Ajker Patrika

শুভ জন্মদিন ‘ভোরের বিহঙ্গী’

সঙ্গীতা ইমাম
আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২২, ১০: ০৭
শুভ জন্মদিন ‘ভোরের বিহঙ্গী’

শিল্পী-সাংবাদিক-সংগ্রামী সত্যেন সেন জন্ম নিয়েছিলেন ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ। তাঁর জন্মের বছরটি পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিচিত্র ঘটনাবহুল সময়। পরাশক্তি নির্ধারণে পৃথিবী তখন দুই শিবিরে বিভক্ত। একদিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া; অন্যদিকে পারস্য, তিব্বত, আফগানিস্তান। এই মেরুকরণের মধ্যেই রোপিত হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বীজ। বাংলার রাজনীতির ক্ষেত্রেও সময়টি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সরকারের ঘোষিত বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) রদের দাবিতে বাংলা তখন উত্তাল। একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্রোত ক্রমেই গভীর হয়ে উঠছিল এই সময়টিতে। তার প্রভাব পড়েছে পূর্ববঙ্গে, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলায় যে রাজনীতি সচেতনতায় ঋদ্ধ মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল, সত্যেন সেন তেমনই এক পরিবারে জন্মেছিলেন। ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ১৯৪৭ সালে একদিকে যখন ভারতবর্ষ স্বাধীন হচ্ছে আর অন্যদিকে রচিত হচ্ছে দেশভাগের মর্মন্তুদ ইতিহাস, সত্যেন সেনের বয়স তখন চল্লিশ পেরিয়ে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশভাগের নির্মম পটচিত্র, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং তার পরপরই বাঙালির মহান ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, বাংলার মানুষের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পুনরুত্থান—এসবই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন; কখনো শিল্পীর চোখ দিয়ে, কখনো সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একনিষ্ঠ সংগঠকের চোখ দিয়ে। নিঃসন্দেহে প্রতিটি ঘটনাই তাঁকে নাড়া দিয়েছে। ফলে তিনিও সাড়া দিয়েছেন কখনো শিল্পের ভাষায় আবার কখনো রাজনীতির ভাষায়। ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার আগপর্যন্ত এই মহান সংগ্রামীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় মানুষের মুক্তির মন্ত্রে রচিত।

তাঁর বাহাত্তর বছর সাত মাসের জীবনে তিনি জেলেই থেকেছেন প্রায় ২২টি বছর। কারাগারের বন্দী দিনগুলোতেই তিনি সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁর রচনাবলি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। তবে রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠক হিসেবে সত্যেন সেন জীবনের যে পাঠ রেখে গেছেন আমাদের জন্য, তা যুগ-যুগান্তরে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে বাংলার মানুষের ইতিহাসে। কৃষক সংগঠন গড়ার কাজ করেছেন স্কুলজীবন থেকেই। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়িয়ে তিনি কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন তাঁদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। সেই পথ ধরেই পরবর্তীকালে কৃষক সমিতি গড়ে তোলা এবং নিবেদিতপ্রাণ কৃষকনেতা হিসেবে তাঁর পরিচিতি প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ প্রগতি লেখক সংঘের সংগঠক সোমেন চন্দ নিহত হলে সংগঠন পরিচালনার কাজে ঢাকা চলে আসেন সত্যেন সেন। কিন্তু কৃষক সংগঠন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি কোনো দিন। প্রগতি লেখক সংঘের সংগঠক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এ সময় থেকেই তাঁর গান রচনা শুরু। ১৯৪৩ সালে বাংলাজুড়ে দুর্ভিক্ষ নেমে এলে তিনি যেমন গণসংগীতশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন, তেমনি দায়িত্ব পালন করেছেন দুর্গত এলাকায় আর্তমানুষের সেবায়।

সঙ্গীতা ইমাম১৯৪৬ সালের নির্বাচনে সত্যেন সেন কাজ করেছেন নারায়ণগঞ্জের কমিউনিস্ট নেতা ব্রজেন দাসের পক্ষে। নির্বাচনী প্রচারণার জন্যও তিনি বেছে নিয়েছিলেন সংগীতকে। গঠন করেছিলেন কবিয়াল দল। সত্যেন সেনের নেতৃত্বে শিল্পী দল নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, রহিমাবাদ প্রভৃতি এলাকায়। তাঁর সঙ্গী ছিলেন শিল্পী সাধন দাশগুপ্ত।

১৯৫৫ সালে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত অজয় রায় প্রণীত সত্যেন সেন জীবনী গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সংবাদ পত্রিকার বিখ্যাত ‘বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি’ শিরোনামের কলামটি সত্যেন সেনই লিখতেন। এই কলামটির জন্য ঢাকা শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় তিনি ঘুরে বেড়াতেন। ১৯৬৮ সালে দৈনিক সংবাদেই তাঁর আরেকটি পাঠকনন্দিত কলাম ছিল ‘শহরের ইতিকথা’ শিরোনামে। সাহিত্য রচনার জন্যও এভাবেই পরিব্রাজকের মতো সারা দেশ ঘুরে বেড়াতেন সত্যেন সেন।

তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘ভোরের বিহঙ্গী’ প্রকাশ হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। তিন বছরের কারাবাসের পর মুক্তি পেলেন ১৯৬৮ সালে। এই তিন বছরেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর তিনটি গ্রন্থ: গ্রাম বাংলার পথে পথে (১৯৬৫), রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ (১৯৬৬) এবং অভিশপ্ত নগরী (১৯৬৭)। আটষট্টি সালে মুক্তি পেয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন নারিন্দার মনির হোসেন লেনে সাংবাদিক এম এ করিমের বাড়িতে। এম এ করিমের নববিবাহিত স্ত্রী হেলেন করিম ছিলেন তাঁর অভিভাবকের মতোই। নিরলসভাবে তিনি সত্যেন সেনের রচনার শ্রুতলিখনের কাজ করেছেন।

১৯৬৮ সালে এ বাড়িতেই ছয়জন মিলে ‘ওরে ওরে বঞ্চিত সর্বহারা দল’ গানটির মহড়ার মধ্য দিয়ে পত্তন হয়েছিল আজকের উদীচীর। ‘উদীচী’ নামটিও সত্যেন সেনেরই দেওয়া। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের জোয়ারে সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সারসহ আরও অনেকের নেতৃত্বে উদীচী অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি শরণার্থীশিবিরগুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার এক অপূর্ব সংকলন প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ (১৯৭১) গ্রন্থটি। বাংলার মানুষের মুক্তিসংগ্রামের এক অনন্য দলিল এ বইটি। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০টি।

একজন দেশপ্রেমিক সংগঠক ও আজীবন বিপ্লবী মানুষ হিসেবে সত্যেন সেন প্রতিটি প্রজন্মের সামনেই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর আদর্শ ও জীবনবোধ যেমন প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর কর্মে, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনাচরণেও। এই মহাপ্রাণের প্রতিধ্বনি যুগ-যুগান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ আজও করে চলছে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। ১৯৮৫ সালে তাঁর বিপুল রচনাসম্ভার প্রথম প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিল উদীচী এবং ১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম খণ্ড। এরপর ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত উদীচীর উদ্যোগেই পাঁচ খণ্ডের এই রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমানে ১০ খণ্ডে এই অমর শিল্পীর রচনাবলি প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক বদিউর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত সত্যেন সেন রচনাবলি এই মহান ব্যক্তিসত্তাকে জানতে ও তাঁর আদর্শ উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা পালন করছে।

আজ স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেছে। পৃথিবীও বদলে গেছে নানাভাবে। কিন্তু মানুষের মুক্তির জন্য, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ ও পৃথিবী বিনির্মাণের জন্য যে গান গেয়ে গেছেন সত্যেন সেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। তাই তাঁর প্রতিটি জন্মদিন কেবল স্মরণের নিছক আনুষ্ঠানিকতাই নয়; তাঁর আদর্শের লড়াইকে শাণিত করার শপথপাঠেরও দিন।

লেথক: শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ