Ajker Patrika

কোন কুয়াশায় আবৃত ৪২ কোটি টাকার সড়কবাতি

স্বপ্না রেজা
আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০: ০২
কোন কুয়াশায় আবৃত ৪২ কোটি টাকার সড়কবাতি

উত্তরবঙ্গের মানুষজন চোখে কম দেখাকে বলেন, চোখে কুয়াশা পড়েছে। সহজ, সরল অভিব্যক্তি। যে কেউ প্রথম ধাক্কায় কথার মানে খুঁজে পেতে কিছুটা চিন্তিত হবেন; বিশেষ করে যাঁরা ‘চোখে কুয়াশা’ কথাটার সঙ্গে মোটেও পরিচিত নন, জানেন না কিংবা এর আগে শোনেননি। বাস্তবতা হলো, ওখানকার সাধারণ মানুষের চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে তাঁরা এভাবেই নিজের সমস্যার কথা প্রকাশ করেন।

শহরের শিক্ষিত ও সচেতন মানুষজন যতটা সহজে জানতে পারেন যে চোখে ছানি পড়লে তাঁরা আর স্পষ্ট দেখতে পান না, তাঁদের দৃষ্টিশক্তি তথা আলো কমে আসে, গ্রামগঞ্জের সহজ-সরল মানুষজন তত সহজে জানতে পারেন না যে ছানির কারণেই তাঁর দৃষ্টিশক্তি বা আলো কমে গেছে; বরং অধিক, অতিসরলতার কারণেই তাঁরা মনে করেন এবং বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে চোখে কুয়াশা পড়েছে। সাধারণত এই কুয়াশা মধ্য কিংবা প্রবীণ বয়সে দেখা দেয়; অর্থাৎ জীবনের পরিণত পর্যায়ে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ উত্তরবঙ্গের সাধারণ, সহজ-সরল মানুষের চোখের কুয়াশার কথা মনে করিয়ে দিল। ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কবাতির আলো মাত্র দুই মাসেই কমে এসেছে। ছানি বা কুয়াশা পড়ার কথা নয় সড়কবাতির এবং তা প্রকৃতির নিয়মেই। সাধারণত মানুষের চোখের আলো কমে আসে পরিণত বয়সে। সেখানে মাত্র দুই মাসেই সড়কবাতির আলো কমে গেছে। যদিও ব্যক্তি ও বস্তু, উভয়েরই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও যন্ত্রাংশের একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেছেন যে রংপুর সিটি করপোরেশনে ঘটে যাওয়া সড়কবাতির আলো কমে আসার কাণ্ডকারখানা উত্তরবঙ্গের মানুষের চোখের আলো কমে আসার মতো সাধারণ, সহজ কিংবা সরল নয়।

রংপুর সিটি করপোরেশনে ৪২ কোটি টাকার সড়কবাতির আলো দুই মাসেই কমে গেছে। কী আলো, কেমন আলো যে দুই মাসেই কমে গেল! মানুষের চোখের আলো কমে আসতে বয়স লাগে, আর ৪২ কোটি টাকার সড়কবাতির আলো দুই মাসেই কমে এল! ৪২ কোটি টাকা কিন্তু কম টাকা নয়। আবার এই টাকার উৎস কিংবা মালিকও কিন্তু সিটি করপোরেশন নয়। এককথায় জনগণের টাকা। জনগণ এই টাকার মালিক। জনগণকে সেবা দেবে, আলোকিত করে রাখবে, সে জন্যই তো জনগণ টাকা দেয় রাজস্বের মাধ্যমে। আর জনগণকে সেবা দিতে সেই টাকাই ব্যয় হয়। এই টাকার যাচ্ছেতাই ব্যবহার কিংবা অপচয় জনগণ মানবে কেন? কখনোই মানতে পারে না। মানা উচিত নয়।

যা-ই হোক, সিটি করপোরেশন সড়কবাতির আলো কমে আসার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে। ব্যাখ্যা ঠিক নয়, রীতিমতো অভিযোগ কিংবা দোষারোপ করেছে বলা যায়। অভিযোগের তর্জনী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দিকে। সিটি করপোরেশন বলছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শর্ত অনুযায়ী কাজ করেনি। রংপুর সিটি করপোরেশনকে আলোকিত করে রাখার জন্য নাকি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জার্মানির তৈরি সড়কবাতি লাগানোর কথা ছিল। প্রতিষ্ঠানটি লাগিয়েছে চীনের তৈরি বাতি। এমন কথায় যদি কেউ বুঝে নেন যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে কাজ করেছে তার ইচ্ছেমতো, তাহলে কীভাবে তার ভুল ভাঙানো সম্ভব? কেউবা আবার ভেবে বসতে পারেন যে শুধু কোভিড নয়, তার সঙ্গে এসেছে সড়কবাতিও এবং এই চীনা বাতির দৌরাত্ম্য কিন্তু কম নয়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ তেমনটাই বোঝাচ্ছে। আজব ব্যাপার হলো, এই আলো কমে আসার ব্যাখ্যা বা কারণ, যা-ই বলি না কেন, তা কিন্তু উত্তরবঙ্গের সাধারণ মানুষের মতো সহজ-সরল ‘কুয়াশা’র মতো নয়; বরং সংশয়ে ভরা এক বিশাল অন্ধকার অথবা জটিল, তেমন একটা কিছু বলা যায়। খোঁড়াখুঁড়ি করলে হয়তো মস্ত কেচ্ছাকাহিনি বেরিয়ে আসবে সড়কবাতির আলো কমে আসার গল্প থেকে—কেউ কেউ আবার এমনও মনে করছেন। এ রকম চমকপ্রদ ঘটনা তো প্রায়ই ঘটছে চারপাশে। এত বিপুল পরিমাণ টাকায় স্থাপন করা সড়কবাতির আলো দুই মাসেই কমে আসবে, তা কি সোজা একটা ব্যাখ্যায় মানা যায়?

প্রকাশিত সংবাদ পড়ে আজব দিকটি আবিষ্কৃত হলো এই, ৪২ কোটি টাকার এলইডি বাতি তথা সড়কবাতি স্থাপনের আগে দরপত্র আহ্বানকারী রংপুর সিটি করপোরেশন বাতিগুলো পরীক্ষা করে দেখেনি যে দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যে বাতিগুলো স্থাপন করার কথা, তা স্থাপন হচ্ছে কি না কিংবা স্থাপন হবে কি না; অর্থাৎ দরপত্রে উল্লেখ করা জার্মানির বাতি কি না। নাকি বুঝে নিতে হবে যে এসব যাচাই-বাছাই করা সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে পড়ে না? সে কারণেই সম্ভবত সড়কবাতির আলো মাত্র দুই মাসে কমে আসার বিষয়টি সিটি করপোরেশনের নজরে এলে তারা বাতিগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অতি সহজেই বলতে পারে যে বাতিগুলো জার্মানি কিংবা ফ্রান্সের নয়, চীনের তৈরি।

পত্রিকান্তরে জানা যায়, সরবরাহকৃত এলইডি বাতিতে ব্র্যান্ড, ভোল্টেজ, রেঞ্জ, ওয়াট, কান্ট্রি অব অরিজিন, লুমেন, লাইফটাইম সম্পর্কে কোনো তথ্য উল্লেখ নেই, যা সাধারণত সব ধরনের বাতিতে থাকে। বাতির ‘এসপিডি’র (সার্স প্রোটেকশন ডিভাইস) গায়ে ‘মেড ইন চায়না’ লেখা। প্রকল্প পরিচালক, সিটি করপোরেশন একটি সংবাদপত্রে বলেছেন, ‘এসপিডি একটি ডিভাইস, যা বাতির জন্য খুবই উল্লেখযোগ্য। এটি বজ্রপাত নিরোধক হিসেবে কাজ করে। চীনের তৈরি এসপিডি লাগানো হয়েছে, যা টেকসই হবে না। এটি হতে হবে জার্মানি কিংবা ফ্রান্সের। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেই অনুযায়ী কাজ করেনি।’ প্রকল্প পরিচালক আরও বলেছেন, সরবরাহকৃত বাতিগুলো দরপত্রবহির্ভূত। সে কারণে বাতি অপসারণ করতে বলা হয়েছে। দরপত্রবহির্ভূত হলে তো অপসারণের নির্দেশ দিতেই হয়। গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে সেই নির্দেশ দিয়েছেনও প্রকল্প পরিচালক। কিন্তু এমনতর নির্দেশ বাতি স্থাপনের পর কেন, আগে হলো না কেন? কী বলার আছে কিংবা বলবেন প্রকল্প পরিচালক? নাকি এটা প্রকল্প বিধায় নজরদারি, যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন পড়ে না, প্রকল্প নিজের মতো করেই চলে!

অন্যদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এডেক্স করপোরেশন লিমিটেডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব বাতি জার্মানির। বাতির ভেতর যে এসপিডি রয়েছে, সেটি চীনের তৈরি। সিটি করপোরেশন ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাঝে ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে বলে তারা মনে করে। দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে মনে হওয়া স্বাভাবিক, ৪২ কোটি টাকার সড়কবাতি স্থাপনের বিষয়ে একধরনের উদাসীনতা কিংবা অসচেতনতা রয়েছে; কিংবা অন্য কোনো বড় কারণ থাকতে পারে। এলইডি বাতির আলো কমে আসাটা এ ধরনের বাতির বৈশিষ্ট্য হলেও দুই মাসে আলো কমে আসার ঘটনাটি মেনে নেওয়া যায় কি না, ভেবে দেখতে হবে।

উত্তরবঙ্গের সাধারণ মানুষের চোখে যে কুয়াশা পড়ে, সেই কুয়াশা কিন্তু রংপুর সিটি করপোরেশনের সড়কবাতির চোখে পড়েনি। এখানে দরপত্রবহির্ভূত বাতি স্থাপনের ঘটনা ঘটেছে। কীভাবে এমন ঘটনা ঘটল, তার দায় ও জবাবদিহি দুই পক্ষের নির্ধারিত হলেও দায়ের বেশির ভাগটা পড়ে রংপুর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাঁধে। দরপত্র অনুযায়ী কেন তারা বাতি যাচাই-বাছাই করেনি? সোজাসাপ্টা কথা, দুই পক্ষের বক্তব্য দায়িত্ববোধসম্পন্ন মনে হয়নি; বরং অনুসন্ধানী মন অন্য কিছুর আশঙ্কা করে। এই সমাজে তো বালিশ, চাদরের কেলেঙ্কারির গল্প আছে। সুতরাং অন্য আশঙ্কা দূর করার জন্য প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটন হওয়া জরুরি। দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের গাফিলতি, অবহেলা, উদাসীনতা কিংবা দুর্নীতি যেন প্রশ্রয় না পায়।

লেখক: স্বপ্না রেজা,কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...