মোহাম্মদ ইদ্রিস

১৯২০-এর দশকের কোনো এক দিন। ড্যান্ডি শহরের কোনো এক জুট মিলের মালিক মাথায় সোলার হ্যাট পরে আমাদের ফরিদপুর শহরের পাটের বাজার দেখতে এসেছিলেন, দাদার মুখে সে গল্প শুনেছি।
সে ঘটনার প্রায় ১০২ বছর পর অবশেষে দেখলাম স্কটল্যান্ডের ড্যান্ডি শহরে বিশ্বের প্রথম জুটমিল। মিল ঠিক নয়, জুট মিউজিয়াম। পাট উৎপন্ন করত বাংলার কৃষক, আর সব পাটকল ছিল স্কটল্যান্ডে। সহজ বাংলা ভাষায় এরই নাম ছিল সাম্রাজ্যবাদ।
ভারডান্ট ওয়ার্কস মিউজিয়াম
‘গতস্য শোচনা নাস্তি’ অতি পুরোনো সংস্কৃত শ্লোক। তবুও বয়স্কা নর্তকী বারবার আয়না দেখে, বিগত যৌবনের সৌন্দর্য খোঁজে। আর বৃদ্ধ মানুষ চোখ বন্ধ করে বিগত যৌবনের সুখ চিন্তা করে। আমাদের এক কালের প্রভুদের অবস্থাও ঠিক তাই। এখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নেই, ড্যান্ডি শহরে জুট মিলও নেই। বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা জুট মিলকে মিউজিয়াম বানিয়ে স্কটিশেরা পুরোনো শৌর্য ও ঐশ্বর্য মনে রাখার চেষ্টা করছে।
১৯৫৪ সালে হক-ভাসানি মুসলিম লীগকে ডুবিয়ে দিয়ে যেদিন সরকার গঠনের শপথ নিচ্ছিল, ঠিক সেই দিন নারায়ণগঞ্জের পাটকলে বিহারি আর বাঙালি শ্রমিকদের মধ্য রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা বাঁধিয়ে মুসলিম লীগের গুন্ডারা গণপ্রতিনিধিত্বের সরকারকে খাটো করবার চেষ্টা করেছিল। সে কথা ইতিহাস বইতে পড়েছি। ‘আমরা পাট রপ্তানি করে যে পরিমাণ বিদেশি টাকা আয় করি, তার বেশির ভাগ টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়’, এই নিয়ে মুসলিম লীগ সমর্থকদের সঙ্গে ঝগড়া করেছি। বাংলার সোনালি আঁশ পাট। স্কুলের পরীক্ষায় ইংরেজি ভাষায় ‘জুট’ রচনা লিখেছি। কিন্তু হাজি আদমজীর ছেলেদের উদ্যোগে তৈরি, দাউদ, বাওয়ানী অথবা খোদ আদমজী জুট মিলটাও কোনো দিন দেখিনি। তাই স্কটল্যান্ডের ড্যান্ডি শহরে বেড়াতে এসে ‘ভারডান্ট ওয়ার্কস’ মিউজিয়াম দেখার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। সুন্দর সাজানো-গোছানো মিউজিয়ামের ভেতর পাটকলে ব্যবহার করা সব যন্ত্রপাতি দেখলাম, আর গাইডের মুখে শুনলাম এক রূপকথার গল্প।
সোনালি আঁশের উত্থান
তিসির তেল আমরা বেশ চিনি। বাংলাদেশে তিসি ফলানো হয় মূলত তেলের জন্য। এ তেল কাঠের বার্নিশ উজ্জ্বল করে, আর ক্রিকেট ব্যাটের স্ট্রোক বাড়ায়। তবে মিসর ও জর্জিয়ায় তিসির চাষ করা করা হয় এ উদ্ভিদের ছাল থেকে সুতা তৈরির জন্য। তিসি গাছের ছাল পাটের মতো প্রক্রিয়াজাত করে যে সুতা বানানো হয়, তার ইংরেজি নাম ফ্ল্যাক্স। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ড্যান্ডি শহরে অনেকগুলো ফ্ল্যাক্স মিল ছিল। সেখানে এই সুতা দিয়ে মোটা ক্যানভাস ও লিনেন কাপড় তৈরি করা হতো। ড্যান্ডি শহরে ফ্ল্যাক্স আমদানি করা হতো কৃষ্ণ সাগর পারের ক্রিমিয়া ও জর্জিয়া অঞ্চল থেকে। রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে উনিশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে ফ্ল্যাক্সের উৎপাদন এবং সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
প্রায় একই সময় কলকাতা বন্দরে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকেরা ফ্ল্যাক্স আঁশের মতো দেখতে বাংলা পাটের প্রতি নজর দেয়। ১৮২০ সালে প্রথমবারের মতো আড়াই মন ওজনের একটি পাটের বেল ড্যান্ডি শহরে এসে পৌঁছায়।
কিন্তু পাটের আঁশ শক্ত। ফলে ফ্ল্যাক্সের বদলে পাট ব্যবহার করা গেল না। অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেল যে, তিমি মাছের তেলে পাট ভেজালে তা নরম হয়, যা ফ্ল্যাক্স মিলে ব্যবহার কর যায়। তায়ে (Tay) নদীর তীরে অবস্থিত ড্যান্ডি নৌবন্দর অনেক আগে থেকেই তিমি মাছ ধরা এবং বেচাকেনার বাজার হিসেবে বিখ্যাত ছিল। সেখানে তিমি মাছের তেল সস্তায় এবং প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। লাভ-ক্ষতির অঙ্ক করতে ব্যাপারীদের বেশি সময় লাগল না। ড্যান্ডি শহরে ডেভিড লিন্ডসে তাঁর ফ্ল্যাক্স মিল ‘ভারডান্ট ওয়ার্কস’-এর কিছু বিবর্তন করে ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন বিশ্বের প্রথম জুট মিল বা পাটকল।
শুরু হলো পাটের অগ্রযাত্রা। একে একে ড্যান্ডির ফ্ল্যাক্স মিলগুলো জুট মিলে পরিণত হতে থাকল। ড্যান্ডি ডকইয়ার্ডে তৈরি হতে থাকল বড় বড় জাহাজ। ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল খুলে গেলে এশিয়া আর ইউরোপের মধ্যে নৌপথের দূরত্ব কমে যায়। ফলে কাঁচা পাট কলকাতা বন্দর থেকে ৯০ দিনে ড্যান্ডি বন্দরে পৌঁছাতে থাকল। সোনায় সোহাগা। নতুন জুট মিল তৈরি হতে থাকল সেখানে। নেহাত বাংলা ঘরের ছনের চালে আটন-ছাটন আর রুয়া-ফুসসির বাঁধনে কাজে লাগা বাংলার পাট বিলেতি জুট মিলের সৌজন্যে হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলার এক পণ্য। আমাদের দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল, যার নাম হলো সোনালি আঁশ। আর নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দর বাংলার ড্যান্ডি নামে বিখ্যাত হলো।
বাংলার পাট, ড্যান্ডির নারী
পাট হাটের ফড়িয়া, দালাল, আর পাট গুদামের মালিকদের ব্যাংক ব্যালান্স এবং পেটের ভুঁড়ি দুটোই সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকল। কুষ্টিয়া রেল স্টেশনের পাশে ঠাকুর অ্যান্ড কোম্পানির গুদাম খুলে, ধুতি কাছা দিয়ে পাটের ব্যবসায় নেমে গেলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে, কবির নোবেল প্রাইজ পাওয়া জ্ঞানে কাজ হলো না। পাটের ব্যবসা লাটে উঠল। ধনী হলো ড্যান্ডির জুটমিল মালিকেরা। দিনে দিনে, মাসে মাসে সেখানে বাড়তে থাকল পাটকলের সংখ্যা। ১৯০৯ সালে ড্যান্ডি শহরে ছিল ১৩০টি পাটকল। ১৯০১ সালে ড্যান্ডি শহরের মোট ৮৬ হাজার শ্রমিকের অর্ধেক ছিল পাট শ্রমিক। এর পঁচাত্তর ভাগ ছিল নারী।
হাতে চালানো তাঁতের কাজ কষ্টসাধ্য হওয়ায় তাঁত বুননের কাজে প্রথম দিকে নারী শ্রমিক নেওয়া হতো না। কিন্তু বৈদ্যুতিক তাঁত চালু হলে নারীরা পাটকলে কাজ করার উপযুক্ত বিবেচিত হয়। অর্থনৈতিক প্রয়োজন, ঘরের বাঁধন ছিঁড়ে বাইরে যাওয়ার উৎসাহ আর কম বেতনে কাজ করতে রাজি হওয়া বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিক পাটকলে নিয়োগ পেতে থাকে।
ড্যান্ডিতে এক সময় ৪১ হাজার পাটকল শ্রমিকের মধ্যে ৩১ হাজার ছিল নারী। সে শহরে নারীদের কাজ আছে, নগদ টাকায় বেতন আছে, নারী শ্রমিকদের মধ্যে কমরেডশিপ আছে—কথাগুলো পুরো স্কটল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, আর স্বাধীনচেতা নারীরা দলে দলে ড্যান্ডি শহরে আসতে থাকল। ১৯১১ সালে সেখানে প্রতি ১০০ জন পুরুষের অনুপাতে নারীর সংখ্যা ছিল ১৫০ জন। সে সময় ড্যান্ডি শহরের মেয়েরা বিয়ের জন্য ঘরজামাই খুঁজত। ছেলে রান্নাবান্না পারে কি না, বাচ্চাকাচ্চা দেখাশোনা করতে পারবে কি না, জামা কাপড় ধোয়া, ইস্তিরি করার কাজ করতে পারে কি না, বিয়ের জন্য এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো ছেলেদের।
কেটল-বয়লার, জ্যামের শহর কিংবা শি টাউনের গল্প
এই শহরে শ্রমজীবী নারীরা বেকার পুরুষদের বিয়ে করে ঘরে রাখত, আর নিজেরা জুট মিলে কাজ করে টাকা উপার্জন করত। পুরুষেরা বাড়িতে বসে ঘর গৃহস্থালির অবসরে আশপাশের বাগান থেকে স্ট্রবেরি আর ব্ল্যাক কারেন্ট সংগ্রহ করে জ্যাম বানাত। সে সময় ড্যান্ডি ‘জ্যামের শহর’ বলেও প্রভূত খ্যাতি অর্জন করে। পাটের ফিরতি জাহাজে আসা ড্যান্ডির জ্যাম কলকাতার মধ্যবিত্তের ঘরে পৌঁছে যেত। এখন সে শহরে জ্যাম তৈরি হয় না। তবুও কলকাতার মধ্যবিত্ত ঘরে বিকেলের নাশতায় পাউরুটির টোস্ট, আর জ্যাম দিয়ে অতিথি আপ্যায়নের রেওয়াজ রয়ে গেছে।
এক কাপ চা দিয়ে অতিথি আপ্যায়নের রীতি ড্যান্ডি শহরেও ছিল। তবে চা বানানোর দায়িত্ব ছিল পুরুষদের। কেটলিতে পানি গরম করে চা বানাতে হতো। তাই ড্যান্ডির পুরুষদের নাম হয়ে যায় ‘কেটল-বয়লার’। স্কটল্যান্ডের অন্য শহরের মানুষ ড্যান্ডির নাম দেয় ‘শি টাউন’ বা ‘নারীদের শহর’। কিন্তু এ সমস্ত টিটকারি দেওয়া কথা ড্যান্ডির নারীদের একটুকুও বদলাতে পারেনি। তারা দিনে দশ ঘণ্টা কাজ করত। প্রয়োজন হলে রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল করত। রাতে সুন্দর কাপড় পরে দলে দলে শহরে ঘুরে বেড়াত, থিয়েটার দেখত, নাইট ক্লাবে নাচত, পানাহার করত, আনন্দ ফুর্তি করত। তাদের আনন্দ ফুর্তির মাত্রা একটু বেশি হলে পুলিশ বাধা দিত। দুপক্ষের মধ্যে লড়াই বেধে যেত। কোনো কোনো রাতে ড্যান্ডি শহরের কেন্দ্রস্থল কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতো। বিশ শতকের প্রথম দশকের কোনো এক বছর ড্যান্ডি শহরে শান্তি ভঙ্গের দায়ে হাজত খাটা ১ হাজার ৪০০ মানুষের মধ্যে ৮০০ জনই ছিল নারী।
উপমহাদেশের রক্ত শোষণ করে ধনী হওয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নারী বা পুরুষদের বাহবা দেওয়ার মানুষ আমি নই। তারপরও ড্যান্ডির নারীদের সাহসে বাহবা না দিয়ে পারি না।
শি টাউনের নারীদের শ্রমিক আন্দোলন
ড্যান্ডি শহরে শ্রমিক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল জুট মিলের নারী শ্রমিকেরা। তবে তারা কোনো দিন পুরুষ নিয়ন্ত্রিত শ্রমিক সংগঠনের নিয়ম মেনে চলত না। তারা শ্রমের ন্যায্য মূল্য আদায় করা, কারখানা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ধর্মঘট, মিটিং-মিছিল নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করত এবং মাঝেমধ্যে সফলতা লাভ করত।
‘সমান কাজের সমান মূল্য’ পুরুষ-নারীর সমান বেতন এবং বৃহত্তর সমাজে নারী-পুরুষের সমঅধিকার অর্জনের সংগ্রামে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েই ড্যান্ডি টাউন কাউন্সিল কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের দেখাশোনা করার জন্য ক্রেস ও নার্সারি প্রতিষ্ঠা করে এবং শুধুমাত্র নারীদের বসবাসের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করে।
ইংল্যান্ডে নারীদের ভোটের অধিকার অর্জনে ‘সাফরাজেট’ আন্দোলনে ড্যান্ডির নারী শ্রমিকেরা প্রভূত অবদান রাখে। তাদের কাজের দক্ষতা, অর্থনৈতিক শক্তি আর স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ শাসক শ্রেণি অবশেষে ১৯১৮ সালে প্রথমবারের মতো নারীদের ভোটের অধিকার দিতে বাধ্য হয়। ড্যান্ডির নারীরা ১৯২২ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোট দিয়ে তাদের নতুন অধিকারের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে। তারা এই ভোটে নারীদের ভোটাধিকার বিরোধী, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কট্টর সমর্থক এবং ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে পরাজিত করে।
বাংলার বস্ত্রবালিকারা
পাট ব্যবসায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো উন্নতি হয়নি। বাংলার নেংটি পরা কৃষকদের ভাগ্য খোলেনি। কিন্তু ড্যান্ডি শহরের মেয়েরা পাটকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদল করতে পেরেছিল। পুরো ব্রিটেনে, তথা পশ্চিম ইউরোপীয় মেয়েদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল।
ড্যান্ডির জুট মিউজিয়াম দেখছি, গাইডের কথা শুনছি, আর আমার কল্পনার চোখে ভেসে উঠছিল তাদেরই উত্তরসূরি পাটের দেশের মানুষ আমার স্বজাতি, অন্য এক তন্তু, তুলার কাপড় সেলাইয়ের কাজে নিয়োজিত ঢাকা শহরের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের চেহারা। কী জুটছে তাদের কপালে?
আমি যখন বাংলাদেশে যাই, তখন এয়ারপোর্ট থেকে ফরিদপুর যাওয়ার পথে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমি গাড়িতে বসে দেখি হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিক রাস্তার দুধারে সুশৃঙ্খলভাবে হেঁটে যাচ্ছে। রং-বেরঙের পোশাকে এরা সবাই দেখতে সুন্দর, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। এরা সবাই নারী। এরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এদের সংখ্যা ৩২ লাখ। এরা বছরে ৩ দশমিক ১ লাখ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। তবুও গার্মেন্টস শ্রমিক নারীদের অবস্থা এমন কেন? বেতন কম, কাজের নিরাপত্তা নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই। কেন?
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয় ছিল ৯৪ ডলার বা ৮ হাজার ৪০০ টাকা। বর্তমানে তা ২ হাজার ৮৮২ ডলার বা ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আমরা এখন পাকিস্তান ও ভারতকে ছাড়িয়ে গেছি এবং আরও ওপরে যাচ্ছি। কিন্তু যে শিলাখণ্ডের শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে আমরা আরও ওপরে উঠছি, গার্মেন্টস শিল্পের সেই নারী শ্রমিকদের আমরা কতটা মর্যাদা দিতে শিখেছি? আশা করি বাংলাদেশের পাট যেমন একদিন পশ্চিমা দেশগুলোর নারীমুক্তিতে কার্যকারী ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি আজকের দিনে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত নারীরা অদূর ভবিষ্যতে পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোতে নারীমুক্তির সূচনা করবে।
বাংলায় পাটকল ও ড্যান্ডির পতন
১৮৭০ সালে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা কলকাতার প্রথম পাটকল প্রতিষ্ঠা করে। তখন থেকে এ ব্যবসায় ড্যান্ডির একচেটিয়া আধিপত্য কমতে থাকে। বিশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যে কলকাতা পাটকলের শ্রমিক সংখ্যা ড্যান্ডিকে ছাড়িয়ে যায় এবং পরিবর্তনের গতিধারা অব্যাহত থাকে। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ব পাকিস্তানে নতুন নতুন এবং বড় বড় পাটকল প্রতিষ্ঠিত হলে ড্যান্ডির অবস্থা রাতারাতি বদলে যায়। ১৯৫০-এর দশকে সেখানে পাটকলের সংখ্যা পঞ্চাশের নিচে নেমে যায়।
১৯৯৮ সালের ১৯ অক্টোবর। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩১০ টন কাঁচা পাট নিয়ে এমভি বাংলার ঊর্মি যখন স্কটল্যান্ডের ড্যান্ডি বন্দরে পৌঁছায়, তখন সে শহরের মিলের সংখ্যা ছিল মাত্র একটি। এর পর ড্যান্ডি বন্দরে আর কোনো দিন পাটের জাহাজ নোঙর করেনি।
শেষ লটের পাটের শেষ কোস্টার কাজ ১৯৯৯ সালের মে মাসে শেষ হলে, তায়েব্যাংক পাওয়ার লুমসের মালিক সব মেশিনপত্র বিক্রি করে দেয় কলকাতা পাটকলের মালিক জি জে ওয়াদওহার কাছে। ১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে ফিরতি যাত্রায় বাংলার ঊর্মি ড্যান্ডির শেষ পাটকলের শেষ যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে কলকাতা বন্দরে পৌঁছে দেয়। এ যেন বাংলার ছেলে বাংলায় ফিরে আসা।
‘দ্যাট ওয়াজ দি এন্ড’, বলে আমার গাইডের চোখ ছলছল করে উঠল। একজন বয়স্ক পুরুষের চোখে জল দেখে আমিও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। নরম সুরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এই মিলে কাজ করেছ নাকি?’ একটু মৃদু হেসে তিনি জবাব দিলেন, ‘না, আমার মা করেছে। আমি কাজের বয়সী হওয়ার আগেই এই মিল বন্ধ হয়ে গেছে। মায়ের মুখে অনেক গল্প শুনেছি। আমার মা এখন বেঁচে নেই। মাকে সম্মান জানানোর জন্য আমি সপ্তাহে একদিন এই জুট মিউজিয়ামে ভলান্টিয়ার গাইড হিসেবে কাজ করি। বেতন পাই না। কিন্তু আনন্দ পাই।’
এবার আমার চোখ ছলছল করে উঠল। পেছনে পরের ব্যাচের দর্শক জমা হয়ে গেছে, কথা বাড়াতে পারলাম না। ‘ইউ আর ডুয়িং এ গ্রেট জব, কিপ ইট আপ’, বললাম। হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিলাম। সুভেনির শপে ঢুকতেই চোখে পড়ল একখানা বই ‘জুট নো মোর’। বইখানা কিনলাম।
লেখক: ডিরেক্টর, এশিয়ান রিসোর্স সেন্টার, বার্মিংহাম, ইংল্যান্ড

১৯২০-এর দশকের কোনো এক দিন। ড্যান্ডি শহরের কোনো এক জুট মিলের মালিক মাথায় সোলার হ্যাট পরে আমাদের ফরিদপুর শহরের পাটের বাজার দেখতে এসেছিলেন, দাদার মুখে সে গল্প শুনেছি।
সে ঘটনার প্রায় ১০২ বছর পর অবশেষে দেখলাম স্কটল্যান্ডের ড্যান্ডি শহরে বিশ্বের প্রথম জুটমিল। মিল ঠিক নয়, জুট মিউজিয়াম। পাট উৎপন্ন করত বাংলার কৃষক, আর সব পাটকল ছিল স্কটল্যান্ডে। সহজ বাংলা ভাষায় এরই নাম ছিল সাম্রাজ্যবাদ।
ভারডান্ট ওয়ার্কস মিউজিয়াম
‘গতস্য শোচনা নাস্তি’ অতি পুরোনো সংস্কৃত শ্লোক। তবুও বয়স্কা নর্তকী বারবার আয়না দেখে, বিগত যৌবনের সৌন্দর্য খোঁজে। আর বৃদ্ধ মানুষ চোখ বন্ধ করে বিগত যৌবনের সুখ চিন্তা করে। আমাদের এক কালের প্রভুদের অবস্থাও ঠিক তাই। এখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নেই, ড্যান্ডি শহরে জুট মিলও নেই। বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা জুট মিলকে মিউজিয়াম বানিয়ে স্কটিশেরা পুরোনো শৌর্য ও ঐশ্বর্য মনে রাখার চেষ্টা করছে।
১৯৫৪ সালে হক-ভাসানি মুসলিম লীগকে ডুবিয়ে দিয়ে যেদিন সরকার গঠনের শপথ নিচ্ছিল, ঠিক সেই দিন নারায়ণগঞ্জের পাটকলে বিহারি আর বাঙালি শ্রমিকদের মধ্য রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা বাঁধিয়ে মুসলিম লীগের গুন্ডারা গণপ্রতিনিধিত্বের সরকারকে খাটো করবার চেষ্টা করেছিল। সে কথা ইতিহাস বইতে পড়েছি। ‘আমরা পাট রপ্তানি করে যে পরিমাণ বিদেশি টাকা আয় করি, তার বেশির ভাগ টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়’, এই নিয়ে মুসলিম লীগ সমর্থকদের সঙ্গে ঝগড়া করেছি। বাংলার সোনালি আঁশ পাট। স্কুলের পরীক্ষায় ইংরেজি ভাষায় ‘জুট’ রচনা লিখেছি। কিন্তু হাজি আদমজীর ছেলেদের উদ্যোগে তৈরি, দাউদ, বাওয়ানী অথবা খোদ আদমজী জুট মিলটাও কোনো দিন দেখিনি। তাই স্কটল্যান্ডের ড্যান্ডি শহরে বেড়াতে এসে ‘ভারডান্ট ওয়ার্কস’ মিউজিয়াম দেখার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। সুন্দর সাজানো-গোছানো মিউজিয়ামের ভেতর পাটকলে ব্যবহার করা সব যন্ত্রপাতি দেখলাম, আর গাইডের মুখে শুনলাম এক রূপকথার গল্প।
সোনালি আঁশের উত্থান
তিসির তেল আমরা বেশ চিনি। বাংলাদেশে তিসি ফলানো হয় মূলত তেলের জন্য। এ তেল কাঠের বার্নিশ উজ্জ্বল করে, আর ক্রিকেট ব্যাটের স্ট্রোক বাড়ায়। তবে মিসর ও জর্জিয়ায় তিসির চাষ করা করা হয় এ উদ্ভিদের ছাল থেকে সুতা তৈরির জন্য। তিসি গাছের ছাল পাটের মতো প্রক্রিয়াজাত করে যে সুতা বানানো হয়, তার ইংরেজি নাম ফ্ল্যাক্স। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ড্যান্ডি শহরে অনেকগুলো ফ্ল্যাক্স মিল ছিল। সেখানে এই সুতা দিয়ে মোটা ক্যানভাস ও লিনেন কাপড় তৈরি করা হতো। ড্যান্ডি শহরে ফ্ল্যাক্স আমদানি করা হতো কৃষ্ণ সাগর পারের ক্রিমিয়া ও জর্জিয়া অঞ্চল থেকে। রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে উনিশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে ফ্ল্যাক্সের উৎপাদন এবং সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
প্রায় একই সময় কলকাতা বন্দরে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকেরা ফ্ল্যাক্স আঁশের মতো দেখতে বাংলা পাটের প্রতি নজর দেয়। ১৮২০ সালে প্রথমবারের মতো আড়াই মন ওজনের একটি পাটের বেল ড্যান্ডি শহরে এসে পৌঁছায়।
কিন্তু পাটের আঁশ শক্ত। ফলে ফ্ল্যাক্সের বদলে পাট ব্যবহার করা গেল না। অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেল যে, তিমি মাছের তেলে পাট ভেজালে তা নরম হয়, যা ফ্ল্যাক্স মিলে ব্যবহার কর যায়। তায়ে (Tay) নদীর তীরে অবস্থিত ড্যান্ডি নৌবন্দর অনেক আগে থেকেই তিমি মাছ ধরা এবং বেচাকেনার বাজার হিসেবে বিখ্যাত ছিল। সেখানে তিমি মাছের তেল সস্তায় এবং প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। লাভ-ক্ষতির অঙ্ক করতে ব্যাপারীদের বেশি সময় লাগল না। ড্যান্ডি শহরে ডেভিড লিন্ডসে তাঁর ফ্ল্যাক্স মিল ‘ভারডান্ট ওয়ার্কস’-এর কিছু বিবর্তন করে ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন বিশ্বের প্রথম জুট মিল বা পাটকল।
শুরু হলো পাটের অগ্রযাত্রা। একে একে ড্যান্ডির ফ্ল্যাক্স মিলগুলো জুট মিলে পরিণত হতে থাকল। ড্যান্ডি ডকইয়ার্ডে তৈরি হতে থাকল বড় বড় জাহাজ। ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল খুলে গেলে এশিয়া আর ইউরোপের মধ্যে নৌপথের দূরত্ব কমে যায়। ফলে কাঁচা পাট কলকাতা বন্দর থেকে ৯০ দিনে ড্যান্ডি বন্দরে পৌঁছাতে থাকল। সোনায় সোহাগা। নতুন জুট মিল তৈরি হতে থাকল সেখানে। নেহাত বাংলা ঘরের ছনের চালে আটন-ছাটন আর রুয়া-ফুসসির বাঁধনে কাজে লাগা বাংলার পাট বিলেতি জুট মিলের সৌজন্যে হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলার এক পণ্য। আমাদের দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল, যার নাম হলো সোনালি আঁশ। আর নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দর বাংলার ড্যান্ডি নামে বিখ্যাত হলো।
বাংলার পাট, ড্যান্ডির নারী
পাট হাটের ফড়িয়া, দালাল, আর পাট গুদামের মালিকদের ব্যাংক ব্যালান্স এবং পেটের ভুঁড়ি দুটোই সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকল। কুষ্টিয়া রেল স্টেশনের পাশে ঠাকুর অ্যান্ড কোম্পানির গুদাম খুলে, ধুতি কাছা দিয়ে পাটের ব্যবসায় নেমে গেলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে, কবির নোবেল প্রাইজ পাওয়া জ্ঞানে কাজ হলো না। পাটের ব্যবসা লাটে উঠল। ধনী হলো ড্যান্ডির জুটমিল মালিকেরা। দিনে দিনে, মাসে মাসে সেখানে বাড়তে থাকল পাটকলের সংখ্যা। ১৯০৯ সালে ড্যান্ডি শহরে ছিল ১৩০টি পাটকল। ১৯০১ সালে ড্যান্ডি শহরের মোট ৮৬ হাজার শ্রমিকের অর্ধেক ছিল পাট শ্রমিক। এর পঁচাত্তর ভাগ ছিল নারী।
হাতে চালানো তাঁতের কাজ কষ্টসাধ্য হওয়ায় তাঁত বুননের কাজে প্রথম দিকে নারী শ্রমিক নেওয়া হতো না। কিন্তু বৈদ্যুতিক তাঁত চালু হলে নারীরা পাটকলে কাজ করার উপযুক্ত বিবেচিত হয়। অর্থনৈতিক প্রয়োজন, ঘরের বাঁধন ছিঁড়ে বাইরে যাওয়ার উৎসাহ আর কম বেতনে কাজ করতে রাজি হওয়া বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিক পাটকলে নিয়োগ পেতে থাকে।
ড্যান্ডিতে এক সময় ৪১ হাজার পাটকল শ্রমিকের মধ্যে ৩১ হাজার ছিল নারী। সে শহরে নারীদের কাজ আছে, নগদ টাকায় বেতন আছে, নারী শ্রমিকদের মধ্যে কমরেডশিপ আছে—কথাগুলো পুরো স্কটল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, আর স্বাধীনচেতা নারীরা দলে দলে ড্যান্ডি শহরে আসতে থাকল। ১৯১১ সালে সেখানে প্রতি ১০০ জন পুরুষের অনুপাতে নারীর সংখ্যা ছিল ১৫০ জন। সে সময় ড্যান্ডি শহরের মেয়েরা বিয়ের জন্য ঘরজামাই খুঁজত। ছেলে রান্নাবান্না পারে কি না, বাচ্চাকাচ্চা দেখাশোনা করতে পারবে কি না, জামা কাপড় ধোয়া, ইস্তিরি করার কাজ করতে পারে কি না, বিয়ের জন্য এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো ছেলেদের।
কেটল-বয়লার, জ্যামের শহর কিংবা শি টাউনের গল্প
এই শহরে শ্রমজীবী নারীরা বেকার পুরুষদের বিয়ে করে ঘরে রাখত, আর নিজেরা জুট মিলে কাজ করে টাকা উপার্জন করত। পুরুষেরা বাড়িতে বসে ঘর গৃহস্থালির অবসরে আশপাশের বাগান থেকে স্ট্রবেরি আর ব্ল্যাক কারেন্ট সংগ্রহ করে জ্যাম বানাত। সে সময় ড্যান্ডি ‘জ্যামের শহর’ বলেও প্রভূত খ্যাতি অর্জন করে। পাটের ফিরতি জাহাজে আসা ড্যান্ডির জ্যাম কলকাতার মধ্যবিত্তের ঘরে পৌঁছে যেত। এখন সে শহরে জ্যাম তৈরি হয় না। তবুও কলকাতার মধ্যবিত্ত ঘরে বিকেলের নাশতায় পাউরুটির টোস্ট, আর জ্যাম দিয়ে অতিথি আপ্যায়নের রেওয়াজ রয়ে গেছে।
এক কাপ চা দিয়ে অতিথি আপ্যায়নের রীতি ড্যান্ডি শহরেও ছিল। তবে চা বানানোর দায়িত্ব ছিল পুরুষদের। কেটলিতে পানি গরম করে চা বানাতে হতো। তাই ড্যান্ডির পুরুষদের নাম হয়ে যায় ‘কেটল-বয়লার’। স্কটল্যান্ডের অন্য শহরের মানুষ ড্যান্ডির নাম দেয় ‘শি টাউন’ বা ‘নারীদের শহর’। কিন্তু এ সমস্ত টিটকারি দেওয়া কথা ড্যান্ডির নারীদের একটুকুও বদলাতে পারেনি। তারা দিনে দশ ঘণ্টা কাজ করত। প্রয়োজন হলে রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল করত। রাতে সুন্দর কাপড় পরে দলে দলে শহরে ঘুরে বেড়াত, থিয়েটার দেখত, নাইট ক্লাবে নাচত, পানাহার করত, আনন্দ ফুর্তি করত। তাদের আনন্দ ফুর্তির মাত্রা একটু বেশি হলে পুলিশ বাধা দিত। দুপক্ষের মধ্যে লড়াই বেধে যেত। কোনো কোনো রাতে ড্যান্ডি শহরের কেন্দ্রস্থল কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতো। বিশ শতকের প্রথম দশকের কোনো এক বছর ড্যান্ডি শহরে শান্তি ভঙ্গের দায়ে হাজত খাটা ১ হাজার ৪০০ মানুষের মধ্যে ৮০০ জনই ছিল নারী।
উপমহাদেশের রক্ত শোষণ করে ধনী হওয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নারী বা পুরুষদের বাহবা দেওয়ার মানুষ আমি নই। তারপরও ড্যান্ডির নারীদের সাহসে বাহবা না দিয়ে পারি না।
শি টাউনের নারীদের শ্রমিক আন্দোলন
ড্যান্ডি শহরে শ্রমিক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল জুট মিলের নারী শ্রমিকেরা। তবে তারা কোনো দিন পুরুষ নিয়ন্ত্রিত শ্রমিক সংগঠনের নিয়ম মেনে চলত না। তারা শ্রমের ন্যায্য মূল্য আদায় করা, কারখানা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ধর্মঘট, মিটিং-মিছিল নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করত এবং মাঝেমধ্যে সফলতা লাভ করত।
‘সমান কাজের সমান মূল্য’ পুরুষ-নারীর সমান বেতন এবং বৃহত্তর সমাজে নারী-পুরুষের সমঅধিকার অর্জনের সংগ্রামে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েই ড্যান্ডি টাউন কাউন্সিল কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের দেখাশোনা করার জন্য ক্রেস ও নার্সারি প্রতিষ্ঠা করে এবং শুধুমাত্র নারীদের বসবাসের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করে।
ইংল্যান্ডে নারীদের ভোটের অধিকার অর্জনে ‘সাফরাজেট’ আন্দোলনে ড্যান্ডির নারী শ্রমিকেরা প্রভূত অবদান রাখে। তাদের কাজের দক্ষতা, অর্থনৈতিক শক্তি আর স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ শাসক শ্রেণি অবশেষে ১৯১৮ সালে প্রথমবারের মতো নারীদের ভোটের অধিকার দিতে বাধ্য হয়। ড্যান্ডির নারীরা ১৯২২ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোট দিয়ে তাদের নতুন অধিকারের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে। তারা এই ভোটে নারীদের ভোটাধিকার বিরোধী, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কট্টর সমর্থক এবং ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে পরাজিত করে।
বাংলার বস্ত্রবালিকারা
পাট ব্যবসায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো উন্নতি হয়নি। বাংলার নেংটি পরা কৃষকদের ভাগ্য খোলেনি। কিন্তু ড্যান্ডি শহরের মেয়েরা পাটকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদল করতে পেরেছিল। পুরো ব্রিটেনে, তথা পশ্চিম ইউরোপীয় মেয়েদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল।
ড্যান্ডির জুট মিউজিয়াম দেখছি, গাইডের কথা শুনছি, আর আমার কল্পনার চোখে ভেসে উঠছিল তাদেরই উত্তরসূরি পাটের দেশের মানুষ আমার স্বজাতি, অন্য এক তন্তু, তুলার কাপড় সেলাইয়ের কাজে নিয়োজিত ঢাকা শহরের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের চেহারা। কী জুটছে তাদের কপালে?
আমি যখন বাংলাদেশে যাই, তখন এয়ারপোর্ট থেকে ফরিদপুর যাওয়ার পথে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমি গাড়িতে বসে দেখি হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিক রাস্তার দুধারে সুশৃঙ্খলভাবে হেঁটে যাচ্ছে। রং-বেরঙের পোশাকে এরা সবাই দেখতে সুন্দর, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। এরা সবাই নারী। এরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এদের সংখ্যা ৩২ লাখ। এরা বছরে ৩ দশমিক ১ লাখ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। তবুও গার্মেন্টস শ্রমিক নারীদের অবস্থা এমন কেন? বেতন কম, কাজের নিরাপত্তা নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই। কেন?
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয় ছিল ৯৪ ডলার বা ৮ হাজার ৪০০ টাকা। বর্তমানে তা ২ হাজার ৮৮২ ডলার বা ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আমরা এখন পাকিস্তান ও ভারতকে ছাড়িয়ে গেছি এবং আরও ওপরে যাচ্ছি। কিন্তু যে শিলাখণ্ডের শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে আমরা আরও ওপরে উঠছি, গার্মেন্টস শিল্পের সেই নারী শ্রমিকদের আমরা কতটা মর্যাদা দিতে শিখেছি? আশা করি বাংলাদেশের পাট যেমন একদিন পশ্চিমা দেশগুলোর নারীমুক্তিতে কার্যকারী ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি আজকের দিনে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত নারীরা অদূর ভবিষ্যতে পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোতে নারীমুক্তির সূচনা করবে।
বাংলায় পাটকল ও ড্যান্ডির পতন
১৮৭০ সালে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা কলকাতার প্রথম পাটকল প্রতিষ্ঠা করে। তখন থেকে এ ব্যবসায় ড্যান্ডির একচেটিয়া আধিপত্য কমতে থাকে। বিশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যে কলকাতা পাটকলের শ্রমিক সংখ্যা ড্যান্ডিকে ছাড়িয়ে যায় এবং পরিবর্তনের গতিধারা অব্যাহত থাকে। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ব পাকিস্তানে নতুন নতুন এবং বড় বড় পাটকল প্রতিষ্ঠিত হলে ড্যান্ডির অবস্থা রাতারাতি বদলে যায়। ১৯৫০-এর দশকে সেখানে পাটকলের সংখ্যা পঞ্চাশের নিচে নেমে যায়।
১৯৯৮ সালের ১৯ অক্টোবর। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩১০ টন কাঁচা পাট নিয়ে এমভি বাংলার ঊর্মি যখন স্কটল্যান্ডের ড্যান্ডি বন্দরে পৌঁছায়, তখন সে শহরের মিলের সংখ্যা ছিল মাত্র একটি। এর পর ড্যান্ডি বন্দরে আর কোনো দিন পাটের জাহাজ নোঙর করেনি।
শেষ লটের পাটের শেষ কোস্টার কাজ ১৯৯৯ সালের মে মাসে শেষ হলে, তায়েব্যাংক পাওয়ার লুমসের মালিক সব মেশিনপত্র বিক্রি করে দেয় কলকাতা পাটকলের মালিক জি জে ওয়াদওহার কাছে। ১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে ফিরতি যাত্রায় বাংলার ঊর্মি ড্যান্ডির শেষ পাটকলের শেষ যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে কলকাতা বন্দরে পৌঁছে দেয়। এ যেন বাংলার ছেলে বাংলায় ফিরে আসা।
‘দ্যাট ওয়াজ দি এন্ড’, বলে আমার গাইডের চোখ ছলছল করে উঠল। একজন বয়স্ক পুরুষের চোখে জল দেখে আমিও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। নরম সুরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এই মিলে কাজ করেছ নাকি?’ একটু মৃদু হেসে তিনি জবাব দিলেন, ‘না, আমার মা করেছে। আমি কাজের বয়সী হওয়ার আগেই এই মিল বন্ধ হয়ে গেছে। মায়ের মুখে অনেক গল্প শুনেছি। আমার মা এখন বেঁচে নেই। মাকে সম্মান জানানোর জন্য আমি সপ্তাহে একদিন এই জুট মিউজিয়ামে ভলান্টিয়ার গাইড হিসেবে কাজ করি। বেতন পাই না। কিন্তু আনন্দ পাই।’
এবার আমার চোখ ছলছল করে উঠল। পেছনে পরের ব্যাচের দর্শক জমা হয়ে গেছে, কথা বাড়াতে পারলাম না। ‘ইউ আর ডুয়িং এ গ্রেট জব, কিপ ইট আপ’, বললাম। হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিলাম। সুভেনির শপে ঢুকতেই চোখে পড়ল একখানা বই ‘জুট নো মোর’। বইখানা কিনলাম।
লেখক: ডিরেক্টর, এশিয়ান রিসোর্স সেন্টার, বার্মিংহাম, ইংল্যান্ড

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে।
২ দিন আগে
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই।
৩ দিন আগে
১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায়...
৪ দিন আগে
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
৭ দিন আগেসম্পাদকীয়

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে। শহীদদের সংখ্যাটা প্রায় ১০ হাজার! রহনপুর সরকারি এ বি উচ্চবিদ্যালয়ে ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। এখানেও শত শত মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। বধ্যভূমির যে স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেখানেই শহীদদের সম্মানে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এই বধ্যভূমিটি রহনপুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর নামে পরিচিত।
ছবি: সংগৃহীত

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে। শহীদদের সংখ্যাটা প্রায় ১০ হাজার! রহনপুর সরকারি এ বি উচ্চবিদ্যালয়ে ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। এখানেও শত শত মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। বধ্যভূমির যে স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেখানেই শহীদদের সম্মানে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এই বধ্যভূমিটি রহনপুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর নামে পরিচিত।
ছবি: সংগৃহীত

ডান্ডি শহরে ডেভিড লিন্ডসে তাঁর ফ্ল্যাক্স মিল ‘ভারডান্ট ওয়ার্কস’এর কিছু বিবর্তন করে ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন বিশ্বের প্রথম জুট মিল বা পাটকল।
২১ জুন ২০২২
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই।
৩ দিন আগে
১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায়...
৪ দিন আগে
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
৭ দিন আগেসম্পাদকীয়

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই। তাঁর সাক্ষাৎকারে এমন কিছু প্রসঙ্গে আলাপ করেছি, যা হয়তো অত স্বচ্ছন্দে হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে করতে পারতাম না। যেমন ধরেন যৌনতা-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো। তবে আড্ডাবাজ ব্যক্তিত্বের জন্যও তাঁর সাক্ষাৎকারটি হয়েছে অনেক প্রাণবন্ত। তাঁকে তো বাম ঘরানার লেখকই ধরা হয়, মার্ক্সবাদে তাঁর বিশ্বাস ছিল। তবে তিনি কিন্তু গোঁড়া মার্ক্সবাদী ছিলেন না।
আমি এ ব্যাপারটিও তাঁর সঙ্গে খোলাসা করার জন্য আলাপ করেছি। সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজমের নামে একসময় একধরনের যান্ত্রিক মার্ক্সবাদ চর্চা হয়েছে সাহিত্যে। তিনি এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি এ সাক্ষাৎকারেই বলেছেন, এ দেশের মার্ক্সবাদীদের অনেক জ্ঞান থাকলেও কাণ্ডজ্ঞান নেই। তিনি তাঁর লেখায় জীবনকে একেবারে ভেতর থেকে ধরার চেষ্টা করেছেন। অহেতুক শ্রমিকশ্রেণির জয়গান গাননি, লাল পতাকা ওঠাননি। আমার সাক্ষাৎকারে সেক্সের সঙ্গে ক্লাস পজিশনের সম্পর্ক নিয়ে কথা আছে। তিনি এও বলছেন, তাঁর চিলেকোঠার সেপাইয়ের রিকশাশ্রমিক হাড্ডি খিজির যে চরিত্র, তাকে তিনি মহান করে দেখাননি, শুধু শ্রমিকশ্রেণির বিজয়গাথা তিনি দেখাননি।
বরং হাড্ডি খিজির যে একটি লুম্পেন চরিত্র, তার ভেতর যে নানা জোচ্চুরি আছে, সেটাকেও দেখিয়েছেন। এই যে মানুষকে টোটালিটিতে দেখতে এবং দেখাতে পারা, এটাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শক্তি।
তো এগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা হতো তাঁর সঙ্গে, সেটাকেই আমি সাক্ষাৎকারে ধরতে চেষ্টা করেছি।
সূত্র: মঞ্জুরুল আজিম পলাশ কর্তৃক কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ‘দূরগামী কথার ভেতর’, পৃষ্ঠা: ২৭-২৮।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই। তাঁর সাক্ষাৎকারে এমন কিছু প্রসঙ্গে আলাপ করেছি, যা হয়তো অত স্বচ্ছন্দে হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে করতে পারতাম না। যেমন ধরেন যৌনতা-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো। তবে আড্ডাবাজ ব্যক্তিত্বের জন্যও তাঁর সাক্ষাৎকারটি হয়েছে অনেক প্রাণবন্ত। তাঁকে তো বাম ঘরানার লেখকই ধরা হয়, মার্ক্সবাদে তাঁর বিশ্বাস ছিল। তবে তিনি কিন্তু গোঁড়া মার্ক্সবাদী ছিলেন না।
আমি এ ব্যাপারটিও তাঁর সঙ্গে খোলাসা করার জন্য আলাপ করেছি। সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজমের নামে একসময় একধরনের যান্ত্রিক মার্ক্সবাদ চর্চা হয়েছে সাহিত্যে। তিনি এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি এ সাক্ষাৎকারেই বলেছেন, এ দেশের মার্ক্সবাদীদের অনেক জ্ঞান থাকলেও কাণ্ডজ্ঞান নেই। তিনি তাঁর লেখায় জীবনকে একেবারে ভেতর থেকে ধরার চেষ্টা করেছেন। অহেতুক শ্রমিকশ্রেণির জয়গান গাননি, লাল পতাকা ওঠাননি। আমার সাক্ষাৎকারে সেক্সের সঙ্গে ক্লাস পজিশনের সম্পর্ক নিয়ে কথা আছে। তিনি এও বলছেন, তাঁর চিলেকোঠার সেপাইয়ের রিকশাশ্রমিক হাড্ডি খিজির যে চরিত্র, তাকে তিনি মহান করে দেখাননি, শুধু শ্রমিকশ্রেণির বিজয়গাথা তিনি দেখাননি।
বরং হাড্ডি খিজির যে একটি লুম্পেন চরিত্র, তার ভেতর যে নানা জোচ্চুরি আছে, সেটাকেও দেখিয়েছেন। এই যে মানুষকে টোটালিটিতে দেখতে এবং দেখাতে পারা, এটাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শক্তি।
তো এগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা হতো তাঁর সঙ্গে, সেটাকেই আমি সাক্ষাৎকারে ধরতে চেষ্টা করেছি।
সূত্র: মঞ্জুরুল আজিম পলাশ কর্তৃক কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ‘দূরগামী কথার ভেতর’, পৃষ্ঠা: ২৭-২৮।

ডান্ডি শহরে ডেভিড লিন্ডসে তাঁর ফ্ল্যাক্স মিল ‘ভারডান্ট ওয়ার্কস’এর কিছু বিবর্তন করে ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন বিশ্বের প্রথম জুট মিল বা পাটকল।
২১ জুন ২০২২
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে।
২ দিন আগে
১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায়...
৪ দিন আগে
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
৭ দিন আগেসম্পাদকীয়

১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায় শিয়ালবাড়ি এলাকায়। মিরপুরের প্রশিকা ভবন থেকে কমার্স কলেজের দিকে যেতে একটি কালভার্ট ছিল। এখন যদিও রাস্তার মাঝে ঢাকা পড়েছে। সেখানেই ৬০টি বস্তায় প্রায় ৩৫০টি মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল। সৈয়দ আলী জামে মসজিদের পাশের কুয়ায় পাওয়া গিয়েছিল অসংখ্য লাশ। ৬ নম্বর লেনের শেষ প্রান্তের মাঠে স্তূপাকারে পড়ে থাকা দুই শতাধিক লাশ শিয়ালবাড়ি গণকবরে কবর দেওয়া হয়। এটি ছিল ১০ কাঠা জমির ওপর। বেশির ভাগই দখল হয়ে গেছে। যেটুকু অংশ বাকি আছে, তা বর্তমানে মাতবরবাড়ি পারিবারিক কবরস্থান। শিয়ালবাড়ির যেসব কুয়ায় শহীদদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে এখন বহুতল ভবন, কারখানা, শপিং মল।
তথ্য ও ছবি: মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি, মিরাজ মিজু

১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায় শিয়ালবাড়ি এলাকায়। মিরপুরের প্রশিকা ভবন থেকে কমার্স কলেজের দিকে যেতে একটি কালভার্ট ছিল। এখন যদিও রাস্তার মাঝে ঢাকা পড়েছে। সেখানেই ৬০টি বস্তায় প্রায় ৩৫০টি মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল। সৈয়দ আলী জামে মসজিদের পাশের কুয়ায় পাওয়া গিয়েছিল অসংখ্য লাশ। ৬ নম্বর লেনের শেষ প্রান্তের মাঠে স্তূপাকারে পড়ে থাকা দুই শতাধিক লাশ শিয়ালবাড়ি গণকবরে কবর দেওয়া হয়। এটি ছিল ১০ কাঠা জমির ওপর। বেশির ভাগই দখল হয়ে গেছে। যেটুকু অংশ বাকি আছে, তা বর্তমানে মাতবরবাড়ি পারিবারিক কবরস্থান। শিয়ালবাড়ির যেসব কুয়ায় শহীদদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে এখন বহুতল ভবন, কারখানা, শপিং মল।
তথ্য ও ছবি: মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি, মিরাজ মিজু

ডান্ডি শহরে ডেভিড লিন্ডসে তাঁর ফ্ল্যাক্স মিল ‘ভারডান্ট ওয়ার্কস’এর কিছু বিবর্তন করে ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন বিশ্বের প্রথম জুট মিল বা পাটকল।
২১ জুন ২০২২
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে।
২ দিন আগে
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই।
৩ দিন আগে
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

ডান্ডি শহরে ডেভিড লিন্ডসে তাঁর ফ্ল্যাক্স মিল ‘ভারডান্ট ওয়ার্কস’এর কিছু বিবর্তন করে ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন বিশ্বের প্রথম জুট মিল বা পাটকল।
২১ জুন ২০২২
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে।
২ দিন আগে
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই।
৩ দিন আগে
১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায়...
৪ দিন আগে