দায়িত্ব নিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দিয়েছিল চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ তারা বাতিল করবে। ঘোষণা অনুযায়ী তিন দিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ অন্তত ১২ জন সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে পুরোনো পথেই হাঁটল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার। তারাও শুরু করেছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। এরই মধ্যে আগের আমলে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া ও পদোন্নতিবঞ্চিত ছয়জন কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব পদে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে বলছেন, অতীতের সরকারগুলোর পথেই হাঁটছে এ সরকারও। প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধই করা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গতকাল বৃহস্পতিবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, অতীতের সরকারগুলোর সময় চুক্তি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল, এখন তা অব্যাহত থাকুক, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
৫ আগস্টের আগপর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের শেষ সময়ে প্রশাসনের দুই শীর্ষ পদসহ অন্তত ২৪টি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ছিলেন অবসরে যাওয়া সাবেক আমলারা। এ নিয়ে প্রশাসনে একধরনের অস্বস্তি ছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ৭৪ জন কর্মকর্তার মধ্যে প্রশাসনের শীর্ষ পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ১৩ জনই চুক্তিতে কর্মরত। চুক্তিতে নিয়োগ পেলেন যাঁরা
এই সরকার দায়িত্ব নিয়েই উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক দিনেই ১১ জন সচিবের চুক্তি বাতিল করা হয়। পরে আরও কয়েকটি পদের চুক্তি বাতিল করে সরকার। এরপর ৬ জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় প্রশাসনে। তাঁরা সবাই বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের কর্মকর্তা। এর মধ্যে ওই ব্যাচের মেধাতালিকায় প্রথম হওয়া ড. শেখ আবদুর রশিদকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নিয়েই মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকে ওএসডি করে। ওএসডি অবস্থায় ২০১৬ সালে অবসরে যান তিনি।
১৯৮২ ব্যাচের অপর কর্মকর্তা ড. আব্দুল মোমেন। ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি প্রায় একই কায়দায় তাঁকেও ওএসডি করা হয়। তিনি অবসরে যান ২০১৩ সালে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৭ আগস্ট তাঁকে চুক্তিতে ২ বছরের জন্য জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব করা হয়।
রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জন বিভাগের সিনিয়র সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন ড. নাসিমুল গনি। আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নিয়েই ২০০৯ সালে শুরুতে ওএসডি করে তাঁকে। এর আগে তিনি বিটিভির মহাপরিচালক ও রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব ছিলেন। ২০১৩ সালের ২৮ মে ওএসডি অবস্থায় অবসরে যান তিনি।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সিনিয়র সচিব পদে চুক্তিতে আছেন ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের কর্মকর্তা এম এ আকমল হোসেন আজাদ। এর আগে ১৭ আগস্ট তাঁকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব থাকাকালে তিনি ওএসডি হন ২০০৯ সালে। এরপর ২০১৩ সালে ওএসডি অবস্থায় চাকরি থেকে অবসরে যান।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব পদে চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন মো. এহছানুল হক। তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক ছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনের দুই বছর তিনি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও বিআরটিএর চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ওএসডি থাকা অবস্থায় অবসরে যান তিনি।
গত বুধবার বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের কর্মকর্তা মো. মোখলেস-উর-রহমানকে দুই বছরের জন্য চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের পুরো সময় তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব, সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও পিএসসির সচিব পদে কর্মরত ছিলেন। ২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি অবসরে যান।
এ ছাড়া ইউনূস সেন্টারের কর্মকর্তা লামিয়া মোরশেদকে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় এসডিজির মুখ্য সমন্বয়ক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চুক্তিতে। পাশাপাশি সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক মো. মাহফুজ আলমকে সচিব পদমর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া শেখ হাসিনা সরকারের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ আরও চারজন কর্মকর্তা এখনো বহাল রয়েছেন।
যা বললেন বিশেষজ্ঞরা
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রশাসনবিষয়ক একাধিক বইয়ের লেখক মো. ফিরোজ মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটি কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, তা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। চুক্তি ছাড়া বর্তমান সরকারের কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে গতিশীল করতে হলে অতীতের বঞ্চিত ও বর্তমান প্রশাসনে যাঁদের নিয়ে দলীয় বিতর্ক নেই—এমন কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের দায়িত্ব দিতে হবে। পরে ধীরে ধীরে তা নিয়মের মধ্য আসবে।’
তবে টিআইবির ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, প্রশাসনের উৎকর্ষসাধনের বাধাগুলোর অন্যতম চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে চুক্তির নিয়োগ বাতিলের ঘোষণা দেওয়ায় একধরনের স্বস্তি এসেছিল। তবে বাস্তবতার নিরিখে হয়তো সরকার তাদের ঘোষণা থেকে সাময়িকভাবে সরে এসেছে। সেটার পেছনে নিশ্চয়ই তাদের যুক্তিও আছে। আমরা এটাকে সাময়িক বিষয় হিসেবেই দেখতে চাই। এটা যেন প্রবণতা বা ট্রেন্ড হয়ে না দাঁড়ায়। এটি যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না নেয়।’
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে