Ajker Patrika

দ্বিতীয় অয়েল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার খবর কী

ড. মইনুল ইসলাম
দ্বিতীয় অয়েল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার খবর কী

বাংলাদেশের একমাত্র অয়েল রিফাইনারি চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি ১৯৬৮ সালে মাত্র ১৫ লাখ টন ক্যাপাসিটি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফ্রান্সের ‘টেকনিপ’ প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারিতে। ইস্টার্ন রিফাইনারির বয়স এখন ৫৫ বছর, এর ‘ইকোনমিক লাইফ টাইম’ অনেক আগেই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এরপর ৫৫ বছরেও ওই রিফাইনারির ক্যাপাসিটি বাড়ানো কিংবা দ্বিতীয় আরেকটি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার ইস্যু সরকারের অগ্রাধিকার পেতে সমর্থ হয়নি। অথচ বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় ৭৫ লাখ টন পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্টস আমদানি করছে, যার মধ্যে প্রায় ৬০ লাখ টন রিফাইনড্ পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্টস। এ জন্য প্রতিবছর অতিরিক্ত মূল্য হিসেবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে আমাদের। বছরে দুইবার টেন্ডারের মাধ্যমে এই রিফাইনড্ পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্টস আমদানি করা হয়, যার বেশির ভাগই আসে সিঙ্গাপুরের একটি ফার্মের মাধ্যমে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাকি এই টেন্ডার থেকে মার্জিন আহরণের সুযোগ থাকে! এখন ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি টন ক্যাপাসিটির একটি অয়েল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা দেশের জন্য ফরজ হয়ে গেছে, অথচ প্রচণ্ড লবিংয়ের শিকার হয়ে রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি প্রায় এক দশক ধরে ঝুলে রয়েছে! এত দিন শোনা যাচ্ছিল যে দ্বিতীয় অয়েল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি ‘ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড’ নামের ভারতীয় সরকারি মালিকানার একটি কনসালট্যান্ট ফার্মের নানাবিধ আপত্তির কারণে অগ্রসর হতে পারছে না। ‘টেকনিপ’ নামের যে ফরাসি কোম্পানিটি ইস্টার্ন রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাদের এ-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো নাকি ভারতীয় ওই কনসালট্যান্ট ফার্ম বারবার আটকে দিচ্ছে! ব্যাপারটা খুবই রহস্যময়। কারণ দেশের জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এভাবে যদি ভারতীয় একটি সরকারি মালিকানার কোম্পানির কারণে বছরের পর বছর আটকে থাকে, তাহলে এর দায়ভার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর ওপরই সরাসরি বর্তায়। এ ক্ষেত্রে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, তিনি ওই ভারতীয় কনসালট্যান্ট ফার্মের ভেটো উতরাতে পারছেন না, সেটাও কি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? বাংলাদেশ পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারতের আসাম রাজ্যের নুমালিগড় থেকে রিফাইনড্ পেট্রোলিয়াম আমদানি করছে ২০২৩ সাল থেকে। ভারতীয় কনসালট্যান্ট ফার্মের আপত্তিগুলো ভারতকে এ ক্ষেত্রে অন্যায্য সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় তো?

বেশ কয়েক বছর আগে কক্সবাজারের মহেশখালীতে কুয়েতের একটি কোম্পানি অয়েল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার জন্য জমি নিয়ে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু খবরাখবর নিয়ে জানা যাচ্ছে যে সাম্প্রতিক সময়ে এই কোম্পানি তাদের রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার কাজটি আর একটুও এগিয়ে নেয়নি। শুধু সাইনবোর্ডটি আজও রয়ে গেছে। এই রিফাইনারি আদৌ কি প্রতিষ্ঠিত হবে? পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে পত্র-পত্রিকায় খবর বেরোচ্ছে যে সৌদি আরবের বহুজাতিক তেল কোম্পানি আরামকো বাংলাদেশে একটি বৃহদাকার অয়েল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। খবর যদি সত্যি হয় তাহলে প্রস্তাবটি এত দিনে বাস্তবায়ন-পর্যায়ে চলে আসার কথা। এ ক্ষেত্রেও অগ্রগতি নেই বললেই চলে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত একজন সচিব নাকি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তাঁর অবসরে যাওয়ার অব্যবহিত পূর্বে রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার জন্য টেন্ডার আহ্বানের জন্য ফাইলে স্বাক্ষর করে গিয়েছিলেন। এরপর আরও ছয় মাস অতিবাহিত হলেও কোন রহস্যজনক কারণে ওই টেন্ডারটি ফ্লোট করা হয়নি! এগুলোর মানে হলো, পর্দার আড়ালে রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার ইস্যুটি নিয়ে নানাবিধ লবিং পুরোদমে চালু রয়েছে। এই লবিস্টরাই পুরো প্রক্রিয়া হয়তো ছয় মাস ধরে আটকে রাখতে সমর্থ হয়েছে। ২০২১ সালের ১ এপ্রিল ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ শীর্ষক একটি প্রকল্প-প্রস্তাব (ডিপিপি) গৃহীত হয়েছিল বলে জানা যায়, যেখানে তিন মিলিয়ন টন রিফাইনিং ক্যাপাসিটির ওই দ্বিতীয় ইউনিটটি ১ জানুয়ারি ২০২২ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৬ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৯ হাজার ৩৭২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে ওই প্রকল্প প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু গত আড়াই বছরেও ওই প্রকল্প-প্রস্তাবটির আর কোনো অগ্রগতির খবর মিলছে না। বর্তমানে আর কোনো বিকল্প প্রকল্প-প্রস্তাবের হদিসও পাওয়া যাচ্ছে না।

আমার অবাক লাগছে যে প্রয়োজনীয় ক্যাপাসিটির আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন নতুন অয়েল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সম্পর্কে সরকার আড়াই বছর ধরে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে রয়েছে। অথচ কারও কারও খামখেয়ালিপনায় অপ্রয়োজনীয় কিংবা স্বল্প-প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের বদ-খাসলত আমাদের সরকারকে যেন পেয়ে বসেছে! সে জন্যই এসব প্রকল্প গ্রহণ থেকে সরকারকে বিরত রাখার জন্য আমাকে প্রায়ই কলম ধরতে হচ্ছে। প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট প্রকল্প মূল্যায়নের পদ্ধতি প্রয়োগ করে কখনোই গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করা যাবে না। কারণ ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প প্রযুক্তি বিশ্বে পাওয়া যাবে, যেখানে এর অর্ধেকেরও কম ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পে ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ অনেক বেশি নিরাপদে উৎপাদন করা যাবে। (পারমাণবিক প্রযুক্তি অত্যন্ত বিপজ্জনক, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্ল্যান্ট থেকে জীবন-সংহারী বিকিরণ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে)।

দ্বিতীয় যে প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের জনগণের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো, ঢাকায় নির্মীয়মাণ বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। ১২ বছর ধরে প্রকল্পটি চলমান, ইতিমধ্যেই প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় চার গুণ খরচ হয়ে গেছে। পাঁচজন লোকের প্রাণও গেছে এই প্রকল্পের নির্মাণ-দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। এই প্রকল্পের জন্য ১২ বছর ধরে এয়ারপোর্ট রোড ব্যবহারকারী জনগণকে কী বিপুল ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে, সেটা ভুক্তভোগী কাউকে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বলা হচ্ছে, এ বছরও প্রকল্পটি শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। আরও দুঃখজনক হলো, এখন স্বীকার করা হচ্ছে যে প্রকল্পটি প্রকৃত বিচারে ঢাকার জনগণের চলাচলের ভোগান্তিকে তেমন প্রশমিত করতে পারবে না।

তৃতীয় যে কম প্রয়োজনীয় প্রকল্পের উল্লেখ করব সেটা হলো, ঢাকা-ফরিদপুর-যশোর রেললাইন।

চতুর্থ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প। পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে প্রথম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের দুই-তৃতীয়াংশ ক্যাপাসিটি এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। আমরা নিজেরাও ব্যবহার করতে পারছি না, অন্য কোনো দেশের কাছে এই স্যাটেলাইটের উদ্বৃত্ত ক্যাপাসিটি বিক্রিও করতে পারছি না। অথচ এখন কৃষি খাতে ব্যবহারের অজুহাত দিয়ে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের তোড়জোড় চলছে!

পঞ্চম যে প্রকল্পটি স্বল্প প্রয়োজনীয় প্রমাণিত হবে সেটি হলো, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মীয়মাণ রেলপথ, এটাও বেশ কয়েক বছর আন্ডার-ইউটিলাইজড থেকে যাবে। উল্লিখিত প্রকল্পগুলোর তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় আধুনিক অয়েল রিফাইনারি।
একটি আধুনিক অয়েল রিফাইনারির প্রয়োজনীয়তা কতখানি, সেটা বোঝানোর জন্য একটি দুঃখজনক ঘটনা সবাইকে মনে করিয়ে 
দিতে চাই। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধির হিড়িক পড়েছিল, তখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ‘স্যাংশন’ আরোপ করায় সেটাকে অকেজো করার উদ্দেশ্যে রাশিয়া আন্তর্জাতিক দাম থেকে অনেক কম দামে তেল বিক্রির উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশকেও রাশিয়া ওই সুযোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার ‘হেভি ক্রুড অয়েল’ রিফাইনিং ক্যাপাসিটি আমাদের ইস্টার্ন রিফাইনারির না থাকায় সেই সুবিধা নিতে পারিনি। অথচ ভারত গত দেড় বছরে রাশিয়ার এই সুবিধা নিয়ে কয়েক বিলিয়ন ডলার মুনাফা কামিয়ে নিয়েছে। তারা রাশিয়ার ক্রুড অয়েল রিফাইন করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিক্রির মাধ্যমে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে ভোঁতা করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে তারা মার্কিন স্যাংশনের কোনো তোয়াক্কাই করেনি। আমার অবাক লাগছে যে এরপরও বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের টনক নড়েনি। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গতিশীল অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ ৫৫ বছর ধরে মাত্র ১৫ লাখ টন অয়েল রিফাইনিং ক্যাপাসিটির একটি পুরোনো প্রযুক্তির প্ল্যান্ট নিয়ে যেভাবে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছে, সেটা সত্যিই অভাবনীয় একটি ব্যাপার! ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ৭০ লাখ টন অয়েল রিফাইনিং ক্যাপাসিটির একটি অত্যাধুনিক নতুন প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠার যে সম্ভাব্য ব্যয় হবে তা পাঁচ বছরের মধ্যেই মেটানো যাবে রিফাইনড্ অয়েল আমদানির ব্যয়-সাশ্রয় থেকে, কিন্তু এত কিছুর পরও বিষয়টি যথাযোগ্য বিবেচনা পাচ্ছে না কেন, তা সত্যিই রহস্যজনক। অনতিবিলম্বে এ ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত কামনা করছি।

ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ