Ajker Patrika

‘পাখিটা বুকের ভেতর রয়’

মন্টি বৈষ্ণব, ঢাকা
আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২১, ১১: ৩৯
‘পাখিটা বুকের ভেতর রয়’

মানুষ জীবন ধারণের জন্য যা কিছু গ্রহণ করে, তার সিংহভাগই আসে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণের আছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পশু-পাখি ও মানুষের সঙ্গে প্রতিটি গাছের ভাষা ও আচরণ আলাদা। গাছের কাছে না গেলে সেই ভাষা বোঝা যায় না।

সনাতন মালো উল্লাস। প্রকৃতিকে ভালোবাসেন মনপ্রাণ উজাড় করে। ভালোবাসার সেই জায়গা থেকে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা অপ্রয়োজনীয়, মূল্যহীন নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি করেন বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম। 

রাস্তাঘাটে নিতান্তই অবহেলায় পড়ে থাকা উপকরণ দিয়ে ভাস্কর্য তৈরির প্রসঙ্গে সনাতন বলেন, ‘শিল্পকর্ম, চিন্তা, চর্চা, সাধনা বা সংরক্ষণ এক সূত্রে গাঁথা। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা মূল বিষয় বলে মনে হয় না আমার কাছে। আগ্রহ বা ভালোবাসা থাকলে যেকোনো জায়গা থেকে মানুষ অনেক কিছু তৈরি করতে পারে। আমার কাজের মূল উপাদান রাস্তাঘাটে, মাঠে, জঙ্গলে, পুকুরপাড়ে, নদীর ধারে পড়ে থাকা গাছের শেকড়, ভাঙা ডালপালা, লতাপাতা ও পশু-পাখির হাড়গোড়। ভাস্কর্য নিয়ে আমার কাজ করা ভালো লাগার জায়গা থেকে। এই ভালো লাগাটা ক্রমাগত ভালোবাসায় পরিবর্তিত হচ্ছে। তবে এই ভালোবাসাকে যত্ন ও পরিচর্যায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আন্তরিকতার। সেই আন্তরিকতার গভীরে আছে মানবিক সমাজ গঠনে নিজেকে নিবেদন করা।’ 

রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা অপ্রয়োজনীয়, মূল্যহীন নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি করেন বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম তৈরি করেন সনাতন মালো উল্লাসতবে নিজের তৈরি শিল্পকর্মকে ‘ভাস্কর্য’ বলার চেয়ে ‘রূপান্তর’ বলতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন সনাতন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমরা তো কোনো কিছু সৃষ্টি বা তৈরি করতে পারি না; বরং এই প্রকৃতিতে যা আছে, সেটাকে চিন্তা আর ইচ্ছেশক্তির সমন্বয়ে রূপান্তর করতে পারি মাত্র। আমরা কেউ গাছ বা পাখি সৃষ্টি করতে পারি না। কিন্তু গাছের শেকড়, পাতা, ফুল বা পাখির পালক, এমনকি ফেলে দেওয়া যেকোনো প্রাকৃতিক উপকরণ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম তৈরি করতে পারি। প্রাকৃতিক এই উপকরণগুলো একসময় সেই সময়ের ইতিহাসকে বহন করবে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া সভ্যতা যখন মানুষ মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করে, তখন সেখান থেকে উদ্ধারকৃত ভাস্কর্য এবং অন্যান্য শিল্পকর্মই বলে দেয় সেই সময়ের ইতিহাস।’ 

এ ধরনের শিল্পকর্মের দিকে সনাতনের আকর্ষণ কিন্তু ছোটবেলা থেকেই। বলা যায়, বেড়ে ওঠার সঙ্গেই কাঠ খোদাইয়ের বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে। সনাতন বলছেন, ‘তখন আমি বড়জোর তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বাড়িতে প্রায় প্রতিবছর বর্ষাকালের শুরু কিংবা শীতের শেষে চার-পাঁচজনের একদল কাঠমিস্ত্রি আসতেন। তাঁরা মাসাধিককাল কিংবা তারও বেশি সময় ধরে নতুন নৌকা বানানো, পুরোনো নৌকা মেরামতের পাশাপাশি কাঠের নানা আসবাব তৈরি করতেন। বাড়ির খুব কাছেই ছিল কুমার নদ। তাঁরা নদের পাড়ে নৌকার বাদাম টানিয়ে ছায়াময় জায়গা তৈরি করে সেখানে কাজ করতেন সকাল থেকে রাত অবধি। স্কুল থেকে ফিরে প্রায় সারা দিনই কাটত সেই মিস্ত্রিদের সঙ্গে। হাতুড়ি, বাটাল, বাইসখান, রেন্দা, করাত, শীল ইত্যাদি হাতিয়ারের আলাদা আলাদা শব্দ আমাকে খুব টানত। কখনো কখনো টুকরো কাঠের ওপর হাতুড়ি ও বাটাল নিয়ে কিছু একটা করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করতাম। বলতে গেলে শুরুর প্রথমটা সেখান থেকেই।’ 

নিজের তৈরি শিল্পকর্মকে ‘ভাস্কর্য’ বলার চেয়ে ‘রূপান্তর’ বলতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন সনাতনসনাতনের চারুকলায় পড়ার ভীষণ ইচ্ছা থাকলেও উপযুক্ত গাইডলাইন বা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সেদিকে আর যাননি। কোনো সম্ভ্রান্ত বা বনেদি পরিবারে তাঁর জন্ম হয়নি। খুব সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী পরিবারে জন্ম। সনাতনের পূর্বপুরুষের পেশা ছিল মাছ ধরা। অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও বৈরী স্রোতে দাঁড় বেয়ে, জাল বেয়ে, মাছ ধরে, কখনো বিক্রি করে তাঁর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাজীবন শেষ হয়। সনাতনের ছোটবেলা কেটেছে জল-কাদা, স্রোত, রোদ-বৃষ্টি, ঝড়, নৌকা, নদী, অন্ধকার রাত আর নদীতে ভেসে যাওয়া সুখ-দুঃখের গল্পের সঙ্গে। পাড় ভেঙে জলে পড়ে যাওয়া গাছ, শেকড়, লতাপাতা আরও অনেক কিছুর সঙ্গে মিলেমিশে কেটেছে তাঁর ছেলেবেলা। একসময় মাছ ধরার নৌকায়ও কুপিবাতির আলোয় পড়ালেখা করেছেন। 

 ২০০৫ সালে তিনি ঢাকায় স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। ছাত্রজীবন শেষে ঢোকেন বেসরকারি চাকরিতে। এর মধ্যে তিনি সময় ও সুযোগ বের করে তাঁর কাজ করার উপাদান সংগ্রহ করতেন। কাজের প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে গেলে সেখান থেকে তিনি নিয়ে আসতেন গাছের টুকরো বা শেকড়সহ বিভিন্ন উপকরণ। এ ছাড়া পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনের বেসমেন্টে তাঁর কাজের জন্য একটা রুম ছিল। সেখানে তিনি তাঁর কাজগুলো সংরক্ষণে রাখতেন। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবে হাজারো মানুষের অনেক মূল্যবান জিনিসের সঙ্গে তাঁর কাজগুলোও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ঘটনার পরে ক্ষোভে অনেক দিন তিনি কাজ থেকে দূরে ছিলেন। 

বর্তমানে কাজের পরিবেশ বা পরিধির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘সীমিত আয়ের চাকরি করে ভাস্কর্যের মতো বিরাট বিষয়ে চর্চা করা দুঃসাহস ছাড়া আর কিছুই নয়। সংগ্রহে থাকা কিছু কাঠ আর শিকড় নিয়ে সাধারণ অ্যান্টিকাটার ও হাতুড়ি-বাটাল দিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এভাবে কাজ করা ভীষণ কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ। একদিকে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, অন্যদিকে শিল্পচর্চা। নিজের জীবনের টানাপোড়েন মাঝেমধ্যে এই কাজে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যদি টাকা-পয়সা উপার্জনের চাপ না থাকত, তবে নিজের মনের মতো করে তৈরি করতাম বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম। যদিও মাঝেমধ্যে মনে হয় এই উন্মাদনা নিতান্তই বিলাসিতা।’ 

সনাতন মালো উল্লাসের করা একটি শিল্পকর্মসনাতন গান করেন, লেখেন। কাঠের তৈরি এসব ভাস্কর্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিজের গানের কাছেই ফিরে গেলেন তিনি। বললেন, ‘আমার লেখা একটা গানের একটা প্রিয় লাইন হলো—“পাখিটা বুকের ভেতর রয়…”। আমি আমার কাজে প্রথম এবং সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পাই প্রকৃতির কাছ থেকে। দু-একজন জানেন আমি বড় গাছদের “মা”, আর ছোট গাছদের “সন্তান” বলে ডাকি। সুযোগ পেলে গাছ লাগাই। বৃক্ষ নিধনে ভীষণ কষ্ট পাই। পরিবারের সহযোগিতা না থাকলে কেউ কোনো কাজই ভালোভাবে করতে পারে না। আমি কৃতজ্ঞ আমার ব্যক্তিগত এবং আত্মিক পরিবারের কাছে। আত্মিক পরিবারের দু-একজন সুহৃদ কিছু কাজ সংরক্ষণের জন্য জায়গা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। এর বাইরে সহযোগিতা বলতে যা বোঝায়, তা পাইনি কারও কাছ থেকে।’ 

সনাতনের করা এই ‘ব্যক্তিগত’ ও ‘আত্মিক’ পরিবারের উল্লেখ বেশ আগ্রহী করে তুলল। জানতে চাইলে বললেন, ‘আমি তিন রকম পরিবারের সদস্য। একটি নিজস্ব বা ব্যক্তিগত, একটি বৃহত্তর, আরেকটি আদর্শিক। ব্যক্তিগত পরিবার বলতে বৈবাহিক সূত্রে শিল্পী আক্তার আমার জীবনবন্ধু। আমাদের একটি কন্যাসন্তান আছে। তার নাম মেঘবতী স্লোগান। সে ৮ পেরিয়ে ৯-এর পথে। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। আমরা বলি, “স্লোগান শিল্পী সনাতন—এক সত্তায় তিনজন”। মা-বাবা আছেন। আমার তিন বোন ও চার ভাই। এ ছাড়া দেশ ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে মানবধর্মে বিশ্বাসী অগণিত আপনজন আমার আদর্শিক পরিবারের সদস্য।’ 

জীবনযাপনের উপায়ের সঙ্গে শিল্পচর্চাকে যুক্ত করতে পারলে জীবন সার্থক হবে বলে মনে করেন সনাতনএই কাজ নিয়ে পরিকল্পনা কী—জানতে চাইলে সনাতন বলেন, ‘এটা আমার পেশা নয়। আবার শুধু শখের বসে করছি, তা-ও নয়। তবে যদি কখনো জীবনযাপনের সঙ্গে একে সম্পূর্ণভাবে যুক্ত করতে পারি, তবে জীবন সার্থক হবে। অনেক কিছু নিয়ে অনেক ভাবনা আছে, সবটা তো আর বাস্তবায়ন সম্ভব না। প্রতিনিয়ত কাজ করা এবং কাজগুলো সংরক্ষণের মতো একটি জায়গা হলে একটি গ্যালারি করতাম। কাজগুলো সবাইকে দেখানোর জন্য প্রদর্শন করতে চাই। পাখিরা যাতে ভালো থাকে, তার জন্য পৃথিবীকে সবুজ করতে চাই। দেশ যে আদর্শের জন্য স্বাধীন হয়েছে, সেই আলোকে অগণিত ভাস্কর্য করতে চাই। নতুন প্রজন্মকে এই বিষয়ের প্রতি আগ্রহী করতে একটি পাঠশালা করার ভাবনা অনেক দিনের। যদিও আমার চলমান বাস্তবতায় এটা অনেকটাই অলীক কল্পনা। সব থেকে বড় কথা হলো, আমি প্রতিনিয়ত শিখতে চাই, জানতে চাই এবং কাজ করতে চাই।’ 

আলাপে পাখির প্রসঙ্গই ঘুরেফিরে আসে বারবার। নিজের স্বপ্ন ও কাজ যেন পাখির ডানাতেই ভর করে আছে। যেন সবুজই সনাতনের একমাত্র আরাধ্য। বললেন, ‘পৃথিবী ক্রমাগত পাখিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই প্রিয় শরীর খাঁচাটাও একদিন পাখিশূন্য হয়ে যাবে। যেদিন পৃথিবী থেকে শেষ পাখিটা বিলুপ্ত হবে, সেই দিন সেই পৃথিবীতে কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে কি না, সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমি আমার কাজের মাধ্যমে একটা কথা বারবার বলতে চাই। সেটা হলো, মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই পাখিদের বাসযোগ্য করতে হবে পৃথিবীকে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোচির ইহুদি পরিবারের ঐতিহ্য যেভাবে বাঁচিয়ে রাখছেন এক মুসলিম

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
কোচির ইহুদি পাড়ায় সারা আন্টির রেখে যাওয়া দোকানের সামনে ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
কোচির ইহুদি পাড়ায় সারা আন্টির রেখে যাওয়া দোকানের সামনে ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।

এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।

ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’

আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।

থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’

এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’

কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।

এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

ইব্রাহিম থাহার সারা আন্টি তাঁর পরিণত বয়সে। ছবি: ইব্রাহিম থাহার সৌজন্যে
ইব্রাহিম থাহার সারা আন্টি তাঁর পরিণত বয়সে। ছবি: ইব্রাহিম থাহার সৌজন্যে

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।

আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।

থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।

ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’

উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’

এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

সারা আন্টির দোকানে কিপ্পা সেলাই করছেন ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
সারা আন্টির দোকানে কিপ্পা সেলাই করছেন ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’

ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।

থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’

সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’

তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’

থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’

বিবিসি থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গাবতলী সেতু বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
গাবতলী সেতু বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সাহিত্যচর্চা এবং মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট

সম্পাদকীয়
সাহিত্যচর্চা এবং মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।

অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।

তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।

কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।

সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।

পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত