Ajker Patrika

আমাদের উপাচার্যরা: শ্রদ্ধায় ও লজ্জায়

আবু তাহের খান
আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২২, ১২: ৫৮
আমাদের উপাচার্যরা: শ্রদ্ধায় ও লজ্জায়

জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনের আলোচনায় অংশ নিয়ে গত ২৯ মার্চ জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও সাংসদ মুজিবুল হক বলেছেন, ‘আগে উপাচার্যদের কথা শুনলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসত। এখন তাঁদের দুর্নীতির খবর শুনে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে।’ তাঁর এই বক্তব্য বস্তুত দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান দুরবস্থারই বহিঃপ্রকাশ। এই অভিযোগ শিক্ষামন্ত্রীও সংসদে প্রদত্ত তাঁর জবাবে অস্বীকার করেননি বা করতে পারেননি। তবে এ বিষয়ে যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে তিনি যা বলেছেন তা আরও এক দফা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে, যা বরেণ্য শিক্ষাবিদদের মর্যাদা ও অবস্থানকে হেয়প্রতিপন্ন করারই শামিল। তিনি বলেছেন, ‘বরেণ্য শিক্ষাবিদদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী হন না।’ কিন্তু তিনি কি দয়া করে সুনির্দিষ্টভাবে বলবেন, কোন বরেণ্য শিক্ষাবিদকে উপাচার্য হওয়ার অনুরোধ জানানোর পরও এ বিষয়ে তিনি তাঁর অপারগতা প্রকাশ করেছেন? এটি জানতে পারলে সাধারণ মানুষের কাছে পুরো বিষয়টিই আরও স্পষ্ট হবে।

আসলে এসব আত্মরক্ষামূলক বক্তব্যের অনেকটাই অন্যায্যতাকে জায়েজ করার শামিল বলেই সাধারণ মানুষ মনে করে। তা ছাড়া, এসব বক্তব্যের বড় অংশ তথ্যভিত্তিক নয় বলেও অভিমত রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট কর্তৃক সুপারিশকৃত তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেলে একাধিকবার অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নাম থাকা সত্ত্বেও ওই পদে তাঁকে নিয়োগ না করায় তিনি এবং অন্য সবাই বুঝে গিয়েছিলেন যে তাঁর মতো স্বাধীনচেতা নিরাপস ব্যক্তিত্বকে শাসকমহলের পছন্দ নয়। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে গভীর আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন এই পণ্ডিত পরবর্তীকালে এ পদের ব্যাপারে তাঁর অনাগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন। আর ওই ঘটনার পূর্বাপর উল্লেখ না করে সেটাকেই সূত্র মেনে সাম্প্রতিক কালে অনেককেই বলতে শোনা গেছে যে পণ্ডিতজনেরা উপাচার্য পদে আসতে চান না, যেমনটি শিক্ষামন্ত্রীও বলেছেন। শিক্ষামন্ত্রী তো তা-ও শুধু এটুকু বলেছেন। অনেকে এ বিষয়ে কিছুই না জেনেও নিছক কথার কথা হিসেবে বলে দিচ্ছেন যে বরেণ্য শিক্ষকেরা উপাচার্য পদে আসতে চান না। আসলে উল্লিখিত যৌক্তিক অনাগ্রহমূলক ঘটনার বাইরে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যে সিনেট কর্তৃক উপাচার্য নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাব করার পর কেউ তা গ্রহণে অস্বীকার করেছেন। ফলে এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতজনদের বস্তুতই এ মর্মে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে যে তাঁরা বোধ হয় আসলেই দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে চান, যা মোটেও সঠিক নয়; বরং সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকলে তাঁদের অনেকেই অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে এ পদে যোগদানে আগ্রহী।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আরেকটি কথা বলেছেন, ‘উপাচার্য শুধু একাডেমিক দিক দেখেন না, নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলিও জরুরি।’ তাঁর এ কথায় সায় দিতে গেলে তো মানতেই হবে যে বরেণ্য পণ্ডিতদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি নেই বলেই যাঁদের মধ্যে সেসব গুণ আছে তাঁদেরই বাছাই করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ১৯৯০ সালের পর থেকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, যাঁদের কেউ কেউ এখন দুর্নীতি, অদক্ষতা ও স্বজনপ্রীতির ‘রোল মডেল’ হয়ে আলোচনায় এসেছেন। কিন্তু নেতৃত্বের গুণাবলিসংক্রান্ত তালিকার কোন অংশের জন্য তাঁরা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তা কি জানা সম্ভব?

এবার আসা যাক উপাচার্যদের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ ও তাঁদের আচরণের কারণে লজ্জায় মাথা অবনত হওয়ার বিষয়ে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, যিনি ১৯৬৯-৭১ সময়কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। শেষোক্ত ওই পদে তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন ১৯৬৯-এর ফেব্রুয়ারিতে। অর্থাৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তাল দিনগুলোতে তিনি ওই পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু কেউ কি বলতে পারবেন, ১৯৭২-৭৩ সময়কালে উপাচার্যের দায়িত্ব পালনকালে কখনো তিনি ক্ষমতাসীন দলের প্রতি রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বমূলক কোনো আচরণ করেছিলেন? যদি করতেন তাহলে ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে যথাক্রমে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান নির্বাচিত হতে পারতেন না। সদ্য স্বাধীন দেশের ওই পরিবেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যদের মধ্যকার কেউ সেদিন দায়িত্বে থাকলে এটি ঘটতে পারত বলে মনে হয় না। দেশ পুনর্গঠনের অজুহাত দিয়ে ছাত্রলীগের প্রার্থীদেরই হয়তো তাঁরা কোনো না কোনো কৌশলে জিতিয়ে আনতেন। কিন্তু উপাচার্যের পদকে অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী কখনো দলীয় ভিত্তিতে দেখেননি—দেখেছেন শুদ্ধ জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকাজে নেতৃত্বদানের সুযোগ হিসেবে।

একইভাবে ১৯৭৩-৭৫ সময়কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ড. আবদুল মতিন চৌধুরী (বোস অধ্যাপক নামে খ্যাত)। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর যিনি ‘আমার নেতাকে ওরা মেরে ফেলল’ বলে শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। কিন্তু তাঁর উপাচার্যত্বেরকালে ছাত্রলীগকে তিনি কোনোরূপ বিশেষ সুবিধা দিয়েছিলেন, ইতিহাসে তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। আমাদের এ সময়ের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কি ঘুণাক্ষরেও এরূপ দৃঢ়চিত্ত প্রদর্শনের মানসিক সামর্থ্য রাখেন? স্বাধীনতা-উত্তরকালের এই দুই উপাচার্যসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ববর্তী উপাচার্যদের দিকে তাকালে বস্তুতই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মমতায় মানুষের মাথা অবনত হয়ে আসে। সেই সময়কার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও কমবেশি এ রকমই ছিল।

কিন্তু এখন? এখন কারা নিযুক্ত হচ্ছেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে? তাঁরা কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেরা শিক্ষাবিদ, দক্ষ প্রশাসক—নাকি সরকারি দলের একনিষ্ঠ সমর্থক? জবাব হচ্ছে, তাঁদের অধিকাংশ এর কোনোটিই নন। তাঁরা শিক্ষক হিসেবে যেমন অগ্রবর্তী সারির নন, তেমনি দক্ষ নন প্রশাসক হিসেবেও। এমনকি তাঁদের কারও কারও অতীত ইতিহাস, তাঁরা যে সরকারি দলের একনিষ্ঠ সমর্থক, সেই প্রমাণও বহন করে না। তাহলে তাঁরা কারা? আসলে তাঁদের অধিকাংশই হচ্ছেন তোষামোদে ও চাটুকার এবং বিশেষ সুবিধা হাসিলের উদ্দেশ্যে সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণকারী ব্যক্তি, যাঁরা উপাচার্যের মতো একটি সম্মানজনক পদ দখল করে উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা অর্জনের পাশাপাশি বৈষয়িক সুবিধা অর্জনের হীন চেষ্টায় লিপ্ত। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাঁদের মধ্যকার একটি বড় অংশই আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক নন। নিছক উপাচার্য হওয়ার জন্যই তাঁরা রাতারাতি রাজনৈতিক পরিচয় পাল্টে সরকারি দলের খাতায় নাম লিখিয়েছেন এবং সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ করে’ উপাচার্যের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন।

প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে শুধু উপাচার্যই নয়, অন্যান্য প্রশাসনিক পদে বসার জন্যও রাতারাতি খোলস পাল্টানোর এ রীতি বেশ জোরেশোরেই চালু আছে।

বলা হচ্ছে, উপাচার্য হওয়ার জন্য শুধু পাণ্ডিত্য থাকলে হবে না, নেতৃত্বের গুণাবলিও থাকতে হবে। খুবই ন্যায্য কথা। কিন্তু বাস্তবে এখন নেতৃত্বের এমন সব গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই উপাচার্য পদে নিয়োগ পাচ্ছেন, যাঁদের দু-একজন শুদ্ধ ও প্রমিত ভাষায় কথাও বলতে পারেন না। আর প্রায়ই এমন হালকা সব কথা তাঁরা বলেন, যেসব কথা শুনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তো বটেই, বাইরের সাধারণ মানুষও প্রকাশ্যে হাসিঠাট্টা করে। এই হচ্ছে তাঁদের নেতৃত্বের ‘গুণাবলি’। আর একাডেমিক যোগ্যতাতে তাঁরা শুধু পিছিয়েই নেই; বরং কারও কারও ব্যাপারে এমন প্রশ্নও উঠেছে যে প্রয়োজনীয় প্রকাশনা ও গবেষণাকর্ম ছাড়া এ পর্যন্ত তাঁরা এলেন কেমন করে? আসলে নেতৃত্বের গুণাবলি নয়; বরং শতভাগ স্তাবক, চাটুকার ও ব্যক্তিবিশেষের পছন্দের লোকদের, যাঁরা রাজনৈতিকভাবেও পরীক্ষিত নন, নিয়োগ দিতে গিয়েই এমনটি ঘটেছে। দল-সমর্থক লোকও যদি দায়িত্বশীল ও ব্যক্তিত্ববান হন, তাহলে দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় কোনোই সমস্যা হয় না, যদিও এ ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা না থাকাটাই উত্তম।

উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের যাঁরা বাছাই করেন, তাঁদের বিনীতভাবে বলার কথা এটাই যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ। ফলে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে এমন শিক্ষকদেরই সেখানে উপাচার্য পদে নিয়োগ দিন, যাঁরা দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে যথাযথ নেতৃত্ব দিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়টিকে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির আলয় হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। জাতীয় সংসদের ২৯ মার্চের উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) উপাচার্য নিয়োগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক ও সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ইউজিসি যদি ৫০ বছর পরে এসে বলে এটি থাকা দরকার, তাহলে কাজটি হবে কবে? তারপরও তাদের ধন্যবাদ যে বিলম্বে হলেও তারা বিষয়টি উপলব্ধি করেছে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যদের অধিকাংশের জন্য লজ্জায় মানুষের মাথা প্রকৃতপক্ষেই নত হয়ে আসছে। এমনিতেই দেশে শিক্ষার মানগত কোনো উন্নতি নেই। তার ওপর যেটুকু আছে, তা-ও যদি ওই উপাচার্যদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা, দুর্নীতি ও নেতৃত্বহীনতার কারণে ধসে পড়ে, তাহলে বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ের একেবার তলানিতে থাকা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি উদ্ভাবনা ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রে আগামী দু-তিন দশকের মধ্যে আসলেই কোনো অবদান রাখতে পারবে?

আবু তাহের খান, পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা (বিসিক) শিল্প মন্ত্রণালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...