
তানজিম আহমদ সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সন্তান। ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি গাজীপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি, দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব ও ভবিষ্যতের রাজনীতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন।
সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন

প্রধান উপদেষ্টা আপনাকে ফোন করেছিলেন। কী কথা হলো তাঁর সঙ্গে?
আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি। তিনি ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে আমি যেদিন পদযাত্রা করেছি, সেদিন তিনি দেখা করতে পারেননি। তিনি স্বীকার করেছেন আমাদের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ বিষয়টা তিনি দেখবেন। আমার বাবাসহ মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় নেতাদের অবদানের কথা বললেন।
আপনি ৩ নভেম্বর তিনটি দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রা করেছেন। বলেছেন এটি আপনার শেষ পদযাত্রা। শেষ পদযাত্রা কেন?
আমি এই পদযাত্রাটা তিন বছর ধরে করছি। আগের দুই বছর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব যে দল দিয়েছিল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সেই দল সরকারে ছিল। এটা যদি সত্যিকারের নীতি-আদর্শের আওয়ামী লীগ হতো, অবশ্যই আমার দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে ফেলত। তারা তো তা করেইনি বরং উপেক্ষা করেছে।
এবার দেখছি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে অনেকের বিবৃতি আসছে। অথচ দুই বছর আগে আমাকে তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি। দুই বছর আগে আমি তাদের পেজে এমন কমেন্ট করেছি।
ওই যে একাত্তরের ইতিহাস, ওই যে একটা বিবাদ—সেটারই প্রতিফলন। আসলে একটা পরিবার আওয়ামী লীগ নামের দলটাকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে। এটা আওয়ামী লীগ না।
আমি তো এই ছিনতাই হওয়া আওয়ামী লীগের কাছে কিছু পেলাম না। তাই এবার গেলাম প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে। কারণ, সারা দেশের মানুষের তাঁর ওপর অনেক আশা-ভরসা। আমরা সবাই আশা করছি সংস্কার হবে, যাতে করে আগামী দিনে যে গণতান্ত্রিক সরকার আসবে, তারা যেন সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করতে পারে।
আমি কেন বলছি শেষ পদযাত্রা? কারণ, রাষ্ট্রের কাছে আমার বাবাসহ জাতীয় নেতাদের সন্তান হিসেবে তাঁদের প্রতি সম্মান জানানোর অধিকার চাওয়ার বিষয়টি আমাকে খুব লজ্জিত করছে।
এরপরও যদি মানুষের কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হয়, তখনো কি এমন পদযাত্রা আর করবেন না?
আমি তো অনবরত কথা বলে যাচ্ছি। তবে একই দাবিতে পদযাত্রাটা শেষ করতে চাই, কারণ এতে আমি নিজে বিব্রত হচ্ছি। এটা খুব দুঃখজনক। আমার দাবি তিনটা সহজ। প্রথম, ৩ নভেম্বরকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া, যাতে মানুষ জানতে পারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। কারা এই চার নেতা? যাঁরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে শুধু দুটি রাষ্ট্র ‘ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্সের’ মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ। আমাদের একটা ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্স আছে—প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স। ওইটার ভিত্তিতে আমরা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ একটা সরকার গঠন করেছিলাম। ইতিহাস সংরক্ষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে যদি সেই দিনকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটা দ্বিতীয় দাবি। আমার তৃতীয় দাবি স্পষ্ট—জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন—সকল বীর, হিরো, সুপারহিরো—যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের জীবনী তথা তাঁদের অবদান পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা এবং সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা; যেন একজন তরুণ বা তরুণী পড়ে বলতে পারেন, ‘ও মাই গড, তাঁরা এত বিসর্জন দিয়েছেন দেশের জন্য! এটা অনুপ্রেরণা জাগায়, একদম রক্ত গরম করে ফেলে। তাঁরা আমার দেশের জন্য এত করেছেন, তাহলে আমাদের আরও ভালো কিছু করতে হবে।’ এই যৌক্তিক দাবি পূরণ না করার তো কোনো কারণ আমি দেখছি না।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই ব্যাপারে আপনার কী জানা আছে?
আমি যা জেনেছি এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। গণহত্যা যখন শুরু হলো ২৫ মার্চ, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমার বাবা সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ছিলেন। তিনি একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল যে বঙ্গবন্ধু এই টেপ রেকর্ডারে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং একটা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার কথা ছিল একই মর্মে। সেই সময়ে শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সব সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই রেকর্ডেড মেসেজটা দেননি এবং ওই কাগজে স্বাক্ষর দেননি। আমার বাবা পরে বাসায় চলে আসেন। আমার মা-বোনদের মুখ থেকে শুনেছি, বাবা বাসায় এসে সব ফাইলপত্র ফেলে, তছনছ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের ২৩ বছরের আন্দোলন নষ্ট হয়ে গেল।’
আমি যেটা ধারণা করছি, যেহেতু বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন এবং আমার বাবা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে মুক্তির সংগ্রামে যোগ দেবেন, এই সময়টুকুর মধ্যে ইপিআরে আক্রমণ হয়েছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এই খবরগুলো ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে। জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে। আমি মনে করছি, যেহেতু জিয়াউর রহমান দেখেছিলেন যে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি, তিনি তখন নিজ উদ্যোগে ঘোষণা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রথমবার। প্রথমবার তিনি কিন্তু বলেছিলেন, ‘আই, প্রেসিডেন্ট জিয়া...’। তারপর রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে বলেন যে আপনি ঘোষণাটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দিন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘অন বিহাফ আওয়ার গ্রেট লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...’। এগুলো হচ্ছে ইতিহাসের টুকরা টুকরা ঘটনা। এগুলোকে আমাদের পূর্ণাঙ্গভাবে বিবেচনা, বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জিয়াউর রহমান যেটা করেছিলেন একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে, তাঁর অবস্থান থেকে ওই সময়, ওই মুহূর্তে সেটা তিনি সঠিক মনে করেছিলেন। মানুষ তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘোষণার অপেক্ষায় থাকে, সেটা যখন আসছিল না, তখন তিনি নিজে এই পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকেই নির্দেশনা আসে। কিন্তু এখানে ২৫, ২৬, ২৭ মার্চের গ্যাপটা কেন সৃষ্টি হলো, এটাও প্রশ্নের একটা বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধে আপনি সবার অবদানের কথা বলছেন। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মনে করেন কি না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জেনেছি, পড়েছি। আমার কাছে মনে হয়, অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, আবার বলছি। জনগণ তাঁর নামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাঁর নামেই যুদ্ধ হয়েছে। তাঁর নামেই সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। এখানে কিছু প্রশ্ন আসে। তাঁর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি কোনো ভূমিকা ছিল না। আমার মতে, আমরা ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ বলতে পারি—বঙ্গবন্ধু একজন এবং বাকি যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁরা সবাই ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ হতে পারেন। আমরা তো এটাকে শেয়ার করতে পারি। কেন আমরা একজনের ওপরে দিয়ে দিচ্ছি সবকিছু? একজনই যদি হতে হয় তাহলে সেটা মানুষ সিদ্ধান্ত নিক যে তিনি জাতির পিতা কি না। যদি মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, হ্যাঁ তিনিই জাতির পিতা এবং সঙ্গে ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ ছিল, সেটাও ঠিক আছে।
১৫-১৬ বছরে বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে কি তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই। এত বছরের লাগামহীন দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা, পাশাপাশি আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, হত্যা, গুম, মানে অরাজকতার একটা মহোৎসব চলছিল। এখন যেহেতু তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেহেতু এই পুরো জিনিসটাই বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রতিফলিত হলো। মানুষ তো এখন বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখছে। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যগুলোর ওপর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মানুষ এখন লিংক করছে এই অনিয়ম, দুর্নীতি, অত্যাচার—সবকিছু এই ব্যক্তির নামে হয়েছে। এটা তো খুবই অন্যায় করা হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।
আপনি কি রাজনীতি ছেড়েছেন নাকি রাজনীতি আপনাকে ছেড়েছে?
এটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং একটা প্রশ্ন। ২০০৮ সালে আমি খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন করব বলে। সরকারের প্রথম ছয় মাসের যে কর্মকাণ্ড দেখেছি, আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমি হুবহু আঁচ না করতে পারলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে ৫ আগস্টের মতো ঘটনা হয়তো আসবে সামনে। ২০১৪-তে যদি সঠিক নির্বাচন দেওয়া হতো তাহলে হয়তো আর ৫ আগস্ট আসত না।
আমার অবস্থান থেকে, নৈতিকতার দিক থেকে আমি একটা শপথ নিয়েছিলাম বাংলাদেশের জনগণের কাছে, আমি যখন প্রতিমন্ত্রী হই। সেই শপথটা ছিল, আমি আমার সবকিছু দিয়ে সৎভাবে, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। যখন দেখলাম আমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না, যখন দেখলাম লাগামহীন দুর্নীতি শুরু হয়েছে, যখন দেখলাম রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন না এনে দ্বিগুণ গতিতে একই ধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন আমার সিদ্ধান্ত ছিল পদত্যাগ করা। পদত্যাগের মাধ্যমে আমি চেয়েছিলাম প্রতিবাদের একটা বীজ বপন করে দিতে।
শুধু কি এই কারণেই আপনাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হলো? শেখ সেলিমের সঙ্গে নাকি আপনার বিরোধ হয়েছিল?
না, এ রকম কিছু হয়নি। হ্যাঁ, দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, কিন্তু ওটা কারণ ছিল না। কারণটা হচ্ছে, এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু ছিল এবং কোনো না কোনোভাবে পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা ছিল একটা প্রধান কারণ। আমি চেষ্টা করছিলাম প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য। কিন্তু ওই বিশেষ পারিবারিক চাপ ছিল পুলিশের ওপর। এটাও একটা কারণ, ব্যক্তিগতভাবে কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি। কিন্তু তাদের প্রভাব ছিল। সেই প্রভাবটা আমি বুঝতে পেরেছি, সেই প্রভাবটা একটা ফ্যাক্টর।
পদত্যাগের আর একটা কারণ ছিল বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত। যেভাবে তদন্ত হচ্ছিল আমার কাছে এটা ভালো লাগেনি। আমি চেয়েছিলাম তদন্তটা একদম পরিষ্কার হবে, স্বচ্ছ হবে। কিন্তু দেখা গেল তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানকে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরোপুরি বাইপাস করে, যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ছিল বিডিআর। দৃশ্য থেকে আমাদের পুরোপুরি বাইরে রাখা হলো এবং তদন্তটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। আমি তো মে মাস পর্যন্ত ছিলাম, তদন্ত চলেছে তার পরেও। এরপর কী হয়েছে আমি জানি না। ওই পর্যন্ত যখন আমি দেখলাম তদন্তটা আমাদের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, আমার কাছে এটা খুব অস্বাভাবিক লেগেছে। এটা তো হওয়ার কথা না। এখানে তো আমাদের সম্পৃক্ত থাকার কথা। আমি যদি সম্পৃক্ত থাকতাম, চেষ্টা করতাম স্বচ্ছ একটা তদন্ত করাতে। এখন অনেক প্রশ্ন উঠেছে বিডিআরের তদন্ত নিয়ে।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। আবার তিনিই কি দলটির বড় ক্ষতির কারণ হলেন?
আমি এটাই বলব, আশি ও নব্বইয়ের দশকে দলের মধ্যে কিছুটা ব্যালান্স ছিল। কারণ ওই সময় পর্যন্ত দলীয় ফোরামগুলোতে কথা বলা যেত। বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হতো। কেউ কোনো বিষয়ে মতামত দিলে সেটা একেবারে অগ্রাহ্য করা হতো না। কিন্তু পরে ওই গণতন্ত্রটা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন অধঃপতন শুরু হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা নীতি-আদর্শকেন্দ্রিক না হয়ে সুবিধাকেন্দ্রিক হয়ে যাই। আপনি যখন এককভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করবেন, আপনার কিন্তু লাইক-মাইন্ডের লোকজন লাগবে, যাঁরা আপনাকে অন্ধভাবে সমর্থন করবেন। তাই নীতি-আদর্শ বিচ্যুত করে আপনি দলের ভেতর এমন কিছু লোকজন ঢুকিয়েছেন, যাঁরা স্বার্থান্বেষী, যাঁরা নিজের পকেট ভারী করার জন্য, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য এ দলটাকে একেবার মূল নৈতিক জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি আপনার বোন শারমিন আহমদ বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনায় আওয়ামী লীগের কারও মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। তাই এই দলটিতে তিনি যাবেন না, দল গড়বেন না। বোনের সঙ্গে কি আপনি একমত?
আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। আমি বারবার বলছি, শেখ হাসিনাসহ এই আওয়ামী লীগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার আওয়ামী লীগ না। খাঁটি আওয়ামী লীগ না। আওয়ামী লীগটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নামটা ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভেতরে কিন্তু ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আমার আম্মা একটা কথা বলতেন সব সময়, মাছের পচন ধরে মাছের মাথা থেকে, রাজনৈতিক দলের পচনও ধরে মাথা থেকে।
আপনি আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন বলে শোনা যাচ্ছিল। কথাটি কি ঠিক?
কথাটা একেবারেই সত্যি না। অনেকেই অনেক জায়গা থেকে বলছেন। আমি জানি না কেন বলছেন। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, আমি রাজনীতিতে এলে তাঁদের অসুবিধা হয়ে যাবে, হয়তো আমি জনপ্রিয় বেশি, ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন—আমি জানি না। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, আমি রাজনীতিতে আসছি না। আমি যেখানে আছি, আমার কাজ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। আমি স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি।
বাংলাদেশে এখন বিশাল একটা সমস্যা হচ্ছে, এই যে চারদিকে এখন হাসপাতালে ভরে গেছে। চিকিৎসাখানা, ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে মানুষ ভুগছে। এটার কারণ হচ্ছে, একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন আধুনিক জীবনযাপন করছে, শহরকেন্দ্রিক। যার ফলে আমরা নানাবিধ অসুখ-বিসুখে ভুগছি। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছি। আমি হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছি—এটা আমাকে সাংঘাতিকভাবে সন্তুষ্টি দেয়। কারণ একটা মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে স্বাস্থ্য, সুস্থতা। এখন আমি কথা বলছি, এটা যদি রাজনীতি হয়, তাহলে রাজনীতি। আমি তো কথা বলেই যাব, এটা তো আমার দেশ, আমার অধিকার আছে কথা বলার। কিন্তু ওই প্ল্যাটফর্ম করে রাজনীতি করার ইচ্ছা আমার নেই।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের যে প্রভাব গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী বলে আপনি মনে করেন?
উপায় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম, নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পরিবর্তন আনল। তাই এখন নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের মালিকানা নিতে হবে। কিন্তু সেটা অবশ্যই একাত্তর সালকে ভুলে গিয়ে না। কারণ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের প্রাণশক্তি। আর ৫ আগস্ট হচ্ছে সেটারই ধারাবাহিকতা। আবার বলছি, ৫ আগস্টের যে দাবিদাওয়া ছিল, সেগুলো কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেরও দাবিদাওয়া। সেই সময়ের মানুষ যেটা চেয়েছিল, ৫ আগস্টেও ছাত্র-জনতা তা-ই চেয়েছে। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গাথা। নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে ইতিহাস থেকে। সেটাকে প্রাণশক্তি করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করতে হবে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে, কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও জানতে হবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমরা অনুপ্রেরণা নিতে পারব তাঁদের কাছ থেকে, যাঁরা অবদান রেখেছেন বাংলাদেশের জন্য।
যেকোনো সভ্যতার দিকে যদি তাকাই, আমি রোমের কথা, গ্রিসের কথাই বলব। তারা এতদূর এগোতে পেরেছিল একটা কারণে—তারা তাদের নায়কদের সম্মান করত। তাই আপনার জন্য যাঁরা অবদান রেখেছেন, বলিদান দিয়েছেন, আপনি যদি তাঁদের সম্মান না দেন তাহলে আপনার কোনো ভবিষ্যৎ হবে না। এটা ইতিহাসই বলে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে আপনি কেন দলটির তেমন সমালোচনা করেননি, এখন যেমন করছেন?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমার এক ভাগনেকেও কিন্তু গুম করা হয়েছিল। তাকে ১১ দিন আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। আমি যখন পদত্যাগ নাটকের শিকার হই—পদত্যাগ করতেও কিন্তু আমাকে প্রায় যুদ্ধ করতে হয়েছিল। পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হচ্ছিল না, বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছিল, অনেক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত আমি সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। এখানেও আবার নাটক—আমি স্পিকার হামিদ সাহেবের কাছে পাঠিয়েছিলাম পদত্যাগপত্র। তিনি বললেন, এটা কে না কে পাঠিয়েছে! অথচ আমি তাঁকে ফোন করে বললাম, ‘হামিদ কাকু (তাঁকে কাকু ডাকতাম), আমি কিন্তু পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি। পরে আমি নিজে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। এটা শুনে প্রধানমন্ত্রী খুব আশ্চর্য হলেন, ‘তুমি পদত্যাগ করে আসছো?’ তার আগে অনেক ঘটনা ছিল। অনেকভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল আমাকে রাখার জন্য।
যাই হোক, এখানে বুঝতে হবে, বিডিআর বিদ্রোহ, ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনা পরম্পরায় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে। রীতিমতো একনায়কতন্ত্রের পথে যাত্রা। ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের প্রভাব চারদিকে ছিল। ২০১১, ২০১২, ২০১৩ সালের দিকে কিন্তু গুম হওয়া শুরু করল। খোঁজ করে দেখেন, এই সংস্কৃতিটা শুরু হয়েছে তখন। এই অবস্থায় আমার আরেক ভাগনেকে পুলিশ বেধড়ক মারধর করল। এগুলো সব আমার জন্য ইশারা ছিল।
আমরা দেখেছি, সরকার যে-ই হোক না কেন, একটা পর্যায়ে গিয়ে ‘ফ্যাসিস্ট’ আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বইটি নিশ্চয়ই পড়েছেন, অনেকটা সে রকম। যেখানে শাসক বদলালেও স্বৈরশাসন বারবার ফিরে আসে। উপন্যাসটির সঙ্গে বাস্তবতার মিল পান কি?
‘অল অ্যানিমেলস আর ইক্যুয়াল বাট সাম অ্যানিমেলস আর মোর ইক্যুয়াল।’ পড়েছি অ্যানিমেল ফার্ম। যাই হোক, ফ্যাসিস্ট আচরণ আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট সরকার ছিল না। কারণ, এখানে ফ্যাসিস্ট সংজ্ঞার একটা বিষয় আছে। ফ্যাসিজম একটা মতাদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু এখানে তো কোনো মতাদর্শ ছিল না। এটা তো একটা দুর্নীতি, হত্যাযজ্ঞ, গুম, খুনের উৎসব ছিল। আমি বলব এটা একটা ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিয়া এবং পরিবারতন্ত্রের সম্মিলন—তিনটার সংমিশ্রণে এটা একটা হাইব্রিড ফিউশন সিস্টেম। এটার নাম এখনো কেউ দিতে পারেনি। এ জন্যই আমরা বলি ফ্যাসিস্ট।
কেন যেন এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা পরিবারকেন্দ্রিক। আমরা শ্রীলঙ্কায় সেটা দেখেছি। পাকিস্তানে দেখেছি। বাংলাদেশে দেখেছি। একমাত্র ভারত কিছুটা বেরিয়ে এসেছে, কারণ ওরা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। যদিও কংগ্রেস আছে কিন্তু ওদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এত মজবুত যে ওই সুবিধা ওরা পাচ্ছে না আমাদের তুলনায়। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও মজবুত করতে হবে, যাতে এ রকম ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিওক্রেসি পরিবারতন্ত্র আর মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে। আমাদের সবার এক থাকতে হবে এই জায়গাটায়। সব রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য যেন হয় জনসেবা। রাজনীতির মূলে আমাদের চলে যেতে হবে। এ জন্য জনগণেরই চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু জনগণ তো খুব অসহায়।
শেখ হাসিনার ১৫-১৬ বছরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে আচরণ, সেটা কি তাঁর নিজের গড়া, নাকি আশপাশের কারও মাধ্যমে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন? আপনার কী মনে হয়?
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমি তাঁর খুব কাছাকাছি থেকে বিরোধীদলীয় রাজনীতি করেছিলাম। পরে ২০০৮-০৯ সালে যখন মন্ত্রিসভায় ছিলাম, তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁর ভাবভঙ্গি, আচার পুরোপুরি ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তিনি আগে যেমন ছিলেন, তা থেকে রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেলেন। আমি যতটুকু দেখেছি, তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ নেই বাংলাদেশে। যা কিছু হতো, তাঁর ইচ্ছায় হতো। দলীয় ফোরামে এবং ইনফরমাল মিটিংয়ে কোনো বিষয়ে কথা হলে সবাই ভেবেছি তাঁকে এই ব্যাপারে বলতে হবে, কিন্তু তিনি আসার পর সবাই চুপ থাকতেন এবং তিনি কী শুনতে চান, সেটা আঁচ করে অন্যরা সুর পাল্টে ফেলতেন।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আপাতত আমার কোনো নির্ধারিত পরিকল্পনা নেই। আমি যে কাজটা করছি সেটা করেই আমি তৃপ্তি পাই, খুব সন্তুষ্ট আছি। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো আমাদের কারোরই জানা নেই। এটা মহান আল্লাহ তাআলাই জানেন।
কিন্তু অনেকের বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে একটা আশা ছিল যে সোহেল তাজ একটা দল গঠন করবেন, দিশা দেখাবেন।
আমি বিশ্বাস করি যে তরুণদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা প্রত্যেকে একটা করে দুর্গ হতে পারি বাংলাদেশের জন্য। প্রত্যেককেই নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নীতি-আদর্শ থাকতে হবে এবং দৃঢ়তা থাকতে হবে। আমরা যদি এই অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে পারি, তাহলে আরও অনেকেই চলে আসবে। সবাইকে নিজ উদ্যোগে বেরিয়ে আসতে হবে, কারও জন্য অপেক্ষা করলে হবে না। তাহলে আপনা-আপনি একটা নেতৃত্ব চলে আসবে।
বর্তমান তরুণদের ওপর আপনার আস্থা কতটুকু?
আসলে আমরা সবাই আশ্চর্য হয়েছি এবারের এই আন্দোলনটা দেখে। আমরা ভেবেছিলাম জেন-জি হচ্ছে মোবাইল ডিভাইস নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু তারা প্রমাণ করল যে তারাও আন্দোলন করতে পারে, অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে। জীবন দিতে পারে। এটা আমাদের আশান্বিত করে যে তারা পারবে।
এই অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সফল বা ব্যর্থ বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের বাংলাদেশ কিন্তু একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখনো আমরা এটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কারণ, ১৫-১৬ বছরে যে একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল, তাতে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা—সব ক্ষেত্রে ‘ইয়েস ম্যান’ বসিয়ে তাদের মতলব হাসিল করা হয়েছে। এখন এই অন্তর্বর্তী সরকার এসে এ রকম একটা পরিস্থিতির ভেতরে পড়েছে। তাদের কোনো দল নেই। তাদের বসিয়েছে ছাত্ররা। অন্যদিকে বড় বড় রাজনৈতিক দল আছে, যাদের সমর্থক গোষ্ঠী সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় আওয়ামী লীগে এখনো ন্যূনতম সমর্থক আছে ৩০ শতাংশ। বিএনপির আছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। ২০-২৫ শতাংশ আছে স্বতন্ত্র। বাকিরা জামায়াতের সমর্থক। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আপনি যখন সংস্কার করতে যাবেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল কিন্তু তাদের সুবিধাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য নানাভাবে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করবে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা। গণ-অভ্যুত্থান যখন ঘটে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিন্তু আকাশচুম্বী হয়। জনগণ খুশি থাকে কখন? তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজ যখন সুন্দরভাবে করতে পারে। এর মধ্যে আছে দ্রব্যমূল্য, নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা। দুর্ভাগ্যবশত এই ক্ষেত্রগুলো কিন্তু এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এই সরকার। আমি আগে যে প্রতিকূলতার কথা বললাম, তাদের ওই বাধাগুলো অতিক্রম করতে একটু সময় লাগছে। আমি মনে করি, এদিকে নজর দেওয়া উচিত। সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে পারেনি। এখন উল্টো দাম বেড়ে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। আমার বিনীত পরামর্শ থাকবে যে এদিকে একটু বেশি মনোনিবেশ করার। কারণ, জনগণ যদি আবার তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো না পায় তাহলে কথা বলা শুরু করবে। তাই আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নাগালের মধ্যে আনতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও।
প্রধান উপদেষ্টা আপনাকে ফোন করেছিলেন। কী কথা হলো তাঁর সঙ্গে?
আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি। তিনি ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে আমি যেদিন পদযাত্রা করেছি, সেদিন তিনি দেখা করতে পারেননি। তিনি স্বীকার করেছেন আমাদের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ বিষয়টা তিনি দেখবেন। আমার বাবাসহ মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় নেতাদের অবদানের কথা বললেন।
আপনি ৩ নভেম্বর তিনটি দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রা করেছেন। বলেছেন এটি আপনার শেষ পদযাত্রা। শেষ পদযাত্রা কেন?
আমি এই পদযাত্রাটা তিন বছর ধরে করছি। আগের দুই বছর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব যে দল দিয়েছিল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সেই দল সরকারে ছিল। এটা যদি সত্যিকারের নীতি-আদর্শের আওয়ামী লীগ হতো, অবশ্যই আমার দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে ফেলত। তারা তো তা করেইনি বরং উপেক্ষা করেছে।
এবার দেখছি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে অনেকের বিবৃতি আসছে। অথচ দুই বছর আগে আমাকে তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি। দুই বছর আগে আমি তাদের পেজে এমন কমেন্ট করেছি।
ওই যে একাত্তরের ইতিহাস, ওই যে একটা বিবাদ—সেটারই প্রতিফলন। আসলে একটা পরিবার আওয়ামী লীগ নামের দলটাকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে। এটা আওয়ামী লীগ না।
আমি তো এই ছিনতাই হওয়া আওয়ামী লীগের কাছে কিছু পেলাম না। তাই এবার গেলাম প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে। কারণ, সারা দেশের মানুষের তাঁর ওপর অনেক আশা-ভরসা। আমরা সবাই আশা করছি সংস্কার হবে, যাতে করে আগামী দিনে যে গণতান্ত্রিক সরকার আসবে, তারা যেন সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করতে পারে।
আমি কেন বলছি শেষ পদযাত্রা? কারণ, রাষ্ট্রের কাছে আমার বাবাসহ জাতীয় নেতাদের সন্তান হিসেবে তাঁদের প্রতি সম্মান জানানোর অধিকার চাওয়ার বিষয়টি আমাকে খুব লজ্জিত করছে।
এরপরও যদি মানুষের কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হয়, তখনো কি এমন পদযাত্রা আর করবেন না?
আমি তো অনবরত কথা বলে যাচ্ছি। তবে একই দাবিতে পদযাত্রাটা শেষ করতে চাই, কারণ এতে আমি নিজে বিব্রত হচ্ছি। এটা খুব দুঃখজনক। আমার দাবি তিনটা সহজ। প্রথম, ৩ নভেম্বরকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া, যাতে মানুষ জানতে পারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। কারা এই চার নেতা? যাঁরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে শুধু দুটি রাষ্ট্র ‘ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্সের’ মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ। আমাদের একটা ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্স আছে—প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স। ওইটার ভিত্তিতে আমরা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ একটা সরকার গঠন করেছিলাম। ইতিহাস সংরক্ষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে যদি সেই দিনকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটা দ্বিতীয় দাবি। আমার তৃতীয় দাবি স্পষ্ট—জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন—সকল বীর, হিরো, সুপারহিরো—যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের জীবনী তথা তাঁদের অবদান পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা এবং সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা; যেন একজন তরুণ বা তরুণী পড়ে বলতে পারেন, ‘ও মাই গড, তাঁরা এত বিসর্জন দিয়েছেন দেশের জন্য! এটা অনুপ্রেরণা জাগায়, একদম রক্ত গরম করে ফেলে। তাঁরা আমার দেশের জন্য এত করেছেন, তাহলে আমাদের আরও ভালো কিছু করতে হবে।’ এই যৌক্তিক দাবি পূরণ না করার তো কোনো কারণ আমি দেখছি না।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই ব্যাপারে আপনার কী জানা আছে?
আমি যা জেনেছি এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। গণহত্যা যখন শুরু হলো ২৫ মার্চ, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমার বাবা সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ছিলেন। তিনি একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল যে বঙ্গবন্ধু এই টেপ রেকর্ডারে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং একটা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার কথা ছিল একই মর্মে। সেই সময়ে শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সব সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই রেকর্ডেড মেসেজটা দেননি এবং ওই কাগজে স্বাক্ষর দেননি। আমার বাবা পরে বাসায় চলে আসেন। আমার মা-বোনদের মুখ থেকে শুনেছি, বাবা বাসায় এসে সব ফাইলপত্র ফেলে, তছনছ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের ২৩ বছরের আন্দোলন নষ্ট হয়ে গেল।’
আমি যেটা ধারণা করছি, যেহেতু বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন এবং আমার বাবা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে মুক্তির সংগ্রামে যোগ দেবেন, এই সময়টুকুর মধ্যে ইপিআরে আক্রমণ হয়েছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এই খবরগুলো ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে। জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে। আমি মনে করছি, যেহেতু জিয়াউর রহমান দেখেছিলেন যে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি, তিনি তখন নিজ উদ্যোগে ঘোষণা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রথমবার। প্রথমবার তিনি কিন্তু বলেছিলেন, ‘আই, প্রেসিডেন্ট জিয়া...’। তারপর রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে বলেন যে আপনি ঘোষণাটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দিন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘অন বিহাফ আওয়ার গ্রেট লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...’। এগুলো হচ্ছে ইতিহাসের টুকরা টুকরা ঘটনা। এগুলোকে আমাদের পূর্ণাঙ্গভাবে বিবেচনা, বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জিয়াউর রহমান যেটা করেছিলেন একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে, তাঁর অবস্থান থেকে ওই সময়, ওই মুহূর্তে সেটা তিনি সঠিক মনে করেছিলেন। মানুষ তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘোষণার অপেক্ষায় থাকে, সেটা যখন আসছিল না, তখন তিনি নিজে এই পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকেই নির্দেশনা আসে। কিন্তু এখানে ২৫, ২৬, ২৭ মার্চের গ্যাপটা কেন সৃষ্টি হলো, এটাও প্রশ্নের একটা বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধে আপনি সবার অবদানের কথা বলছেন। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মনে করেন কি না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জেনেছি, পড়েছি। আমার কাছে মনে হয়, অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, আবার বলছি। জনগণ তাঁর নামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাঁর নামেই যুদ্ধ হয়েছে। তাঁর নামেই সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। এখানে কিছু প্রশ্ন আসে। তাঁর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি কোনো ভূমিকা ছিল না। আমার মতে, আমরা ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ বলতে পারি—বঙ্গবন্ধু একজন এবং বাকি যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁরা সবাই ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ হতে পারেন। আমরা তো এটাকে শেয়ার করতে পারি। কেন আমরা একজনের ওপরে দিয়ে দিচ্ছি সবকিছু? একজনই যদি হতে হয় তাহলে সেটা মানুষ সিদ্ধান্ত নিক যে তিনি জাতির পিতা কি না। যদি মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, হ্যাঁ তিনিই জাতির পিতা এবং সঙ্গে ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ ছিল, সেটাও ঠিক আছে।
১৫-১৬ বছরে বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে কি তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই। এত বছরের লাগামহীন দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা, পাশাপাশি আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, হত্যা, গুম, মানে অরাজকতার একটা মহোৎসব চলছিল। এখন যেহেতু তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেহেতু এই পুরো জিনিসটাই বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রতিফলিত হলো। মানুষ তো এখন বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখছে। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যগুলোর ওপর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মানুষ এখন লিংক করছে এই অনিয়ম, দুর্নীতি, অত্যাচার—সবকিছু এই ব্যক্তির নামে হয়েছে। এটা তো খুবই অন্যায় করা হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।
আপনি কি রাজনীতি ছেড়েছেন নাকি রাজনীতি আপনাকে ছেড়েছে?
এটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং একটা প্রশ্ন। ২০০৮ সালে আমি খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন করব বলে। সরকারের প্রথম ছয় মাসের যে কর্মকাণ্ড দেখেছি, আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমি হুবহু আঁচ না করতে পারলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে ৫ আগস্টের মতো ঘটনা হয়তো আসবে সামনে। ২০১৪-তে যদি সঠিক নির্বাচন দেওয়া হতো তাহলে হয়তো আর ৫ আগস্ট আসত না।
আমার অবস্থান থেকে, নৈতিকতার দিক থেকে আমি একটা শপথ নিয়েছিলাম বাংলাদেশের জনগণের কাছে, আমি যখন প্রতিমন্ত্রী হই। সেই শপথটা ছিল, আমি আমার সবকিছু দিয়ে সৎভাবে, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। যখন দেখলাম আমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না, যখন দেখলাম লাগামহীন দুর্নীতি শুরু হয়েছে, যখন দেখলাম রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন না এনে দ্বিগুণ গতিতে একই ধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন আমার সিদ্ধান্ত ছিল পদত্যাগ করা। পদত্যাগের মাধ্যমে আমি চেয়েছিলাম প্রতিবাদের একটা বীজ বপন করে দিতে।
শুধু কি এই কারণেই আপনাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হলো? শেখ সেলিমের সঙ্গে নাকি আপনার বিরোধ হয়েছিল?
না, এ রকম কিছু হয়নি। হ্যাঁ, দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, কিন্তু ওটা কারণ ছিল না। কারণটা হচ্ছে, এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু ছিল এবং কোনো না কোনোভাবে পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা ছিল একটা প্রধান কারণ। আমি চেষ্টা করছিলাম প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য। কিন্তু ওই বিশেষ পারিবারিক চাপ ছিল পুলিশের ওপর। এটাও একটা কারণ, ব্যক্তিগতভাবে কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি। কিন্তু তাদের প্রভাব ছিল। সেই প্রভাবটা আমি বুঝতে পেরেছি, সেই প্রভাবটা একটা ফ্যাক্টর।
পদত্যাগের আর একটা কারণ ছিল বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত। যেভাবে তদন্ত হচ্ছিল আমার কাছে এটা ভালো লাগেনি। আমি চেয়েছিলাম তদন্তটা একদম পরিষ্কার হবে, স্বচ্ছ হবে। কিন্তু দেখা গেল তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানকে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরোপুরি বাইপাস করে, যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ছিল বিডিআর। দৃশ্য থেকে আমাদের পুরোপুরি বাইরে রাখা হলো এবং তদন্তটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। আমি তো মে মাস পর্যন্ত ছিলাম, তদন্ত চলেছে তার পরেও। এরপর কী হয়েছে আমি জানি না। ওই পর্যন্ত যখন আমি দেখলাম তদন্তটা আমাদের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, আমার কাছে এটা খুব অস্বাভাবিক লেগেছে। এটা তো হওয়ার কথা না। এখানে তো আমাদের সম্পৃক্ত থাকার কথা। আমি যদি সম্পৃক্ত থাকতাম, চেষ্টা করতাম স্বচ্ছ একটা তদন্ত করাতে। এখন অনেক প্রশ্ন উঠেছে বিডিআরের তদন্ত নিয়ে।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। আবার তিনিই কি দলটির বড় ক্ষতির কারণ হলেন?
আমি এটাই বলব, আশি ও নব্বইয়ের দশকে দলের মধ্যে কিছুটা ব্যালান্স ছিল। কারণ ওই সময় পর্যন্ত দলীয় ফোরামগুলোতে কথা বলা যেত। বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হতো। কেউ কোনো বিষয়ে মতামত দিলে সেটা একেবারে অগ্রাহ্য করা হতো না। কিন্তু পরে ওই গণতন্ত্রটা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন অধঃপতন শুরু হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা নীতি-আদর্শকেন্দ্রিক না হয়ে সুবিধাকেন্দ্রিক হয়ে যাই। আপনি যখন এককভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করবেন, আপনার কিন্তু লাইক-মাইন্ডের লোকজন লাগবে, যাঁরা আপনাকে অন্ধভাবে সমর্থন করবেন। তাই নীতি-আদর্শ বিচ্যুত করে আপনি দলের ভেতর এমন কিছু লোকজন ঢুকিয়েছেন, যাঁরা স্বার্থান্বেষী, যাঁরা নিজের পকেট ভারী করার জন্য, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য এ দলটাকে একেবার মূল নৈতিক জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি আপনার বোন শারমিন আহমদ বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনায় আওয়ামী লীগের কারও মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। তাই এই দলটিতে তিনি যাবেন না, দল গড়বেন না। বোনের সঙ্গে কি আপনি একমত?
আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। আমি বারবার বলছি, শেখ হাসিনাসহ এই আওয়ামী লীগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার আওয়ামী লীগ না। খাঁটি আওয়ামী লীগ না। আওয়ামী লীগটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নামটা ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভেতরে কিন্তু ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আমার আম্মা একটা কথা বলতেন সব সময়, মাছের পচন ধরে মাছের মাথা থেকে, রাজনৈতিক দলের পচনও ধরে মাথা থেকে।
আপনি আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন বলে শোনা যাচ্ছিল। কথাটি কি ঠিক?
কথাটা একেবারেই সত্যি না। অনেকেই অনেক জায়গা থেকে বলছেন। আমি জানি না কেন বলছেন। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, আমি রাজনীতিতে এলে তাঁদের অসুবিধা হয়ে যাবে, হয়তো আমি জনপ্রিয় বেশি, ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন—আমি জানি না। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, আমি রাজনীতিতে আসছি না। আমি যেখানে আছি, আমার কাজ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। আমি স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি।
বাংলাদেশে এখন বিশাল একটা সমস্যা হচ্ছে, এই যে চারদিকে এখন হাসপাতালে ভরে গেছে। চিকিৎসাখানা, ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে মানুষ ভুগছে। এটার কারণ হচ্ছে, একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন আধুনিক জীবনযাপন করছে, শহরকেন্দ্রিক। যার ফলে আমরা নানাবিধ অসুখ-বিসুখে ভুগছি। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছি। আমি হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছি—এটা আমাকে সাংঘাতিকভাবে সন্তুষ্টি দেয়। কারণ একটা মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে স্বাস্থ্য, সুস্থতা। এখন আমি কথা বলছি, এটা যদি রাজনীতি হয়, তাহলে রাজনীতি। আমি তো কথা বলেই যাব, এটা তো আমার দেশ, আমার অধিকার আছে কথা বলার। কিন্তু ওই প্ল্যাটফর্ম করে রাজনীতি করার ইচ্ছা আমার নেই।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের যে প্রভাব গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী বলে আপনি মনে করেন?
উপায় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম, নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পরিবর্তন আনল। তাই এখন নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের মালিকানা নিতে হবে। কিন্তু সেটা অবশ্যই একাত্তর সালকে ভুলে গিয়ে না। কারণ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের প্রাণশক্তি। আর ৫ আগস্ট হচ্ছে সেটারই ধারাবাহিকতা। আবার বলছি, ৫ আগস্টের যে দাবিদাওয়া ছিল, সেগুলো কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেরও দাবিদাওয়া। সেই সময়ের মানুষ যেটা চেয়েছিল, ৫ আগস্টেও ছাত্র-জনতা তা-ই চেয়েছে। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গাথা। নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে ইতিহাস থেকে। সেটাকে প্রাণশক্তি করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করতে হবে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে, কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও জানতে হবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমরা অনুপ্রেরণা নিতে পারব তাঁদের কাছ থেকে, যাঁরা অবদান রেখেছেন বাংলাদেশের জন্য।
যেকোনো সভ্যতার দিকে যদি তাকাই, আমি রোমের কথা, গ্রিসের কথাই বলব। তারা এতদূর এগোতে পেরেছিল একটা কারণে—তারা তাদের নায়কদের সম্মান করত। তাই আপনার জন্য যাঁরা অবদান রেখেছেন, বলিদান দিয়েছেন, আপনি যদি তাঁদের সম্মান না দেন তাহলে আপনার কোনো ভবিষ্যৎ হবে না। এটা ইতিহাসই বলে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে আপনি কেন দলটির তেমন সমালোচনা করেননি, এখন যেমন করছেন?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমার এক ভাগনেকেও কিন্তু গুম করা হয়েছিল। তাকে ১১ দিন আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। আমি যখন পদত্যাগ নাটকের শিকার হই—পদত্যাগ করতেও কিন্তু আমাকে প্রায় যুদ্ধ করতে হয়েছিল। পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হচ্ছিল না, বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছিল, অনেক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত আমি সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। এখানেও আবার নাটক—আমি স্পিকার হামিদ সাহেবের কাছে পাঠিয়েছিলাম পদত্যাগপত্র। তিনি বললেন, এটা কে না কে পাঠিয়েছে! অথচ আমি তাঁকে ফোন করে বললাম, ‘হামিদ কাকু (তাঁকে কাকু ডাকতাম), আমি কিন্তু পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি। পরে আমি নিজে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। এটা শুনে প্রধানমন্ত্রী খুব আশ্চর্য হলেন, ‘তুমি পদত্যাগ করে আসছো?’ তার আগে অনেক ঘটনা ছিল। অনেকভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল আমাকে রাখার জন্য।
যাই হোক, এখানে বুঝতে হবে, বিডিআর বিদ্রোহ, ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনা পরম্পরায় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে। রীতিমতো একনায়কতন্ত্রের পথে যাত্রা। ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের প্রভাব চারদিকে ছিল। ২০১১, ২০১২, ২০১৩ সালের দিকে কিন্তু গুম হওয়া শুরু করল। খোঁজ করে দেখেন, এই সংস্কৃতিটা শুরু হয়েছে তখন। এই অবস্থায় আমার আরেক ভাগনেকে পুলিশ বেধড়ক মারধর করল। এগুলো সব আমার জন্য ইশারা ছিল।
আমরা দেখেছি, সরকার যে-ই হোক না কেন, একটা পর্যায়ে গিয়ে ‘ফ্যাসিস্ট’ আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বইটি নিশ্চয়ই পড়েছেন, অনেকটা সে রকম। যেখানে শাসক বদলালেও স্বৈরশাসন বারবার ফিরে আসে। উপন্যাসটির সঙ্গে বাস্তবতার মিল পান কি?
‘অল অ্যানিমেলস আর ইক্যুয়াল বাট সাম অ্যানিমেলস আর মোর ইক্যুয়াল।’ পড়েছি অ্যানিমেল ফার্ম। যাই হোক, ফ্যাসিস্ট আচরণ আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট সরকার ছিল না। কারণ, এখানে ফ্যাসিস্ট সংজ্ঞার একটা বিষয় আছে। ফ্যাসিজম একটা মতাদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু এখানে তো কোনো মতাদর্শ ছিল না। এটা তো একটা দুর্নীতি, হত্যাযজ্ঞ, গুম, খুনের উৎসব ছিল। আমি বলব এটা একটা ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিয়া এবং পরিবারতন্ত্রের সম্মিলন—তিনটার সংমিশ্রণে এটা একটা হাইব্রিড ফিউশন সিস্টেম। এটার নাম এখনো কেউ দিতে পারেনি। এ জন্যই আমরা বলি ফ্যাসিস্ট।
কেন যেন এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা পরিবারকেন্দ্রিক। আমরা শ্রীলঙ্কায় সেটা দেখেছি। পাকিস্তানে দেখেছি। বাংলাদেশে দেখেছি। একমাত্র ভারত কিছুটা বেরিয়ে এসেছে, কারণ ওরা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। যদিও কংগ্রেস আছে কিন্তু ওদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এত মজবুত যে ওই সুবিধা ওরা পাচ্ছে না আমাদের তুলনায়। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও মজবুত করতে হবে, যাতে এ রকম ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিওক্রেসি পরিবারতন্ত্র আর মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে। আমাদের সবার এক থাকতে হবে এই জায়গাটায়। সব রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য যেন হয় জনসেবা। রাজনীতির মূলে আমাদের চলে যেতে হবে। এ জন্য জনগণেরই চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু জনগণ তো খুব অসহায়।
শেখ হাসিনার ১৫-১৬ বছরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে আচরণ, সেটা কি তাঁর নিজের গড়া, নাকি আশপাশের কারও মাধ্যমে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন? আপনার কী মনে হয়?
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমি তাঁর খুব কাছাকাছি থেকে বিরোধীদলীয় রাজনীতি করেছিলাম। পরে ২০০৮-০৯ সালে যখন মন্ত্রিসভায় ছিলাম, তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁর ভাবভঙ্গি, আচার পুরোপুরি ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তিনি আগে যেমন ছিলেন, তা থেকে রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেলেন। আমি যতটুকু দেখেছি, তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ নেই বাংলাদেশে। যা কিছু হতো, তাঁর ইচ্ছায় হতো। দলীয় ফোরামে এবং ইনফরমাল মিটিংয়ে কোনো বিষয়ে কথা হলে সবাই ভেবেছি তাঁকে এই ব্যাপারে বলতে হবে, কিন্তু তিনি আসার পর সবাই চুপ থাকতেন এবং তিনি কী শুনতে চান, সেটা আঁচ করে অন্যরা সুর পাল্টে ফেলতেন।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আপাতত আমার কোনো নির্ধারিত পরিকল্পনা নেই। আমি যে কাজটা করছি সেটা করেই আমি তৃপ্তি পাই, খুব সন্তুষ্ট আছি। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো আমাদের কারোরই জানা নেই। এটা মহান আল্লাহ তাআলাই জানেন।
কিন্তু অনেকের বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে একটা আশা ছিল যে সোহেল তাজ একটা দল গঠন করবেন, দিশা দেখাবেন।
আমি বিশ্বাস করি যে তরুণদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা প্রত্যেকে একটা করে দুর্গ হতে পারি বাংলাদেশের জন্য। প্রত্যেককেই নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নীতি-আদর্শ থাকতে হবে এবং দৃঢ়তা থাকতে হবে। আমরা যদি এই অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে পারি, তাহলে আরও অনেকেই চলে আসবে। সবাইকে নিজ উদ্যোগে বেরিয়ে আসতে হবে, কারও জন্য অপেক্ষা করলে হবে না। তাহলে আপনা-আপনি একটা নেতৃত্ব চলে আসবে।
বর্তমান তরুণদের ওপর আপনার আস্থা কতটুকু?
আসলে আমরা সবাই আশ্চর্য হয়েছি এবারের এই আন্দোলনটা দেখে। আমরা ভেবেছিলাম জেন-জি হচ্ছে মোবাইল ডিভাইস নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু তারা প্রমাণ করল যে তারাও আন্দোলন করতে পারে, অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে। জীবন দিতে পারে। এটা আমাদের আশান্বিত করে যে তারা পারবে।
এই অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সফল বা ব্যর্থ বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের বাংলাদেশ কিন্তু একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখনো আমরা এটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কারণ, ১৫-১৬ বছরে যে একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল, তাতে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা—সব ক্ষেত্রে ‘ইয়েস ম্যান’ বসিয়ে তাদের মতলব হাসিল করা হয়েছে। এখন এই অন্তর্বর্তী সরকার এসে এ রকম একটা পরিস্থিতির ভেতরে পড়েছে। তাদের কোনো দল নেই। তাদের বসিয়েছে ছাত্ররা। অন্যদিকে বড় বড় রাজনৈতিক দল আছে, যাদের সমর্থক গোষ্ঠী সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় আওয়ামী লীগে এখনো ন্যূনতম সমর্থক আছে ৩০ শতাংশ। বিএনপির আছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। ২০-২৫ শতাংশ আছে স্বতন্ত্র। বাকিরা জামায়াতের সমর্থক। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আপনি যখন সংস্কার করতে যাবেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল কিন্তু তাদের সুবিধাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য নানাভাবে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করবে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা। গণ-অভ্যুত্থান যখন ঘটে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিন্তু আকাশচুম্বী হয়। জনগণ খুশি থাকে কখন? তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজ যখন সুন্দরভাবে করতে পারে। এর মধ্যে আছে দ্রব্যমূল্য, নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা। দুর্ভাগ্যবশত এই ক্ষেত্রগুলো কিন্তু এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এই সরকার। আমি আগে যে প্রতিকূলতার কথা বললাম, তাদের ওই বাধাগুলো অতিক্রম করতে একটু সময় লাগছে। আমি মনে করি, এদিকে নজর দেওয়া উচিত। সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে পারেনি। এখন উল্টো দাম বেড়ে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। আমার বিনীত পরামর্শ থাকবে যে এদিকে একটু বেশি মনোনিবেশ করার। কারণ, জনগণ যদি আবার তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো না পায় তাহলে কথা বলা শুরু করবে। তাই আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নাগালের মধ্যে আনতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও।

তানজিম আহমদ সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সন্তান। ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি গাজীপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি, দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব ও ভবিষ্যতের রাজনীতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন।
সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন

প্রধান উপদেষ্টা আপনাকে ফোন করেছিলেন। কী কথা হলো তাঁর সঙ্গে?
আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি। তিনি ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে আমি যেদিন পদযাত্রা করেছি, সেদিন তিনি দেখা করতে পারেননি। তিনি স্বীকার করেছেন আমাদের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ বিষয়টা তিনি দেখবেন। আমার বাবাসহ মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় নেতাদের অবদানের কথা বললেন।
আপনি ৩ নভেম্বর তিনটি দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রা করেছেন। বলেছেন এটি আপনার শেষ পদযাত্রা। শেষ পদযাত্রা কেন?
আমি এই পদযাত্রাটা তিন বছর ধরে করছি। আগের দুই বছর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব যে দল দিয়েছিল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সেই দল সরকারে ছিল। এটা যদি সত্যিকারের নীতি-আদর্শের আওয়ামী লীগ হতো, অবশ্যই আমার দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে ফেলত। তারা তো তা করেইনি বরং উপেক্ষা করেছে।
এবার দেখছি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে অনেকের বিবৃতি আসছে। অথচ দুই বছর আগে আমাকে তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি। দুই বছর আগে আমি তাদের পেজে এমন কমেন্ট করেছি।
ওই যে একাত্তরের ইতিহাস, ওই যে একটা বিবাদ—সেটারই প্রতিফলন। আসলে একটা পরিবার আওয়ামী লীগ নামের দলটাকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে। এটা আওয়ামী লীগ না।
আমি তো এই ছিনতাই হওয়া আওয়ামী লীগের কাছে কিছু পেলাম না। তাই এবার গেলাম প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে। কারণ, সারা দেশের মানুষের তাঁর ওপর অনেক আশা-ভরসা। আমরা সবাই আশা করছি সংস্কার হবে, যাতে করে আগামী দিনে যে গণতান্ত্রিক সরকার আসবে, তারা যেন সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করতে পারে।
আমি কেন বলছি শেষ পদযাত্রা? কারণ, রাষ্ট্রের কাছে আমার বাবাসহ জাতীয় নেতাদের সন্তান হিসেবে তাঁদের প্রতি সম্মান জানানোর অধিকার চাওয়ার বিষয়টি আমাকে খুব লজ্জিত করছে।
এরপরও যদি মানুষের কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হয়, তখনো কি এমন পদযাত্রা আর করবেন না?
আমি তো অনবরত কথা বলে যাচ্ছি। তবে একই দাবিতে পদযাত্রাটা শেষ করতে চাই, কারণ এতে আমি নিজে বিব্রত হচ্ছি। এটা খুব দুঃখজনক। আমার দাবি তিনটা সহজ। প্রথম, ৩ নভেম্বরকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া, যাতে মানুষ জানতে পারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। কারা এই চার নেতা? যাঁরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে শুধু দুটি রাষ্ট্র ‘ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্সের’ মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ। আমাদের একটা ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্স আছে—প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স। ওইটার ভিত্তিতে আমরা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ একটা সরকার গঠন করেছিলাম। ইতিহাস সংরক্ষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে যদি সেই দিনকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটা দ্বিতীয় দাবি। আমার তৃতীয় দাবি স্পষ্ট—জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন—সকল বীর, হিরো, সুপারহিরো—যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের জীবনী তথা তাঁদের অবদান পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা এবং সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা; যেন একজন তরুণ বা তরুণী পড়ে বলতে পারেন, ‘ও মাই গড, তাঁরা এত বিসর্জন দিয়েছেন দেশের জন্য! এটা অনুপ্রেরণা জাগায়, একদম রক্ত গরম করে ফেলে। তাঁরা আমার দেশের জন্য এত করেছেন, তাহলে আমাদের আরও ভালো কিছু করতে হবে।’ এই যৌক্তিক দাবি পূরণ না করার তো কোনো কারণ আমি দেখছি না।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই ব্যাপারে আপনার কী জানা আছে?
আমি যা জেনেছি এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। গণহত্যা যখন শুরু হলো ২৫ মার্চ, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমার বাবা সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ছিলেন। তিনি একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল যে বঙ্গবন্ধু এই টেপ রেকর্ডারে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং একটা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার কথা ছিল একই মর্মে। সেই সময়ে শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সব সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই রেকর্ডেড মেসেজটা দেননি এবং ওই কাগজে স্বাক্ষর দেননি। আমার বাবা পরে বাসায় চলে আসেন। আমার মা-বোনদের মুখ থেকে শুনেছি, বাবা বাসায় এসে সব ফাইলপত্র ফেলে, তছনছ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের ২৩ বছরের আন্দোলন নষ্ট হয়ে গেল।’
আমি যেটা ধারণা করছি, যেহেতু বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন এবং আমার বাবা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে মুক্তির সংগ্রামে যোগ দেবেন, এই সময়টুকুর মধ্যে ইপিআরে আক্রমণ হয়েছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এই খবরগুলো ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে। জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে। আমি মনে করছি, যেহেতু জিয়াউর রহমান দেখেছিলেন যে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি, তিনি তখন নিজ উদ্যোগে ঘোষণা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রথমবার। প্রথমবার তিনি কিন্তু বলেছিলেন, ‘আই, প্রেসিডেন্ট জিয়া...’। তারপর রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে বলেন যে আপনি ঘোষণাটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দিন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘অন বিহাফ আওয়ার গ্রেট লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...’। এগুলো হচ্ছে ইতিহাসের টুকরা টুকরা ঘটনা। এগুলোকে আমাদের পূর্ণাঙ্গভাবে বিবেচনা, বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জিয়াউর রহমান যেটা করেছিলেন একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে, তাঁর অবস্থান থেকে ওই সময়, ওই মুহূর্তে সেটা তিনি সঠিক মনে করেছিলেন। মানুষ তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘোষণার অপেক্ষায় থাকে, সেটা যখন আসছিল না, তখন তিনি নিজে এই পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকেই নির্দেশনা আসে। কিন্তু এখানে ২৫, ২৬, ২৭ মার্চের গ্যাপটা কেন সৃষ্টি হলো, এটাও প্রশ্নের একটা বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধে আপনি সবার অবদানের কথা বলছেন। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মনে করেন কি না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জেনেছি, পড়েছি। আমার কাছে মনে হয়, অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, আবার বলছি। জনগণ তাঁর নামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাঁর নামেই যুদ্ধ হয়েছে। তাঁর নামেই সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। এখানে কিছু প্রশ্ন আসে। তাঁর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি কোনো ভূমিকা ছিল না। আমার মতে, আমরা ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ বলতে পারি—বঙ্গবন্ধু একজন এবং বাকি যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁরা সবাই ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ হতে পারেন। আমরা তো এটাকে শেয়ার করতে পারি। কেন আমরা একজনের ওপরে দিয়ে দিচ্ছি সবকিছু? একজনই যদি হতে হয় তাহলে সেটা মানুষ সিদ্ধান্ত নিক যে তিনি জাতির পিতা কি না। যদি মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, হ্যাঁ তিনিই জাতির পিতা এবং সঙ্গে ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ ছিল, সেটাও ঠিক আছে।
১৫-১৬ বছরে বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে কি তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই। এত বছরের লাগামহীন দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা, পাশাপাশি আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, হত্যা, গুম, মানে অরাজকতার একটা মহোৎসব চলছিল। এখন যেহেতু তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেহেতু এই পুরো জিনিসটাই বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রতিফলিত হলো। মানুষ তো এখন বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখছে। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যগুলোর ওপর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মানুষ এখন লিংক করছে এই অনিয়ম, দুর্নীতি, অত্যাচার—সবকিছু এই ব্যক্তির নামে হয়েছে। এটা তো খুবই অন্যায় করা হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।
আপনি কি রাজনীতি ছেড়েছেন নাকি রাজনীতি আপনাকে ছেড়েছে?
এটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং একটা প্রশ্ন। ২০০৮ সালে আমি খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন করব বলে। সরকারের প্রথম ছয় মাসের যে কর্মকাণ্ড দেখেছি, আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমি হুবহু আঁচ না করতে পারলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে ৫ আগস্টের মতো ঘটনা হয়তো আসবে সামনে। ২০১৪-তে যদি সঠিক নির্বাচন দেওয়া হতো তাহলে হয়তো আর ৫ আগস্ট আসত না।
আমার অবস্থান থেকে, নৈতিকতার দিক থেকে আমি একটা শপথ নিয়েছিলাম বাংলাদেশের জনগণের কাছে, আমি যখন প্রতিমন্ত্রী হই। সেই শপথটা ছিল, আমি আমার সবকিছু দিয়ে সৎভাবে, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। যখন দেখলাম আমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না, যখন দেখলাম লাগামহীন দুর্নীতি শুরু হয়েছে, যখন দেখলাম রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন না এনে দ্বিগুণ গতিতে একই ধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন আমার সিদ্ধান্ত ছিল পদত্যাগ করা। পদত্যাগের মাধ্যমে আমি চেয়েছিলাম প্রতিবাদের একটা বীজ বপন করে দিতে।
শুধু কি এই কারণেই আপনাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হলো? শেখ সেলিমের সঙ্গে নাকি আপনার বিরোধ হয়েছিল?
না, এ রকম কিছু হয়নি। হ্যাঁ, দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, কিন্তু ওটা কারণ ছিল না। কারণটা হচ্ছে, এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু ছিল এবং কোনো না কোনোভাবে পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা ছিল একটা প্রধান কারণ। আমি চেষ্টা করছিলাম প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য। কিন্তু ওই বিশেষ পারিবারিক চাপ ছিল পুলিশের ওপর। এটাও একটা কারণ, ব্যক্তিগতভাবে কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি। কিন্তু তাদের প্রভাব ছিল। সেই প্রভাবটা আমি বুঝতে পেরেছি, সেই প্রভাবটা একটা ফ্যাক্টর।
পদত্যাগের আর একটা কারণ ছিল বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত। যেভাবে তদন্ত হচ্ছিল আমার কাছে এটা ভালো লাগেনি। আমি চেয়েছিলাম তদন্তটা একদম পরিষ্কার হবে, স্বচ্ছ হবে। কিন্তু দেখা গেল তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানকে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরোপুরি বাইপাস করে, যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ছিল বিডিআর। দৃশ্য থেকে আমাদের পুরোপুরি বাইরে রাখা হলো এবং তদন্তটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। আমি তো মে মাস পর্যন্ত ছিলাম, তদন্ত চলেছে তার পরেও। এরপর কী হয়েছে আমি জানি না। ওই পর্যন্ত যখন আমি দেখলাম তদন্তটা আমাদের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, আমার কাছে এটা খুব অস্বাভাবিক লেগেছে। এটা তো হওয়ার কথা না। এখানে তো আমাদের সম্পৃক্ত থাকার কথা। আমি যদি সম্পৃক্ত থাকতাম, চেষ্টা করতাম স্বচ্ছ একটা তদন্ত করাতে। এখন অনেক প্রশ্ন উঠেছে বিডিআরের তদন্ত নিয়ে।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। আবার তিনিই কি দলটির বড় ক্ষতির কারণ হলেন?
আমি এটাই বলব, আশি ও নব্বইয়ের দশকে দলের মধ্যে কিছুটা ব্যালান্স ছিল। কারণ ওই সময় পর্যন্ত দলীয় ফোরামগুলোতে কথা বলা যেত। বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হতো। কেউ কোনো বিষয়ে মতামত দিলে সেটা একেবারে অগ্রাহ্য করা হতো না। কিন্তু পরে ওই গণতন্ত্রটা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন অধঃপতন শুরু হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা নীতি-আদর্শকেন্দ্রিক না হয়ে সুবিধাকেন্দ্রিক হয়ে যাই। আপনি যখন এককভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করবেন, আপনার কিন্তু লাইক-মাইন্ডের লোকজন লাগবে, যাঁরা আপনাকে অন্ধভাবে সমর্থন করবেন। তাই নীতি-আদর্শ বিচ্যুত করে আপনি দলের ভেতর এমন কিছু লোকজন ঢুকিয়েছেন, যাঁরা স্বার্থান্বেষী, যাঁরা নিজের পকেট ভারী করার জন্য, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য এ দলটাকে একেবার মূল নৈতিক জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি আপনার বোন শারমিন আহমদ বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনায় আওয়ামী লীগের কারও মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। তাই এই দলটিতে তিনি যাবেন না, দল গড়বেন না। বোনের সঙ্গে কি আপনি একমত?
আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। আমি বারবার বলছি, শেখ হাসিনাসহ এই আওয়ামী লীগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার আওয়ামী লীগ না। খাঁটি আওয়ামী লীগ না। আওয়ামী লীগটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নামটা ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভেতরে কিন্তু ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আমার আম্মা একটা কথা বলতেন সব সময়, মাছের পচন ধরে মাছের মাথা থেকে, রাজনৈতিক দলের পচনও ধরে মাথা থেকে।
আপনি আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন বলে শোনা যাচ্ছিল। কথাটি কি ঠিক?
কথাটা একেবারেই সত্যি না। অনেকেই অনেক জায়গা থেকে বলছেন। আমি জানি না কেন বলছেন। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, আমি রাজনীতিতে এলে তাঁদের অসুবিধা হয়ে যাবে, হয়তো আমি জনপ্রিয় বেশি, ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন—আমি জানি না। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, আমি রাজনীতিতে আসছি না। আমি যেখানে আছি, আমার কাজ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। আমি স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি।
বাংলাদেশে এখন বিশাল একটা সমস্যা হচ্ছে, এই যে চারদিকে এখন হাসপাতালে ভরে গেছে। চিকিৎসাখানা, ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে মানুষ ভুগছে। এটার কারণ হচ্ছে, একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন আধুনিক জীবনযাপন করছে, শহরকেন্দ্রিক। যার ফলে আমরা নানাবিধ অসুখ-বিসুখে ভুগছি। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছি। আমি হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছি—এটা আমাকে সাংঘাতিকভাবে সন্তুষ্টি দেয়। কারণ একটা মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে স্বাস্থ্য, সুস্থতা। এখন আমি কথা বলছি, এটা যদি রাজনীতি হয়, তাহলে রাজনীতি। আমি তো কথা বলেই যাব, এটা তো আমার দেশ, আমার অধিকার আছে কথা বলার। কিন্তু ওই প্ল্যাটফর্ম করে রাজনীতি করার ইচ্ছা আমার নেই।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের যে প্রভাব গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী বলে আপনি মনে করেন?
উপায় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম, নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পরিবর্তন আনল। তাই এখন নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের মালিকানা নিতে হবে। কিন্তু সেটা অবশ্যই একাত্তর সালকে ভুলে গিয়ে না। কারণ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের প্রাণশক্তি। আর ৫ আগস্ট হচ্ছে সেটারই ধারাবাহিকতা। আবার বলছি, ৫ আগস্টের যে দাবিদাওয়া ছিল, সেগুলো কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেরও দাবিদাওয়া। সেই সময়ের মানুষ যেটা চেয়েছিল, ৫ আগস্টেও ছাত্র-জনতা তা-ই চেয়েছে। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গাথা। নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে ইতিহাস থেকে। সেটাকে প্রাণশক্তি করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করতে হবে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে, কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও জানতে হবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমরা অনুপ্রেরণা নিতে পারব তাঁদের কাছ থেকে, যাঁরা অবদান রেখেছেন বাংলাদেশের জন্য।
যেকোনো সভ্যতার দিকে যদি তাকাই, আমি রোমের কথা, গ্রিসের কথাই বলব। তারা এতদূর এগোতে পেরেছিল একটা কারণে—তারা তাদের নায়কদের সম্মান করত। তাই আপনার জন্য যাঁরা অবদান রেখেছেন, বলিদান দিয়েছেন, আপনি যদি তাঁদের সম্মান না দেন তাহলে আপনার কোনো ভবিষ্যৎ হবে না। এটা ইতিহাসই বলে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে আপনি কেন দলটির তেমন সমালোচনা করেননি, এখন যেমন করছেন?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমার এক ভাগনেকেও কিন্তু গুম করা হয়েছিল। তাকে ১১ দিন আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। আমি যখন পদত্যাগ নাটকের শিকার হই—পদত্যাগ করতেও কিন্তু আমাকে প্রায় যুদ্ধ করতে হয়েছিল। পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হচ্ছিল না, বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছিল, অনেক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত আমি সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। এখানেও আবার নাটক—আমি স্পিকার হামিদ সাহেবের কাছে পাঠিয়েছিলাম পদত্যাগপত্র। তিনি বললেন, এটা কে না কে পাঠিয়েছে! অথচ আমি তাঁকে ফোন করে বললাম, ‘হামিদ কাকু (তাঁকে কাকু ডাকতাম), আমি কিন্তু পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি। পরে আমি নিজে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। এটা শুনে প্রধানমন্ত্রী খুব আশ্চর্য হলেন, ‘তুমি পদত্যাগ করে আসছো?’ তার আগে অনেক ঘটনা ছিল। অনেকভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল আমাকে রাখার জন্য।
যাই হোক, এখানে বুঝতে হবে, বিডিআর বিদ্রোহ, ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনা পরম্পরায় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে। রীতিমতো একনায়কতন্ত্রের পথে যাত্রা। ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের প্রভাব চারদিকে ছিল। ২০১১, ২০১২, ২০১৩ সালের দিকে কিন্তু গুম হওয়া শুরু করল। খোঁজ করে দেখেন, এই সংস্কৃতিটা শুরু হয়েছে তখন। এই অবস্থায় আমার আরেক ভাগনেকে পুলিশ বেধড়ক মারধর করল। এগুলো সব আমার জন্য ইশারা ছিল।
আমরা দেখেছি, সরকার যে-ই হোক না কেন, একটা পর্যায়ে গিয়ে ‘ফ্যাসিস্ট’ আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বইটি নিশ্চয়ই পড়েছেন, অনেকটা সে রকম। যেখানে শাসক বদলালেও স্বৈরশাসন বারবার ফিরে আসে। উপন্যাসটির সঙ্গে বাস্তবতার মিল পান কি?
‘অল অ্যানিমেলস আর ইক্যুয়াল বাট সাম অ্যানিমেলস আর মোর ইক্যুয়াল।’ পড়েছি অ্যানিমেল ফার্ম। যাই হোক, ফ্যাসিস্ট আচরণ আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট সরকার ছিল না। কারণ, এখানে ফ্যাসিস্ট সংজ্ঞার একটা বিষয় আছে। ফ্যাসিজম একটা মতাদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু এখানে তো কোনো মতাদর্শ ছিল না। এটা তো একটা দুর্নীতি, হত্যাযজ্ঞ, গুম, খুনের উৎসব ছিল। আমি বলব এটা একটা ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিয়া এবং পরিবারতন্ত্রের সম্মিলন—তিনটার সংমিশ্রণে এটা একটা হাইব্রিড ফিউশন সিস্টেম। এটার নাম এখনো কেউ দিতে পারেনি। এ জন্যই আমরা বলি ফ্যাসিস্ট।
কেন যেন এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা পরিবারকেন্দ্রিক। আমরা শ্রীলঙ্কায় সেটা দেখেছি। পাকিস্তানে দেখেছি। বাংলাদেশে দেখেছি। একমাত্র ভারত কিছুটা বেরিয়ে এসেছে, কারণ ওরা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। যদিও কংগ্রেস আছে কিন্তু ওদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এত মজবুত যে ওই সুবিধা ওরা পাচ্ছে না আমাদের তুলনায়। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও মজবুত করতে হবে, যাতে এ রকম ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিওক্রেসি পরিবারতন্ত্র আর মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে। আমাদের সবার এক থাকতে হবে এই জায়গাটায়। সব রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য যেন হয় জনসেবা। রাজনীতির মূলে আমাদের চলে যেতে হবে। এ জন্য জনগণেরই চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু জনগণ তো খুব অসহায়।
শেখ হাসিনার ১৫-১৬ বছরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে আচরণ, সেটা কি তাঁর নিজের গড়া, নাকি আশপাশের কারও মাধ্যমে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন? আপনার কী মনে হয়?
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমি তাঁর খুব কাছাকাছি থেকে বিরোধীদলীয় রাজনীতি করেছিলাম। পরে ২০০৮-০৯ সালে যখন মন্ত্রিসভায় ছিলাম, তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁর ভাবভঙ্গি, আচার পুরোপুরি ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তিনি আগে যেমন ছিলেন, তা থেকে রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেলেন। আমি যতটুকু দেখেছি, তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ নেই বাংলাদেশে। যা কিছু হতো, তাঁর ইচ্ছায় হতো। দলীয় ফোরামে এবং ইনফরমাল মিটিংয়ে কোনো বিষয়ে কথা হলে সবাই ভেবেছি তাঁকে এই ব্যাপারে বলতে হবে, কিন্তু তিনি আসার পর সবাই চুপ থাকতেন এবং তিনি কী শুনতে চান, সেটা আঁচ করে অন্যরা সুর পাল্টে ফেলতেন।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আপাতত আমার কোনো নির্ধারিত পরিকল্পনা নেই। আমি যে কাজটা করছি সেটা করেই আমি তৃপ্তি পাই, খুব সন্তুষ্ট আছি। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো আমাদের কারোরই জানা নেই। এটা মহান আল্লাহ তাআলাই জানেন।
কিন্তু অনেকের বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে একটা আশা ছিল যে সোহেল তাজ একটা দল গঠন করবেন, দিশা দেখাবেন।
আমি বিশ্বাস করি যে তরুণদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা প্রত্যেকে একটা করে দুর্গ হতে পারি বাংলাদেশের জন্য। প্রত্যেককেই নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নীতি-আদর্শ থাকতে হবে এবং দৃঢ়তা থাকতে হবে। আমরা যদি এই অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে পারি, তাহলে আরও অনেকেই চলে আসবে। সবাইকে নিজ উদ্যোগে বেরিয়ে আসতে হবে, কারও জন্য অপেক্ষা করলে হবে না। তাহলে আপনা-আপনি একটা নেতৃত্ব চলে আসবে।
বর্তমান তরুণদের ওপর আপনার আস্থা কতটুকু?
আসলে আমরা সবাই আশ্চর্য হয়েছি এবারের এই আন্দোলনটা দেখে। আমরা ভেবেছিলাম জেন-জি হচ্ছে মোবাইল ডিভাইস নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু তারা প্রমাণ করল যে তারাও আন্দোলন করতে পারে, অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে। জীবন দিতে পারে। এটা আমাদের আশান্বিত করে যে তারা পারবে।
এই অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সফল বা ব্যর্থ বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের বাংলাদেশ কিন্তু একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখনো আমরা এটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কারণ, ১৫-১৬ বছরে যে একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল, তাতে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা—সব ক্ষেত্রে ‘ইয়েস ম্যান’ বসিয়ে তাদের মতলব হাসিল করা হয়েছে। এখন এই অন্তর্বর্তী সরকার এসে এ রকম একটা পরিস্থিতির ভেতরে পড়েছে। তাদের কোনো দল নেই। তাদের বসিয়েছে ছাত্ররা। অন্যদিকে বড় বড় রাজনৈতিক দল আছে, যাদের সমর্থক গোষ্ঠী সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় আওয়ামী লীগে এখনো ন্যূনতম সমর্থক আছে ৩০ শতাংশ। বিএনপির আছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। ২০-২৫ শতাংশ আছে স্বতন্ত্র। বাকিরা জামায়াতের সমর্থক। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আপনি যখন সংস্কার করতে যাবেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল কিন্তু তাদের সুবিধাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য নানাভাবে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করবে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা। গণ-অভ্যুত্থান যখন ঘটে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিন্তু আকাশচুম্বী হয়। জনগণ খুশি থাকে কখন? তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজ যখন সুন্দরভাবে করতে পারে। এর মধ্যে আছে দ্রব্যমূল্য, নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা। দুর্ভাগ্যবশত এই ক্ষেত্রগুলো কিন্তু এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এই সরকার। আমি আগে যে প্রতিকূলতার কথা বললাম, তাদের ওই বাধাগুলো অতিক্রম করতে একটু সময় লাগছে। আমি মনে করি, এদিকে নজর দেওয়া উচিত। সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে পারেনি। এখন উল্টো দাম বেড়ে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। আমার বিনীত পরামর্শ থাকবে যে এদিকে একটু বেশি মনোনিবেশ করার। কারণ, জনগণ যদি আবার তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো না পায় তাহলে কথা বলা শুরু করবে। তাই আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নাগালের মধ্যে আনতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও।
প্রধান উপদেষ্টা আপনাকে ফোন করেছিলেন। কী কথা হলো তাঁর সঙ্গে?
আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি। তিনি ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে আমি যেদিন পদযাত্রা করেছি, সেদিন তিনি দেখা করতে পারেননি। তিনি স্বীকার করেছেন আমাদের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ বিষয়টা তিনি দেখবেন। আমার বাবাসহ মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় নেতাদের অবদানের কথা বললেন।
আপনি ৩ নভেম্বর তিনটি দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রা করেছেন। বলেছেন এটি আপনার শেষ পদযাত্রা। শেষ পদযাত্রা কেন?
আমি এই পদযাত্রাটা তিন বছর ধরে করছি। আগের দুই বছর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব যে দল দিয়েছিল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সেই দল সরকারে ছিল। এটা যদি সত্যিকারের নীতি-আদর্শের আওয়ামী লীগ হতো, অবশ্যই আমার দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে ফেলত। তারা তো তা করেইনি বরং উপেক্ষা করেছে।
এবার দেখছি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে অনেকের বিবৃতি আসছে। অথচ দুই বছর আগে আমাকে তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি। দুই বছর আগে আমি তাদের পেজে এমন কমেন্ট করেছি।
ওই যে একাত্তরের ইতিহাস, ওই যে একটা বিবাদ—সেটারই প্রতিফলন। আসলে একটা পরিবার আওয়ামী লীগ নামের দলটাকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে। এটা আওয়ামী লীগ না।
আমি তো এই ছিনতাই হওয়া আওয়ামী লীগের কাছে কিছু পেলাম না। তাই এবার গেলাম প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে। কারণ, সারা দেশের মানুষের তাঁর ওপর অনেক আশা-ভরসা। আমরা সবাই আশা করছি সংস্কার হবে, যাতে করে আগামী দিনে যে গণতান্ত্রিক সরকার আসবে, তারা যেন সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করতে পারে।
আমি কেন বলছি শেষ পদযাত্রা? কারণ, রাষ্ট্রের কাছে আমার বাবাসহ জাতীয় নেতাদের সন্তান হিসেবে তাঁদের প্রতি সম্মান জানানোর অধিকার চাওয়ার বিষয়টি আমাকে খুব লজ্জিত করছে।
এরপরও যদি মানুষের কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হয়, তখনো কি এমন পদযাত্রা আর করবেন না?
আমি তো অনবরত কথা বলে যাচ্ছি। তবে একই দাবিতে পদযাত্রাটা শেষ করতে চাই, কারণ এতে আমি নিজে বিব্রত হচ্ছি। এটা খুব দুঃখজনক। আমার দাবি তিনটা সহজ। প্রথম, ৩ নভেম্বরকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া, যাতে মানুষ জানতে পারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। কারা এই চার নেতা? যাঁরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে শুধু দুটি রাষ্ট্র ‘ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্সের’ মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ। আমাদের একটা ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্স আছে—প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স। ওইটার ভিত্তিতে আমরা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ একটা সরকার গঠন করেছিলাম। ইতিহাস সংরক্ষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে যদি সেই দিনকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটা দ্বিতীয় দাবি। আমার তৃতীয় দাবি স্পষ্ট—জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন—সকল বীর, হিরো, সুপারহিরো—যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের জীবনী তথা তাঁদের অবদান পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা এবং সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা; যেন একজন তরুণ বা তরুণী পড়ে বলতে পারেন, ‘ও মাই গড, তাঁরা এত বিসর্জন দিয়েছেন দেশের জন্য! এটা অনুপ্রেরণা জাগায়, একদম রক্ত গরম করে ফেলে। তাঁরা আমার দেশের জন্য এত করেছেন, তাহলে আমাদের আরও ভালো কিছু করতে হবে।’ এই যৌক্তিক দাবি পূরণ না করার তো কোনো কারণ আমি দেখছি না।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই ব্যাপারে আপনার কী জানা আছে?
আমি যা জেনেছি এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। গণহত্যা যখন শুরু হলো ২৫ মার্চ, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমার বাবা সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ছিলেন। তিনি একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল যে বঙ্গবন্ধু এই টেপ রেকর্ডারে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং একটা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার কথা ছিল একই মর্মে। সেই সময়ে শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সব সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই রেকর্ডেড মেসেজটা দেননি এবং ওই কাগজে স্বাক্ষর দেননি। আমার বাবা পরে বাসায় চলে আসেন। আমার মা-বোনদের মুখ থেকে শুনেছি, বাবা বাসায় এসে সব ফাইলপত্র ফেলে, তছনছ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের ২৩ বছরের আন্দোলন নষ্ট হয়ে গেল।’
আমি যেটা ধারণা করছি, যেহেতু বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন এবং আমার বাবা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে মুক্তির সংগ্রামে যোগ দেবেন, এই সময়টুকুর মধ্যে ইপিআরে আক্রমণ হয়েছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এই খবরগুলো ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে। জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে। আমি মনে করছি, যেহেতু জিয়াউর রহমান দেখেছিলেন যে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি, তিনি তখন নিজ উদ্যোগে ঘোষণা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রথমবার। প্রথমবার তিনি কিন্তু বলেছিলেন, ‘আই, প্রেসিডেন্ট জিয়া...’। তারপর রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে বলেন যে আপনি ঘোষণাটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দিন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘অন বিহাফ আওয়ার গ্রেট লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...’। এগুলো হচ্ছে ইতিহাসের টুকরা টুকরা ঘটনা। এগুলোকে আমাদের পূর্ণাঙ্গভাবে বিবেচনা, বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জিয়াউর রহমান যেটা করেছিলেন একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে, তাঁর অবস্থান থেকে ওই সময়, ওই মুহূর্তে সেটা তিনি সঠিক মনে করেছিলেন। মানুষ তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘোষণার অপেক্ষায় থাকে, সেটা যখন আসছিল না, তখন তিনি নিজে এই পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকেই নির্দেশনা আসে। কিন্তু এখানে ২৫, ২৬, ২৭ মার্চের গ্যাপটা কেন সৃষ্টি হলো, এটাও প্রশ্নের একটা বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধে আপনি সবার অবদানের কথা বলছেন। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মনে করেন কি না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জেনেছি, পড়েছি। আমার কাছে মনে হয়, অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, আবার বলছি। জনগণ তাঁর নামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাঁর নামেই যুদ্ধ হয়েছে। তাঁর নামেই সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। এখানে কিছু প্রশ্ন আসে। তাঁর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি কোনো ভূমিকা ছিল না। আমার মতে, আমরা ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ বলতে পারি—বঙ্গবন্ধু একজন এবং বাকি যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁরা সবাই ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ হতে পারেন। আমরা তো এটাকে শেয়ার করতে পারি। কেন আমরা একজনের ওপরে দিয়ে দিচ্ছি সবকিছু? একজনই যদি হতে হয় তাহলে সেটা মানুষ সিদ্ধান্ত নিক যে তিনি জাতির পিতা কি না। যদি মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, হ্যাঁ তিনিই জাতির পিতা এবং সঙ্গে ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ ছিল, সেটাও ঠিক আছে।
১৫-১৬ বছরে বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে কি তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই। এত বছরের লাগামহীন দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা, পাশাপাশি আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, হত্যা, গুম, মানে অরাজকতার একটা মহোৎসব চলছিল। এখন যেহেতু তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেহেতু এই পুরো জিনিসটাই বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রতিফলিত হলো। মানুষ তো এখন বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখছে। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যগুলোর ওপর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মানুষ এখন লিংক করছে এই অনিয়ম, দুর্নীতি, অত্যাচার—সবকিছু এই ব্যক্তির নামে হয়েছে। এটা তো খুবই অন্যায় করা হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।
আপনি কি রাজনীতি ছেড়েছেন নাকি রাজনীতি আপনাকে ছেড়েছে?
এটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং একটা প্রশ্ন। ২০০৮ সালে আমি খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন করব বলে। সরকারের প্রথম ছয় মাসের যে কর্মকাণ্ড দেখেছি, আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমি হুবহু আঁচ না করতে পারলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে ৫ আগস্টের মতো ঘটনা হয়তো আসবে সামনে। ২০১৪-তে যদি সঠিক নির্বাচন দেওয়া হতো তাহলে হয়তো আর ৫ আগস্ট আসত না।
আমার অবস্থান থেকে, নৈতিকতার দিক থেকে আমি একটা শপথ নিয়েছিলাম বাংলাদেশের জনগণের কাছে, আমি যখন প্রতিমন্ত্রী হই। সেই শপথটা ছিল, আমি আমার সবকিছু দিয়ে সৎভাবে, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। যখন দেখলাম আমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না, যখন দেখলাম লাগামহীন দুর্নীতি শুরু হয়েছে, যখন দেখলাম রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন না এনে দ্বিগুণ গতিতে একই ধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন আমার সিদ্ধান্ত ছিল পদত্যাগ করা। পদত্যাগের মাধ্যমে আমি চেয়েছিলাম প্রতিবাদের একটা বীজ বপন করে দিতে।
শুধু কি এই কারণেই আপনাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হলো? শেখ সেলিমের সঙ্গে নাকি আপনার বিরোধ হয়েছিল?
না, এ রকম কিছু হয়নি। হ্যাঁ, দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, কিন্তু ওটা কারণ ছিল না। কারণটা হচ্ছে, এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু ছিল এবং কোনো না কোনোভাবে পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা ছিল একটা প্রধান কারণ। আমি চেষ্টা করছিলাম প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য। কিন্তু ওই বিশেষ পারিবারিক চাপ ছিল পুলিশের ওপর। এটাও একটা কারণ, ব্যক্তিগতভাবে কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি। কিন্তু তাদের প্রভাব ছিল। সেই প্রভাবটা আমি বুঝতে পেরেছি, সেই প্রভাবটা একটা ফ্যাক্টর।
পদত্যাগের আর একটা কারণ ছিল বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত। যেভাবে তদন্ত হচ্ছিল আমার কাছে এটা ভালো লাগেনি। আমি চেয়েছিলাম তদন্তটা একদম পরিষ্কার হবে, স্বচ্ছ হবে। কিন্তু দেখা গেল তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানকে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরোপুরি বাইপাস করে, যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ছিল বিডিআর। দৃশ্য থেকে আমাদের পুরোপুরি বাইরে রাখা হলো এবং তদন্তটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। আমি তো মে মাস পর্যন্ত ছিলাম, তদন্ত চলেছে তার পরেও। এরপর কী হয়েছে আমি জানি না। ওই পর্যন্ত যখন আমি দেখলাম তদন্তটা আমাদের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, আমার কাছে এটা খুব অস্বাভাবিক লেগেছে। এটা তো হওয়ার কথা না। এখানে তো আমাদের সম্পৃক্ত থাকার কথা। আমি যদি সম্পৃক্ত থাকতাম, চেষ্টা করতাম স্বচ্ছ একটা তদন্ত করাতে। এখন অনেক প্রশ্ন উঠেছে বিডিআরের তদন্ত নিয়ে।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। আবার তিনিই কি দলটির বড় ক্ষতির কারণ হলেন?
আমি এটাই বলব, আশি ও নব্বইয়ের দশকে দলের মধ্যে কিছুটা ব্যালান্স ছিল। কারণ ওই সময় পর্যন্ত দলীয় ফোরামগুলোতে কথা বলা যেত। বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হতো। কেউ কোনো বিষয়ে মতামত দিলে সেটা একেবারে অগ্রাহ্য করা হতো না। কিন্তু পরে ওই গণতন্ত্রটা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন অধঃপতন শুরু হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা নীতি-আদর্শকেন্দ্রিক না হয়ে সুবিধাকেন্দ্রিক হয়ে যাই। আপনি যখন এককভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করবেন, আপনার কিন্তু লাইক-মাইন্ডের লোকজন লাগবে, যাঁরা আপনাকে অন্ধভাবে সমর্থন করবেন। তাই নীতি-আদর্শ বিচ্যুত করে আপনি দলের ভেতর এমন কিছু লোকজন ঢুকিয়েছেন, যাঁরা স্বার্থান্বেষী, যাঁরা নিজের পকেট ভারী করার জন্য, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য এ দলটাকে একেবার মূল নৈতিক জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি আপনার বোন শারমিন আহমদ বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনায় আওয়ামী লীগের কারও মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। তাই এই দলটিতে তিনি যাবেন না, দল গড়বেন না। বোনের সঙ্গে কি আপনি একমত?
আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। আমি বারবার বলছি, শেখ হাসিনাসহ এই আওয়ামী লীগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার আওয়ামী লীগ না। খাঁটি আওয়ামী লীগ না। আওয়ামী লীগটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নামটা ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভেতরে কিন্তু ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আমার আম্মা একটা কথা বলতেন সব সময়, মাছের পচন ধরে মাছের মাথা থেকে, রাজনৈতিক দলের পচনও ধরে মাথা থেকে।
আপনি আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন বলে শোনা যাচ্ছিল। কথাটি কি ঠিক?
কথাটা একেবারেই সত্যি না। অনেকেই অনেক জায়গা থেকে বলছেন। আমি জানি না কেন বলছেন। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, আমি রাজনীতিতে এলে তাঁদের অসুবিধা হয়ে যাবে, হয়তো আমি জনপ্রিয় বেশি, ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন—আমি জানি না। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, আমি রাজনীতিতে আসছি না। আমি যেখানে আছি, আমার কাজ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। আমি স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি।
বাংলাদেশে এখন বিশাল একটা সমস্যা হচ্ছে, এই যে চারদিকে এখন হাসপাতালে ভরে গেছে। চিকিৎসাখানা, ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে মানুষ ভুগছে। এটার কারণ হচ্ছে, একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন আধুনিক জীবনযাপন করছে, শহরকেন্দ্রিক। যার ফলে আমরা নানাবিধ অসুখ-বিসুখে ভুগছি। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছি। আমি হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছি—এটা আমাকে সাংঘাতিকভাবে সন্তুষ্টি দেয়। কারণ একটা মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে স্বাস্থ্য, সুস্থতা। এখন আমি কথা বলছি, এটা যদি রাজনীতি হয়, তাহলে রাজনীতি। আমি তো কথা বলেই যাব, এটা তো আমার দেশ, আমার অধিকার আছে কথা বলার। কিন্তু ওই প্ল্যাটফর্ম করে রাজনীতি করার ইচ্ছা আমার নেই।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের যে প্রভাব গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী বলে আপনি মনে করেন?
উপায় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম, নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পরিবর্তন আনল। তাই এখন নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের মালিকানা নিতে হবে। কিন্তু সেটা অবশ্যই একাত্তর সালকে ভুলে গিয়ে না। কারণ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের প্রাণশক্তি। আর ৫ আগস্ট হচ্ছে সেটারই ধারাবাহিকতা। আবার বলছি, ৫ আগস্টের যে দাবিদাওয়া ছিল, সেগুলো কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেরও দাবিদাওয়া। সেই সময়ের মানুষ যেটা চেয়েছিল, ৫ আগস্টেও ছাত্র-জনতা তা-ই চেয়েছে। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গাথা। নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে ইতিহাস থেকে। সেটাকে প্রাণশক্তি করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করতে হবে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে, কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও জানতে হবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমরা অনুপ্রেরণা নিতে পারব তাঁদের কাছ থেকে, যাঁরা অবদান রেখেছেন বাংলাদেশের জন্য।
যেকোনো সভ্যতার দিকে যদি তাকাই, আমি রোমের কথা, গ্রিসের কথাই বলব। তারা এতদূর এগোতে পেরেছিল একটা কারণে—তারা তাদের নায়কদের সম্মান করত। তাই আপনার জন্য যাঁরা অবদান রেখেছেন, বলিদান দিয়েছেন, আপনি যদি তাঁদের সম্মান না দেন তাহলে আপনার কোনো ভবিষ্যৎ হবে না। এটা ইতিহাসই বলে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে আপনি কেন দলটির তেমন সমালোচনা করেননি, এখন যেমন করছেন?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমার এক ভাগনেকেও কিন্তু গুম করা হয়েছিল। তাকে ১১ দিন আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। আমি যখন পদত্যাগ নাটকের শিকার হই—পদত্যাগ করতেও কিন্তু আমাকে প্রায় যুদ্ধ করতে হয়েছিল। পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হচ্ছিল না, বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছিল, অনেক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত আমি সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। এখানেও আবার নাটক—আমি স্পিকার হামিদ সাহেবের কাছে পাঠিয়েছিলাম পদত্যাগপত্র। তিনি বললেন, এটা কে না কে পাঠিয়েছে! অথচ আমি তাঁকে ফোন করে বললাম, ‘হামিদ কাকু (তাঁকে কাকু ডাকতাম), আমি কিন্তু পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি। পরে আমি নিজে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। এটা শুনে প্রধানমন্ত্রী খুব আশ্চর্য হলেন, ‘তুমি পদত্যাগ করে আসছো?’ তার আগে অনেক ঘটনা ছিল। অনেকভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল আমাকে রাখার জন্য।
যাই হোক, এখানে বুঝতে হবে, বিডিআর বিদ্রোহ, ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনা পরম্পরায় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে। রীতিমতো একনায়কতন্ত্রের পথে যাত্রা। ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের প্রভাব চারদিকে ছিল। ২০১১, ২০১২, ২০১৩ সালের দিকে কিন্তু গুম হওয়া শুরু করল। খোঁজ করে দেখেন, এই সংস্কৃতিটা শুরু হয়েছে তখন। এই অবস্থায় আমার আরেক ভাগনেকে পুলিশ বেধড়ক মারধর করল। এগুলো সব আমার জন্য ইশারা ছিল।
আমরা দেখেছি, সরকার যে-ই হোক না কেন, একটা পর্যায়ে গিয়ে ‘ফ্যাসিস্ট’ আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বইটি নিশ্চয়ই পড়েছেন, অনেকটা সে রকম। যেখানে শাসক বদলালেও স্বৈরশাসন বারবার ফিরে আসে। উপন্যাসটির সঙ্গে বাস্তবতার মিল পান কি?
‘অল অ্যানিমেলস আর ইক্যুয়াল বাট সাম অ্যানিমেলস আর মোর ইক্যুয়াল।’ পড়েছি অ্যানিমেল ফার্ম। যাই হোক, ফ্যাসিস্ট আচরণ আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট সরকার ছিল না। কারণ, এখানে ফ্যাসিস্ট সংজ্ঞার একটা বিষয় আছে। ফ্যাসিজম একটা মতাদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু এখানে তো কোনো মতাদর্শ ছিল না। এটা তো একটা দুর্নীতি, হত্যাযজ্ঞ, গুম, খুনের উৎসব ছিল। আমি বলব এটা একটা ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিয়া এবং পরিবারতন্ত্রের সম্মিলন—তিনটার সংমিশ্রণে এটা একটা হাইব্রিড ফিউশন সিস্টেম। এটার নাম এখনো কেউ দিতে পারেনি। এ জন্যই আমরা বলি ফ্যাসিস্ট।
কেন যেন এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা পরিবারকেন্দ্রিক। আমরা শ্রীলঙ্কায় সেটা দেখেছি। পাকিস্তানে দেখেছি। বাংলাদেশে দেখেছি। একমাত্র ভারত কিছুটা বেরিয়ে এসেছে, কারণ ওরা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। যদিও কংগ্রেস আছে কিন্তু ওদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এত মজবুত যে ওই সুবিধা ওরা পাচ্ছে না আমাদের তুলনায়। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও মজবুত করতে হবে, যাতে এ রকম ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিওক্রেসি পরিবারতন্ত্র আর মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে। আমাদের সবার এক থাকতে হবে এই জায়গাটায়। সব রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য যেন হয় জনসেবা। রাজনীতির মূলে আমাদের চলে যেতে হবে। এ জন্য জনগণেরই চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু জনগণ তো খুব অসহায়।
শেখ হাসিনার ১৫-১৬ বছরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে আচরণ, সেটা কি তাঁর নিজের গড়া, নাকি আশপাশের কারও মাধ্যমে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন? আপনার কী মনে হয়?
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমি তাঁর খুব কাছাকাছি থেকে বিরোধীদলীয় রাজনীতি করেছিলাম। পরে ২০০৮-০৯ সালে যখন মন্ত্রিসভায় ছিলাম, তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁর ভাবভঙ্গি, আচার পুরোপুরি ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তিনি আগে যেমন ছিলেন, তা থেকে রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেলেন। আমি যতটুকু দেখেছি, তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ নেই বাংলাদেশে। যা কিছু হতো, তাঁর ইচ্ছায় হতো। দলীয় ফোরামে এবং ইনফরমাল মিটিংয়ে কোনো বিষয়ে কথা হলে সবাই ভেবেছি তাঁকে এই ব্যাপারে বলতে হবে, কিন্তু তিনি আসার পর সবাই চুপ থাকতেন এবং তিনি কী শুনতে চান, সেটা আঁচ করে অন্যরা সুর পাল্টে ফেলতেন।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আপাতত আমার কোনো নির্ধারিত পরিকল্পনা নেই। আমি যে কাজটা করছি সেটা করেই আমি তৃপ্তি পাই, খুব সন্তুষ্ট আছি। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো আমাদের কারোরই জানা নেই। এটা মহান আল্লাহ তাআলাই জানেন।
কিন্তু অনেকের বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে একটা আশা ছিল যে সোহেল তাজ একটা দল গঠন করবেন, দিশা দেখাবেন।
আমি বিশ্বাস করি যে তরুণদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা প্রত্যেকে একটা করে দুর্গ হতে পারি বাংলাদেশের জন্য। প্রত্যেককেই নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নীতি-আদর্শ থাকতে হবে এবং দৃঢ়তা থাকতে হবে। আমরা যদি এই অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে পারি, তাহলে আরও অনেকেই চলে আসবে। সবাইকে নিজ উদ্যোগে বেরিয়ে আসতে হবে, কারও জন্য অপেক্ষা করলে হবে না। তাহলে আপনা-আপনি একটা নেতৃত্ব চলে আসবে।
বর্তমান তরুণদের ওপর আপনার আস্থা কতটুকু?
আসলে আমরা সবাই আশ্চর্য হয়েছি এবারের এই আন্দোলনটা দেখে। আমরা ভেবেছিলাম জেন-জি হচ্ছে মোবাইল ডিভাইস নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু তারা প্রমাণ করল যে তারাও আন্দোলন করতে পারে, অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে। জীবন দিতে পারে। এটা আমাদের আশান্বিত করে যে তারা পারবে।
এই অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সফল বা ব্যর্থ বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের বাংলাদেশ কিন্তু একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখনো আমরা এটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কারণ, ১৫-১৬ বছরে যে একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল, তাতে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা—সব ক্ষেত্রে ‘ইয়েস ম্যান’ বসিয়ে তাদের মতলব হাসিল করা হয়েছে। এখন এই অন্তর্বর্তী সরকার এসে এ রকম একটা পরিস্থিতির ভেতরে পড়েছে। তাদের কোনো দল নেই। তাদের বসিয়েছে ছাত্ররা। অন্যদিকে বড় বড় রাজনৈতিক দল আছে, যাদের সমর্থক গোষ্ঠী সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় আওয়ামী লীগে এখনো ন্যূনতম সমর্থক আছে ৩০ শতাংশ। বিএনপির আছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। ২০-২৫ শতাংশ আছে স্বতন্ত্র। বাকিরা জামায়াতের সমর্থক। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আপনি যখন সংস্কার করতে যাবেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল কিন্তু তাদের সুবিধাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য নানাভাবে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করবে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা। গণ-অভ্যুত্থান যখন ঘটে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিন্তু আকাশচুম্বী হয়। জনগণ খুশি থাকে কখন? তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজ যখন সুন্দরভাবে করতে পারে। এর মধ্যে আছে দ্রব্যমূল্য, নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা। দুর্ভাগ্যবশত এই ক্ষেত্রগুলো কিন্তু এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এই সরকার। আমি আগে যে প্রতিকূলতার কথা বললাম, তাদের ওই বাধাগুলো অতিক্রম করতে একটু সময় লাগছে। আমি মনে করি, এদিকে নজর দেওয়া উচিত। সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে পারেনি। এখন উল্টো দাম বেড়ে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। আমার বিনীত পরামর্শ থাকবে যে এদিকে একটু বেশি মনোনিবেশ করার। কারণ, জনগণ যদি আবার তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো না পায় তাহলে কথা বলা শুরু করবে। তাই আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নাগালের মধ্যে আনতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও।

ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৪ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৪ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৪ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগে
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অসংগতি, বৈষম্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তিনি। শিক্ষা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান, ছাত্র সংসদ, ছাত্ররাজনীতির গতিধারা এবং শিক্ষাব্যবস্থার নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা
মাসুদ রানা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল দাবি ছিল ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন’। গত দেড় বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীনতার পথে কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রশ্ন হলো, বৈষম্যহীনতা মূল রেখে, ডালপালা ছাঁটলে তো কোনো লাভ হবে না। বৈষম্য তো রয়ে গেছে আমাদের মূলে। একটা দেশে কীভাবে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, বাংলার আবার ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম থাকতে পারে? আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, এইসব শিক্ষাকাঠামোর কোথাও মিলনস্থান নেই। এভাবে আমরা আমাদের দেশের মানুষকে শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করেছি। এ রকম একটা সমাজে বৈষম্যহীন করার জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগে, তার তো সব অনুপস্থিতি এখনো আছে।
সুতরাং আমি গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়েই বৈষম্যহীনতা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোর চেষ্টা দেখিনি। গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়তোবা আরও বেশি ধনী হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কোনো দিক দিয়েই কমেনি।
আগের সরকারের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। বর্তমান সরকার যে পরিমার্জন এনেছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা কি রেখেছে?
আগের সরকার যা করেছে এবং বর্তমান সরকার যা করছে, আসলে তা হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগের সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করেছে। আর এই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চব্বিশের আন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটা সময় লাগে। ইতিহাসকে আসলে একটা সময় দিতে হয়। এটা সত্যি সত্যি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না, সেটা সময়ের আলোকে আসলে রেকটিফাই ও টেস্ট করতে হয়। মানে ফিল্টারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখনই এটা দেওয়ার মানে হলো, আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান, ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস তো ব্যবহার্য বিষয় না। ইতিহাস তো ধারণ করার বিষয়।
চব্বিশকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা মানেই হলো, আপনাদের কোনো লাভের বিষয় আছে। আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান টিস্যু পেপারের মতো। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আপনাদের হীন স্বার্থ হাসিলের ব্যবস্থা করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কাকে বাদ দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দকে বাদ দেওয়া যায়? এঁদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা দিয়ে ধর্ম ও জাতিভেদের ব্যাপারগুলো টেনে নিয়ে আসা ঠিক না। তাঁরা সময় দ্বারা পরীক্ষিত। ভালো মানের লোক দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সরকারের কি ম্যান্ডেট থাকতে পারে আমলাদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় যোগ বা বিয়োগ করার? তাদের এই যোগ ও বাদ দেওয়ার কোনোটাই সমর্থন করতে পারি না।
গত দেড় বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি করবে, লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো দলের জাতীয় নেতারা অন্যায় করলে সেটার প্রতিবাদ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে থাকবে, শিক্ষায় কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, গবেষণায় কীভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায়; শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত থাকবে এবং সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় বৃত্তের মধ্যে চলে যায়, তখন একটা দলের মধ্যে আটকে থাকলে তো তারা পুরো আকাশ দেখতে পাবে না। সে কারণে তারা সেই দলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে মাফ করে দেয়। আর অন্য দলের সামান্য অন্যায়কে বড় করে দেখে থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের চরিত্র হওয়া উচিত না। এই আকাঙ্ক্ষাটা জুলাই আন্দোলনের পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার ফিরে এসেছে। দলান্ধতা আবার বেড়ে
গেছে। কিন্তু সবার না। যেমন উগ্র ডানপন্থীদের কার্যক্রম প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করার জন্য তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখেন?
ছাত্র সংসদের কিছু দায়িত্ব আছে। তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না, সেগুলোর সবকিছু লিখিত না থাকলেও অধিকাংশ জনের কাছে সেগুলোর একটা ধারণা আছে। ছাত্র সংসদের কাজ তো ছিন্নমূল মানুষকে লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া না। ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয় বা কাউকে পেটানো না। তারা নিজেদের প্রশাসনের অংশ মনে করে। উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা আমাদেরই পার্ট।’ তা হতে পারে না।
ছাত্র সংসদের নির্ধারিত কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিষয়গুলো দেখভাল করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণাকে কীভাবে অগ্রসর করা যায়, কীভাবে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত করা যায়—এসব নিয়ে কাজ করা। উন্নত দেশের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রয়োজনে বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে বা গ্রাম থেকে যখন শিক্ষার্থীরা আসে, নতুন একটা শহর চেনার কথা না। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের কাজ আসলে এগুলোই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কলারশিপ পাবে, কে আর্থিকভাবে দুর্বল—এদের জন্যই তারা কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে এরা যা করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা দলকে কীভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করা যায়, সেগুলোতে তাদের মূল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে?
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সরকার তো নির্দলীয়। এই নির্দলীয় সরকার কি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকারের একাডেমিকভাবে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়েছে? সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় উপাচার্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনিক সব পদে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ডিনদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। গত সরকার যা করেছে, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা কি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন আশার আলো দেখাতে পারবে?
এই দেশে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যেহেতু দেশের শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের মান ভালো না, সেহেতু দেশের লক্ষ-কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কোনো সরকার কি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তার কত অংশ দেশে ফিরে আসছেন? এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে এই যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এটাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ড্রেন’। আমরা যাঁদের মেধাবী হিসেবে তৈরি করছি, তাঁদের সেবাটা পাচ্ছে না এ দেশ। তার চিত্রটা দেখা পাওয়া যায় রাস্তাঘাটে হাঁটলে। শুধু তা-ই না, এ দেশে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে থিয়েটার, টেলিভিশন, গানের শিল্পীসহ নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে গেছেন। সুতরাং শিক্ষক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণে দেশে মেধাবীদের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
একটা দেশ উন্নত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নির্দিষ্টসংখ্যক উচ্চ মানের মানুষের। এঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শরীরের রক্তশূন্যতার মতো। আমরা এখন সেই রক্তশূন্যতার মধ্যে ভুগছি। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ভালো করা না যায়, তাহলে দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। বেকারত্বের কারণেই দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আমার আবেদন বা অনুরোধ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তৈরি হয়। আগে উন্নত মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ, উন্নত মানুষের মাধ্যমেই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব। দালানকোঠা নির্মাণ করে দেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশ শিক্ষায় উন্নত না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পেরেছে। একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা দশের মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল দাবি ছিল ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন’। গত দেড় বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীনতার পথে কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রশ্ন হলো, বৈষম্যহীনতা মূল রেখে, ডালপালা ছাঁটলে তো কোনো লাভ হবে না। বৈষম্য তো রয়ে গেছে আমাদের মূলে। একটা দেশে কীভাবে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, বাংলার আবার ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম থাকতে পারে? আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, এইসব শিক্ষাকাঠামোর কোথাও মিলনস্থান নেই। এভাবে আমরা আমাদের দেশের মানুষকে শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করেছি। এ রকম একটা সমাজে বৈষম্যহীন করার জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগে, তার তো সব অনুপস্থিতি এখনো আছে।
সুতরাং আমি গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়েই বৈষম্যহীনতা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোর চেষ্টা দেখিনি। গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়তোবা আরও বেশি ধনী হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কোনো দিক দিয়েই কমেনি।
আগের সরকারের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। বর্তমান সরকার যে পরিমার্জন এনেছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা কি রেখেছে?
আগের সরকার যা করেছে এবং বর্তমান সরকার যা করছে, আসলে তা হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগের সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করেছে। আর এই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চব্বিশের আন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটা সময় লাগে। ইতিহাসকে আসলে একটা সময় দিতে হয়। এটা সত্যি সত্যি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না, সেটা সময়ের আলোকে আসলে রেকটিফাই ও টেস্ট করতে হয়। মানে ফিল্টারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখনই এটা দেওয়ার মানে হলো, আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান, ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস তো ব্যবহার্য বিষয় না। ইতিহাস তো ধারণ করার বিষয়।
চব্বিশকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা মানেই হলো, আপনাদের কোনো লাভের বিষয় আছে। আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান টিস্যু পেপারের মতো। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আপনাদের হীন স্বার্থ হাসিলের ব্যবস্থা করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কাকে বাদ দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দকে বাদ দেওয়া যায়? এঁদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা দিয়ে ধর্ম ও জাতিভেদের ব্যাপারগুলো টেনে নিয়ে আসা ঠিক না। তাঁরা সময় দ্বারা পরীক্ষিত। ভালো মানের লোক দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সরকারের কি ম্যান্ডেট থাকতে পারে আমলাদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় যোগ বা বিয়োগ করার? তাদের এই যোগ ও বাদ দেওয়ার কোনোটাই সমর্থন করতে পারি না।
গত দেড় বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি করবে, লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো দলের জাতীয় নেতারা অন্যায় করলে সেটার প্রতিবাদ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে থাকবে, শিক্ষায় কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, গবেষণায় কীভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায়; শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত থাকবে এবং সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় বৃত্তের মধ্যে চলে যায়, তখন একটা দলের মধ্যে আটকে থাকলে তো তারা পুরো আকাশ দেখতে পাবে না। সে কারণে তারা সেই দলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে মাফ করে দেয়। আর অন্য দলের সামান্য অন্যায়কে বড় করে দেখে থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের চরিত্র হওয়া উচিত না। এই আকাঙ্ক্ষাটা জুলাই আন্দোলনের পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার ফিরে এসেছে। দলান্ধতা আবার বেড়ে
গেছে। কিন্তু সবার না। যেমন উগ্র ডানপন্থীদের কার্যক্রম প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করার জন্য তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখেন?
ছাত্র সংসদের কিছু দায়িত্ব আছে। তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না, সেগুলোর সবকিছু লিখিত না থাকলেও অধিকাংশ জনের কাছে সেগুলোর একটা ধারণা আছে। ছাত্র সংসদের কাজ তো ছিন্নমূল মানুষকে লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া না। ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয় বা কাউকে পেটানো না। তারা নিজেদের প্রশাসনের অংশ মনে করে। উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা আমাদেরই পার্ট।’ তা হতে পারে না।
ছাত্র সংসদের নির্ধারিত কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিষয়গুলো দেখভাল করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণাকে কীভাবে অগ্রসর করা যায়, কীভাবে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত করা যায়—এসব নিয়ে কাজ করা। উন্নত দেশের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রয়োজনে বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে বা গ্রাম থেকে যখন শিক্ষার্থীরা আসে, নতুন একটা শহর চেনার কথা না। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের কাজ আসলে এগুলোই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কলারশিপ পাবে, কে আর্থিকভাবে দুর্বল—এদের জন্যই তারা কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে এরা যা করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা দলকে কীভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করা যায়, সেগুলোতে তাদের মূল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে?
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সরকার তো নির্দলীয়। এই নির্দলীয় সরকার কি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকারের একাডেমিকভাবে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়েছে? সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় উপাচার্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনিক সব পদে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ডিনদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। গত সরকার যা করেছে, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা কি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন আশার আলো দেখাতে পারবে?
এই দেশে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যেহেতু দেশের শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের মান ভালো না, সেহেতু দেশের লক্ষ-কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কোনো সরকার কি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তার কত অংশ দেশে ফিরে আসছেন? এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে এই যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এটাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ড্রেন’। আমরা যাঁদের মেধাবী হিসেবে তৈরি করছি, তাঁদের সেবাটা পাচ্ছে না এ দেশ। তার চিত্রটা দেখা পাওয়া যায় রাস্তাঘাটে হাঁটলে। শুধু তা-ই না, এ দেশে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে থিয়েটার, টেলিভিশন, গানের শিল্পীসহ নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে গেছেন। সুতরাং শিক্ষক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণে দেশে মেধাবীদের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
একটা দেশ উন্নত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নির্দিষ্টসংখ্যক উচ্চ মানের মানুষের। এঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শরীরের রক্তশূন্যতার মতো। আমরা এখন সেই রক্তশূন্যতার মধ্যে ভুগছি। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ভালো করা না যায়, তাহলে দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। বেকারত্বের কারণেই দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আমার আবেদন বা অনুরোধ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তৈরি হয়। আগে উন্নত মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ, উন্নত মানুষের মাধ্যমেই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব। দালানকোঠা নির্মাণ করে দেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশ শিক্ষায় উন্নত না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পেরেছে। একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা দশের মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।

আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি।
১০ নভেম্বর ২০২৪
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৪ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৪ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগেসৈয়দা সাদিয়া শাহরীন

অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন—নির্বাচন হবে। কবে হবে? সে উত্তরটাও সুনির্ধারিতভাবে পাওয়া গেছে বছরের শেষ দিকে এসে। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। আকাঙ্ক্ষিত তফসিল। সারা বছর যাঁরা ‘নির্বাচন কবে হবে’—এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করেছেন, তাঁরা নির্বাচনের তারিখটা জেনে নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছেন। এবার বহুল আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনটা আসছে বছর ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেই ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হবে!
ভবিষ্যতের কথা থাক। লেখাটা আসলে এ বছরের আলোচিত ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিতে ছাপা হয়েছে, যেন অতীতের ভুল শুধরে নতুন বছরে আমরা ভালো কিছু করে এর সুফল ভোগ করতে পারি। ২০২৫ সালে এত ঘটনা ঘটে গেছে যে একে ‘ঘটনার ঘনঘটার বছর’ বললে নিশ্চয়ই দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ হবে না! দেখুন তো পাঠক, নিচের ঘটনাগুলো আপনার মনে পড়ছে কি না।
২. ২০২৫। সালটা ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে কেটেছে অনেকের। শিশু ধর্ষণ থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি—কী হয়নি এ বছর? অপরাধ যে কয়েক গুণ বেড়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা মাগুরার আট বছর বয়সী শিশুর ধর্ষণের বিচার চেয়েছিলাম। বছরের শুরুতে সেই শিশুর ওপর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল পুরো দেশ। তবু ঢাকার কেরানীগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। রাঙামাটিতে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে ষাট বছরের বৃদ্ধ। ঝিনাইদহে চকলেটের প্রলোভনে ধর্ষণের শিকার হয় চার বছর বয়সী শিশু।
৩. ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ নামের এক ব্যক্তির মাথা থেঁতলে মেরে ফেলা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল নেট দুনিয়ায়। ফুটেজটা কোনো দুঃস্বপ্ন হলেই ভালো হতো। কিন্তু না, বাস্তব ঘটনার সাক্ষী এটি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় একই রকমভাবে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। এলাকাবাসী সেদিন সাহসের পরিচয় দিয়ে রুখে দিয়েছেন হামলাকারীকে। চাঁদাবাজি নিয়ে মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল বলে দেশের মানুষ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল তখন।
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বছরের শুরুর দিকেই এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেশামুল হক হামলার শিকার হন। পরে বেরিয়ে আসে এই হামলার পেছনে হাত রয়েছে চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পাওয়া দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর। কারাগারে থাকতেই যেখানে তাঁরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়, সেখানে তাঁদের জামিন দেওয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, তা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই জনগণ নির্ধারণ করে ফেলেছে।
৪. সোনার দাম যেভাবে এ বছর বেড়েছে, তা এক ব্যাপার বটে! এর চেয়েও বড় ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল যখন এক ব্যবসায়ী নিজের সোনার দোকানে নিজেই ডাকাতি করিয়ে ‘কট’ খেয়ে যান। মানিকগঞ্জ শহরের স্বর্ণকারপট্টি এলাকায় শুভ দাস লোক ভাড়া করে নিজের দোকানে ডাকাতির নাটক সাজিয়ে গ্রাহকদের স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি তাঁর এই চালাকি।
তবে রাজধানীর বনশ্রীর ঘটনাটি দুঃখজনক ছিল। আনোয়ার হোসেন নামে এক সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে ১৬০ ভরি সোনা ও এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছয়-সাতজন দুর্বৃত্ত।
৫. আপনারা হয়তো কোনো কমেডি সিনেমায় দেখে থাকবেন, ছিনতাইকারী শুধু টাকাপয়সা বা ফোন ছিনতাই করে না, গায়ের জামা-পায়ের জুতা সবই নিয়ে চলে যায়। রাজধানীর শ্যামলীতে সত্যিই যখন এ রকম একটি ঘটনা ঘটল, তখন এর সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি জব্দ করা হয় ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও চাপাতি। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে মেলে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছিনতাইকারী চক্রটি চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়া দেয় মাঠপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের। প্রতিদিন ঢাকার একাধিক এলাকায় চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে ছিনতাই কার্যক্রম চালায় চক্রটি। চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় না তাদের, ছিনতাই শেষে মালপত্র বিক্রির পর ভাড়া দিতে হয়। এমনকি ছিনতাইয়ের মালপত্র বিক্রিও করতে হয় ছিনতাইকারী চক্রের মূল হোতাদের কাছে। ছিনতাই করার এক আধুনিক প্যাকেজ বটে!
বছরজুড়ে মোহাম্মদপুর এলাকাটিও কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনার জন্য এক আতঙ্কের জায়গা হয়ে রয়েছে। যখন-তখন চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসা তরুণেরা এলাকাটির ত্রাস। পুলিশ তৎপরতা না বাড়ালে সেখানকার অপরাধ চলতেই থাকবে।
৬. বছরের আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড ছিল প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারভেজ হত্যাকাণ্ড। শুধু হাসির ‘অপরাধে’ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।
বাড্ডায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে। পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পল্লবীতে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে প্রবেশ করে মুখোশ ও হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়াকে। চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে বিএনপি-সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কারণ নাকি ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত শত্রুতা রয়েছে—সবই জটিল রহস্যে মুড়ে আছে।
লক্ষ্মীপুরে বিএনপির নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু পুরো দেশকেই মর্মাহত করেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বর্বরতার সব মাত্রা যেন ছাড়িয়ে গেছে। কবর থেকে উঠিয়ে নুরাল পাগলার লাশ পুড়িয়ে তথাকথিত মব কী অর্জন করতে পেরেছে, তা এক রহস্য। মবের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংবাদমাধ্যমও। একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে সংবাদকর্মীরা।
নাটকীয় কায়দায় যেভাবে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদিকে দিনদুপুরে গুলি করা হলো, তা এই বছরটির জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যুর পর সারা দেশ এখনো জনরোষে ফুঁসছে, বিচার চাইছে সবাই। কিন্তু বিচার কার হবে? পলাতক হত্যাকারীকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা হোক। তবেই না হবে বিচার।
৭. ২০২৫ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা কোনটি? এর উত্তরে বলতে হয়—বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর দেশে ফিরেছেন। ফিরেই মাটির স্পর্শ নিয়েছেন। জানিয়েছেন দেশ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা। তাঁকে সংবর্ধনা দিতে মানুষের যে ঢল নেমেছিল ঢাকার পূর্বাচলের পথে, তা প্রত্যাবর্তনের এক অভূতপূর্ব দৃশ্য বলে মেনে নিতে হয়।
আবার সেই নির্বাচনে ফিরে আসা যাক। তারেক রহমানের আগমনে দেশের রাজনৈতিক পট কতটা আর কীভাবে পরিবর্তন হবে, তা সময় বলে দেবে। নির্বাচনের ওপর কেমন আর কতটা প্রভাব পড়বে, তা-ও সময়ই বলে দেবে। কিন্তু নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন এ বছর যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা কিংবা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা নতুন বছরে ঠেকানো যাবে কি না। কারণ,
দেশের হাল যাঁরা ধরবেন, দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা তো তাঁদেরই হাতে থাকবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তাঁরা থাকবেন জনগণের হৃদয়ে। হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া কি খুব কঠিন?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন—নির্বাচন হবে। কবে হবে? সে উত্তরটাও সুনির্ধারিতভাবে পাওয়া গেছে বছরের শেষ দিকে এসে। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। আকাঙ্ক্ষিত তফসিল। সারা বছর যাঁরা ‘নির্বাচন কবে হবে’—এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করেছেন, তাঁরা নির্বাচনের তারিখটা জেনে নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছেন। এবার বহুল আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনটা আসছে বছর ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেই ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হবে!
ভবিষ্যতের কথা থাক। লেখাটা আসলে এ বছরের আলোচিত ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিতে ছাপা হয়েছে, যেন অতীতের ভুল শুধরে নতুন বছরে আমরা ভালো কিছু করে এর সুফল ভোগ করতে পারি। ২০২৫ সালে এত ঘটনা ঘটে গেছে যে একে ‘ঘটনার ঘনঘটার বছর’ বললে নিশ্চয়ই দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ হবে না! দেখুন তো পাঠক, নিচের ঘটনাগুলো আপনার মনে পড়ছে কি না।
২. ২০২৫। সালটা ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে কেটেছে অনেকের। শিশু ধর্ষণ থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি—কী হয়নি এ বছর? অপরাধ যে কয়েক গুণ বেড়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা মাগুরার আট বছর বয়সী শিশুর ধর্ষণের বিচার চেয়েছিলাম। বছরের শুরুতে সেই শিশুর ওপর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল পুরো দেশ। তবু ঢাকার কেরানীগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। রাঙামাটিতে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে ষাট বছরের বৃদ্ধ। ঝিনাইদহে চকলেটের প্রলোভনে ধর্ষণের শিকার হয় চার বছর বয়সী শিশু।
৩. ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ নামের এক ব্যক্তির মাথা থেঁতলে মেরে ফেলা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল নেট দুনিয়ায়। ফুটেজটা কোনো দুঃস্বপ্ন হলেই ভালো হতো। কিন্তু না, বাস্তব ঘটনার সাক্ষী এটি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় একই রকমভাবে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। এলাকাবাসী সেদিন সাহসের পরিচয় দিয়ে রুখে দিয়েছেন হামলাকারীকে। চাঁদাবাজি নিয়ে মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল বলে দেশের মানুষ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল তখন।
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বছরের শুরুর দিকেই এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেশামুল হক হামলার শিকার হন। পরে বেরিয়ে আসে এই হামলার পেছনে হাত রয়েছে চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পাওয়া দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর। কারাগারে থাকতেই যেখানে তাঁরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়, সেখানে তাঁদের জামিন দেওয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, তা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই জনগণ নির্ধারণ করে ফেলেছে।
৪. সোনার দাম যেভাবে এ বছর বেড়েছে, তা এক ব্যাপার বটে! এর চেয়েও বড় ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল যখন এক ব্যবসায়ী নিজের সোনার দোকানে নিজেই ডাকাতি করিয়ে ‘কট’ খেয়ে যান। মানিকগঞ্জ শহরের স্বর্ণকারপট্টি এলাকায় শুভ দাস লোক ভাড়া করে নিজের দোকানে ডাকাতির নাটক সাজিয়ে গ্রাহকদের স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি তাঁর এই চালাকি।
তবে রাজধানীর বনশ্রীর ঘটনাটি দুঃখজনক ছিল। আনোয়ার হোসেন নামে এক সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে ১৬০ ভরি সোনা ও এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছয়-সাতজন দুর্বৃত্ত।
৫. আপনারা হয়তো কোনো কমেডি সিনেমায় দেখে থাকবেন, ছিনতাইকারী শুধু টাকাপয়সা বা ফোন ছিনতাই করে না, গায়ের জামা-পায়ের জুতা সবই নিয়ে চলে যায়। রাজধানীর শ্যামলীতে সত্যিই যখন এ রকম একটি ঘটনা ঘটল, তখন এর সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি জব্দ করা হয় ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও চাপাতি। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে মেলে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছিনতাইকারী চক্রটি চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়া দেয় মাঠপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের। প্রতিদিন ঢাকার একাধিক এলাকায় চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে ছিনতাই কার্যক্রম চালায় চক্রটি। চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় না তাদের, ছিনতাই শেষে মালপত্র বিক্রির পর ভাড়া দিতে হয়। এমনকি ছিনতাইয়ের মালপত্র বিক্রিও করতে হয় ছিনতাইকারী চক্রের মূল হোতাদের কাছে। ছিনতাই করার এক আধুনিক প্যাকেজ বটে!
বছরজুড়ে মোহাম্মদপুর এলাকাটিও কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনার জন্য এক আতঙ্কের জায়গা হয়ে রয়েছে। যখন-তখন চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসা তরুণেরা এলাকাটির ত্রাস। পুলিশ তৎপরতা না বাড়ালে সেখানকার অপরাধ চলতেই থাকবে।
৬. বছরের আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড ছিল প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারভেজ হত্যাকাণ্ড। শুধু হাসির ‘অপরাধে’ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।
বাড্ডায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে। পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পল্লবীতে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে প্রবেশ করে মুখোশ ও হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়াকে। চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে বিএনপি-সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কারণ নাকি ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত শত্রুতা রয়েছে—সবই জটিল রহস্যে মুড়ে আছে।
লক্ষ্মীপুরে বিএনপির নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু পুরো দেশকেই মর্মাহত করেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বর্বরতার সব মাত্রা যেন ছাড়িয়ে গেছে। কবর থেকে উঠিয়ে নুরাল পাগলার লাশ পুড়িয়ে তথাকথিত মব কী অর্জন করতে পেরেছে, তা এক রহস্য। মবের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংবাদমাধ্যমও। একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে সংবাদকর্মীরা।
নাটকীয় কায়দায় যেভাবে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদিকে দিনদুপুরে গুলি করা হলো, তা এই বছরটির জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যুর পর সারা দেশ এখনো জনরোষে ফুঁসছে, বিচার চাইছে সবাই। কিন্তু বিচার কার হবে? পলাতক হত্যাকারীকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা হোক। তবেই না হবে বিচার।
৭. ২০২৫ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা কোনটি? এর উত্তরে বলতে হয়—বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর দেশে ফিরেছেন। ফিরেই মাটির স্পর্শ নিয়েছেন। জানিয়েছেন দেশ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা। তাঁকে সংবর্ধনা দিতে মানুষের যে ঢল নেমেছিল ঢাকার পূর্বাচলের পথে, তা প্রত্যাবর্তনের এক অভূতপূর্ব দৃশ্য বলে মেনে নিতে হয়।
আবার সেই নির্বাচনে ফিরে আসা যাক। তারেক রহমানের আগমনে দেশের রাজনৈতিক পট কতটা আর কীভাবে পরিবর্তন হবে, তা সময় বলে দেবে। নির্বাচনের ওপর কেমন আর কতটা প্রভাব পড়বে, তা-ও সময়ই বলে দেবে। কিন্তু নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন এ বছর যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা কিংবা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা নতুন বছরে ঠেকানো যাবে কি না। কারণ,
দেশের হাল যাঁরা ধরবেন, দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা তো তাঁদেরই হাতে থাকবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তাঁরা থাকবেন জনগণের হৃদয়ে। হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া কি খুব কঠিন?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি।
১০ নভেম্বর ২০২৪
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৪ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৪ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হলো নির্বাচনের ব্যয়।
সুস্থ গণতন্ত্রের প্রধান অন্তরায় হলো টাকার রাজনীতি। নির্বাচনী ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে নির্বাচন-পরবর্তী দুর্নীতি রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচনের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, বিজয়ীরা ক্ষমতায় গিয়ে সুদে-আসলে সেই অর্থ জনগণের পকেট থেকেই আদায় করার চেষ্টা করেন।
নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন অনেকগুলো যুগোপযোগী সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এই সুপারিশগুলোর একটি বড় অংশই উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন করে নিবিড় নজরদারি করার প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়া একটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি করতে পারে ভবিষ্যতে।
‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি আগে থেকেই শিকড় গেড়ে আছে। যখন একজন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা খরচ করে মনোনয়ন কেনেন এবং নির্বাচনে লড়েন, তখন জনসেবা নয় বরং ‘বিনিয়োগের মুনাফা’ তোলাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎস।
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় উপেক্ষার কারণে ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যেরও কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে বুঝতে হবে যে, লোকদেখানো সংস্কার দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, তা কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রায়ণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার হয়তো নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কার করা সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের বৈঠকে বিভিন্ন দলের নেতাদের মতামত নেওয়ার জন্য চা-নাশতা বাবদ রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল যে আসেনি, তা পরবর্তী সময়ে কমিশনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিরসন করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের পরে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার কোনো বিলাসিতার বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার অপরিহার্য শর্ত। সরকারকে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে এবং সংস্কার কমিশনের বাকি সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে একটি প্রকৃত অর্থবহ পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় ভোটের নামে অর্থের খেলা চলবেই এবং দুর্নীতি নামক দানবটি আমাদের শাসনব্যবস্থাকে কুরে কুরে খেতে থাকবে।

সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হলো নির্বাচনের ব্যয়।
সুস্থ গণতন্ত্রের প্রধান অন্তরায় হলো টাকার রাজনীতি। নির্বাচনী ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে নির্বাচন-পরবর্তী দুর্নীতি রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচনের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, বিজয়ীরা ক্ষমতায় গিয়ে সুদে-আসলে সেই অর্থ জনগণের পকেট থেকেই আদায় করার চেষ্টা করেন।
নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন অনেকগুলো যুগোপযোগী সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এই সুপারিশগুলোর একটি বড় অংশই উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন করে নিবিড় নজরদারি করার প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়া একটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি করতে পারে ভবিষ্যতে।
‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি আগে থেকেই শিকড় গেড়ে আছে। যখন একজন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা খরচ করে মনোনয়ন কেনেন এবং নির্বাচনে লড়েন, তখন জনসেবা নয় বরং ‘বিনিয়োগের মুনাফা’ তোলাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎস।
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় উপেক্ষার কারণে ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যেরও কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে বুঝতে হবে যে, লোকদেখানো সংস্কার দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, তা কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রায়ণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার হয়তো নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কার করা সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের বৈঠকে বিভিন্ন দলের নেতাদের মতামত নেওয়ার জন্য চা-নাশতা বাবদ রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল যে আসেনি, তা পরবর্তী সময়ে কমিশনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিরসন করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের পরে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার কোনো বিলাসিতার বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার অপরিহার্য শর্ত। সরকারকে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে এবং সংস্কার কমিশনের বাকি সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে একটি প্রকৃত অর্থবহ পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় ভোটের নামে অর্থের খেলা চলবেই এবং দুর্নীতি নামক দানবটি আমাদের শাসনব্যবস্থাকে কুরে কুরে খেতে থাকবে।

আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি।
১০ নভেম্বর ২০২৪
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৪ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৪ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।
গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।
বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।
এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।
গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।
বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।
এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি।
১০ নভেম্বর ২০২৪
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৪ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৪ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৪ ঘণ্টা আগে