Ajker Patrika

অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো

চিররঞ্জন সরকার
আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২২, ০৮: ৪২
অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো

নাক গলানো বা ‘নোজপোকিং’ শব্দটি বহুল প্রচলিত। নাক গলানো অর্থ অনধিকারচর্চা। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে, অহেতুক প্রশ্ন করতে পছন্দ করে। আপনি যতই অপছন্দ করুন না কেন, ব্যক্তিগত নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রশ্ন আপনাকে শুনতেই হবে। অনেকে কৌতূহলের বশে এসব প্রশ্ন করেন।

কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করা যে উচিত নয়, এই অজ্ঞতা থেকে কেউ কেউ এসব প্রশ্ন করেন। তবে বেশির ভাগ মানুষ জেনেবুঝেও অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে নাক গলান, মাথা ঘামান। এটা এখন যেন আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, ‘অন্যদের সমস্ত কিছুতে নাক গলাতে বাঙালি শুধু পছন্দই করে না, এটাকে কর্তব্য ব’লে গণ্য করে। বাঙালি তার এলাকার সকলের সমস্ত খবর রাখে, খারাপ খবরগুলো মুখস্থ রাখে; এবং যদি কারো কোনো খারাপ খবর না থাকে, তবে বাঙালি তার একটা খারাপ খবর তৈরি করে। বাঙালি অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বাস করে না। বাঙালি অন্যের একান্ত বা ব্যক্তিগত কিছু সহ্য করে না। তাই বাঙালির কোনো ব্যক্তিগত জীবন নেই। … বাঙালির চোখে ব্যক্তিগত জীবন পাপ; বাঙালি মনে করে, দরোজা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পাপকর্মে লিপ্ত হয়; তাই তার দায়িত্ব অন্যের দরোজা ভেঙে ঢুকে তাকে পাপ থেকে উদ্ধার করা। তবে বাঙালি উদ্ধার করে না, অন্যকে বিপদে ফেলাই তার সমস্ত উদ্বেগের উদ্দেশ্য।’

আমাদের স্বভাব অবশ্য বড়ই বিচিত্র। আমরা অন্যের ব্যাপারে শুধু নাক গলাতেই পছন্দ করি না, একধরনের সমালোচনা, পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করতেও ওস্তাদ! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একেবারে ছোটবেলায় যেদিন একটু বেশি পড়তাম, মা-সহ অনেকেই বলতেন, ইশ্, উনি যেন বিদ্যাসাগর হবেন! সারা দিন শুধু পড়া আর পড়া। কেন, একটু খেলতে পারো না! চোখ দুটোকেও তো একটু রেস্ট দিতে হয়! আর যখন খেলে ফিরতাম, তখন শুরু হতো বিপরীত বক্তব্য: ফিরলে কেন? যাও আরও খেলো। তোমাদের তো লেখাপড়া নেই, অন্য কোনো কাজও নেই! খেলোয়াড় হওয়ার জন্য জন্ম হয়েছে যেন!

খেতে চাইলে বলা হতো, এই ঘরে কোত্থেকে এক রাক্ষস এসে জুটেছে, সারাক্ষণ কেবল খাই খাই করে। কেন, তুমি কয় দিন ধরে না খেয়ে আছো? হাভাতে ঘরের সন্তানেরা এমন স্বভাবের হয়। আবার যখন কোনো একটা কিছু খেতে মন চাইত না, তখনই বলা হতো, তুমি কি লাটসাহেবের নাতি হয়েছ নাকি? গলা দিয়ে কিছু নামে না! না খেলে শরীরটা ভালো থাকবে কীভাবে? তোমাদের তো আবার জ্বালানোর স্বভাব! না খেয়ে কিছু একটা অসুখ বাঁধিয়ে পরিবারের সবাইকে না ভোগালে চলবে কেন?

স্কুল পাস দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় প্রশ্ন: কোথায় ভর্তি হচ্ছ? এলাকাতেই থাকবে, নাকি ঢাকায় যাবে? অবশ্য ঢাকায় ভর্তি হওয়া খুব কঠিন। তোমার যা রেজাল্ট, তাতে আর কত দূরই বা যেতে পারবে!

কলেজজীবন শেষে আবারও প্রশ্ন: কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে? মেডিকেল-বুয়েটে ট্রাই করোনি? ও, তুমি সায়েন্স বাদ দিয়ে আর্টসে চলে এসেছ? তাহলে আর কি! এখন ইউনিভার্সিটিতেই পচে মরো! তা কোন ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা দিচ্ছ? চান্স পাবে কি না, জানি না। তবে ঢাকা ইউনিভার্সিটিকে টার্গেট করো। ঢাকা না হলে জাহাঙ্গীরনগর দেখো।

ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর আবার প্রশ্ন: কোন সাবজেক্টে চান্স পেয়েছ? অর্থনীতি অথবা ইংরেজিতে পড়তে পারলে না? রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বাংলা, দর্শন—এসব সাবজেক্টে পড়ে কোনো লাভ নেই। এসব সাবজেক্টে গাধারা পড়ে!

কিছুদিন যাওয়ার পর শুরু হয় নতুন উৎপাত। প্রশ্ন আসা শুরু করে, বান্ধবী-টান্ধবী কিছু জোটাতে পারলে? নাকি চোখের দেখাতেই মনের সুখ? যে প্রেম করে, তার সম্পর্কে বলা হচ্ছে: ছেলেটা একটা লম্পট। প্রেমট্রেম করে একেবারে গোল্লায় গেল। আর যার কপালে প্রেম জোটেনি তার সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ছেলেটা একটা ঘোড়েল মাল। ডুবে ডুবে পানি খায়। ও এত চালাক যে, ওর প্রেমট্রেমের ব্যাপারগুলো কাকপক্ষীও টের পায় না। আবার কারও সম্পর্কে এমনও শুনেছি যে, ও আর প্রেম কি করবে, ও তো পুরাই একটু বলদ। ও পারে কেবল বাপের টাকা ধ্বংস করতে আর ষাঁড়ের মতো গিলতে! আস্ত অপদার্থ একটা!

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বহুবার শোনা প্রশ্ন হচ্ছে, কোন ইয়ারে উঠলে? রেজাল্ট কেমন? চাকরির জন্য ট্রাই করছ? বিসিএসের জন্য পড়ছ তো?

বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিলে শোনা যায় ভিন্ন ধরনের প্রশ্ন: বেতন কত? এই টাকায় জীবন চলে? এই দিয়ে নিজেই কী খাবে আর সংসারের খরচই বা কীভাবে জোগাবে? এর পরের রাউন্ডে আসে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রশ্ন।

বিয়ে করছ না কেন? ছ্যাঁকা খেয়েছ নাকি? তোমার বাবা-মা মেয়ে দেখছেন না? পছন্দমতো পাচ্ছেন না? এত খুঁজলে হয়? বেশি বাছলে কিন্তু খারাপটাই জোটে। বিয়ের ক্ষেত্রে সবকিছু সমানভাবে মিলবে না। কিছু ছাড় দিতেই হবে।

এখনো কেন বিয়ে করো না? এখনই তো সময়। দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাকাচ্চা নিতে হবে তো! আর সবকিছুর তো একটা সময় আছে।

সমস্যা কী? তোমার দিক থেকে মিলছে না, নাকি মেয়েরাই...। অনেক মালদার পাট্টির ধান্দায় আছ নাকি?

কিছু কিছু বিষয়ে দেখা যায় ব্যক্তি বা পরিবারের মাথাব্যথা নেই, কিন্তু চারপাশের মানুষ মাথায় বাড়ি দিয়ে দিয়ে মাথার খুলি উড়িয়ে দেওয়ার অবস্থা করে দেয়। সমাজের এই পেইনের কারণে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে, এমন মানুষের সংখ্যা এই যুগে একেবারে কম না!

তবে বিয়ে করে ফেললেই আপনার প্রতি পাবলিকের দরদ কমে যাবে, তা ভাববেন না। এরপর শুরু হবে: কবে বাচ্চা নিচ্ছ? বাচ্চা নিতে দেরি হলে ঘনিষ্ঠ হওয়ার ভাব ধরে খুবই সহানুভূতিশীল হয়ে বলবে: সমস্যাটা কার? তোমার? নাকি বউয়ের? ডাক্তার দেখাচ্ছ? কাকে?

বাচ্চা হওয়ার পরও শান্তি নেই। শুরু হবে: বাচ্চার মনে হয় গ্রোথ কম! ওজন কত? ওমা! ওর ওজন দেখি অনেক কম! এখনো হামাগুড়ি দেওয়া শেখে নাই? দাঁত উঠেছে? এখনো ওঠে নাই? ডাক্তার দেখিয়েছ? কথা বলে? বাবা-মা বলে? বলেন কী, এত দিনে তো ছড়া-কবিতা বলার কথা!

এই প্রতিটি প্রশ্নের সঙ্গে থাকবে নিজের বা কোনো আত্মীয়ের শিশুর অভিজ্ঞতা, কত তাড়াতাড়ি সে হামাগুড়ি দিয়েছে বা তার দাঁত উঠেছে বা কথা বলছে, গান-কবিতা শিখেছে...।

বাচ্চাকে কোন স্কুলে দিয়েছেন, রোল কত? বাচ্চা একটা হলে বলবে: একটা কেন! আবার দুটো হলে বলবে: একটা নয় কেন? এমন প্রশ্ন চলতেই থাকে।

জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মানুষ আসলে খুবই দরদি। তারা জানতে চায়, বুঝতে চায়, নিদান দিতে চায়। তাই প্রশ্ন করে এবং প্রশ্নগুলো চলতেই থাকে চলতেই থাকে। আমৃত্যু। সন্তান বড় হলে আবারও আসে চাকরিবাকরির প্রশ্ন, এরপর আবার বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন। তারপর নাতি-নাতনির প্রশ্ন। এরপর নাতি-নাতনির ঘরে সন্তান নিয়ে প্রশ্ন!

এসব প্রশ্নবাণ থেকে রেহাই পাওয়ার পথ কী? হেসে হেসে জবাব দেবেন? এসব ‘ব্যক্তিগত প্রশ্ন’ না করতে অনুরোধ করবেন? নিশ্চিত, তাতেও রেহাই পাবেন না। তাহলে সমাধান কী? সমাধান একটাই, রগচটা হয়ে যাওয়া, এসব প্রশ্ন শুনলেই উত্তেজিত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করা। আপনার বাবা কত বছর বয়সে বিয়ে করেছেন, পরকীয়া করেছেন কি না, সেই প্রশ্ন করা। সাহস করে বলা, আপনার মা বিয়ের আগে কয়টা প্রেম করেছেন? অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স। যে আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে একটা প্রশ্ন করবে, আপনি তার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে দশটা প্রশ্ন করুন। আপনি সফল হবেন। সে ভাগবেই ভাগবে! খুব বেশি হলে আড়ালে-আবডালে আপনাকে বেয়াদব বা ক্রেজি বলবে—এই যা!

চিররঞ্জন সরকার: গবেষক ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করে যা বলল ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

দুই মামলা থেকে মির্জা আব্বাস-আমান-গয়েশ্বরসহ ৪৫ জনকে অব্যাহতি

হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, হেলমেট ও ভুয়া নম্বরপ্লেট উদ্ধার

বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব

মেসিকে ১৫ কোটি টাকার ঘড়ি উপহার দিলেন আম্বানি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ