Ajker Patrika

কাউকে অসম্মান করে সমাজ পরিবর্তন হয় না

আমানুল্লাহ ফেরদৌস
আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২২, ১১: ০৪
কাউকে অসম্মান করে সমাজ পরিবর্তন হয় না

ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা কয়েক শতক ধরে শিকল ভাঙার জন্য একদম উদ্‌গ্রীব হয়ে আছেন। এই শিকল ভাঙতে গিয়ে এমন কিছু করা ঠিক হবে না,যা অন্যদের অসম্মানিত করে। কুরুচিপূর্ণ কার্টুন এঁকে তা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করে শিকল ভাঙা কতটা সহজ হবে, তা ভাবার সময় এসেছে। কারও মানসিকতায় পরিবর্তন আনার জন্য উগ্র ও ফ্যাসিবাদীপ্রবণতা সুফল দেয় বলে মনে হয় না।

আমাদের শিকল ভাঙার সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। প্রায় আট যুগ আগে কবি কাজী নজরুল ইসলাম হুগলি জেলে বসে গেয়ে উঠেছিলেন ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল। এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল…’। ‘শিকল-পরা ছল’ বলতে, কবি প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের স্বাধীনতা অর্জনে কারাবরণ করে শিকল পরার ভীতি দূর করাকে বোঝাতে চেয়েছেন।

তাঁর আহ্বানে কয় কোটি ভারতীয় ইংরেজদের বিরোধিতা করে শিকল পরে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেছিলেন? দলে দলে মানুষ কারাবরণ করবে, এটা প্রত্যাশিত নয়। নেতাজি সুভাষ বসুর আহ্বানে শতকোটি বৃহত্তর ভারতবাসীর কয়েক কোটিও ইংরেজদের বিরুদ্ধে মাঠে নামেনি। ইংরেজদের তাড়ানোর জন্য তাদের সহযোগিতা নিয়ে কেন কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের মতো দল গঠন করতে হলো? ভাবতে হবে সেটাও। কৈবর্ত, পীর-মাশায়েখ, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, সূর্য সেনদের বিদ্রোহে ইংরেজরা নাস্তানাবুদ হয়েছে। কিন্তু ভারতের সাধারণ মধ্যবিত্ত বা আমজনতা ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে দলে দলে যোগ না দিয়ে তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের সহযোগিতাই করে গেছে।

‘চল চল চল, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল…’ এই রণসংগীত শুনে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সবাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের সেই বিখ্যাত জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে বাঙালি প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেও সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া যোদ্ধার সংখ্যা লাখ ছাড়ায়নি। মাত্র ৯১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা (বর্তমানে সেই সংখ্যা ২ লাখ প্লাস-মাইনাসে গিয়ে পৌঁছেছে) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এটাই স্বাভাবিক। পরিবর্তন প্রত্যাশা করেন সবাই। কিন্তু পরিবর্তনকে সংগঠিত করতে অল্পসংখ্যক মানুষই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

পাঞ্জাব রেজিমেন্টের যে কয়েক হাজার পাকিস্তানি সৈন্য বর্বরতা চালিয়েছে, তাদের হাওয়ায় মিশিয়ে দেওয়া যেত যদি এ দেশের এক কোটি লোক রাস্তায় নেমে আসত। রাস্তায় নামা তো দূরের কথা, বরং আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে তামাশা দেখেছি। রেডিও শুনে শুনে সময় পার করেছি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়েছি, সরকারের চাকরি করে বেতন নিয়েছি, কয়জন আমলা আকবর আলি খানের মতো, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বা এইচ টি ইমামের মতো বিদ্রোহ করেছেন? বা সিভিলিয়ান থেকে কয়জন আর সাদেক হোসেন খোকা বা কাদের সিদ্দিকী হতে পেরেছেন? কয়জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কয়জন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লইয়ার, সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন? সে সময় দালালের সংখ্যাও ছিল অনেক। এই রাজাকার গোষ্ঠীই পথ দেখিয়ে মানুষের বাড়িঘর পুড়িয়েছে, মা-বোনদের ইজ্জত লুট করিয়েছে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করিয়েছে। এ রকম সংকটময় মুহূর্তেও বাম-ডানের বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই ঘরেই বসে ছিলেন। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া! ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার বঙ্গবন্ধুর সেই আহ্বানে কয় লাখ বাড়িতে দুর্গ গড়ে তোলা হয়েছিল? হ্যাঁ, এ দেশের মায়েরা তাঁদের সাধ্যমতো মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়ে-পরিয়ে সাহায্য করেছিলেন।

প্রশ্ন হলো, ভারতবর্ষে শিকল ভাঙার গান কেন ব্যর্থ হয়ে যায় বারবার? স্বাধীনতা চেয়েছি, স্বাধীনতা পেয়েছি বা অর্জন করেছি। বুঝলাম আমরা ইংরেজদের তাড়িয়েছি, পাঞ্জাবিদের তাড়িয়েছি কিন্তু শিকল যেটা আমাদের পায়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, সেই শিকল থেকে মুক্তি আমরা পাচ্ছি না কেন? ৭৫ বছর আগে ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরেও পুরো ভারতবর্ষ কেন আজও দারিদ্র্যের অভিশাপমুক্ত হতে পারছে না? ভারতে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক শাসনের পরও কেন এখন হিন্দুত্ববাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে? বাংলাদেশেও কেন ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বহাল রাখা সম্ভব হচ্ছে না? কেন ধর্মীয় উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে?

এই অঞ্চলে রাজা আসে, রাজা যায় কিন্তু উপরিকাঠামোর কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় না কেন? এর ব্যাখ্যা নির্মোহভাবে খুঁজতে হবে। উত্তর কিছুটা যুক্তিসংগতভাবে দিয়ে গেছেন কার্ল মার্ক্স, ম্যাক্স ভেবার, কার্ট উইফোগেল, চার্লস মেটকাফ, হামজা আলাভি, ইরফান হাবিব, আর কে মুখার্জি, নাজমুল করিম, আহমদ ছফা, এমনকি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও।

আমানুল্লাহ ফেরদৌসউৎপাদনপদ্ধতির সেই সব চিন্তাধারা (ডিসকোর্স) আলোচনা না করে বয়স্ক মানুষদের ব্যক্তিগত অঙ্গে যতই বল ছোড়া হোক না কেন, মেয়েরা দশবার বিশ্বকাপ জিতুক না কেন, ইরানের মেয়েরা যতই তাদের হিজাব পুড়িয়ে দিক না কেন, নারীবাদী বলি, মুক্তমনা বলি, শাহবাগি বলি আর যতই তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বা বাম ঘরানার ব্যক্তিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘন ঘন পোস্ট দিন না কেন, তাতে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না; বরং এসব করে সমাজবিজ্ঞানের ‘আদারিং’ তত্ত্বটিকে আরও জোরালো করা হচ্ছে। কিছু উগ্রপন্থীকে বোঝাতে গিয়ে কোটি কোটি বয়স্ক মানুষকে অপমান করা হচ্ছে, তাদের মনোজগতে পরিবর্তন আনার জন্য যুক্তি দিয়ে বোঝানোর পরিবর্তে একধরনের হাস্যকর পথ বেছে নেওয়া হচ্ছে। এসব করে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে গত ৫০ বছরে আমাদের অর্জনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও নারী ও মেয়েশিশুদের উন্নয়নে এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কিন্তু পুরো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে অনন্য সফলতা এখন পর্যন্ত 
দেখাতে পেরেছে।

তথাকথিত প্রগতিবাদীদের কিছু কিছু আচরণ আসলে উগ্রবাদী ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পক্ষেই যায়। এসব আচরণের বিরুদ্ধে তারাও তাদের ডিসকোর্স বানাবে এবং একদিন যদি ইরানের মতো খোমেনিতন্ত্র এখানেও চালু করতে চায়, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ভুলে গেলে চলবে না, যারা স্লোগান তুলেছিল ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ তারা কিন্তু দেশ ছেড়ে চলে যায়নি। তাদের রাতারাতি আধুনিক বানানোও সম্ভব হবে না। সমাজে সবার জন্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে, পড়ালেখা শেখাতে হবে, মানুষের সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে, নতুবা তারা তাহেরী-আহমুদুল্লাহ-ইব্রাহিম হুজুর বা শিশুবক্তার ওয়াজ শুনতে যাবেই। পীরের আস্তানায় গিয়ে মনটাকে শান্ত করতে চাইতেই পারে।

পাঠ্যপুস্তক করতে হবে বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী। একমুখী পাঠ্যক্রম চালু করতে হবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের স্তরে স্তরে সুশাসন দৃশ্যমান হতে হবে। সমাজের মৌলকাঠামোতে হাত দিতে হবে। এসব ব্যাপারে কথা না বলে ‘ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুন’ তত্ত্ব আওড়ালে সুফল কিছু পাওয়া যাবে না।

চিরুনি দিয়ে আঁচড়িয়ে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে বিতাড়িত করতে পারবে না; বরং এতে তারা আরও শক্তিশালী হবে! বিশ্ব ইতিহাস তার প্রমাণ! চিরুনি দিয়ে আঁচড়িয়ে বা বয়স্ক মানুষের পেছনে বল মেরে রেনেসাঁ আসেনি, গির্জার কর্তৃত্ব বিলোপ হয়নি, জারের শাসন ভেঙে পড়েনি কিংবা সামাজিক ইতিহাসে আদিম সাম্যবাদ-দাসপ্রথা-সামন্ততন্ত্রের গর্ভে পুঁজিবাদের বিকাশ হয়নি! সমাজবিজ্ঞানের সমাজ বিবর্তনের ধারাবাহিক ইতিহাসটা ভালো করে পাঠ করতে হবে সবাইকে। বাংলাদেশের নারী-পুরুষ সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে এগিয়ে যাক, সব দেশের নারীরা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী পোশাক পরার অধিকার পাক, এই প্রত্যাশা করি। 

লেখক: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...