Ajker Patrika

তিউনিসীয় কর্তৃত্ববাদ ও আমার কারাবন্দী বাবা

কাউথার ফারজানি
তিউনিসীয় কর্তৃত্ববাদ ও আমার কারাবন্দী বাবা

আগে যখন বাবা দিবস কাছে আসত, তখন আমি প্রায়ই বাবাকে জ্বালাতাম। বলতাম, প্রতিটি দিনই বাবা দিবস। বাবা আমার কথা শুনে হাসতেন। বাবা দিবসে আমরা একে অপরকে ফোন করতাম, আড্ডা দিতাম এবং আমি তাঁকে বলতাম—আমি গর্বিত যে তিনি আমার বাবা।

এবারের বাবা দিবসে এসবের কিছুই হয়নি। কোনো হাসাহাসি হয়নি, কেউ কাউকে কোনো বার্তা পাঠাইনি। বাবা দিবসে আমি ও ভাইবোনেরা এই প্রার্থনা করেছি যে আমাদের বাবা যেন নিরাপদে ও সুস্থভাবে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন।

বাবা সাইদ ফারজানিকে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তিউনিসিয়ায় আটক করা হয়। তিনি বিরোধী এন্নাহদা পার্টির একজন সদস্য এবং সেই ১০ জন বিশিষ্ট বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে একজন, যাঁরা ভিন্ন মত অবলম্বনের জন্য প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদের সর্বশেষ দমনপীড়নের শিকার হয়ে আটক হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি এবং কোনো কিছুর জন্য তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্তও করা হয়নি। আমাদের সন্দেহ, তাঁর প্রকৃত অপরাধ—তিনি নিজের দেশকে খুব বেশি ভালোবাসেন এবং সেখানে কর্তৃত্ববাদের ফিরে আসার বিরোধিতা করছেন।

বাবাকে গ্রেপ্তারের প্রায় চার মাস হয়ে গেছে। আমরা এখনো তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। আমরা জানি যে বাবা এখন কারাগারের একটি কক্ষে ১২০ জন বন্দীর সঙ্গে জঘন্য অবস্থায় রয়েছেন। এসব বন্দীর মধ্যে কিছু নৃশংস অপরাধী রয়েছে, যারা কিনা প্রায়ই অন্যদের ওপর হামলা করে।

বাবাকে যখন প্রথম কারারুদ্ধ করা হয়, তখন তিনি অনশন শুরু করেন। তাঁর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তাঁকে অনশন ভেঙে ফেলতে হয়। কারাগারে ফেরত পাঠানোর পর, সেলের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ এবং অন্য বন্দীদের অবিরত ধূমপানের কারণে তাঁর ব্রঙ্কাইটিস হয়ে যায়। তাঁকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তারপর একটি ইনহেলার দিয়ে তাঁকে কারাগারে ফেরত পাঠানো হয়। এই ইনহেলার আগে কখনো তাঁর দরকার পড়েনি। এটা সত্যিই আমাদের উদ্বিগ্ন করেছিল। গত চার মাসের দুঃস্বপ্ন ৩০ বছরের বেশি আগের সময়ের এই স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে।

বাবা যখন প্রথম কারারুদ্ধ হন, তখন আমার বয়স তিন বছর। এটি ছিল ১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাস। তিউনিসিয়ার তৎকালীন স্বৈরশাসক জাইন এল আবিদিন বেন আলি তখন সবেমাত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তিনি বিরোধী এন্নাহদা পার্টি এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর ওপর দমনপীড়নের নির্দেশ দেন। বেন আলির ভয় ছিল, এন্নাহদার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা তাঁর প্রেসিডেন্সির ক্ষতির কারণ হতে পারে।

মাঝরাতে ওরা বাবাকে ধরতে এসেছিল। এক ডজন সশস্ত্র পুলিশের সদর দরজা দিয়ে জোর করে ঢোকার শব্দে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলাম। তারা মাকে মেঝেতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, বাবাকে হাতকড়া পরায় এবং তারপর বাড়ি লুটপাট করে।

আমি নীরবে বাবার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করতে হাসার চেষ্টা করেছিলেন। আমি মনে করতে পারি না যে এটি কতক্ষণ স্থায়ী হয়েছিল। তবে মনে আছে, আমার সাত বছর বয়সী বড় ভাই সেফেদিন একজন ভয়ংকর-দর্শন নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনি কি আমার বাবাকে মেরে ফেলবেন?’ লোকটি তখন তাকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেয়েছিলেন। এরপর ভাই ভয়ে চুপ হয়ে যায়।

এই প্রথম আমি বাবাকে বিপদে পড়তে দেখেছিলাম এবং বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি অজেয় নন এবং পৃথিবী তত নিরাপদ স্থান নয়। নিয়ে যাওয়ার আগে, বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি আমাকে আদর করতে পারেন কি না। আমি বাবার দিকে হেঁটে গেলাম, নিচু হয়ে তাঁকে চুমু দিতে দিলাম।

বাবাকে শেষ পর্যন্ত ১৯৮৯ সালে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি হুইলচেয়ারে করে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। কারণ নির্যাতনকারীরা তাঁর মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। যেদিন তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন, সেদিন ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন। কিন্তু আমরা আর আগের জীবনে ফিরে যেতে পারিনি। বাবা জানতেন, বেন আলির অত্যাচারের খড়্গ তাঁর ওপর আবার নেমে আসবে। এটি কেবল সময়ের ব্যাপার, তাই তিনি তাঁর প্রিয় দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর কিছুদিন পর আমরাও সেখানে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলাম।

অত্যাচার ও কারাবাস বাবার শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল কিন্তু তাঁর মনকে নয়। নির্বাসনে তিনি পরিবারের পাশাপাশি দেশের জন্যও নিজেকে উৎসর্গ করেন। তিনি তিউনিসিয়ায় মানবাধিকারের সক্রিয় সমর্থক এবং বেন আলির শাসনের সোচ্চার সমালোচক ছিলেন। তিনি প্রায়ই তিউনিসিয়ার বন্দীদের মুক্তির জন্য প্রচার চালাতেন। তিউনিসিয়ার নৃশংস স্বৈরশাসন সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করেছেন।

২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে তিউনিসিয়ার বিপ্লবে বেন আলির পতন হলে বাবা তৎক্ষণাৎ তিউনিস চলে যান। তাঁর দল এন্নাহদাকে অবশেষে আইনগতভাবে রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় এবং তিউনিসিয়ায় প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক নির্বাচনে দলটি জয়লাভ করে। 
২০১৯ সালে বাবা পার্লামেন্টের একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। কয়েক দশক ধরে অবহেলার শিকার হওয়ার পর তিনি তাঁর নিজ শহর কাইরুয়ানকে অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে চেয়েছিলেন। তিনি সেই আসনে জিতেছিলেন। প্রতি সপ্তাহে তিনি শেয়ার ট্যাক্সিতে করে শহরে ভ্রমণ এবং তাঁর নির্বাচনী এলাকার জনগণের সঙ্গে সভা করা শুরু করেন।

এরপর ২০২১ সালের জুলাই মাসে কাইস সাইদ তিউনিসিয়ায় একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করেন, পার্লামেন্ট স্থগিত এবং নির্বাহী ও বিধানিক ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি দেশকে আবার কর্তৃত্ববাদের অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে আনেন।

বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁকে খুব শিগগির গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি জানতেন যে তিনি একটি টার্গেট তালিকায় আছেন এবং নিরাপত্তা বাহিনী তাঁকে বারবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে গেছে। তিনি চাইলে পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু এবার তিনি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

নির্বাসন থেকে ফিরে আসার পর বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা-ই ঘটুক না কেন, আর কখনো তিউনিসিয়া ছাড়বেন না। একজন বয়স্ক মানুষ হিসেবে দেশেই মরতে চেয়েছিলেন তিনি।

যুক্তরাজ্যে থাকার সময় বাবা ব্রিটিশ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার অধিকার ত্যাগ করেছিলেন, যদিও তিনি এটি পাওয়ার অধিকারী ছিলেন। তিনি তিউনিসিয়ার একজন নাগরিক হিসেবে বেন আলির বিরোধিতা করতে চেয়েছিলেন, একজন তিউনিসিয়ান হিসেবে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন এবং বিদেশি পাসপোর্ট 
ছাড়াই তিউনিসিয়ার রাজনীতিতে অংশ নিতে চেয়েছিলেন।

গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক দিন আগে বাবা আমাদের এমন কিছু বলেছিলেন, যা আমরা ইতিমধ্যেই জানতাম। তিনি এ জীবনটাই বেছে নিয়েছেন, তাঁর সিদ্ধান্তগুলো নীতির ভিত্তিতে নেওয়া, কোনো ভয় থেকে নয় এবং তিনি স্বাধীনতা, মর্যাদা ও তিউনিসীয়দের প্রাপ্য অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।

যেদিন বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেদিন আমি এতটাই রাগ, বেদনা, দুঃখ ও অবিচার অনুভব করেছি যে আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না। তাঁকে হারানোর সেই শৈশবের ট্রমা আবার ফিরে এসেছিল।

একটি বিষয় যা আমাকে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করে তা হলো, বাবার মতো লোকদের সহজেই ‘ইসলামপন্থী’ তকমা দিয়ে তাঁদের অমানবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। তাঁরা যে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা একপাশে সরিয়ে রেখে তাঁদের কারাদণ্ডকে দ্রুত মান্যতা দেওয়া হয়েছে। বাবা কোনো রাজনৈতিক আদর্শের অন্ধ অনুসারী নন। তিনি একজন নীতিমান মানুষ, স্বাধীনতার প্রবক্তা এবং গণতন্ত্রের একজন নির্ভীক সমর্থক। তিনি একজন কোমল, স্নেহময় পিতাও বটে, যিনি তাঁর সন্তানদের নাম ধরে গান করেন। এমন একজন বাবার মেয়ে হতে পেরে আমি সত্যিই সম্মানিত বোধ করি।

অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, গ্রেপ্তারের কথা শুনে ভয়ে আমি কি কখনো বাবাকে তিউনিসিয়া ছেড়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি? না, আমি কখনোই তা করিনি। গ্রেপ্তারের ভয়ে তিনি যে নিজের দেশ ছেড়ে যাননি, এ জন্য আমি তাঁকে খুব ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি।

এই বাবা দিবসে আমি বাবার সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম তাঁকে একটুখানি জড়িয়ে ধরতে, একটু কথা বলতে, চেয়েছিলাম তাঁর হাসি দেখতে। কিন্তু হলো না। আমি তাঁকে খুব মিস করছি। কিন্তু আমি এই সত্যে সান্ত্বনা পাই যে যদিও তিনি শারীরিকভাবে কারাগারে বন্দী, কিন্তু মনের দিক দিয়ে তিনি সবচেয়ে মুক্ত মানুষ।

লেখক: তিউনিসীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ অ্যাকটিভিস্ট 

(১৮ জুন বিশ্ব বাবা দিবস উপলক্ষে আল জাজিরা পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক ও কলাম লেখক রোকেয়া রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...