Ajker Patrika

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

কে জিতছেন, কেন জিতছেন

জাহীদ রেজা নূর, নিউইয়র্ক থেকে
কমলা নাকি ট্রাম্প—কে করবেন শাসন তা বেছে নিতে ভোট দিলেন ভোটাররা। গতকাল নিউইয়র্কে ভোট দিতে আসেন এক নারী। ছবি: এএফপি
কমলা নাকি ট্রাম্প—কে করবেন শাসন তা বেছে নিতে ভোট দিলেন ভোটাররা। গতকাল নিউইয়র্কে ভোট দিতে আসেন এক নারী। ছবি: এএফপি

এই লেখাটি যখন তৈরি হচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ৪ নভেম্বরের রাত সাড়ে ৯টা। বাংলাদেশ ততক্ষণে ৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার দেখা পেয়েছে। লেখাটি যখন ছাপা হবে ততক্ষণে মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল একটু একটু করে প্রকাশ পেতে থাকবে। বিজয়ের পাল্লা কমলা হ্যারিস নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকছে, সেটা আজকের পত্রিকার পাঠক ততক্ষণে জেনে যাবেন।

তাই এই লেখাটি তৈরি হবে নির্বাচনের আগের কিছু কথা নিয়ে। কোন কথা ফলল, তা এই লেখা দেখে সবাই একটু ঝালিয়ে নিতে পারেন। মিলিয়ে দেখতে পারেন, জয়ের ব্যাপারে যে ভবিষ্যদ্বাণী দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো ফলছে কি না।

ট্রাম্পের বিজয়ের ব্যাপারে পাঁচটি কারণ দেখানো হয়েছিল। প্রথমেই বলা হয়েছিল, দেশজুড়ে এই মুদ্রাস্ফীতির কালে ট্রাম্প ক্ষমতায় নেই, সেটাই তাঁর বিজয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। দেশের অর্থনীতি যে ভালো নেই, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। প্রতিদিন বাড়তি মূল্য দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার কারণে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টের প্রতি নাখোশ হচ্ছে জনগণ। করোনার মতো ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্নের পর মুদ্রাস্ফীতি যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা সত্তরের দশকের পর যুক্তরাষ্ট্র আর কখনোই দেখেনি। এ কারণেই ট্রাম্প জনগণকে এই প্রশ্নটি স্বচ্ছন্দে করতে পারছেন, ‘আপনারা কি চার বছর আগের তুলনায় এখন ভালো আছেন?’

না, ভালো নেই। চার বছর আগেই তো ট্রাম্প ক্ষমতা হারিয়েছিলেন বাইডেনের কাছে।

২০২৪ সালে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। করোনার প্রভাবে মুদ্রাস্ফীতি তার একটি বড় কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের এক-চতুর্থাংশ মানুষ কেবল দেশের অগ্রগতি হচ্ছে বলে মনে করেন। বাকিরা চাইছেন এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার।

ট্রাম্পের একটা ইতিবাচক দিক হলো, নানা ধরনের স্ক্যান্ডালের পরও তাঁর জনপ্রিয়তা কখনো ৪০ শতাংশের নিচে নামেনি। ২০২১ সালে ক্যাপিটলের ঘটনায় ফৌজদারি মামলা হওয়ার পরও ৪০ শতাংশ মানুষ তাঁর ওপর সমর্থন বজায় রেখেছে। যখন ডেমোক্র্যাটরা এবং রিপাবলিকান দলের একটি অংশ ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার অযোগ্য বলে মনে করছেন, তখন রিপাবলিকান সমর্থকেরা ট্রাম্পকে ‘উইচ হান্টিং-এর শিকার’ বলে মনে করছেন। জনমত জরিপে কমলা আর ট্রাম্পের অবস্থান সমানে সমান। তাই ট্রাম্প আক্রোশের শিকার—এই কথা প্রচার করতে পারলে এবং এ কারণে তাঁর দিকে দোদুল্যমানদের ভোট গেলে ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা আছে।

অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় ট্রাম্পকে ভোটারদের বহুলাংশে সমর্থন করে। বাইডেনের শাসনামলে অবৈধ অভিবাসীদের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে, এটাই ট্রাম্পের জন্য ট্রাম্প কার্ড হয়ে উঠতে পারে।

উচ্চশিক্ষিত নন, এ রকম ভোটাররা একটু বেশি সংখ্যায় ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে গেলে ট্রাম্পের ভাগ্য খুলবে। এই শ্রেণির মানুষই মনে করে থাকেন, তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন, তাঁদের মনে রাখেনি সরকার। ফলে তাঁদের ভোট অবধারিতভাবে যাবে ট্রাম্পের দিকে। সম্প্রতি দেখা গেছে, এ কারণেই ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নেতৃত্ব ডেমোক্র্যাটদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, রিপাবলিকানরা সেখানে জায়গা করে নিচ্ছেন।

গ্রাম ও উপশহরের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে পারলে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের দিকে পা বাড়িয়ে রাখতেই পারেন।

অস্থিতিশীল হয়ে আছে পৃথিবী। এ সময় শক্তিশালী নেতৃত্ব পছন্দ করে মানুষ। এই হিসেবে ট্রাম্পকে শক্তিশালী মানুষ হিসেবেই মনে করে থাকেন বিশ্বনেতারা। ট্রাম্প বলে থাকেন, তিনি হোয়াইট হাউসে থাকাকালীন কোনো বড় যুদ্ধে জড়ায়নি যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বহু মার্কিন নাগরিক এ সময় ইউক্রেন ও ইসরায়েলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা অপচয় করছে বলে বাইডেনের প্রতি নাখোশ হয়ে আছেন।

পুরুষ ভোটারদের এক অংশ স্রেফ পুরুষ হওয়ার কারণেই ট্রাম্পকে ভোট দেবেন।

এ তো গেল ট্রাম্পের পক্ষের কথা। কমলার বিজয়ের পক্ষেও রয়েছে এ রকম পাঁচটি কারণ। একেবারে প্রথম কারণটি হলো, কমলা ট্রাম্প নন। ট্রাম্পের মতো যখন-তখন যেকোনো কথা বলে ফেলেন না তিনি। যা বলেন, যুক্তি দিয়ে ভেবেচিন্তে বলেন। ২০২০ সালে যখন রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে রেকর্ডসংখ্যক ভোট পেয়েছিলেন ট্রাম্প, তখন সে নির্বাচনে কিন্তু ৭০ লাখ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন বাইডেন। আর এবার কমলা হ্যারিস তো বলে যাচ্ছেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় গেলে কী সর্বনাশই-না হবে যুক্তরাষ্ট্রের। ট্রাম্পকে ফ্যাসিস্ট এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলেও প্রচারণা চালিয়েছেন কমলা। বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে, অনেকেই মনে করেন, দেশটি বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। এই ভোটারদের কেউ কেউ যদি দেশকে নির্দিষ্ট পথে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কমলার ওপর নির্ভর করে থাকেন, তাহলে কমলার জয় ঠেকানো যাবে না।

কমলা বাইডেনও নন। এটাও তাঁর একটি ইতিবাচক দিক। বাইডেন যদি শেষপর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকতেন, তাহলে ডেমোক্র্যাট শিবির মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যেত যে ট্রাম্পই হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। বাইডেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডেমোক্র্যাটরা সংঘবদ্ধ হয়ে কমলার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে নির্ঘাত পরাজয়ের জায়গায় নিজেরা আবারও জয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারছে।

নারীদের ব্যাপারে ইতিবাচকভাবে সোচ্চার কমলা। দেশের নারী ভোটারদের বহুলাংশই কমলাকে ভোট দেবেন। ২০২২ সালে গর্ভপাতবিরোধী সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর এই প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হচ্ছে। ফলে নারীরা তাঁদের সুস্পষ্ট অবস্থান নিশ্চয়ই পরিষ্কার করতে চাইবেন এই নির্বাচনে। তা ছাড়া দেশ প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পেতে যাচ্ছে—এই জায়গা থেকেও নারীদের ভোট কমলার দিকে যাবে।

বলা হচ্ছে, বর্ষীয়ান মানুষ ও উচ্চশিক্ষিত সম্প্রদায়ের ভোট যাবে কমলার বাক্সে। এই শ্রেণির মানুষ ভোটকেন্দ্রে এসে থাকেন। অপর দিকে ট্রাম্প মূলত তরুণ ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়। এই তরুণ ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনীহ থাকে। নিউইয়র্ক টাইমস/সিয়েনা পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, কমলা ট্রাম্পের কাছে পিছিয়ে আছেন সেই শ্রেণির ভোটারদের কারণে, যাঁরা নিবন্ধিত ভোটার কিন্তু ২০২০ সালে ভোট দিতে যাননি।

আরও একটি কারণে কমলা জয়ী হতে পারেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে অনেক টাকা খরচ করেছেন। কমলা নির্বাচনী যুদ্ধে নেমেছেন জুলাই মাসে, এরপরই তিনি নির্বাচনী তহবিল হিসেবে এই টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছেন। অপর দিকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকেই ট্রাম্প নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করছিলেন। কিন্তু কমলার মতো এত টাকা সংগ্রহ করতে পারেননি।

দুই দিকের যুক্তিগুলো দেওয়া হলো। এই লেখা পড়ার সময়ই হয়তো যুক্তিগুলোর কোনটি বাস্তবিক অর্থে কাজ করেছে, তা জেনে যাবেন আপনি। জেনে যাবেন, পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো বিষ্ণু মূর্তি, নিন্দা জানাল ভারত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মূর্তিটি ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত
মূর্তিটি ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া সীমান্তে দুই দেশের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ এলাকায় ভগবান বিষ্ণুর একটি মূর্তি ধ্বংসের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে ভারত। আজ বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ঘটনাকে একটি ‘অসম্মানজনক কাজ’ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং সংশ্লিষ্ট দুই দেশকেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসার আহ্বান জানিয়েছে।

কম্বোডিয়ার প্রিয়া বিহার প্রদেশের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, গত সোমবার (২২ ডিসেম্বর) থাই সামরিক বাহিনী একটি এক্সকাভেটর ব্যবহার করে ভগবান বিষ্ণুর মূর্তিটি গুঁড়িয়ে দেয়।

বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূর্তিটি ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। এটি সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ মিটার ভেতরে কম্বোডিয়ার আন সেস এলাকায় অবস্থিত ছিল।

প্রিয়া বিহারের মুখপাত্র লিম চানপানহা এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘বৌদ্ধ ও হিন্দু অনুসারীদের কাছে পূজনীয় প্রাচীন মন্দির ও মূর্তি ধ্বংসের এই ঘটনা আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না।’ তবে থাইল্যান্ডের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে বলেন, সীমান্ত বিরোধের জের ধরে এ ধরনের কাজ অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, ‘ভূখণ্ড নিয়ে দাবি যাই থাকুক না কেন, এ ধরনের অসম্মানজনক কাজ বিশ্বজুড়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। এমন ঘটনা ঘটা উচিত নয়।’

ভারত আবারও উভয় পক্ষকে শান্তি বজায় রাখতে এবং জানমাল ও ঐতিহ্যের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সংলাপ ও কূটনীতির পথে ফেরার অনুরোধ জানিয়েছে।

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের। ঔপনিবেশিক আমলের সীমানা নির্ধারণকে কেন্দ্র করে এই বিরোধের শুরু। গত জুলাইয়ে পাঁচ দিনের লড়াইয়ে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়েছিল। গত ডিসেম্বরে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাতে এ পর্যন্ত ৪০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

বুধবার থেকে উভয় দেশের সামরিক কর্মকর্তারা আবারও যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন।

বিষ্ণু মূর্তি ধ্বংসের এই ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মহল আশা করছে, সংঘাতের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমেই এই সংকটের সমাধান হবে। হিন্দু ও বৌদ্ধ দেবতারা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র এবং এটি আমাদের অভিন্ন সভ্যতা ও ঐতিহ্যের অংশ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গাজায় ধ্বংসস্তূপের মাঝেই বড়দিনের আনন্দ খুঁজছে ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
গত ২১ ডিসেম্বর গাজা সিটিতে ক্রিসমাস উদযাপনের আগে হলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক চার্চের বাইরে গাজার শিশু ও সন্ন্যাসিনীরা। ছবি: এপির সৌজন্যে
গত ২১ ডিসেম্বর গাজা সিটিতে ক্রিসমাস উদযাপনের আগে হলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক চার্চের বাইরে গাজার শিশু ও সন্ন্যাসিনীরা। ছবি: এপির সৌজন্যে

গাজা উপত্যকায় গত দুই বছর ধরে চলা ধ্বংসলীলা আর লাশের মিছিলের মাঝেও বড়দিনের আনন্দ ফিরে পাওয়ার এক বিষাদময় চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানকার ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়। একটি নড়বড়ে যুদ্ধবিরতি কিছুটা স্বস্তি দিলেও, ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি আর বাস্তুচ্যুত মানুষের হাহাকার অনেক ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে ম্লান করে দিয়েছে।

৭৬ বছর বয়সী আত্তাল্লাহ তরাজি সম্প্রতি বড়দিনের উপহার হিসেবে এক জোড়া মোজা আর স্কার্ফ পেয়েছেন। গাজার কনকনে শীত থেকে বাঁচতে এগুলোই এখন তাঁর বড় সম্বল। গির্জার অন্যান্য সদস্যদের সাথে তরাজি যখন গাইলেন—‘খ্রিস্টের জন্ম হয়েছে, হালেলুইয়া’ (একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ প্রভুর প্রশংসা), তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার বিভীষিকা ঢাকা পড়েছিল বিশ্বাসের সুরে।

গাজার সেন্ট্রাল সিটি এলাকার ‘হলি ফ্যামিলি চার্চ’ কম্পাউন্ডে আশ্রয় নেওয়া তরাজি বলেন, ‘আমরা এই পবিত্র মুহূর্তে যুদ্ধ, বিপদ আর বোমাবর্ষণের কথা ভুলে যেতে চাই। খ্রিস্টের জন্মের আনন্দ আমাদের সব তিক্ততাকে ছাপিয়ে যাক।’

তবে সবার জন্য উৎসবের অনুভূতি এক নয়। শাদি আবু দাউদের জন্য এবারের বড়দিনটি অত্যন্ত কষ্টের। গত জুলাই মাসে এই ক্যাথলিক চার্চ কম্পাউন্ডেই ইজরায়েলি হামলায় তাঁর মা নিহত হন ও ছেলে আহত হয়। ইজরায়েল একে ‘দুর্ঘটনা’ বলে দুঃখ প্রকাশ করলেও স্বজন হারানোর ক্ষত এখনও দগদগে। আবু দাউদ বলেন, জখম এখনও কাঁচা। এখানে কোনো উৎসব নেই, আমরা এখনও ‘না যুদ্ধ না শান্তি’র এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে বাস করছি।

গাজার প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে খ্রিস্টানদের সংখ্যা এখন নগণ্য। যুদ্ধের কারণে অনেক পরিবার দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ২৩ বছর বয়সী ওয়াফা ইমাদ এলসায়েঘ জানান, বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়রা না থাকায় আগের মতো আমেজ নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিবার নিয়ে সাজসজ্জা করছি ঠিকই, কিন্তু যাদের সাথে সব আনন্দ ভাগ করে নিতাম, তারা আজ গাজায় নেই। এই পরিবেশ আগের মতো করে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।’

৩৫ বছর বয়সী মা এলিনোর আমাশ তাঁর সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে ঘরে বড়দিনের গাছ (ক্রিসমাস ট্রি) সাজিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানেরা কিছু চকলেট আর মিষ্টি পেয়ে বোমার ভয় ছাড়া শ্বাস নিতে পারছে। কিন্তু তাবুগুলোতে বসবাসকারী মানুষের কষ্ট দেখে চোখে জল আসে।’

গাজার খ্রিস্টানরা মনে করেন, তাঁরা সংখ্যায় যত কমই হোক না কেন, এটি এই ভূমির প্রতি ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের এক অটল সাক্ষ্য। আত্তাল্লাহ তরাজি প্রার্থনা করেন যেন তাঁর জাতি শান্তি ও স্বাধীনতা পায়। তিনি বিশ্বাস করেন, এই পরিস্থিতির চেয়েও বড়দিনের আনন্দ এবং তাঁদের বিশ্বাস অনেক বেশি শক্তিশালী।

গত অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির পর গাজায় হামলার তীব্রতা কমলেও মাঝেমধ্যেই প্রাণঘাতী আঘাত আসছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইজরায়েলি অভিযানে এ পর্যন্ত প্রায় ৭১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অর্ধেকই নারী ও শিশু।

অতিবৃষ্টিতে বাস্তুচ্যুত মানুষের তাবুগুলো তলিয়ে গেছে, যা ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মস্কোতে বিস্ফোরণ, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত তিন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১: ৪২
মস্কোর ঘটনাস্থলে পুলিশ। ছবি: বিবিসি
মস্কোর ঘটনাস্থলে পুলিশ। ছবি: বিবিসি

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এক বিস্ফোরণে দুজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা এবং আরেকজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। রাশিয়ার তদন্ত সংস্থাগুলোর বরাতে জানা গেছে, দক্ষিণ মস্কোর ইয়েলেতস্কায়া স্ট্রিট এলাকায় এই বিস্ফোরণ ঘটে স্থানীয় সময় বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ভোরে। ঘটনাস্থলটি সেই জায়গার কাছে, যেখানে চলতি সপ্তাহের শুরুতে এক রুশ জেনারেল গাড়িবোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন।

রাশিয়ার ইনভেস্টিগেটিভ কমিটির বিবৃতির বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে আটকের চেষ্টা করার সময় বিস্ফোরণটি ঘটে। পুলিশ কর্মকর্তারা যখন ওই ব্যক্তির কাছে যান, তখনই একটি বিস্ফোরক ডিভাইস সক্রিয় হয়ে যায়। বিস্ফোরণের ফলে ঘটনাস্থলেই দুই পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান। এ সময় তাঁদের পাশে থাকা আরেকজন ব্যক্তিও বিস্ফোরণে নিহত হন।

নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার বয়স ছিল ২৪ ও ২৫ বছর। আল জাজিরার মস্কো প্রতিনিধি ইউলিয়া শাপোভালোভার তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে একজনের স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটি তাদের পরিবারের জন্য এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি।’ বিস্ফোরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য এখনো স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছে রুশ কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিস্ফোরণের শব্দ ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। কাছাকাছি বসবাসকারী আলেক্সান্ডার নামের এক ব্যক্তি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘একটা ভয়ংকর শব্দ হয়েছিল, কয়েক দিন আগের গাড়ি বিস্ফোরণের মতোই।’ আরেক বাসিন্দা রোজা জানান, বিস্ফোরণের সময় তাঁদের পুরো ভবনটি কেঁপে ওঠে এবং তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠেন।

বিস্ফোরণের পরপরই এলাকাটি ঘিরে ফেলে পুলিশ বাহিনী। রুশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ছবিতে দেখা গেছে, ঘটনাস্থলে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তদন্তকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক পাচারের অভিযোগে একটি মামলা করেছে।

এই বিস্ফোরণ ঘটেছে সেই এলাকার কাছে, যেখানে গত সোমবার রুশ জেনারেল ফানিল সারভারভ গাড়ির নিচে পেতে রাখা বিস্ফোরক ডিভাইসের মাধ্যমে নিহত হন। সারভারভ রুশ জেনারেল স্টাফের অপারেশনাল ট্রেনিং বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং ইউক্রেনে চলমান সামরিক অভিযানের জন্য সেনাদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

রাশিয়া জেনারেল সারভারভ হত্যার পেছনে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তবে ইউক্রেন এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে রাশিয়া ও দখল করা ইউক্রেনীয় অঞ্চলে একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনায় রুশ সামরিক কর্মকর্তা এবং এই যুদ্ধের সমর্থক বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শানলিউরফা: নবীদের যে নগরে মিলেছে তিন ধর্মের মানুষ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
তুরস্কের শানলিউরফা শহর। ছবি: সিএনএন
তুরস্কের শানলিউরফা শহর। ছবি: সিএনএন

দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের শানলিউরফা শহরকে বলা হয় ‘নবীদের নগরী’। সিরিয়া সীমান্ত থেকে মাত্র ৪০ মাইল উত্তরে অবস্থিত এই শহরটি হাজার বছরের ইতিহাস, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য সংযোগস্থল। এখানে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম—এই তিন একেশ্বরবাদী ধর্মের কাহিনি এসে মিলেছে।

বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানিয়েছে, শানলিউরফার পুরোনো শহরের দেরগাহ মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত নীলাভ পানির ‘বালিক্লিগোল’ বা ‘মাছের হ্রদ’। মূলত এখানে আছে দুটি পুকুর। ধর্মীয় মতে, দুটি পুকুরের বড়টিতে নবী ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন মেসোপটেমিয়ার রাজা নমরুদ। আল্লাহ তৎক্ষণাৎ ওই আগুনকে পানি এবং জ্বলন্ত কাঠকে মাছে রূপান্তরিত করেছিলেন। এ ছাড়া ‘আইনজেলিহা’ নামের ছোট পুকুরটির নামকরণ করা হয়েছে নমরুদের কন্যা জেলিহার নামে। ইব্রাহিম নবীর প্রতি বিশ্বাসের কারণে এই পুকুরে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জেলিহা প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস।

দুটি পুকুরই কালো দাগওয়ালা কার্প মাছে ভরা। এগুলোকে পবিত্র মনে করা হয়। তাই এই মাছগুলোকে ধরা বা এগুলোর ক্ষতি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই কারণেই বালিক্লিগোল শুধু একটি পর্যটনস্থল নয়, বরং গভীর ধর্মীয় আবেগ ও ইতিহাসের প্রতীক। মাছের গায়ে থাকা কালো দাগগুলোকে আগুনের ছাইয়ের চিহ্ন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

বালিক্লিগোলে ভেসে বেড়ায় কালো দাগওয়ালা কার্প মাছ। ছবি: সিএনএন
বালিক্লিগোলে ভেসে বেড়ায় কালো দাগওয়ালা কার্প মাছ। ছবি: সিএনএন

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে শানলিউরফা নানা নামে পরিচিত ছিল। আরামীয়রা একে ডাকত উরহাই, গ্রিক শাসনামলে নাম ছিল এডেসা, আরব বিজয়ের পর নাম হয় রোহা। অটোমানেরা ১৬০৭ সালে এই নগরীর নাম রাখে উরফা। পরে ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিরোধের স্বীকৃতি হিসেবে যুক্ত হয় ‘শানলি’, অর্থাৎ ‘গৌরবময়’।

এই শহরটি ইব্রাহিম (আ.), আইয়ুব (আ.), নূহ (আ.) ও জেথ্রোর মতো নবীদের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে বিশ্বাস করা হয়। পুরোনো শহরের দেরগাহ মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত বালিক্লিগোল মুসলিম তীর্থযাত্রীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। এখানেই রয়েছে মেভলিদ-ই-হালিল গুহা। বিশ্বাস করা হয়, এখানেই জন্ম হয়েছিল ইব্রাহিম নবীর। নারীরা সন্তান কামনায় ও আরোগ্য লাভের আশায় এই গুহায় আসেন।

তবে শানলিউরফার ইতিহাস শুধু ধর্মগ্রন্থেই সীমাবদ্ধ নয়। শহরটি থেকে ১৪ মাইল দূরেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। প্রায় ১১-১২ হাজার বছরের পুরোনো এই স্থাপনাটি মানবসভ্যতার ধারণাকেই বদলে দিয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৯৬০০ সালের এই নিওলিথিক স্থাপনাটি কৃষি ও মৃৎশিল্পের আগেই নির্মিত—যা প্রমাণ করে, ধর্মীয় আচার হয়তো সভ্যতার সূচনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে পাওয়া টি-আকৃতির স্তম্ভ ও খোদাই করা পশুর ভাস্কর্য বিশ্বব্যাপী বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। ছবি: সিএনএন
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। ছবি: সিএনএন

শানলিউরফা প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে ১০ হাজারের বেশি নিদর্শন। এর মধ্যে ‘উরফা ম্যান’ নামের ১১ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো মানব মূর্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাশেই হালেপলিবাহচে মোজাইক জাদুঘর ও কিজিলকয়ুন নেক্রোপলিস শহরের রোমান যুগের ইতিহাস তুলে ধরে।

ইতিহাস ও ধর্মের পাশাপাশি শানলিউরফা খাবার ও আতিথেয়তার জন্যও বিখ্যাত। উরফা কাবাব, পাটলিজান কাবাব, চি কফতে ও শিল্লিক তাতলিসি এখানকার জনপ্রিয় খাবার। স্থানীয়দের সঙ্গে ধীরে চা পান, পুরোনো বাজারে হাঁটা আর ‘সিরা গেসেসি’ নামের সাংস্কৃতিক আড্ডায় অংশ নিলে বোঝা যায়—এই শহর শুধু দেখার নয়, অনুভব করারও।

শানলিউরফা নগরীতে ‘সিরা গেসেসি’ নামে রাতের আড্ডা। ছবি: সিএনএন
শানলিউরফা নগরীতে ‘সিরা গেসেসি’ নামে রাতের আড্ডা। ছবি: সিএনএন

বলা যায়—শানলিউরফা যেন এক জীবন্ত জাদুঘর; যেখানে ধর্ম, ইতিহাস ও মানবসভ্যতার গল্প একসূত্রে গেঁথে পাশাপাশি হাঁটে অতীত ও বর্তমান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত