Ajker Patrika

মিটফোর্ড থেকে ছেলের লাশ বুড়িগঙ্গায় ফেলার হুমকি দেওয়া হয়—শহীদ মোস্তাকিমের বাবার সাক্ষ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চাঁনখারপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন আরও দুজন। তাঁরা হলেন চাঁনখারপুলে ৫ আগস্ট শহীদ হওয়া সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ মোস্তাকিমের বাবা শেখ জামাল হাসান ও শেখ বোরহানউদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আঞ্জুয়ারা ইয়াসমিন।

আজ মঙ্গলবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১-এ তাঁদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। পরে তাঁদের জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। পরবর্তী সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য আগামীকাল বুধবার দিন ধার্য করা হয়েছে।

এর আগে এই মামলায় সাক্ষ্য দেন শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ।

জবানবন্দিতে মোস্তাকিমের ৫৪ বছর বয়সী বাবা শেখ জামাল হাসান বলেন, ‘আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের নাম নাফিসা নাওয়াল। বয়স ১৮। আমার ছেলে গেন্ডারিয়া উইল পাওয়ার স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমি, আমার ছেলে ও আমার পরিবারের সদস্যরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা এই আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। ৫ আগস্ট সকালে আমার ছেলে শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ মোস্তাকিম তার বন্ধু সিয়ামকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়। আমার স্ত্রী আর মেয়েও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণ করে।

‘দুপুরে আমার শ্যালক আসিফ আমাকে মোবাইল ফোনে ছেলে মোস্তাকিমের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর দেয়। আমি বাসায় গিয়ে দেখি, আমার ভাই আবদুর রহমানের ফ্লাটে আমার ছেলে মোস্তাকিমের নিথর দেহ পড়ে রয়েছে। আমি লক্ষ করে দেখলাম, তার বাম চোখে গুলি লেগে মাথার পেছন দিকে বড় গর্ত হয়ে বের হয়ে গেছে।

‘আমি আমার ছেলের বন্ধু সিয়াম আর রূপগঞ্জের আব্দুর রউফসহ আরও কয়েকজন ছাত্রকে সেখানে দেখি। সিয়াম জানায়, আমার ছেলে চাঁনখারপুল নবাব কাটারা এলাকায় হানিফ ফ্লাইওভারের ঢালে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের পেছনের রাস্তায় মিছিলরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। সে আরও জানায়, শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজের দিক থেকে পুলিশ মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে এবং সেই গুলিতে আমার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। পরে কয়েকজন ছাত্র মিলে রিকশায় করে ছেলেকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করে। সিয়াম আরও জানায়, হাসপাতালের চিকিৎসকদের পীড়াপীড়িতে তারা দ্রুত লাশ বাসায় নিয়ে আসে। চিকিৎসকেরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে, লাশ হাসপাতালে রাখা যাবে না। তাড়াতাড়ি লাশ না নিয়ে গেলে তারা বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে দিয়ে দেবে নয়তো বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয়।’

শেখ জামাল হাসান আরও বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা থানার এডিসি আক্তারুল ইসলাম, মো. ইমরুল, এরশাদের নির্দেশে ৪০–৫০ জন পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এর মধ্যে কনস্টেবল সুজন ও নাসিরুল টার্গেট করে আমার ছেলেকে এবং মিছিলের ওপর গুলি করে।’

এ সময় ট্রাইব্যুনালে অঝোরে কেঁদে ওঠেন শেখ জামাল হাসান। আর্তনাদ করে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে ১০ পারা কোরআনের হাফেজ ছিল। ওর কী অপরাধ ছিল? আমি ছেলে হারানোর বেদনায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। আমার ১৪ বছর বয়সী একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে আমি ও আমার স্ত্রী পাগলের মতো জীবন যাপন করছি। আমি আসামিদের বিচার চাই। আমি আসামিদের ফাঁসি চাই।’

বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত ভিডিওর মাধ্যমে আসামিদের নাম জেনেছেন বলে ট্রাইব্যুনালকে জানান তিনি।

ট্রাইব্যুনালে এরপর রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে শেখ বোরহানউদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আঞ্জুয়ারা ইয়াসমিন গত বছরের ৫ আগস্ট তাঁর বাসার ছাদ থেকে দেখা চাঁনখারপুলের পরিস্থিতির বর্ণনা দেন।

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘ওই দিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। চাঁনখারপুল মোড়েই আমার বাসা। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, পুলিশ মাইকে স্থানীয় লোকজনকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করছে। আমি আমার ছাত্রদের ফোন করে কর্মসূচির বিষয়ে জানতে পারি যে তারা শহীদ মিনারে প্রবেশের চেষ্টা করছে, কিন্তু পুলিশ দিচ্ছে না।

‘সকাল ৯টার দিকে বাসার ছাদে উঠে দেখি, চাঁনখারপুল মোড়ে ছাত্র-জনতা সবাইকে বের হয়ে আসার জন্য আহ্বান করছে। ওই সময় পুলিশের কয়েকটি গাড়ি আসে এবং গুলি করতে থাকে। তখন আন্দোলনকারীরা হোসনে দালান রোড, নাজিমুদ্দিন রোডসহ আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নেয়। পুলিশ বিভিন্ন দিকে থাকা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে অনবরত গুলি ছুড়তে থাকে। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে চাঁনখারপুলের নিমতলী গলির বাকরখানি দোকানের সামনে একটি ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায়। তারপর আন্দোলনকারীরা তাকে অটোরিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

‘এর কিছুক্ষণ আগে আমি নবাব কাটরা গলিতে রাস্তার ওপর রক্ত দেখতে পাই। ছাদে আমার সঙ্গে থাকা একজন বলে, পুলিশের গুলিতে সেখানে একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে, ওই রক্ত তার। আমি আমার বাসার ছাদ থেকে ওই দিনের বেশ কিছু ঘটনা আমার মোবাইল ফোনে ধারণ করি। সন্ধ্যার দিকে আমি বোরহানউদ্দিন কলেজে যাই এবং কলেজ গেটের সামনে রক্ত দেখতে পাই। পরে জানতে পারি, সেখানেও একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে জানতে পারি, আমার কলেজের অনেক ছাত্রছাত্রী এই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে।’

আঞ্জুয়ারা ইয়াসমিন আরও বলেন, ‘আমি পত্রপত্রিকা, টিভি নিউজ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, ডিএমপি কমিশনারসহ অন্যদের নির্দেশে গুলি চালানার ঘটনা ঘটেছে। যেভাবে হাজার হাজার আন্দোলনকারী ও কোমলমতি শিশুদের হত্যা ও আহত করা হয়েছে, আমি এর বিচার চাই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...