Ajker Patrika

ছোট ভয় ,বড় ভয়

ছোট ভয় ,বড় ভয়

একেবারে ছোটবেলায় আমি নাকি খুব জেদি ছিলাম। কারও কাছে ভালো কিছু দেখলে সেটাই আমি চাইতাম। যেমন কারও মাথায় বড় চুল দেখলে আমি ওই রকম চুল চাইতাম। আবার বড় চুল থাকত কেবল মেয়েদের মাথায়। আমাকে নাকি শাসিয়ে বলা হতো, তুই কি মেয়ে নাকি যে, তোর মাথায় বড় চুল হবে!

বড় চুলের জন্য ছোটবেলার আদিখ্যেতার জন্যই বুঝি আজ বড়বেলায় আমার মাথায় চুলের এমন বাড়বাড়ন্ত অবস্থা!

যার যা আছে, তাই নিয়ে খুশি থাকতে হয়, আনন্দে থাকতে হয়। আমার স্বভাব নাকি ছিল তার বিপরীত। যা নেই, তার জন্যই আমরা বায়না হতো প্রবল। একেবারে যখন ছোট ছিলাম, তখন নাকি আমাদের সংসারে খুব একটা টানাটানি ছিল না। অভাবের হা-মুখ দৈত্য দাপিয়ে বেড়াত না। ফলে যা চাইতাম, তা দেওয়ার চেষ্টা করা হতো বড়দের পক্ষ থেকে। প্রশ্রয়টা পেয়েছি প্রধানত মেয়েদের কাছ থেকে। মেয়ে মানে আমার ঠাকুরমা (বাবার মা), দিদিমা (মায়ের মা) এবং আমার মার কাছ থেকে। পুরুষদের তুলনায় আমাদের পরিবারে নারীর সংখ্যা বেশি ছিল। পুরুষ বলতে শুধু আমার বাবা। নিজের বাবাকে খুব কম বয়সে হারিয়ে আমার বাবাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল, যখন আসলে তাঁর স্কুলে যাওয়ার বয়স।

আমাকে নিয়ে বড়রা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতেন। কখন কার কাছে কী দেখে সেটা পাওয়ার জন্য আমি বায়না ধরে বসি, সেটাই ছিল ভয়ের কারণ। ভয় কি সংক্রামক? আমার ছোটবেলায় বড়রা আমাকে নিয়ে যে ভয় পেতেন, তাই কি আমার মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে? না হলে আমার এত ভয় কেন? কত মানুষকে দেখি নির্ভয়ে চলতে; কিন্তু আমাকে সারাক্ষণ তাড়া করে ভয়! আচ্ছা, আমার যা নেই বা ছিল না, তা-ই নিয়ে যদি আমি বায়না ধরে থাকি, তাহলে আমার যে সাহসের অভাব, তা আমাকে দেওয়ার জন্য কি আমি কখনো জেদ করিনি, বায়না ধরিনি। আহা, সাহসের জন্য যদি একটু জেদ ধরতাম, তাহলে কি আমাকে আজ এভাবে ভয়ে ভয়ে জীবন কাটাতে হয়?

ছোটবেলায় কারও হাতের আঙুলে আংটি দেখে আমারও আংটির শখ হয়েছিল। না, তখন অবশ্যই আংটি বদলের বিষয়টি মাথায় আসার বয়স নয়। আমার আংটি ছিল না বলেই সেটা পাওয়ার সাধ জেগেছিল। আঙুলে একটি আংটি জুটেওছিল। আবার আংটিটি কীভাবে যেন একদিন হারিয়েও গেল। আংটি হারিয়ে আমি তো ভয়ে কাঠ। আমার পিঠে যে চেলাকাঠের দৌড় প্রতিযোগিতা হবে, সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। তবে আমি আংটি হারানোর কথা কাউকে নিজে থেকে বললাম না। ফলে কেউ বুঝতেও পারল না। যখন জানাজানি হলো, তত দিনে পরিস্থিতি বদলে গেছে। এর মধ্যেই এক রাতে সিঁধেল চোর আমাদের ঘরে ঢুকে অনেক কিছুই নিয়ে গেছে। আমি হাপুস নয়নে কেঁদে আমার আংটি চুরির গল্প বিশ্বাসযোগ্য করে তুললাম এবং আংটি হারানোর পিটুনি থেকে কেমন বেকসুর খালাস পেয়ে গেলাম। ভয় তাড়ানোর এই বুদ্ধি কীভাবে মাথায় এসেছিল, এখন আর তা মনে নেই।

ছোটবেলায় মেয়েদের কাছে বেশি বায়না ধরলেও মেয়েদের আমার সব সময় কেমন যেন ভয় ভয় লাগত। কারণ বড়দের মুখে আলোচনা শুনতাম, নারীদের সম্মান না করলে নাকি সম্মান পাওয়া যায় না। সম্মান জিনিসটা আসলে কী, তা তো আর ওই বয়সে বুঝতাম না। তখন আমি মনে করতাম, কাউকে সম্মান করা মানে তাকে ভয় করা বা ভয় পাওয়া। তাই পারতপক্ষে ছোটবেলায় আমি নারী-সঙ্গ এড়িয়ে চলতাম। অবশ্য মা, ঠাকুমা, দিদিমা এবং পরে কাকিমাকে আমি ভয় করিনি। তাঁরা আমার কাছে নারী ছিলেন না, আমার কাছে তখন নারী মানে পরনারী এবং সর্বদা যাদের ভয় পেতে হবে!

আমি যখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন আমার এক পিসতুত দাদার বিয়ে হলো। এল আমার অতি সুন্দরী গীতা বৌদি। গীতা বৌদিকে আমি কেন যেন ভয় পেতাম না। তিনিও আমাকে খুব আদর করতেন। কোলে নিয়ে গালটাল টিপে দিতেন। শরীর এমন চিপাচিপি করতেন যে, আমি কেমন যেন তাঁর এই আদরের জন্য অপেক্ষা করতাম। গীতা বৌদি আমাকে দলেমলে একাকার করতেন আর বলতেন, ‘মেয়েরা তোকে খুব ভালোবাসবে। দেখবি মেয়েরা তোর জন্য পাগল হয়ে যাবে।’

শুনে লজ্জা পেতাম আবার ভালোও লাগত। ওই বয়সেই কেমন যেন একটি সুখানুভূতি হতো বলে এখনো মনে পড়ে।

বয়স বাড়ে। কোনো মেয়ে আমাকে ভালোবাসে না। কেউ কেউ বরং আমাকে দেখে হাসাহাসি করত আর বলত, তুই কি মেয়ে নাকি রে! আমাকে দেখতে নাকি তখন মেয়ে মেয়ে লাগত! এতে আমার মেয়ে-ভীতি আরও বেড়ে গেল। ছোট ক্লাসে থাকতেই একদিন এক মেয়ে বর-বউ খেলার প্রস্তাব দেওয়ায় আমি নাকি দৌড়ে পালিয়েছিলাম। তবে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম, তখন একদিন গীতা বৌদি আমাকে বললেন, ‘এবার একটি মেয়েকে পছন্দ করে ভালোবাসার কথা বল।’
-যদি রাজি না হয়?
-আর একজনকে বলবি! 
-সে রাজি না হলে?
-আরেকজন খুঁজে বের করবি। আর এর মধ্যে তোকে যদি কেউ নিজে থেকে ভালোবাসার কথা বলে, তবে তো হয়েই গেল!

আমি দেখেশুনে একটি মেয়েকে মোটামুটি পছন্দ করলাম। শ্যামলা বরণ। চোখ দুটি মায়াভরা। ওমর আলীর কবিতার মতো, ‘এ দেশের শ্যামলিমা শ্যামল রং রমণীর অনেক সুনাম শুনেছি!’ হাঁটু পর্যন্ত চুল। ওকে দেখেই আমার মনে গুনগুনিয়ে উঠত, ‘তোমার কাজলকেশ ছড়ানো বলে এই রাত মধুর এমন।’ মনে মনে ভাবি, একদিন বলে ফেলব, ‘আই লাভ ইউ।’

মেয়েটির পিছু নেই। কিন্তু সে যখন আমার দিকে তাকায়, তখনই আমার পা কাঁপা শুরু হয়। উল্টো পথ ধরি আমি। একদিন ওর পিছু নিলাম। ভাবছি, একটু একা পেলেই বলব, ‘কুন্তল বন্যা, কে দিল, তোমায় বলো কন্যা!’

আমাকে অনুসরণ করতে দেখে মেয়েটা হাঁটার গতি শ্লথ করল। তারপর আমার দিকে গ্রীবা ঘুরিয়ে বলল, ‘কিছু বলবেন?’
-আমি চটপট জবাব দিই, ‘আমি? আপনাকে? না-তো।’

মেয়েটি আমার দিকে কেমন একটা ঘৃণার চোখে তাকাল। তারপর যেন আপন মনেই বলল, ‘কাওয়ার্ড কোথাকার!’

আমার মনে হলো কেউ যেন আমার কানে গরম সিসা ঢেলে দিল। কয়েক দিন খুব মনমরা থাকলাম। মনে হলো, একবার বাড়ি গিয়ে গীতা বৌদিকে দেখে আসি। তাঁকে জানিয়ে আসি, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক হলো না। আমি কাউকে ‘আই লাভ ইউ’ বলতে পারলাম না। আমাকেও কেউ বলল না।

এক ছুটিতে বাড়ি গিয়ে শুনলাম সেই ভয়াবহ দুঃসংবাদ: গীতা বৌদি আত্মহত্যা করেছেন। আচ্ছা, গীতা বৌদি আত্মহত্যা করেছিলেন কেন? তাঁর কি বিশেষ কোনো দুঃখবোধ ছিল? দুঃখী মানুষেরা কি আত্মহত্যা করে? নাকি ভীরুতা আত্মহত্যার নিয়ামক? তার পর থেকে আমার আত্মহত্যায়ও দারুণ ভয়। ভয়কে জয় করার কোনো ওষুধ আবিষ্কারের কথা কি কেউ কখনো ভেবেছেন?

তার পর কত বছর চলে গেছে। আমার সংসার জীবনেরও তিন দশকের বেশি হয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে কী মনে করে যেন গিন্নিকে কাছে ডেকে বললাম, ‘আই লাভ ইউ।’ মুখ ঝামটা দিয়ে গিন্নি বললেন, ‘ভীমরতি ধরেছে! ছেলেমেয়েরা শুনলে কী ভাববে?’

ভয় তাড়াতে গিয়ে নতুন ভয়ের শিকার হলাম। ছোটবেলার ছোট ভয়, বড় বেলায় বড় ভয় হয়ে উঠেছে।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোচির ইহুদি পরিবারের ঐতিহ্য যেভাবে বাঁচিয়ে রাখছেন এক মুসলিম

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
কোচির ইহুদি পাড়ায় সারা আন্টির রেখে যাওয়া দোকানের সামনে ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
কোচির ইহুদি পাড়ায় সারা আন্টির রেখে যাওয়া দোকানের সামনে ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।

এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।

ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’

আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।

থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’

এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’

কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।

এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

ইব্রাহিম থাহার সারা আন্টি তাঁর পরিণত বয়সে। ছবি: ইব্রাহিম থাহার সৌজন্যে
ইব্রাহিম থাহার সারা আন্টি তাঁর পরিণত বয়সে। ছবি: ইব্রাহিম থাহার সৌজন্যে

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।

আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।

থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।

ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’

উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’

এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

সারা আন্টির দোকানে কিপ্পা সেলাই করছেন ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
সারা আন্টির দোকানে কিপ্পা সেলাই করছেন ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’

ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।

থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’

সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’

তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’

থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’

বিবিসি থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গাবতলী সেতু বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
গাবতলী সেতু বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সাহিত্যচর্চা এবং মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট

সম্পাদকীয়
সাহিত্যচর্চা এবং মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।

অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।

তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।

কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।

সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।

পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত