সেলিম জাহান

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে। তাই নজরুলের কবিতায়, গানে ও প্রবন্ধে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা অত্যন্ত জোরালোভাবে পরিস্ফুট। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে সমতার পক্ষে, সাম্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সাম্যচিন্তা তাঁর মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা এবং সেই সঙ্গে নৈতিকতার বোধ থেকে এসেছে—যাপিত জীবনের বাস্তবতা থেকে নয়। অন্যদিকে নজরুলের সাম্যচিন্তা একেবারেই জীবন থেকে নেওয়া।
বিভিন্ন লেখায় নজরুল কখনো সাম্যের কথা বলেছেন, কখনো সমতার কথা বলেছেন। এ বিভাজন একটি সচেতন চিন্তা থেকেই এসেছে। সাম্যের ধারণাটি আপেক্ষিক, যেখানে সমতার ধারণাটি অনপেক্ষ। নজরুল যখন বিশ্বমানবতার কথা বলেন, তখন একটি অনপেক্ষ মাত্রিকতা থেকেই সে কথা বলেন। অন্যদিকে তিনি যখন নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেন, তখন সেটা একটা আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি নজরুলের সাম্যচিন্তার দুটি স্তর আছে—একটি সামষ্টিক, অন্যটি ব্যষ্টিক।
সামষ্টিক পর্যায়ে নজরুল সাম্যচিন্তার উচ্চতম মাত্রিকতায় অবস্থান করেছেন। সে সাম্যচিন্তায় বিশ্ব মানবতা, সামগ্রিক মানবতাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর কাছে প্রতিটি মনুষ্যজীবনই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন—
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান’।
মানুষকে সম ভালোবাসায়, সম শ্রদ্ধা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই এই সাম্যচিন্তার মূল কথা।
এ শ্রদ্ধা, এ মর্যাদা নজরুল একজন দরিদ্র মানুষকেও দেন। তাই দারিদ্র্যের অহংকারকে তিনি একটি উচ্চতম স্তরে প্রতিস্থাপন করেছেন তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়। অতি জোরালোভাবে তিনি বলেছেন—
‘হে দারিদ্র্য,
তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।
কন্টক মুকুট শোভা। দিয়াছ তাপস, অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস।’
দারিদ্র্যের মাঝেও যে মর্যাদা ও অহংকার থাকে, তাকেই সমমর্যাদায় নজরুল প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিত্তের সঙ্গে। এ সমতা-বোধ তুলনাহীন। বিশ্বমানবতার প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’তেও।
ব্যষ্টিক দিক থেকে নজরুল সাম্যকে দেখেছেন চারটি মাত্রিকতায়—বিত্তবান ও দরিদ্রের মধ্যে, শ্রম ও পুঁজির মধ্যে, ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে। ধনী-নির্ধনের মধ্যে অসমতাকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এই বলে—
‘তুমি শুয়ে রবে তেতালার পরে,
আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব,
সে ধারণা আজ মিছে’।
দরিদ্র মানুষকে শোষণের মাধ্যমে যে ধনীর বিত্ত গড়ে ওঠে, সেটা নজরুল পরিষ্কার করে বলেছেন—
‘তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?
ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা।
তুমি জান নাকো,
কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে, ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!’
কিংবা
‘দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
তবে মানবতায় চিরবিশ্বাসী নজরুল আশা ছাড়েননি। তাঁর আশাবাদী মন ব্যক্ত করেছে যে এ অসাম্য একদিন শেষ হবে। তিনি যেন দেখতে পেয়েছেন সেই দিনকে, যেখানে দরিদ্রকে তাঁর পাওনা গণ্ডা বুঝিয়ে দিতে হবে—
‘আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা,
শুধিতে হইবে ঋণ!’
কিন্তু না, সে ঋণ এখনো শোধ হয়নি, হয়নি সে শোষণের অবসান। আজও বহু সমাজে দরিদ্র মানুষের অবস্থান প্রান্তিক, যেখানে বঞ্চনা তাঁদের নিত্য সঙ্গী এবং ভঙ্গুরতা তাঁদের জীবনের বিশাল এক মাত্রিকতা।
শ্রম আর পুঁজির মধ্যকার অসমতা সমাজে একটি অসাম্যের জন্ম দেয়। শ্রমিক সেখানে শোষিত আর পুঁজিপতি সেখানে শোষক। শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম দিয়েই গড়ে ওঠে সভ্যতা, আসে উন্নয়ন। আর শ্রমিকের শোষণের মাঝেই বিত্তের সম্পদ গড়ে তোলে পুঁজিপতিরা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এটাই স্বরূপ—অসাম্যই সেখানে নিয়ম। তাই নজরুলের ভাষ্য—
‘রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এ-সব কাহাদের দান!’
সাম্যবাদী নজরুল সর্বদা শ্রমিকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কণ্ঠ মিলিয়েছেন শ্রমিকের সঙ্গে। শ্রমিকের উৎপাদন থেকে পুঁজিপতিদের ফেঁপে ওঠার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে নিন্দা করেছেন শ্রম ও পুঁজির মধ্যকার অসাম্যকে—
‘যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে, বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে,
কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল! কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?’
ধর্মের আতশ কাচে নজরুল অসাম্যকে দেখেছেন তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে—মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের মাঝে বিভাজনের দিক থেকে এবং ধর্মীয় ভণ্ডামির দৃষ্টিকোণ থেকে। নজরুল সব সময়ে বলেছেন, মানবিকতাই মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম। তাই তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ বোধ তাঁর চিন্তাচেতনায় লালন করেছেন, যার জন্য তিনি একদিকে যেমন শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন, অন্যদিকে ইসলামি গানও লিখেছেন। মানবতার মহাবাণীকে তিনি তুলে ধরেছেন এই বলে,
‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!’
ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন সোচ্চার। মানবতার সবচেয়ে বড় বাধা বলে ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে নজরুল চিহ্নিত করেছেন। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক নজরুল মানবিক উদারতাকেই উঁচুতে তুলে ধরেছেন। নিজেকে সকল সংকীর্ণতা, সকল ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান করেছেন—
‘আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!’
প্রথাগত আনুষ্ঠানিক এবং নিয়মসর্বস্ব ধর্ম মানুষের মধ্যে একটা বিভাজনের সৃষ্টি করে। বিভাজিত হন আল্লাহ্-ভগবান-ঈশ্বর; মসজিদ-মন্দির-গির্জা। সেই বিভাজনের হাত ধরেই আসে অসাম্য। নজরুল তাই প্রশ্ন করেন—
‘কে তুমি?-পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত শখ,
কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি?-পথে ফুটে তাজা ফুল!
কিন্তু ধর্মীয় এই অসাম্যকে আঘাত করে তিনি শুনিয়েছেন সাম্যের বাণী—
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান! ’
ধর্ম শুকনা কেতাবের নয়, নয় পুঁথির, নয় অসার নিয়মের, নয় আনুষ্ঠানিকতার। ধর্ম আবদ্ধ নয় উপাসনালয়ে, তীর্থস্থানে। ধর্মের মূল আধার মানুষের মন, তার হৃদয়। তাই নজরুল অক্লেশে বলতে পারেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।’
তবে নজরুল সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ করেছেন ধর্মের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। যে তথাকথিত ধর্মীয় আচার দরিদ্রকে পদদলিত করে, বুভুক্ষুকে ক্ষুধার্ত রাখে, সে আচার ভণ্ডামি ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এ ভণ্ডামি মানুষে-মানুয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে, অসাম্যের জন্ম দেয়। এ ভণ্ডামির সূত্র ধরে ধর্মের তথাকথিত রক্ষকেরা ধর্মকে কুক্ষিগত করে। তখন
‘ভুখারী ফুকারি কয়,
ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’
কিংবা
‘তব মস্জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’
ধর্মের নামে ভণ্ডামিতে নজরুল ব্যথিত হন। বড় দুঃখে বলেন, ‘হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!’ তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠ তখন বলে, ‘খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!’
নারী-পুরুষের সমতা প্রশ্নে নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি তাঁর চিন্তাচেতনার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। নারীর অধিকার, সমাজে নারীর অবস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে নানা জোরালো বক্তব্য এসেছে কবিতাটিতে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাকে মাতা হিসেবে, কন্যা হিসেবে, বধূ হিসেবে, প্রেয়সী হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন নজরুল। সেই সঙ্গে নারীর অবদানকে মহিমান্বিত করেছেন তিনি। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে নারীর শুদ্ধ ‘মনুষ্য-সত্তাকে’ ততটা পরিস্ফুট করেননি তিনি।
কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, সমতার এক অনন্য স্তরে নারীকে স্থাপন করেছেন নজরুল। তাই তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পেরেছেন—
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’
মানব ইতিহাসে নারীর ভূমিকাকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন নজরুল। তাঁর ভাষ্যেও সে কথাটি সুস্পষ্ট।
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
নারী-পুরুষের সাম্য বিষয়ে তিনি সামনের দিকে তাকিয়েছেন, সমাজ-সংস্কারের কথা বলেছেন এবং নারীকে বন্দী করে রাখার ফলাফল সম্পর্কে পুরুষকে সাবধান করে দিয়েছেন।
‘সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই! ’
নজরুলের সাম্যচিন্তা প্রসঙ্গে উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সংগত প্রশ্ন উঠে আসে—বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নজরুলের সাম্যচিন্তা কতখানি প্রাসঙ্গিক। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাক, সাম্যের মাত্রিকতায় আমাদের সময়ের রূপ ও প্রকৃতি কী রকম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা একটি অসম, অস্থিতিশীল এবং অবক্ষয়মান পৃথিবীতে বাস করি।
আজকের বিশ্ব সংজ্ঞায়িত হচ্ছে অসমতার দ্বারা। অসমতা রয়েছে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, অঞ্চলে-অঞ্চলে। অসমতা রয়েছে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে, নানান নৃতাত্ত্বিক দলের মধ্যে, নানান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে, নারী-পুরুষের মাঝে। অসমতা রয়েছে সুযোগে, অসমতা রয়েছে ফলাফলে। এই অসম পরিবেশে মানুষে-মানুষে বিভাজন বাড়ছে, মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এক উচ্চ মাত্রায় স্থিতু হয়েছে।
ব্যক্তি পর্যায়ে, সমাজ পর্যায়ে এবং রাষ্ট্র পর্যায়ে ক্ষমতার অসমতা একটি অস্থির, অস্থিতিশীল কাঠামোর জন্ম দিয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। জন্ম নিয়েছে সহিংসতা ও সন্ত্রাস। সামাজিক সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মানবিক সহনশীলতা। এক অর্থে এর ফলে সামাজিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল বিশ্বমানবতার ধারণা, মানবিকতার চিন্তাচেতনা আমাদের পৃথিবী ও সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করে একটি সুষম জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা নজরুলের সর্বজনীন মানবিকতার বোধের কাছে ফিরে যেতে পারি। সেই মানবিকতার বোধ থেকে মানব উন্নয়নের পথযাত্রা শুরু হতে পারে।
ব্যষ্টিক পর্যায়ে নজরুলের সাম্যচিন্তার যে চতুষ্টয় মাত্রিকতার কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিটির প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান সময়ের জন্য অতি প্রাসঙ্গিক। সে মাত্রিকতা নারী-পুরুষের সাম্যবিষয়ক হতে পারে, ধনী-নির্ধনের অসমতা বিষয়ে হতে পারে, কিংবা শ্রমজীবী বনাম পুঁজিপতি বিষয়ে হতে পারে। বহু অগ্রগতি ও অর্জন সত্ত্বেও নারী-পুরুষের বৈষম্য নানা সমাজে এখনো বিদ্যমান—সে অসমতা শুধু ফলাফলের নয়, সুযোগেরও। নজরুলের নারী-পুরুষ বৈষম্য বিষয়ের চিন্তাচেতনা আমাদের সময়ে এ বৈষম্য রোধে একটা বড় ধারণা দিতে পারে।
ধর্মীয় অসাম্য এবং ধর্মীয় ভণ্ডামি সম্পর্কে নজরুলের বিশ্লেষণ আমাদের সময়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ ও সংহিসতা এবং সন্ত্রাস রোধে একটি দিকনির্দেশনার কাজ করতে পারে। আমাদের সময়ে যে ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতা এবং সহিংসতার সংস্কৃতি মানবিক মূল্যবোধকে বিনষ্ট করছে, সেটাকে প্রতিহত করার জন্যও আমরা নজরুলে ফেরত যেতে পারি।
নজরুলের সাম্যচিন্তা সর্বযুগের জন্যই প্রাসঙ্গিক। কারণ এ চিন্তা মৌলিক সর্বজনীন কিছু মানবিক চিন্তার ওপরে স্থিত। তবে আমি মনে করি যে নজরুলের সাম্যচিন্তার ওপরে আরও আলাপ-আলোচনা, আরও গবেষণা হওয়া দরকার, যাতে আগামী পৃথিবীর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও নজরুল প্রাসঙ্গিক থাকেন।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে। তাই নজরুলের কবিতায়, গানে ও প্রবন্ধে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা অত্যন্ত জোরালোভাবে পরিস্ফুট। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে সমতার পক্ষে, সাম্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সাম্যচিন্তা তাঁর মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা এবং সেই সঙ্গে নৈতিকতার বোধ থেকে এসেছে—যাপিত জীবনের বাস্তবতা থেকে নয়। অন্যদিকে নজরুলের সাম্যচিন্তা একেবারেই জীবন থেকে নেওয়া।
বিভিন্ন লেখায় নজরুল কখনো সাম্যের কথা বলেছেন, কখনো সমতার কথা বলেছেন। এ বিভাজন একটি সচেতন চিন্তা থেকেই এসেছে। সাম্যের ধারণাটি আপেক্ষিক, যেখানে সমতার ধারণাটি অনপেক্ষ। নজরুল যখন বিশ্বমানবতার কথা বলেন, তখন একটি অনপেক্ষ মাত্রিকতা থেকেই সে কথা বলেন। অন্যদিকে তিনি যখন নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেন, তখন সেটা একটা আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি নজরুলের সাম্যচিন্তার দুটি স্তর আছে—একটি সামষ্টিক, অন্যটি ব্যষ্টিক।
সামষ্টিক পর্যায়ে নজরুল সাম্যচিন্তার উচ্চতম মাত্রিকতায় অবস্থান করেছেন। সে সাম্যচিন্তায় বিশ্ব মানবতা, সামগ্রিক মানবতাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর কাছে প্রতিটি মনুষ্যজীবনই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন—
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান’।
মানুষকে সম ভালোবাসায়, সম শ্রদ্ধা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই এই সাম্যচিন্তার মূল কথা।
এ শ্রদ্ধা, এ মর্যাদা নজরুল একজন দরিদ্র মানুষকেও দেন। তাই দারিদ্র্যের অহংকারকে তিনি একটি উচ্চতম স্তরে প্রতিস্থাপন করেছেন তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়। অতি জোরালোভাবে তিনি বলেছেন—
‘হে দারিদ্র্য,
তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।
কন্টক মুকুট শোভা। দিয়াছ তাপস, অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস।’
দারিদ্র্যের মাঝেও যে মর্যাদা ও অহংকার থাকে, তাকেই সমমর্যাদায় নজরুল প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিত্তের সঙ্গে। এ সমতা-বোধ তুলনাহীন। বিশ্বমানবতার প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’তেও।
ব্যষ্টিক দিক থেকে নজরুল সাম্যকে দেখেছেন চারটি মাত্রিকতায়—বিত্তবান ও দরিদ্রের মধ্যে, শ্রম ও পুঁজির মধ্যে, ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে। ধনী-নির্ধনের মধ্যে অসমতাকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এই বলে—
‘তুমি শুয়ে রবে তেতালার পরে,
আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব,
সে ধারণা আজ মিছে’।
দরিদ্র মানুষকে শোষণের মাধ্যমে যে ধনীর বিত্ত গড়ে ওঠে, সেটা নজরুল পরিষ্কার করে বলেছেন—
‘তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?
ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা।
তুমি জান নাকো,
কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে, ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!’
কিংবা
‘দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
তবে মানবতায় চিরবিশ্বাসী নজরুল আশা ছাড়েননি। তাঁর আশাবাদী মন ব্যক্ত করেছে যে এ অসাম্য একদিন শেষ হবে। তিনি যেন দেখতে পেয়েছেন সেই দিনকে, যেখানে দরিদ্রকে তাঁর পাওনা গণ্ডা বুঝিয়ে দিতে হবে—
‘আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা,
শুধিতে হইবে ঋণ!’
কিন্তু না, সে ঋণ এখনো শোধ হয়নি, হয়নি সে শোষণের অবসান। আজও বহু সমাজে দরিদ্র মানুষের অবস্থান প্রান্তিক, যেখানে বঞ্চনা তাঁদের নিত্য সঙ্গী এবং ভঙ্গুরতা তাঁদের জীবনের বিশাল এক মাত্রিকতা।
শ্রম আর পুঁজির মধ্যকার অসমতা সমাজে একটি অসাম্যের জন্ম দেয়। শ্রমিক সেখানে শোষিত আর পুঁজিপতি সেখানে শোষক। শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম দিয়েই গড়ে ওঠে সভ্যতা, আসে উন্নয়ন। আর শ্রমিকের শোষণের মাঝেই বিত্তের সম্পদ গড়ে তোলে পুঁজিপতিরা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এটাই স্বরূপ—অসাম্যই সেখানে নিয়ম। তাই নজরুলের ভাষ্য—
‘রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এ-সব কাহাদের দান!’
সাম্যবাদী নজরুল সর্বদা শ্রমিকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কণ্ঠ মিলিয়েছেন শ্রমিকের সঙ্গে। শ্রমিকের উৎপাদন থেকে পুঁজিপতিদের ফেঁপে ওঠার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে নিন্দা করেছেন শ্রম ও পুঁজির মধ্যকার অসাম্যকে—
‘যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে, বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে,
কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল! কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?’
ধর্মের আতশ কাচে নজরুল অসাম্যকে দেখেছেন তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে—মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের মাঝে বিভাজনের দিক থেকে এবং ধর্মীয় ভণ্ডামির দৃষ্টিকোণ থেকে। নজরুল সব সময়ে বলেছেন, মানবিকতাই মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম। তাই তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ বোধ তাঁর চিন্তাচেতনায় লালন করেছেন, যার জন্য তিনি একদিকে যেমন শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন, অন্যদিকে ইসলামি গানও লিখেছেন। মানবতার মহাবাণীকে তিনি তুলে ধরেছেন এই বলে,
‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!’
ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন সোচ্চার। মানবতার সবচেয়ে বড় বাধা বলে ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে নজরুল চিহ্নিত করেছেন। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক নজরুল মানবিক উদারতাকেই উঁচুতে তুলে ধরেছেন। নিজেকে সকল সংকীর্ণতা, সকল ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান করেছেন—
‘আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!’
প্রথাগত আনুষ্ঠানিক এবং নিয়মসর্বস্ব ধর্ম মানুষের মধ্যে একটা বিভাজনের সৃষ্টি করে। বিভাজিত হন আল্লাহ্-ভগবান-ঈশ্বর; মসজিদ-মন্দির-গির্জা। সেই বিভাজনের হাত ধরেই আসে অসাম্য। নজরুল তাই প্রশ্ন করেন—
‘কে তুমি?-পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত শখ,
কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি?-পথে ফুটে তাজা ফুল!
কিন্তু ধর্মীয় এই অসাম্যকে আঘাত করে তিনি শুনিয়েছেন সাম্যের বাণী—
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান! ’
ধর্ম শুকনা কেতাবের নয়, নয় পুঁথির, নয় অসার নিয়মের, নয় আনুষ্ঠানিকতার। ধর্ম আবদ্ধ নয় উপাসনালয়ে, তীর্থস্থানে। ধর্মের মূল আধার মানুষের মন, তার হৃদয়। তাই নজরুল অক্লেশে বলতে পারেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।’
তবে নজরুল সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ করেছেন ধর্মের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। যে তথাকথিত ধর্মীয় আচার দরিদ্রকে পদদলিত করে, বুভুক্ষুকে ক্ষুধার্ত রাখে, সে আচার ভণ্ডামি ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এ ভণ্ডামি মানুষে-মানুয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে, অসাম্যের জন্ম দেয়। এ ভণ্ডামির সূত্র ধরে ধর্মের তথাকথিত রক্ষকেরা ধর্মকে কুক্ষিগত করে। তখন
‘ভুখারী ফুকারি কয়,
ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’
কিংবা
‘তব মস্জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’
ধর্মের নামে ভণ্ডামিতে নজরুল ব্যথিত হন। বড় দুঃখে বলেন, ‘হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!’ তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠ তখন বলে, ‘খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!’
নারী-পুরুষের সমতা প্রশ্নে নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি তাঁর চিন্তাচেতনার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। নারীর অধিকার, সমাজে নারীর অবস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে নানা জোরালো বক্তব্য এসেছে কবিতাটিতে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাকে মাতা হিসেবে, কন্যা হিসেবে, বধূ হিসেবে, প্রেয়সী হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন নজরুল। সেই সঙ্গে নারীর অবদানকে মহিমান্বিত করেছেন তিনি। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে নারীর শুদ্ধ ‘মনুষ্য-সত্তাকে’ ততটা পরিস্ফুট করেননি তিনি।
কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, সমতার এক অনন্য স্তরে নারীকে স্থাপন করেছেন নজরুল। তাই তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পেরেছেন—
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’
মানব ইতিহাসে নারীর ভূমিকাকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন নজরুল। তাঁর ভাষ্যেও সে কথাটি সুস্পষ্ট।
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
নারী-পুরুষের সাম্য বিষয়ে তিনি সামনের দিকে তাকিয়েছেন, সমাজ-সংস্কারের কথা বলেছেন এবং নারীকে বন্দী করে রাখার ফলাফল সম্পর্কে পুরুষকে সাবধান করে দিয়েছেন।
‘সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই! ’
নজরুলের সাম্যচিন্তা প্রসঙ্গে উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সংগত প্রশ্ন উঠে আসে—বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নজরুলের সাম্যচিন্তা কতখানি প্রাসঙ্গিক। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাক, সাম্যের মাত্রিকতায় আমাদের সময়ের রূপ ও প্রকৃতি কী রকম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা একটি অসম, অস্থিতিশীল এবং অবক্ষয়মান পৃথিবীতে বাস করি।
আজকের বিশ্ব সংজ্ঞায়িত হচ্ছে অসমতার দ্বারা। অসমতা রয়েছে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, অঞ্চলে-অঞ্চলে। অসমতা রয়েছে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে, নানান নৃতাত্ত্বিক দলের মধ্যে, নানান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে, নারী-পুরুষের মাঝে। অসমতা রয়েছে সুযোগে, অসমতা রয়েছে ফলাফলে। এই অসম পরিবেশে মানুষে-মানুষে বিভাজন বাড়ছে, মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এক উচ্চ মাত্রায় স্থিতু হয়েছে।
ব্যক্তি পর্যায়ে, সমাজ পর্যায়ে এবং রাষ্ট্র পর্যায়ে ক্ষমতার অসমতা একটি অস্থির, অস্থিতিশীল কাঠামোর জন্ম দিয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। জন্ম নিয়েছে সহিংসতা ও সন্ত্রাস। সামাজিক সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মানবিক সহনশীলতা। এক অর্থে এর ফলে সামাজিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল বিশ্বমানবতার ধারণা, মানবিকতার চিন্তাচেতনা আমাদের পৃথিবী ও সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করে একটি সুষম জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা নজরুলের সর্বজনীন মানবিকতার বোধের কাছে ফিরে যেতে পারি। সেই মানবিকতার বোধ থেকে মানব উন্নয়নের পথযাত্রা শুরু হতে পারে।
ব্যষ্টিক পর্যায়ে নজরুলের সাম্যচিন্তার যে চতুষ্টয় মাত্রিকতার কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিটির প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান সময়ের জন্য অতি প্রাসঙ্গিক। সে মাত্রিকতা নারী-পুরুষের সাম্যবিষয়ক হতে পারে, ধনী-নির্ধনের অসমতা বিষয়ে হতে পারে, কিংবা শ্রমজীবী বনাম পুঁজিপতি বিষয়ে হতে পারে। বহু অগ্রগতি ও অর্জন সত্ত্বেও নারী-পুরুষের বৈষম্য নানা সমাজে এখনো বিদ্যমান—সে অসমতা শুধু ফলাফলের নয়, সুযোগেরও। নজরুলের নারী-পুরুষ বৈষম্য বিষয়ের চিন্তাচেতনা আমাদের সময়ে এ বৈষম্য রোধে একটা বড় ধারণা দিতে পারে।
ধর্মীয় অসাম্য এবং ধর্মীয় ভণ্ডামি সম্পর্কে নজরুলের বিশ্লেষণ আমাদের সময়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ ও সংহিসতা এবং সন্ত্রাস রোধে একটি দিকনির্দেশনার কাজ করতে পারে। আমাদের সময়ে যে ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতা এবং সহিংসতার সংস্কৃতি মানবিক মূল্যবোধকে বিনষ্ট করছে, সেটাকে প্রতিহত করার জন্যও আমরা নজরুলে ফেরত যেতে পারি।
নজরুলের সাম্যচিন্তা সর্বযুগের জন্যই প্রাসঙ্গিক। কারণ এ চিন্তা মৌলিক সর্বজনীন কিছু মানবিক চিন্তার ওপরে স্থিত। তবে আমি মনে করি যে নজরুলের সাম্যচিন্তার ওপরে আরও আলাপ-আলোচনা, আরও গবেষণা হওয়া দরকার, যাতে আগামী পৃথিবীর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও নজরুল প্রাসঙ্গিক থাকেন।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
সেলিম জাহান

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে। তাই নজরুলের কবিতায়, গানে ও প্রবন্ধে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা অত্যন্ত জোরালোভাবে পরিস্ফুট। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে সমতার পক্ষে, সাম্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সাম্যচিন্তা তাঁর মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা এবং সেই সঙ্গে নৈতিকতার বোধ থেকে এসেছে—যাপিত জীবনের বাস্তবতা থেকে নয়। অন্যদিকে নজরুলের সাম্যচিন্তা একেবারেই জীবন থেকে নেওয়া।
বিভিন্ন লেখায় নজরুল কখনো সাম্যের কথা বলেছেন, কখনো সমতার কথা বলেছেন। এ বিভাজন একটি সচেতন চিন্তা থেকেই এসেছে। সাম্যের ধারণাটি আপেক্ষিক, যেখানে সমতার ধারণাটি অনপেক্ষ। নজরুল যখন বিশ্বমানবতার কথা বলেন, তখন একটি অনপেক্ষ মাত্রিকতা থেকেই সে কথা বলেন। অন্যদিকে তিনি যখন নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেন, তখন সেটা একটা আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি নজরুলের সাম্যচিন্তার দুটি স্তর আছে—একটি সামষ্টিক, অন্যটি ব্যষ্টিক।
সামষ্টিক পর্যায়ে নজরুল সাম্যচিন্তার উচ্চতম মাত্রিকতায় অবস্থান করেছেন। সে সাম্যচিন্তায় বিশ্ব মানবতা, সামগ্রিক মানবতাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর কাছে প্রতিটি মনুষ্যজীবনই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন—
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান’।
মানুষকে সম ভালোবাসায়, সম শ্রদ্ধা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই এই সাম্যচিন্তার মূল কথা।
এ শ্রদ্ধা, এ মর্যাদা নজরুল একজন দরিদ্র মানুষকেও দেন। তাই দারিদ্র্যের অহংকারকে তিনি একটি উচ্চতম স্তরে প্রতিস্থাপন করেছেন তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়। অতি জোরালোভাবে তিনি বলেছেন—
‘হে দারিদ্র্য,
তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।
কন্টক মুকুট শোভা। দিয়াছ তাপস, অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস।’
দারিদ্র্যের মাঝেও যে মর্যাদা ও অহংকার থাকে, তাকেই সমমর্যাদায় নজরুল প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিত্তের সঙ্গে। এ সমতা-বোধ তুলনাহীন। বিশ্বমানবতার প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’তেও।
ব্যষ্টিক দিক থেকে নজরুল সাম্যকে দেখেছেন চারটি মাত্রিকতায়—বিত্তবান ও দরিদ্রের মধ্যে, শ্রম ও পুঁজির মধ্যে, ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে। ধনী-নির্ধনের মধ্যে অসমতাকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এই বলে—
‘তুমি শুয়ে রবে তেতালার পরে,
আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব,
সে ধারণা আজ মিছে’।
দরিদ্র মানুষকে শোষণের মাধ্যমে যে ধনীর বিত্ত গড়ে ওঠে, সেটা নজরুল পরিষ্কার করে বলেছেন—
‘তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?
ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা।
তুমি জান নাকো,
কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে, ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!’
কিংবা
‘দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
তবে মানবতায় চিরবিশ্বাসী নজরুল আশা ছাড়েননি। তাঁর আশাবাদী মন ব্যক্ত করেছে যে এ অসাম্য একদিন শেষ হবে। তিনি যেন দেখতে পেয়েছেন সেই দিনকে, যেখানে দরিদ্রকে তাঁর পাওনা গণ্ডা বুঝিয়ে দিতে হবে—
‘আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা,
শুধিতে হইবে ঋণ!’
কিন্তু না, সে ঋণ এখনো শোধ হয়নি, হয়নি সে শোষণের অবসান। আজও বহু সমাজে দরিদ্র মানুষের অবস্থান প্রান্তিক, যেখানে বঞ্চনা তাঁদের নিত্য সঙ্গী এবং ভঙ্গুরতা তাঁদের জীবনের বিশাল এক মাত্রিকতা।
শ্রম আর পুঁজির মধ্যকার অসমতা সমাজে একটি অসাম্যের জন্ম দেয়। শ্রমিক সেখানে শোষিত আর পুঁজিপতি সেখানে শোষক। শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম দিয়েই গড়ে ওঠে সভ্যতা, আসে উন্নয়ন। আর শ্রমিকের শোষণের মাঝেই বিত্তের সম্পদ গড়ে তোলে পুঁজিপতিরা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এটাই স্বরূপ—অসাম্যই সেখানে নিয়ম। তাই নজরুলের ভাষ্য—
‘রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এ-সব কাহাদের দান!’
সাম্যবাদী নজরুল সর্বদা শ্রমিকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কণ্ঠ মিলিয়েছেন শ্রমিকের সঙ্গে। শ্রমিকের উৎপাদন থেকে পুঁজিপতিদের ফেঁপে ওঠার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে নিন্দা করেছেন শ্রম ও পুঁজির মধ্যকার অসাম্যকে—
‘যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে, বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে,
কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল! কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?’
ধর্মের আতশ কাচে নজরুল অসাম্যকে দেখেছেন তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে—মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের মাঝে বিভাজনের দিক থেকে এবং ধর্মীয় ভণ্ডামির দৃষ্টিকোণ থেকে। নজরুল সব সময়ে বলেছেন, মানবিকতাই মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম। তাই তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ বোধ তাঁর চিন্তাচেতনায় লালন করেছেন, যার জন্য তিনি একদিকে যেমন শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন, অন্যদিকে ইসলামি গানও লিখেছেন। মানবতার মহাবাণীকে তিনি তুলে ধরেছেন এই বলে,
‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!’
ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন সোচ্চার। মানবতার সবচেয়ে বড় বাধা বলে ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে নজরুল চিহ্নিত করেছেন। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক নজরুল মানবিক উদারতাকেই উঁচুতে তুলে ধরেছেন। নিজেকে সকল সংকীর্ণতা, সকল ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান করেছেন—
‘আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!’
প্রথাগত আনুষ্ঠানিক এবং নিয়মসর্বস্ব ধর্ম মানুষের মধ্যে একটা বিভাজনের সৃষ্টি করে। বিভাজিত হন আল্লাহ্-ভগবান-ঈশ্বর; মসজিদ-মন্দির-গির্জা। সেই বিভাজনের হাত ধরেই আসে অসাম্য। নজরুল তাই প্রশ্ন করেন—
‘কে তুমি?-পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত শখ,
কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি?-পথে ফুটে তাজা ফুল!
কিন্তু ধর্মীয় এই অসাম্যকে আঘাত করে তিনি শুনিয়েছেন সাম্যের বাণী—
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান! ’
ধর্ম শুকনা কেতাবের নয়, নয় পুঁথির, নয় অসার নিয়মের, নয় আনুষ্ঠানিকতার। ধর্ম আবদ্ধ নয় উপাসনালয়ে, তীর্থস্থানে। ধর্মের মূল আধার মানুষের মন, তার হৃদয়। তাই নজরুল অক্লেশে বলতে পারেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।’
তবে নজরুল সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ করেছেন ধর্মের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। যে তথাকথিত ধর্মীয় আচার দরিদ্রকে পদদলিত করে, বুভুক্ষুকে ক্ষুধার্ত রাখে, সে আচার ভণ্ডামি ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এ ভণ্ডামি মানুষে-মানুয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে, অসাম্যের জন্ম দেয়। এ ভণ্ডামির সূত্র ধরে ধর্মের তথাকথিত রক্ষকেরা ধর্মকে কুক্ষিগত করে। তখন
‘ভুখারী ফুকারি কয়,
ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’
কিংবা
‘তব মস্জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’
ধর্মের নামে ভণ্ডামিতে নজরুল ব্যথিত হন। বড় দুঃখে বলেন, ‘হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!’ তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠ তখন বলে, ‘খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!’
নারী-পুরুষের সমতা প্রশ্নে নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি তাঁর চিন্তাচেতনার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। নারীর অধিকার, সমাজে নারীর অবস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে নানা জোরালো বক্তব্য এসেছে কবিতাটিতে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাকে মাতা হিসেবে, কন্যা হিসেবে, বধূ হিসেবে, প্রেয়সী হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন নজরুল। সেই সঙ্গে নারীর অবদানকে মহিমান্বিত করেছেন তিনি। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে নারীর শুদ্ধ ‘মনুষ্য-সত্তাকে’ ততটা পরিস্ফুট করেননি তিনি।
কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, সমতার এক অনন্য স্তরে নারীকে স্থাপন করেছেন নজরুল। তাই তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পেরেছেন—
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’
মানব ইতিহাসে নারীর ভূমিকাকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন নজরুল। তাঁর ভাষ্যেও সে কথাটি সুস্পষ্ট।
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
নারী-পুরুষের সাম্য বিষয়ে তিনি সামনের দিকে তাকিয়েছেন, সমাজ-সংস্কারের কথা বলেছেন এবং নারীকে বন্দী করে রাখার ফলাফল সম্পর্কে পুরুষকে সাবধান করে দিয়েছেন।
‘সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই! ’
নজরুলের সাম্যচিন্তা প্রসঙ্গে উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সংগত প্রশ্ন উঠে আসে—বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নজরুলের সাম্যচিন্তা কতখানি প্রাসঙ্গিক। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাক, সাম্যের মাত্রিকতায় আমাদের সময়ের রূপ ও প্রকৃতি কী রকম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা একটি অসম, অস্থিতিশীল এবং অবক্ষয়মান পৃথিবীতে বাস করি।
আজকের বিশ্ব সংজ্ঞায়িত হচ্ছে অসমতার দ্বারা। অসমতা রয়েছে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, অঞ্চলে-অঞ্চলে। অসমতা রয়েছে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে, নানান নৃতাত্ত্বিক দলের মধ্যে, নানান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে, নারী-পুরুষের মাঝে। অসমতা রয়েছে সুযোগে, অসমতা রয়েছে ফলাফলে। এই অসম পরিবেশে মানুষে-মানুষে বিভাজন বাড়ছে, মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এক উচ্চ মাত্রায় স্থিতু হয়েছে।
ব্যক্তি পর্যায়ে, সমাজ পর্যায়ে এবং রাষ্ট্র পর্যায়ে ক্ষমতার অসমতা একটি অস্থির, অস্থিতিশীল কাঠামোর জন্ম দিয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। জন্ম নিয়েছে সহিংসতা ও সন্ত্রাস। সামাজিক সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মানবিক সহনশীলতা। এক অর্থে এর ফলে সামাজিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল বিশ্বমানবতার ধারণা, মানবিকতার চিন্তাচেতনা আমাদের পৃথিবী ও সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করে একটি সুষম জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা নজরুলের সর্বজনীন মানবিকতার বোধের কাছে ফিরে যেতে পারি। সেই মানবিকতার বোধ থেকে মানব উন্নয়নের পথযাত্রা শুরু হতে পারে।
ব্যষ্টিক পর্যায়ে নজরুলের সাম্যচিন্তার যে চতুষ্টয় মাত্রিকতার কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিটির প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান সময়ের জন্য অতি প্রাসঙ্গিক। সে মাত্রিকতা নারী-পুরুষের সাম্যবিষয়ক হতে পারে, ধনী-নির্ধনের অসমতা বিষয়ে হতে পারে, কিংবা শ্রমজীবী বনাম পুঁজিপতি বিষয়ে হতে পারে। বহু অগ্রগতি ও অর্জন সত্ত্বেও নারী-পুরুষের বৈষম্য নানা সমাজে এখনো বিদ্যমান—সে অসমতা শুধু ফলাফলের নয়, সুযোগেরও। নজরুলের নারী-পুরুষ বৈষম্য বিষয়ের চিন্তাচেতনা আমাদের সময়ে এ বৈষম্য রোধে একটা বড় ধারণা দিতে পারে।
ধর্মীয় অসাম্য এবং ধর্মীয় ভণ্ডামি সম্পর্কে নজরুলের বিশ্লেষণ আমাদের সময়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ ও সংহিসতা এবং সন্ত্রাস রোধে একটি দিকনির্দেশনার কাজ করতে পারে। আমাদের সময়ে যে ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতা এবং সহিংসতার সংস্কৃতি মানবিক মূল্যবোধকে বিনষ্ট করছে, সেটাকে প্রতিহত করার জন্যও আমরা নজরুলে ফেরত যেতে পারি।
নজরুলের সাম্যচিন্তা সর্বযুগের জন্যই প্রাসঙ্গিক। কারণ এ চিন্তা মৌলিক সর্বজনীন কিছু মানবিক চিন্তার ওপরে স্থিত। তবে আমি মনে করি যে নজরুলের সাম্যচিন্তার ওপরে আরও আলাপ-আলোচনা, আরও গবেষণা হওয়া দরকার, যাতে আগামী পৃথিবীর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও নজরুল প্রাসঙ্গিক থাকেন।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে। তাই নজরুলের কবিতায়, গানে ও প্রবন্ধে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা অত্যন্ত জোরালোভাবে পরিস্ফুট। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে সমতার পক্ষে, সাম্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সাম্যচিন্তা তাঁর মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা এবং সেই সঙ্গে নৈতিকতার বোধ থেকে এসেছে—যাপিত জীবনের বাস্তবতা থেকে নয়। অন্যদিকে নজরুলের সাম্যচিন্তা একেবারেই জীবন থেকে নেওয়া।
বিভিন্ন লেখায় নজরুল কখনো সাম্যের কথা বলেছেন, কখনো সমতার কথা বলেছেন। এ বিভাজন একটি সচেতন চিন্তা থেকেই এসেছে। সাম্যের ধারণাটি আপেক্ষিক, যেখানে সমতার ধারণাটি অনপেক্ষ। নজরুল যখন বিশ্বমানবতার কথা বলেন, তখন একটি অনপেক্ষ মাত্রিকতা থেকেই সে কথা বলেন। অন্যদিকে তিনি যখন নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেন, তখন সেটা একটা আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি নজরুলের সাম্যচিন্তার দুটি স্তর আছে—একটি সামষ্টিক, অন্যটি ব্যষ্টিক।
সামষ্টিক পর্যায়ে নজরুল সাম্যচিন্তার উচ্চতম মাত্রিকতায় অবস্থান করেছেন। সে সাম্যচিন্তায় বিশ্ব মানবতা, সামগ্রিক মানবতাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর কাছে প্রতিটি মনুষ্যজীবনই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন—
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান’।
মানুষকে সম ভালোবাসায়, সম শ্রদ্ধা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই এই সাম্যচিন্তার মূল কথা।
এ শ্রদ্ধা, এ মর্যাদা নজরুল একজন দরিদ্র মানুষকেও দেন। তাই দারিদ্র্যের অহংকারকে তিনি একটি উচ্চতম স্তরে প্রতিস্থাপন করেছেন তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়। অতি জোরালোভাবে তিনি বলেছেন—
‘হে দারিদ্র্য,
তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।
কন্টক মুকুট শোভা। দিয়াছ তাপস, অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস।’
দারিদ্র্যের মাঝেও যে মর্যাদা ও অহংকার থাকে, তাকেই সমমর্যাদায় নজরুল প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিত্তের সঙ্গে। এ সমতা-বোধ তুলনাহীন। বিশ্বমানবতার প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’তেও।
ব্যষ্টিক দিক থেকে নজরুল সাম্যকে দেখেছেন চারটি মাত্রিকতায়—বিত্তবান ও দরিদ্রের মধ্যে, শ্রম ও পুঁজির মধ্যে, ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে। ধনী-নির্ধনের মধ্যে অসমতাকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এই বলে—
‘তুমি শুয়ে রবে তেতালার পরে,
আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব,
সে ধারণা আজ মিছে’।
দরিদ্র মানুষকে শোষণের মাধ্যমে যে ধনীর বিত্ত গড়ে ওঠে, সেটা নজরুল পরিষ্কার করে বলেছেন—
‘তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?
ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা।
তুমি জান নাকো,
কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে, ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!’
কিংবা
‘দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
তবে মানবতায় চিরবিশ্বাসী নজরুল আশা ছাড়েননি। তাঁর আশাবাদী মন ব্যক্ত করেছে যে এ অসাম্য একদিন শেষ হবে। তিনি যেন দেখতে পেয়েছেন সেই দিনকে, যেখানে দরিদ্রকে তাঁর পাওনা গণ্ডা বুঝিয়ে দিতে হবে—
‘আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা,
শুধিতে হইবে ঋণ!’
কিন্তু না, সে ঋণ এখনো শোধ হয়নি, হয়নি সে শোষণের অবসান। আজও বহু সমাজে দরিদ্র মানুষের অবস্থান প্রান্তিক, যেখানে বঞ্চনা তাঁদের নিত্য সঙ্গী এবং ভঙ্গুরতা তাঁদের জীবনের বিশাল এক মাত্রিকতা।
শ্রম আর পুঁজির মধ্যকার অসমতা সমাজে একটি অসাম্যের জন্ম দেয়। শ্রমিক সেখানে শোষিত আর পুঁজিপতি সেখানে শোষক। শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম দিয়েই গড়ে ওঠে সভ্যতা, আসে উন্নয়ন। আর শ্রমিকের শোষণের মাঝেই বিত্তের সম্পদ গড়ে তোলে পুঁজিপতিরা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এটাই স্বরূপ—অসাম্যই সেখানে নিয়ম। তাই নজরুলের ভাষ্য—
‘রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এ-সব কাহাদের দান!’
সাম্যবাদী নজরুল সর্বদা শ্রমিকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কণ্ঠ মিলিয়েছেন শ্রমিকের সঙ্গে। শ্রমিকের উৎপাদন থেকে পুঁজিপতিদের ফেঁপে ওঠার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে নিন্দা করেছেন শ্রম ও পুঁজির মধ্যকার অসাম্যকে—
‘যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে, বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে,
কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল! কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?’
ধর্মের আতশ কাচে নজরুল অসাম্যকে দেখেছেন তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে—মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের মাঝে বিভাজনের দিক থেকে এবং ধর্মীয় ভণ্ডামির দৃষ্টিকোণ থেকে। নজরুল সব সময়ে বলেছেন, মানবিকতাই মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম। তাই তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ বোধ তাঁর চিন্তাচেতনায় লালন করেছেন, যার জন্য তিনি একদিকে যেমন শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন, অন্যদিকে ইসলামি গানও লিখেছেন। মানবতার মহাবাণীকে তিনি তুলে ধরেছেন এই বলে,
‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!’
ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন সোচ্চার। মানবতার সবচেয়ে বড় বাধা বলে ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে নজরুল চিহ্নিত করেছেন। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক নজরুল মানবিক উদারতাকেই উঁচুতে তুলে ধরেছেন। নিজেকে সকল সংকীর্ণতা, সকল ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান করেছেন—
‘আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!’
প্রথাগত আনুষ্ঠানিক এবং নিয়মসর্বস্ব ধর্ম মানুষের মধ্যে একটা বিভাজনের সৃষ্টি করে। বিভাজিত হন আল্লাহ্-ভগবান-ঈশ্বর; মসজিদ-মন্দির-গির্জা। সেই বিভাজনের হাত ধরেই আসে অসাম্য। নজরুল তাই প্রশ্ন করেন—
‘কে তুমি?-পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত শখ,
কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি?-পথে ফুটে তাজা ফুল!
কিন্তু ধর্মীয় এই অসাম্যকে আঘাত করে তিনি শুনিয়েছেন সাম্যের বাণী—
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান! ’
ধর্ম শুকনা কেতাবের নয়, নয় পুঁথির, নয় অসার নিয়মের, নয় আনুষ্ঠানিকতার। ধর্ম আবদ্ধ নয় উপাসনালয়ে, তীর্থস্থানে। ধর্মের মূল আধার মানুষের মন, তার হৃদয়। তাই নজরুল অক্লেশে বলতে পারেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।’
তবে নজরুল সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ করেছেন ধর্মের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। যে তথাকথিত ধর্মীয় আচার দরিদ্রকে পদদলিত করে, বুভুক্ষুকে ক্ষুধার্ত রাখে, সে আচার ভণ্ডামি ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এ ভণ্ডামি মানুষে-মানুয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে, অসাম্যের জন্ম দেয়। এ ভণ্ডামির সূত্র ধরে ধর্মের তথাকথিত রক্ষকেরা ধর্মকে কুক্ষিগত করে। তখন
‘ভুখারী ফুকারি কয়,
ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’
কিংবা
‘তব মস্জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’
ধর্মের নামে ভণ্ডামিতে নজরুল ব্যথিত হন। বড় দুঃখে বলেন, ‘হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!’ তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠ তখন বলে, ‘খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!’
নারী-পুরুষের সমতা প্রশ্নে নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি তাঁর চিন্তাচেতনার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। নারীর অধিকার, সমাজে নারীর অবস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে নানা জোরালো বক্তব্য এসেছে কবিতাটিতে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাকে মাতা হিসেবে, কন্যা হিসেবে, বধূ হিসেবে, প্রেয়সী হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন নজরুল। সেই সঙ্গে নারীর অবদানকে মহিমান্বিত করেছেন তিনি। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে নারীর শুদ্ধ ‘মনুষ্য-সত্তাকে’ ততটা পরিস্ফুট করেননি তিনি।
কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, সমতার এক অনন্য স্তরে নারীকে স্থাপন করেছেন নজরুল। তাই তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পেরেছেন—
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’
মানব ইতিহাসে নারীর ভূমিকাকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন নজরুল। তাঁর ভাষ্যেও সে কথাটি সুস্পষ্ট।
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
নারী-পুরুষের সাম্য বিষয়ে তিনি সামনের দিকে তাকিয়েছেন, সমাজ-সংস্কারের কথা বলেছেন এবং নারীকে বন্দী করে রাখার ফলাফল সম্পর্কে পুরুষকে সাবধান করে দিয়েছেন।
‘সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই! ’
নজরুলের সাম্যচিন্তা প্রসঙ্গে উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সংগত প্রশ্ন উঠে আসে—বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নজরুলের সাম্যচিন্তা কতখানি প্রাসঙ্গিক। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাক, সাম্যের মাত্রিকতায় আমাদের সময়ের রূপ ও প্রকৃতি কী রকম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা একটি অসম, অস্থিতিশীল এবং অবক্ষয়মান পৃথিবীতে বাস করি।
আজকের বিশ্ব সংজ্ঞায়িত হচ্ছে অসমতার দ্বারা। অসমতা রয়েছে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, অঞ্চলে-অঞ্চলে। অসমতা রয়েছে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে, নানান নৃতাত্ত্বিক দলের মধ্যে, নানান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে, নারী-পুরুষের মাঝে। অসমতা রয়েছে সুযোগে, অসমতা রয়েছে ফলাফলে। এই অসম পরিবেশে মানুষে-মানুষে বিভাজন বাড়ছে, মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এক উচ্চ মাত্রায় স্থিতু হয়েছে।
ব্যক্তি পর্যায়ে, সমাজ পর্যায়ে এবং রাষ্ট্র পর্যায়ে ক্ষমতার অসমতা একটি অস্থির, অস্থিতিশীল কাঠামোর জন্ম দিয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। জন্ম নিয়েছে সহিংসতা ও সন্ত্রাস। সামাজিক সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মানবিক সহনশীলতা। এক অর্থে এর ফলে সামাজিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল বিশ্বমানবতার ধারণা, মানবিকতার চিন্তাচেতনা আমাদের পৃথিবী ও সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করে একটি সুষম জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা নজরুলের সর্বজনীন মানবিকতার বোধের কাছে ফিরে যেতে পারি। সেই মানবিকতার বোধ থেকে মানব উন্নয়নের পথযাত্রা শুরু হতে পারে।
ব্যষ্টিক পর্যায়ে নজরুলের সাম্যচিন্তার যে চতুষ্টয় মাত্রিকতার কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিটির প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান সময়ের জন্য অতি প্রাসঙ্গিক। সে মাত্রিকতা নারী-পুরুষের সাম্যবিষয়ক হতে পারে, ধনী-নির্ধনের অসমতা বিষয়ে হতে পারে, কিংবা শ্রমজীবী বনাম পুঁজিপতি বিষয়ে হতে পারে। বহু অগ্রগতি ও অর্জন সত্ত্বেও নারী-পুরুষের বৈষম্য নানা সমাজে এখনো বিদ্যমান—সে অসমতা শুধু ফলাফলের নয়, সুযোগেরও। নজরুলের নারী-পুরুষ বৈষম্য বিষয়ের চিন্তাচেতনা আমাদের সময়ে এ বৈষম্য রোধে একটা বড় ধারণা দিতে পারে।
ধর্মীয় অসাম্য এবং ধর্মীয় ভণ্ডামি সম্পর্কে নজরুলের বিশ্লেষণ আমাদের সময়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ ও সংহিসতা এবং সন্ত্রাস রোধে একটি দিকনির্দেশনার কাজ করতে পারে। আমাদের সময়ে যে ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতা এবং সহিংসতার সংস্কৃতি মানবিক মূল্যবোধকে বিনষ্ট করছে, সেটাকে প্রতিহত করার জন্যও আমরা নজরুলে ফেরত যেতে পারি।
নজরুলের সাম্যচিন্তা সর্বযুগের জন্যই প্রাসঙ্গিক। কারণ এ চিন্তা মৌলিক সর্বজনীন কিছু মানবিক চিন্তার ওপরে স্থিত। তবে আমি মনে করি যে নজরুলের সাম্যচিন্তার ওপরে আরও আলাপ-আলোচনা, আরও গবেষণা হওয়া দরকার, যাতে আগামী পৃথিবীর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও নজরুল প্রাসঙ্গিক থাকেন।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
১৩ দিন আগে
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
২৩ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫তৌহিদুল হক

রক্ত লাল
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে
গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়
ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের
জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে
রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে
প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা
উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।
কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত
শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।
এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়
দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব
মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।
এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ
ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার
অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে
ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে
বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।
যত দেখি
যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে
জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা
শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।
যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।
হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।
যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।
ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত
করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!
সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।
জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ
আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।
তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে
অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই
কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার
প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।
এ যেন কেমন
গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে
চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে
একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির
মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে
এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ
কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা
আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।
সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে
নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার
অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।
জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?
চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার
যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।
চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?
যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!
চলে আসুন সবজি বাজারে
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু
যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার
উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে
হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।
প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো
পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?
হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে
যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!
চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা
ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।
যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।
আহা! দেখার কেউ নেই!
এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।
কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ
কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?
কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।
চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।
ইতিহাস
আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই
নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব
ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।
আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---
আমি নই কারও!
সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম
ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে
অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ
ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু
এক মুখচ্ছবি।
আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে
হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার
কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।
কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।
দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!
আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না
হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে
ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে
সবকিছুর-ই সময় থাকে---
এরপর---ইতিহাস!

রক্ত লাল
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে
গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়
ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের
জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে
রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে
প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা
উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।
কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত
শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।
এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়
দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব
মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।
এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ
ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার
অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে
ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে
বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।
যত দেখি
যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে
জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা
শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।
যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।
হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।
যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।
ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত
করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!
সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।
জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ
আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।
তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে
অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই
কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার
প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।
এ যেন কেমন
গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে
চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে
একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির
মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে
এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ
কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা
আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।
সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে
নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার
অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।
জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?
চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার
যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।
চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?
যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!
চলে আসুন সবজি বাজারে
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু
যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার
উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে
হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।
প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো
পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?
হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে
যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!
চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা
ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।
যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।
আহা! দেখার কেউ নেই!
এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।
কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ
কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?
কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।
চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।
ইতিহাস
আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই
নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব
ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।
আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---
আমি নই কারও!
সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম
ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে
অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ
ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু
এক মুখচ্ছবি।
আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে
হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার
কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।
কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।
দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!
আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না
হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে
ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে
সবকিছুর-ই সময় থাকে---
এরপর---ইতিহাস!

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে...
২৫ মে ২০২৫
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
২৩ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’
‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’
হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,
‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।
হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।
তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’
ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’
‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’
হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,
‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।
হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।
তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’
ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে...
২৫ মে ২০২৫
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
১৩ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে...
২৫ মে ২০২৫
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
১৩ দিন আগে
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
২৩ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে...
২৫ মে ২০২৫
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
১৩ দিন আগে
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
২৩ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫