যান্ড

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী শহর পোইপেত। ছবি: বিবিসি
কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী শহর পোইপেত। ছবি: বিবিসি

কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী শহর পোইপেতের কাছে একটি রসদ কেন্দ্র লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালিয়েছে থাইল্যান্ড। পোইপেত শহরটি থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর এবং ক্যাসিনোর জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘর্ষ থামার কোনো লক্ষণ না দেখানোর মধ্যেই এই হামলার ঘটনা ঘটল।

কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) স্থানীয় সময় সকাল ১১টার দিকে পোইপেত পৌর এলাকায় থাই বাহিনী দুটি বোমা ফেলেছে। অন্যদিকে থাইল্যান্ডের বিমানবাহিনীর মুখপাত্র এয়ার মার্শাল জ্যাকক্রিট থাম্মাভিচাই জানিয়েছেন, পোইপেতের বাইরে অবস্থিত একটি স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে বিএম-২১ রকেট মজুত করা হচ্ছিল। তাঁর দাবি, এই অভিযানে কোনো বেসামরিক নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হননি।

বিবিসি জানিয়েছে, বিএম-২১ রকেট সাধারণত সাঁজোয়া যান থেকে একযোগে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে ব্যবহৃত হয়। পোইপেত শহরে এই ধরনের হামলার ঘটনা চলমান সংঘাতে প্রথম বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই শহরটি থাই জুয়াড়িদের কাছে জনপ্রিয় ক্যাসিনো কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত।

চলতি মাসে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘর্ষে থাইল্যান্ডে অন্তত ২১ জন এবং কম্বোডিয়ায় ১৭ জন নিহত হয়েছেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পাশাপাশি প্রায় ৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার থাইল্যান্ড জানিয়েছিল, কম্বোডিয়া সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার থাই নাগরিক পোইপেতে আটকা পড়েছেন। কম্বোডিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সীমান্ত বন্ধকে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য ‘প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করেছে এবং জানিয়েছে, দেশ ছাড়ার জন্য আকাশপথ খোলা রয়েছে।

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার শত বছরের পুরোনো সীমান্ত বিরোধ গত ২৪ জুলাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে, যখন কম্বোডিয়া থাইল্যান্ডে রকেট হামলা চালায় এবং পাল্টা জবাবে থাইল্যান্ড বিমান হামলা শুরু করে। পাঁচ দিনব্যাপী তীব্র লড়াইয়ের পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়া হলেও সেটি গত সপ্তাহে আবার ভেস্তে যায়। সর্বশেষ দফায় উভয় পক্ষই একে অপরকে সংঘর্ষ পুনরায় শুরুর জন্য দায়ী করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বর্তমান বাংলাদেশ একাত্তরের পর সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ: ভারতের সংসদীয় কমিটি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
বর্তমান বাংলাদেশ একাত্তরের পর সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ: ভারতের সংসদীয় কমিটি

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ভারতের জন্য ‘সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কংগ্রেস নেতা শশী থারুরের নেতৃত্বে ভারতের একটি সংসদীয় কমিটি আজ বৃহস্পতিবার সরকারকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে এই সতর্কবার্তা দিয়েছে। কমিটি জানিয়েছে, বাংলাদেশে পরিস্থিতি হয়তো ‘বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতায় পর্যবসিত হবে না’, তবে ভারতকে এটি মোকাবিলায় অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে।

সংসদীয় কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ১৯৭১ সালের সংকটের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করে বলেছে, ১৯৭১ সালে চ্যালেঞ্জ ছিল অস্তিত্ব রক্ষা, মানবিক সংকট ও একটি নতুন জাতির জন্ম নিয়ে। তবে বর্তমান চ্যালেঞ্জটি আরও গুরুতর এবং এটি একটি ‘প্রজন্মগত বিচ্ছিন্নতা’। রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এবং ভারতের দিক থেকে সরে যাওয়ার সম্ভাব্য কৌশলগত পুনর্বিন্যাস।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অস্থিরতার পেছনে কয়েকটি কারণ একসঙ্গে কাজ করছে—ইসলামপন্থী চরমপন্থার উত্থান, চীন ও পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আধিপত্যের পতন।

কমিটি সরকারের কাছে একাধিক সুপারিশ জমা দিয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বলেছে, ভারত যদি এই মুহূর্তে নিজেকে নতুন করে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়, তবে যুদ্ধের কারণে নয়, বরং ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়ার কারণে ঢাকা থেকে কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।

কমিটি বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক পুনর্গঠন ও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে, অবকাঠামো উন্নয়ন, বন্দর সম্প্রসারণ ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় চীনের সক্রিয়তার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মোংলা বন্দরের সম্প্রসারণ, লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি ও পেকুয়ায় সাবমেরিন ঘাঁটির উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, পেকুয়ার ওই ঘাঁটিতে আটটি সাবমেরিন রাখার সক্ষমতা রয়েছে, যদিও বাংলাদেশের কাছে বর্তমানে মাত্র দুটি সাবমেরিন আছে।

কমিটির মতে, চীন বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গেই যোগাযোগ বাড়াচ্ছে, যার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীও রয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই ইসলামপন্থী দলটির প্রতিনিধিরা সম্প্রতি চীন সফরও করেছেন।

এই প্রেক্ষাপটে কমিটি সুপারিশ করেছে, বাংলাদেশে কোনো বিদেশি শক্তি যাতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে না পারে, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। পাশাপাশি উন্নয়ন, যোগাযোগব্যবস্থা ও বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঢাকাকে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে, যা অন্য কোনো দেশ (যেমন চীন) দিতে পারবে না।

বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দলগুলোর প্রভাব বাড়ার বিষয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে কমিটি। আগে নিষিদ্ধ থাকা জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরে পাওয়া এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়াকে কমিটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।

অন্যদিকে, ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যার ফলে দলটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। কমিটি মনে করে, আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে নির্বাচন হলে এর ‘গ্রহণযোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

তথ্যসূত্র: এনডিটিভি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ক্রিপটো চুরি করে এই বছর উত্তর কোরিয়ার আয় ২.২ বিলিয়ন ডলার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

২০২৫ সালে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা রেকর্ড পরিমাণ ক্রিপ্টোকারেন্সি চুরি করেছে। ব্লকচেইন তথ্য বিশ্লেষণ প্ল্যাটফর্ম ‘চেইনঅ্যানালিসিস’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—চলতি বছরে দেশটি অন্তত ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ডিজিটাল সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫১ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে বৈশ্বিক পর্যায়ে সংঘটিত সব ধরনের ক্রিপটো সেবা-সংক্রান্ত হ্যাকিং ঘটনার ৭৬ শতাংশের জন্য উত্তর কোরিয়া দায়ী—ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী—বিভিন্ন ক্রিপটো এক্সচেঞ্জ, কাস্টডিয়ান এবং ওয়েব ৩ প্রতিষ্ঠানে অনুপ্রবেশ এই রেকর্ড চুরির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে উত্তর কোরিয়ার আইটি কর্মীরা। এসব কর্মী প্রাথমিকভাবে ভেতরে প্রবেশাধিকার তৈরি করে এবং পরে বড় পরিসরের চুরির পথ সুগম করে তোলে। চেইনঅ্যানালিসিস বলছে, এই কৌশল হ্যাকারদের দ্রুত ও কার্যকরভাবে বড় অঙ্কের সম্পদ হাতাতে সহায়তা করছে।

বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে ক্রিপটো চুরির মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩.৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে বিখ্যাত ক্রিপটো এক্সচেঞ্জ বাইবিটে সংঘটিত এক হামলাতেই ১.৫ বিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে যায়। বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলার পেছনে ছিল উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া হ্যাকার গ্রুপ ‘লাজারাস’।

চুরি করা অর্থ পাচারের জন্য উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা প্রায়ই চীনের কিছু সেবার ওপর নির্ভর করে। চেইনঅ্যানালিসিস-এর জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান অ্যান্ড্রু ফিয়ারম্যান জানান, এসব চীনা মানি লন্ডারিং নেটওয়ার্ক ইচ্ছাকৃতভাবে অবৈধ অর্থ সাদা করতে সহায়তা করে।

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে উত্তর কোরিয়া বৈদেশিক আর্থিক ব্যবস্থায় সহজে লেনদেন করতে পারে না। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার আরোপিত নিষেধাজ্ঞা দেশটিকে সামরিক ও অস্ত্র কর্মসূচির অর্থ জোগাড়ে অবৈধ পথ বেছে নিতে বাধ্য করেছে। গবেষকদের মতে, একসময় আদর্শগত উদ্দেশ্যে সাইবার হামলা চালালেও এখন উত্তর কোরিয়ার হ্যাকিং কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আর্থিক লাভ নিশ্চিত করা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ধর্মীয় বক্তাদের দমনে কঠোর হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ। ছবি: বিবিসি
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ। ছবি: বিবিসি

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদি উৎসবকে লক্ষ্য করে ভয়াবহ বন্দুক হামলার পর দেশটিতে ঘৃণামূলক বক্তব্য ও উগ্রবাদ দমনে কঠোর আইন প্রণয়নের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ। গত ১৪ ডিসেম্বর ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের হানুক্কাহ উৎসবের প্রথম দিন উপলক্ষে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে দুই বন্দুকধারীর গুলিতে অন্তত ১৫ জন নিহত হন। এই হামলাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে উদ্বেগ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

ক্যানবেরায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী অ্যালবানিজ বলেন, নতুন আইন মূলত যারা ঘৃণা, বিভাজন ও উগ্রবাদ ছড়ায়—তাদের লক্ষ্য করেই আনা হবে। তিনি জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে এমন ব্যক্তিদের ভিসা বাতিল বা প্রত্যাখ্যানের ক্ষমতা দেওয়া হবে, যারা ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচার করে। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থায় ইহুদিবিদ্বেষ প্রতিরোধ, মোকাবিলা ও যথাযথ প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করতে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হবে।

প্রস্তাবিত আইনের আওতায় সহিংসতা উসকে দেওয়া ধর্মীয় বক্তা ও নেতাদের জন্য শাস্তির বিধান ছাড়াও ‘অ্যাগ্রাভেটেড হেট স্পিচ’ নামে অপরাধের একটি নতুন সংজ্ঞা সংযোজন করা হবে। অনলাইনে হুমকি ও হয়রানির ক্ষেত্রে শাস্তি নির্ধারণে বিদ্বেষ ছড়ানোনে গুরুতর উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। অ্যালবানিজ বলেন, ‘প্রত্যেক ইহুদি অস্ট্রেলিয়ানের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানিত বোধ করার অধিকার রয়েছে।’

এই হামলার পর দেশটিতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) দক্ষিণ-পশ্চিম সিডনিতে সাতজনকে আটক করা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সহিংস কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তবে পুলিশ বলছে, বন্ডাই হামলার সঙ্গে এই ঘটনার সরাসরি কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায়নি।

এদিকে সরকারের ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও কিছু সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইহুদি কাউন্সিল অব অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে, বন্দুক নিয়ন্ত্রণ ও অনলাইনে বিদ্বেষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ প্রশংসনীয় হলেও, কিছু প্রস্তাব ইসরায়েলপন্থী লবির পুরোনো দাবির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, যা সহিংস উগ্রবাদ দমনের চেয়ে মতপ্রকাশ সীমিত করতে পারে। সংগঠনটির নির্বাহী কর্মকর্তা ড. ম্যাক্স কাইজার সতর্ক করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে মতাদর্শিক নজরদারি চালানো হলে তা ইহুদিদের নিরাপত্তা বাড়ানোর বদলে আরও ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।’

এদিকে প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, গত ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল আক্রমণের পর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ইহুদিবিদ্বেষ রোধে সরকার আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত। তিনি বলেন, ‘আমার দায়িত্ব শুধু ভুল স্বীকার করা নয়, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করাও।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত