Ajker Patrika

ভাড়া চাইতেই বললেন, ‘আমি পুলিশ’

মহিউদ্দিন খান মোহন
ভাড়া চাইতেই বললেন, ‘আমি পুলিশ’

মাস দেড়েক আগের ঘটনা। বাসে যাচ্ছিলাম বনশ্রী থেকে কাকরাইল। কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতে এলে আমার সামনের সিটে বসা এক ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি পুলিশ।’ কন্ডাক্টর ছেলেটি উষ্মা প্রকাশ করে বলল, ‘এক গাড়িতে যদি আপনেরাই চাইরজন ফিরি (ফ্রি) যান, তাইলে আমরা চলুম ক্যামনে?’ ভদ্রলোক চুপচাপ। কন্ডাক্টর ছেলেটি আমার কাছে ভাড়া চাইতেই বললাম, ‘আমি ভাড়া দিব না, কারণ আমি সাংবাদিক।’ ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

বললাম, ‘দেখো তোমরা পুলিশকে ভয় পাও, তাই তারা ভাড়া দেয় না। পুলিশ তো আবার আমাদের, মানে সংবাদিকদের ভয় পায়। তাহলে আমি ভাড়া দেব কেন?’ ছেলেটিকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ওই ভদ্রলোককে বললাম, ‘ভাই, আপনি পুলিশ বলে বাসভাড়া দেবেন না, এটা কেমন কথা? পুলিশদের বাসভাড়া দিতে হবে না এমন কোনো আইন কি দেশে আছে?’ ভদ্রলোক কোনো কথা বলছিলেন না। প্রতিপক্ষ সরব না হলে বাগ্‌যুদ্ধ জমে না, তাই ক্ষান্ত দিলাম। পাশের ভদ্রলোক বললেন, ‘এমনটিই চলছে। কেউ প্রতিবাদ করে না। করে লাভও নেই।

উল্টো নাজেহাল হতে হয়। আপনি সাংবাদিক, তাই পারলেন। সাধারণ মানুষ এত কথা বললে খবর আছিল।’যাঁরা ঢাকার রাস্তায় গণপরিবহনে চলাফেরা করেন, তাঁরা এ ধরনের দৃশ্য হরহামেশাই দেখে থাকবেন। নির্দিষ্ট স্থানে বাস কোম্পানির চেকার ওঠেন।

তাঁরা কতজন যাত্রী, তাঁদের মধ্যে কতজন শিক্ষার্থী—এসব একটি বিলে টুকে দেন; যেটাকে ওয়েবিল বলে। আজকাল অনেক চেকিং পোস্টে কন্ডাক্টরকে গলা উঁচিয়ে সুপারভাইজারের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘পুলিশ পাস এতজন।’ কেউ যদি আমার এ অভিজ্ঞতার কথা বিশ্বাস করতে না চান, তাহলে তাঁকে গণপরিবহন, মানে বাস-মিনিবাসে যাতায়াত করার অনুরোধ করছি। চাইলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছদ্মবেশে বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পারেন।

 ঘটনাটি হয়তো তুচ্ছ; বিশেষ করে হরেকরকম জালিয়াতি-জোচ্চুরির যুগে একজন পুলিশের বাসভাড়া না দেওয়া ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। তবে এখানে একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, সরকারি এই বাহিনীর একশ্রেণির সদস্যের মধ্যে অনৈতিকতা দুরারোগ্য ব্যাধির মতো বাসা বেঁধেছে। যে যেখানে সুযোগ পাচ্ছেন, ফায়দা লুটে নিচ্ছেন। শুধু পুলিশের ওপর দোষারোপ করে লাভ কী? সব জায়গায় আজ অনৈতিকতা অলিখিত নীতিতে পরিণত হয়েছে। ‘পুলিশ ঘুষ খায়’ কথাটি চিরন্তন সত্যে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের পুলিশ ঘুষ খায় কি না, জানি না। অবশ্য ভারতীয় হিন্দি-বাংলা চলচ্চিত্রে পুলিশ এবং রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিকতার যেসব চিত্র তুলে ধরা হয়, তাতে অনুমান করি, তাদের অবস্থাও আমাদের চেয়ে খুব একটা ভালো নয়। পুলিশদের চূড়ান্ত নিয়োগের আগে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। অস্ত্র পরিচালনা ও শৃঙ্খলা মানার প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের নৈতিকতার কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় কি না, এ প্রশ্ন মনে জাগা অসংগত নয়; অন্তত একশ্রেণির পুলিশের অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দেখে।

বাসওয়ালারা কেন পুলিশের কাছ থেকে ভাড়া নেয় না বা নিতে সাহস পায় না, এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম একজন পরিবহন ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘কী করব ভাই, বাস তো রাস্তায় চালাতে হয়। কখন কোন আইনের ফাঁকে ফেলে ঝামেলায় জড়িয়ে দেবে—এ ভয়ে তো থাকি। তবে, আমাদেরও (ব্যবসায়ীদের) দোষ আছে। অনেকেই গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ রাখে না, ড্রাইভারদের লাইসেন্স থাকে না। তাই ঝুটঝামেলা এড়ানোর জন্য পুলিশকে তোয়াজ করে চলতে হয় আমাদের।’ এ বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথাও বলি।

কিছুদিন একটি পরিবহন কোম্পানির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। গুলিস্তান বিআরটিসি বাস টার্মিনালে যেতাম প্রায়ই। প্রতি বৃহস্পতিবার দেখতাম একজন ট্রাফিক কনস্টেবল এসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। একদিন দিতে দেরি হলে সে কী চোটপাট। কয়েক দিন দেখার পর একদিন বললাম, আপনি যেভাবে টাকা চান, মনে হয় যেন আপনি পাওনাদার, ওরা দেনাদার। পুলিশ সাহেব একটুও না ভড়কে বললেন, ‘তাহলে দিন না বন্ধ করে “বিট’’ দেওয়া। তারপর রাস্তায় গাড়ি চালান।’ কোম্পানির স্টাফরা বললেন, ‘স্যার, এই টাকাটা না দিলে নানা ঝামেলা হয়। যেকোনো ছুতোনাতায় মামলা ঠুকে দেয়। তখন আবার আরেক ফ্যাসাদ। তার চেয়ে এই ভালো যে যেভাবে খুশি থাকে, তাকে সেভাবে খুশি রাখি।’

এই খুশি রাখার একটি চেইন রয়েছে। নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত এই চেইনের বিস্তার। নিচের জন খুশি রাখেন তাঁর ওপরের জনকে, তিনি আবার খুশি রাখেন তাঁর ওপরের জনকে। এই খুশি রাখার প্রক্রিয়া চালু থাকায় যে যাঁর খুশিমতো কাজ করে চলেছেন। কোনো কৈফিয়ত নেই, জবাবদিহির বালাই নেই। পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি নিয়ে কথা তো আর কম হলো না, লেখাও হয়েছে বিস্তর। কিন্তু ফলাফল শূন্য। অবস্থা যথা পূর্বং, তথা পরং।

সেদিন বাসে আমার সামনের সিটের যে পুলিশ মহোদয় ভাড়া দিলেন না, তিনি খুব একটা উচ্চ পদে হয়তো চাকরি করেন না। কিন্তু তাঁর চেয়ে অনেক উঁচু পদের পুলিশ কর্মকর্তাদের যেসব কাণ্ডকীর্তির খবর মাঝে মাঝে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়, তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। তেমনি একটি খবর বেরিয়েছে ১১ মের আজকের পত্রিকায় ‘জমি দখলে পুলিশ কমিশনার’ শিরোনামে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি খাসজমি বেদখল থেকে উদ্ধারের পরিবর্তে দখল করে মার্কেট বানিয়ে রমরমা বাণিজ্য করছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম। শুধু তা-ই নয়, সরকারি বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতেও অনীহা রয়েছে পুলিশের এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার। বিষয়টি একটি চিঠির মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানিয়েছেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক।

আজকের পত্রিকার প্রতিবেদনে ওই মার্কেটের দোকানদার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, মার্কেটের ৬০টি দোকানের সালামি বাবদ ৬-৭ লাখ টাকা করে নিয়েছেন কমিশনার নজরুল। তা ছাড়া প্রতিটি দোকানের ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে আদায় করা হয় ৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। বলার অপেক্ষা রাখে না, মার্কেটটির নাম ‘গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ মার্কেট’ রাখা হলেও এর অর্থ পুলিশের তহবিলে জমা পড়ে না। যায় কমিশনার ও তাঁর সাঙাতদের পকেটে। পুলিশ প্রশাসন বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জিএমপি কমিশনারের এহেন বেআইনি বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে এখন পর্যন্ত খবর পাওয়া যায়নি। হয়তো আর দশটি ঘটনার মতো এটাও একসময় ধামাচাপা পড়ে যাবে। আর মোল্লা নজরুল ইসলামও জলাশয় থেকে তীরে উঠে পাখনা ঝাড়া দেওয়া হাঁসের মতো শুকনো ঝরঝরে হয়ে যাবেন।

পুলিশের কতিপয় সদস্যের এহেন অনৈতিক কাজের খবর আমরা প্রায়ই পাই সংবাদমাধ্যমে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার খবরও পাওয়া যায়। কিন্তু তারপরও পুলিশের অভ্যন্তরে অপরাধপ্রবণতা কমছে না; বরং এর সংক্রমণ প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। আজ পুলিশের দিকে সাধারণ মানুষ আঙুল তোলে। অথচ আমাদের পুলিশ বাহিনীর রয়েছে সুমহান ঐতিহ্য। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর সদস্যরা যে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

এই পুলিশের সাহসী সদস্যরাই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর অনেকেই শহীদ হয়েছেন; যাঁদের নাম রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে স্থাপিত স্মৃতিসৌধে লেখা আছে। পুলিশের সেই গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্য কতিপয় দুর্নীতিবাজের জন্য ম্লান হোক—আমরা সেটা চাই না

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাদিকে গুলি: আসামি গ্রেপ্তারের আশা ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ

হাদিকে হত্যাচেষ্টা: ফয়সালের স্ত্রীসহ আরও তিনজন গ্রেপ্তার

জাতীয় সংসদ নির্বাচন: আসিফ-মাহফুজকে ঘিরে এনসিপিতে নতুন সমীকরণ

বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে জামায়াতের দুই ছাত্রনেতা আশরাফ ও মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল

বন্ডাই বিচে আহত এই ব্যক্তি ইসরায়েলে হামাসের হামলার মুখেও পড়েছিলেন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ