Ajker Patrika

স্মৃতিতে সদরঘাট ও নতুন ভাবনা

মামুনুর রশীদ
আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২২, ১৪: ০৭
স্মৃতিতে সদরঘাট ও নতুন ভাবনা

আজকের পত্রিকার জন্য লিখতে বসার আগে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি লেখা পড়ে সদরঘাটের প্রতি আমার সেই পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে, অর্থাৎ আমার শৈশবের প্রান্তে এসে অনেক স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেল। ঢাকা তখন আমার কাছে একটা বিস্ময়। সুদূর গ্রামে থাকা একটি শিশুর কাছে বিস্ময়টাই স্বাভাবিক। আমাদের কাছের বড় শহর টাঙ্গাইল, সে-ও ভীষণ অনুন্নত। এমনি অনুন্নত যে ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস্তাটাও তখন হয়নি। ঢাকায় আসতে হতো বাসে, ময়মনসিংহ হয়ে লোকাল ট্রেন ধরে সন্ধ্যায় এসে পৌঁছাতে হতো ঢাকায়। ভোর ছয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ১৩ ঘণ্টার একটি ভ্রমণ। কিন্তু এই ভ্রমণেও ক্লান্তি নেই, কারণ ঢাকায় এসে গেছি।

ঢাকায় এসে উঠেছিলাম খালার বাড়িতে। খালার বাসা ছিল ক্যান্টনমেন্ট। খালু সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে। কিন্তু তখনো তিনি একটি সরকারি অফিসে কাজ করেন। সুঠাম দেহ এবং সাইকেল চালানোয় পারদর্শী। তিনি সাইকেলের সামনে বসিয়ে আমাকে সদরঘাটে নিয়ে আসেন। সদরঘাটের জনারণ্য তখন অনেকটা সুশৃঙ্খল। বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চ, নৌকার বহর। আমার সেই প্রবীণ আত্মীয় নিরলস সাইকেলচালক। বাকল্যান্ড বাঁধের পাশ দিয়ে বাবুবাজার, ইসলামপুর ঘুরে সাইকেলে বসে থেকে ক্লান্ত হলে নেমে কিছু দূর হেঁটে যেতাম। চোখে আমার দুরন্ত কৌতূহল এবং সেই সঙ্গে শরীরে অদ্ভুত এক প্রাণচাঞ্চল্য। প্রথম দিন ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে একটা আত্মতৃপ্তি যে ঢাকা দেখে ফেলেছি।

পরবর্তী সময়ে আরেকটু বড় হওয়ার পর যখন ঢাকায় আসি, তখন প্রথম সিনেমা দেখি সদরঘাটেরই হল শাবিস্তানে। সিনেমার মাঝখানের বিরতিতে প্রথম ঢাকার লাচ্ছি খাওয়ার আনন্দ এখনো ভুলতে পারিনি। তখনো ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন আছে, নবাবপুরের রেলগেট আছে। রেলগেট পেরিয়েই একটা বিখ্যাত মোগলাই পরোটার দোকান ছিল, সেখানে মোগলাই পরোটা খাওয়াও আমার জীবনে প্রথম অভিজ্ঞতা। এরপর কিছু লেখালেখি, একুশের সংকলন প্রকাশনা—এসব ব্যাপারে প্রায়ই নবাবপুর রেলগেট পেরিয়ে যেতে হতো সদরঘাটের কাছাকাছি। কারণ, সব প্রেসের কর্মকাণ্ড হতো সদরঘাটের কাছাকাছি। বইয়ের দোকানপাট, খুচরা ও পাইকারি সবই একই এলাকায়—বাংলাবাজার। কিছুটা বাবুবাজার এলাকায়।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, কলকাতা থেকে প্রায় এক শ বছর পরে ঢাকায় প্রকাশনাশিল্প গড়ে ওঠে। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটকটি ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকেই প্রকাশিত হয়। তখনকার ঢাকা ছিল অবহেলিত এবং দারিদ্র্যপীড়িত এক নগরী। কিন্তু একমাত্র যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল এই সদরঘাট থেকে। ঢাকা যখন সুবে বাংলার রাজধানী ছিল, তখন যে সমৃদ্ধ ঢাকা এই সদরঘাট থেকেই তৈরি হয়েছিল; তা এক শ-দেড় শ বছরের ব্যবধানে একেবারেই জীর্ণশীর্ণ চেহারায় রূপান্তরিত হয়েছে। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আবার ঢাকা একটু একটু করে গড়ে উঠতে শুরু করে। তবে তার গতি অত্যন্ত শ্লথ।

এর বহু বছর পরে ঢাকা উত্তর দিকে সম্প্রসারিত হতে থাকে। ষাটের দশকে যখন আমি ঢাকায় আসি, প্রায় স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করি, তখন গুলিস্তান হয়ে গেছে। গুলিস্তান, তার সঙ্গে আরেকটি ছোট সিনেমা হল, চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, আইসক্রিমের দোকান ইত্যাদি। এই সময়ে কিছু সুউচ্চ অট্টালিকা দেখা যায় মতিঝিলে, বিশেষ করে বিরাট একটি ঘড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বা ডিআইটির দালান। তারপর ঢাকা উত্তরের দিকে বাড়তে থাকে। 

এ সময়ে রেলস্টেশনটিও ফুলবাড়িয়া থেকে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে কমলাপুরে। মুক্তিযুদ্ধের পরে ঢাকা দেশের রাজধানী হওয়ার পর ক্রমে ক্রমে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে এবং উত্তরের দিকেই বড়লোকদের জন্য আবাসিক এলাকা ও নিম্নবিত্তদের জন্য মালিবাগ, বাসাবো, খিলগাঁও, মান্ডা—এই সব জায়গায় জনবসতি গড়ে ওঠে। সদরঘাট একমাত্র নৌ-চলাচল ছাড়া আর সব ধরনের প্রয়োজন থেকে বিচ্যুত হয়। বাংলাবাজারের যে বইয়ের বিশাল বাজার হতে পারত তা সংকুচিত হতে থাকে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে অন্য জায়গাগুলোতে বইয়ের দোকানের আরেকটি বাজার বসে গেল, অর্থাৎ বইয়ের যে চর্চা, সেটাও কমতে শুরু করল। এ সময়ে কিছু আধুনিক বইয়ের খোঁজ পাওয়া যেত নিউমার্কেটের ভেতরে। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের মতো একটি বইয়ের বাজার বাংলাবাজারও হতে পারত। কিন্তু এই শহরটি নবনির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো শহর বিশারদ বা টাউন প্ল্যানার ছিল না। অনেকটা ইঞ্জিনিয়ার ও ব্রিটিশের তৈরি পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের হাত দিয়েই হয়েছিল। যেহেতু ওই সব প্রকৌশলীর মধ্যে তেমন কোনো ভিশনারি বা সুদূরপ্রসারী বাস্তব পরিকল্পনাবিদ ছিল না, তাই রাস্তাঘাট অত্যন্ত ছোট ছোট। যার ফলস্বরূপ এখনকার ঢাকায় প্রচণ্ড যানজট আমরা অনুভব করি। মাত্র ষাট-সত্তর বছর আগেও ঢাকা শহরের যে পরিকল্পনা তা অত্যন্ত অদূরদর্শিতায় গড়ে ওঠা। স্বাধীনতার পরেও যখন হু হু করে বাড়ছে ঢাকার আয়তন, তখনো পথঘাট ও নগরীর ফুসফুস বলে আখ্যায়িত ফাঁকা জায়গা এবং পার্ক—এগুলোর কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।

পৃথিবীর অনেক বড় শহরের কেন্দ্রস্থলেই থাকে একটা বড় নদী। নদীতে থাকে বড় ব্রিজ। কলকাতার হাওড়া ব্রিজ দেখেই অনুমান করা যায় নিচে স্টিমার চলাচলের ব্যবস্থা রেখে এই সুউচ্চ ব্রিজটি দিয়ে বিশাল অঞ্চলের যোগাযোগ তারা সম্ভবপর করে তুলেছে। অনেক বিলম্বে বুড়িগঙ্গার ওপর একাধিক ব্রিজ এখন স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু তত দিনে অবৈধ দখলদারেরা নদীকে সংকুচিত করে ফেলেছে। শুধু তা-ই নয়, নদীর পানিকে দূষিত করার জন্য যত রকম ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সব রকম কর্মকাণ্ড অদূরদর্শী কলকারখানার মালিকেরা নিয়ে ফেলেছেন। দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে অবাধ নৌ-চলাচলের কারণে বুড়িগঙ্গার কালো পানিতে এখন আর কোনো মৎস্যসম্পদ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক যথার্থই বলেছেন, ঢাকার রাজধানী হওয়া উচিত ছিল সদরঘাট। আর বাংলাবাজার হতে পারত কলকাতার মতো কলেজ স্ট্রিট, যেখানে সারা বছর ক্রেতা ও পাঠকদের ভিড় লেগে থাকে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন ছিল অনেক ভাঙা-গড়া।

সদরঘাট থেকে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান উঠে গেছে। সেই শূন্য জায়গাগুলোতে বইয়ের বাজার হতে পারত। কিন্তু তা না হয়ে অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে আর বাংলাবাজার থেকে ফরাশগঞ্জ হয়ে লালকুঠি-সূত্রাপুরের দিকে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে কাঁচামালের অনেক পাইকারি আড়ত বসেছে। উদ্যোগী প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা মুক্তধারার মতো বিরাট প্রকাশনা সংস্থা ‘মুক্তধারা’ গড়ে তুলেছিলেন ফরাশগঞ্জে। আড়তের চাপে তাঁকেও সেখান থেকে চলে আসতে হয়েছে। বইয়ের প্রতি এবং বইকেন্দ্রিক প্রকাশনা শিল্পের প্রতি কোনো সরকারই গুরুত্বারোপ করেনি। এমনকি কোভিডের ভয়াবহতার সময় যখন প্রকাশনাশিল্প প্রবল প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়, অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়, তখনো সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রাণপণে উদাসীন থেকেছে। ঢাকা শহরটা যদি কোনো টাউন প্ল্যানারের হাতে নির্মিত বা সংস্কারের কাজ হতো, তাহলে অবশ্যই বুড়িগঙ্গা একটা বড় বিবেচনার জায়গায় থাকত এবং শহরবাসীর প্রয়োজনটাও তারা বুঝতে পারত।

এরপর উত্তরে ঢাকার যে সম্প্রসারণের কাজ হয়েছে, সেখানেও মানুষের বিনোদনের জায়গা অত্যন্ত কম। গুলশান-বনানী-ধানমন্ডি-উত্তরায় সেভাবে বইয়ের কোনো দোকান নেই। সিনেমা হল নেই, নাট্যমঞ্চ নেই, মানুষ বসে যে একটু প্রাণভরে নিশ্বাস নেবে, সেই জায়গাটুকুও নেই। বহু বছর ধরে উত্তরায় একটি নাট্যমঞ্চ ও নাগরিক সুবিধার জন্য চেষ্টা করে আসা হচ্ছে। কিন্তু এখনো তার কোনো নাম-নিশানা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মিরপুর একটা বিশাল জনবহুল জায়গা, সেখানেও এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। মিরপুর ১২ নম্বর (ডিওএইচএস মিরপুর) থেকে শাহবাগ আজিজ মার্কেট পর্যন্ত একটি বইয়ের দোকান নেই।

স্কুলের পাশে কোথাও পাঠ্যপুস্তক এবং খাতা, পেনসিল, কলমের দোকান হয়তো আছে কিন্তু সত্যিকার অর্থে কোনো বইয়ের দোকান গড়ে ওঠেনি। যেহেতু প্রকৌশলীরা এই শহরের নকশা প্রণয়ন করেছেন, তাঁদের কাছে মানসিক বিষয়গুলোর কোনো গুরুত্বই পায়নি। হাতিরঝিল নির্মাণকালে যেহেতু স্থপতি, টাউন প্ল্যানার এবং কিছু ভিশনারির সমাবেশ ঘটেছিল, তাই এটি একটি বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের একটি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে এটি সবাই মূল্যায়ন করে থাকে।

একদা বুড়িগঙ্গা থেকে ফতুল্লা হয়ে শীতলক্ষ্যা পর্যন্ত একটা বিনোদনের জায়গা ছিল। এখন নৌযানের প্রবল যানজটে সেটিও অনুপস্থিত। শিশু-যুবক-তরুণ থেকে শুরু করে প্রবীণদের জন্য এই জনবহুল শহরে একটু নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা এবং চিত্তবিনোদনের জন্য প্রেক্ষাগৃহ, পাঠাগার সর্বোপরি বেশ কিছু ফাঁকা জায়গা অত্যাবশ্যক। বিষয়গুলো কোনো অবস্থাতেই শুধু প্রকৌশলীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। যাঁরা ভিশনারি, যাঁরা এসব নিয়ে ভাবতে পারেন, তাঁদের সমন্বয়ে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অতীতে অনেক ভুলভ্রান্তি হয়ে গেছে, ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি করা যাবে না।

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...