Ajker Patrika

চিরকালের বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২২, ১৯: ১৪
চিরকালের বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

অনেক সময় মনে হয় রবীন্দ্রনাথ লোক ছিলেন না অতিশয় দীনহীন এই বাংলাদেশের। পৌরুষে-প্রাণে, স্বভাবে-আচরণে, উদ্যম-উদ্ভাবনায় একক তিনি, একাকীও; তাঁর সঙ্গে এ দেশের আর-পাঁচটি খর্বাকৃতি বস্তুর সাদৃশ্য নেই। মনে হয় অনেক ঊর্ধ্বে তিনি, এসেছেন ব্যত্যয় হিসেবে, অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার মতো আকস্মিকতায়, অপ্রত্যাশিত রূপে।

কিন্তু তবু এই দেশেরই মানুষই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বাঙালিই ছিলেন ব্যক্তিজীবনে, এবং ব্যক্তিনিয়ন্ত্রিত হয় যদ্দ্বারা সেই সমাজজীবনে। 

তাঁকে বলা হয়েছে বিশ্বকবি। নির্বিশেষে সর্বজনীনতা অবশ্যই আছে রবীন্দ্রনাথের, কিন্তু তাঁর বিশেষ পরিচয়, একান্ত ও অন্তরঙ্গ পরিচয় তাঁর বাঙালিত্বের মধ্যেই। রবীন্দ্রপ্রতিভার স্বভাব ও ঝোঁক তাঁর বাঙালিত্ব দ্বারাই অনিবার্য ও স্বাভাবিকরূপে প্রভাবিত, এবং সেই প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত। বাংলা ভাষায় তিনি শ্রেষ্ঠতম লেখক; ভাষার তিনি দাস ছিলেন না, ভাষা তাঁর আজ্ঞাবহ ছিল—এ কথায় অসত্য নেই যদিও, তবু ভাষার যে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, তা অবজ্ঞেয় নয়। এ সেই ক্ষমতা শ্রেষ্ঠতম লেখকের ক্ষেত্রেও যা অপরিহার্য রূপে কার্যকর। কিন্তু আরও বড় সত্য আছে, একটি প্রধান সত্য, এমনকি হতে পারে প্রধানতম সত্য। সে হচ্ছে এই ঘটনা যে রবীন্দ্রনাথ ট্র্যাজেডির লেখক ছিলেন না, লেখক ছিলেন মহাকাব্যের। তাঁর অলৌকিক প্রতিভা ট্র্যাজেডির দিকে ঝুঁকে পড়েনি, ঝুঁকেছিল মহাকাব্যের দিকে। যদিও তিনি কোনো মহাকাব্য লেখেননি, গীতিকাব্যই লিখেছেন। 

ব্যাপারটা ব্যক্তিগত নয়। তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়নি যে তিনি ট্র্যাজেডির লেখক হবেন নাকি লেখক হবেন মহাকাব্যের। এই সিদ্ধান্ত এসেছে তাঁর নিয়ামক বাঙালিত্ব থেকে। 

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমহাকাব্য স্থানকে যত গুরুত্ব দেয়, ট্র্যাজেডি তত দেয় না। সর্বজনীন হয়েও মহাকাব্য বিশেষ দেশের ও দেশান্তর্গত কালের। বিষয়বস্তুর নির্বাচনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দেশেরই মানুষ—দেশের অতীত ও বর্তমানের। কিন্তু সে-কথা আমরা বিশেষভাবে ভাবছি না এখানে। বিশেষভাবে ভাববার কথা এটি যে ট্র্যাজেডির প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে অপক্ষপাত, তাতে তাঁর বাঙালিত্বই প্রতিফলিত। বাঙালির জীবনে নাটক অল্প, ট্র্যাজেডি স্বল্পতর। দুঃখ ও পীড়া বাঙালির জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক বস্তু, কিন্তু যে দুঃসাহস, অশুভের সঙ্গে সংগ্রামে যে দৃঢ়তা থাকলে দুঃখ ও পীড়া ট্র্যাজেডিতে উত্তীর্ণ হয়—অভাব সেই প্রচণ্ড সাহসের, সেই অনমনীয় দৃঢ়তার। এই কারণে একদিকে যেমন তুষ্টি আসে সহজে অন্যদিকে তেমনি সন্ধি ও সহযোগিতাই প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়ায়। অশুভ অবশ্যই আছে, জানি সে রয়েছে, তবু তাকে জানতে চাই না সম্পূর্ণরূপে, চিনতে চাই না পরিপূর্ণ পরিচয়ে, কেননা ভয় আছে দ্বন্দ্বে। সম্মুখ মুখোমুখিতে। রবীন্দ্র-সাহিত্যে অশুভ আছে, কিন্তু তাঁর চিত্রকলাতে যেমন আছে সাহিত্যে তেমন নেই। সাহিত্যে অশুভ প্রায়ই অবগুণ্ঠিত, অনেক সময়ে কুণ্ঠিত, এবং যখন প্রকাশিত, যেমন ‘শিশুতীর্থ’, তখন শুভজন্মের জয়ধ্বনি দ্বারা বিধৌত। ভয়ংকর ও সুন্দর হয়ে আছে তাঁর জগতে, যেমন এসেছে রানী সুদর্শনার কাছে। অশুভ চরম নয় কোথাও, শেষ কথাও নয় কোনো রচনায়। মানুষের প্রবৃত্তিকে চিত্রিত করে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাসে। তুলনাবিহীন পাশবিক অন্ধকারের চিত্র আছে ‘চতুরঙ্গে’। কিন্তু সে প্রবৃত্তি মানবিকই, অশুভ নয়, আধিদৈবিক। কোনো বিবেচনাতেই পাপ নয়; পদস্খলনের সম্ভাবনা শুধু। বিপরীত পক্ষে সে ব্যাধিও নয় সমাজের। 

জীবনে দুর্ভোগ এত বেশি রূঢ় যে আমরা নতুন করে দুর্ভোগকে দেখতে চাই না সাহিত্যে। আমরা অন্তরাল চাই। সস্তা চলচ্চিত্র, চটুল গান, যৌনতা—এসব বস্তু মধ্যবিত্ত বাঙালির পলায়ন-কেন্দ্র। সাহিত্যেও তা-ই আছে, পলায়নের আকাঙ্ক্ষা আছে খুব বড় করে। আধ্যাত্মিকতাও পলায়নের বাসনা থেকেই উদ্ভূত। সেখানে আধ্যাত্মিক চিন্তায়, আত্মার সদ্‌গতি কামনা নেই, দৈহিক সুখের গোপন ও ভীরু লালসা আছে বড় হয়ে। নাটক যে আমাদের সাহিত্যের উজ্জ্বলতম অংশ নয়, তার কারণ অবশ্যই দ্বন্দ্ব-ভীরুতা। রবীন্দ্রনাথের সফলতা নাটকেই সর্বাপেক্ষা স্বল্প। কেননা, তাঁর নাটকে শুভের জয় পূর্বনির্ধারিত। আর তাঁর পাঠকও ট্র্যাজেডি চায়নি পড়তে, চেয়েছে রূপকথা—যা নাকি পুরস্কারে ও তিরস্কারে পরিপূর্ণ। 

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররবীন্দ্রনাথের তাই ট্র্যাজেডি লেখবার কথা নয়, তিনি বাঙালি বলে। সেটাকে তাঁর দুর্বলতা বলার দরকার নেই, সেটা তাঁর প্রতিভার নিজস্ব স্বভাব। কোনো রূপকল্পে লিখেছেন লেখক তা দিয়ে তাঁর বিচার হয় না, বিচার হয় লেখার শিল্পমূল্য দিয়ে, শিল্পগত উৎকর্ষ দিয়ে। তদুপরি রূপকল্প হিসেবেও মহাকাব্য যে ট্র্যাজেডির পশ্চাদ্‌বর্তী এমন কথাও জোর দিয়ে বলবার আবশ্যকতা দেখি না। কিন্তু মহাকাব্য রবীন্দ্রনাথ একবারই লিখেছেন, ‘গোরা’তে। তখন উদ্দীপনা ছিল সমগ্র দেশে, ঐক্য ছিল জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। সেই ঐক্য ও উদ্দীপনা একটা বড় বস্তু, তেমন বস্তু যার অভাব ঘটলে মহাকাব্য রচনা হয় না। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন একই সঙ্গে ঐক্য ও উদ্দীপনা এনেছিল এই দেশে, অন্তত দেশের সেই অংশে যে-অংশে সামাজিক অবস্থান ছিল রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু পরে উদ্দীপনার অবসান ঘটেছে, ঐক্যও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নেতিবাচক শক্তিই ছিল প্রধান, যখন তার লক্ষ্য অর্জিত হলো তখন অবসানের ক্লান্তিতে জাতীয় বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ যতটা দ্রুত বিস্তারশীল হয়ে উঠল, তত দ্রুত তার বিস্তার বোধ হয় আগে আর কখনো হয়নি। আপসপন্থীরা একদিকে গেলেন, নিরাপসবাদীরা অন্যদিকে। প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত হিন্দুর স্বার্থ এবং উন্মেষকামী মধ্যবিত্ত মুসলিম স্বার্থে সংঘাত হয়ে দাঁড়াল অপরিহার্য। গ্রাম ও শহরের বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পেল ক্রমশ। নতুন কোনো ‘গোরা’ লেখা আর সম্ভব হলো না রবীন্দ্রনাথের মতো অসামান্য শিল্পীর পক্ষেও। সেই পথে আর গেলেন না তিনি, অসামান্য বলেই গেলেন না, সামান্য হলে, কবি কায়কোবাদ হলে যেতেন হয়তো এবং ব্যর্থ হতেন দৃষ্টিকটুরূপে। কেননা, মহাকাব্য নিজস্ব সাংস্কৃতিক পটভূমি ছাড়া রচিত হয়নি কখনো, হতে পারে না কিছুতেই। অসাধারণ বাস্তববুদ্ধি ছিল রবীন্দ্রনাথের, তাই কবিতা লিখেছেন অজস্র, ছোটগল্প লিখেছেন বহু, উপন্যাস লিখেছেন অনেক কটি, কিন্তু মহাকাব্য আর লেখেননি, উদ্যমও নেননি লেখার। ‘চতুরঙ্গ’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘চার অধ্যায়’, ‘শেষের কবিতা’—সমগ্র দেশ এদের কোনোটিতেই আসেনি, এমনকি ‘যোগাযোগ’—এ-ও নয়। ছোটগল্পে তো আসবার কথাই ছিল না, কবিতাতে ততোধিক। 

মহাকাব্যিক প্রতিভা মহাকাব্য আর দ্বিতীয়বার লিখলেন না, ‘গোরা’কে ছাড়িয়ে গেল না সেই প্রতিভা, যা নিজেকে নিজে অতিক্রম করেছে সমগ্র জীবনে। এর কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজে নন, কারণ বাঙালি জীবনের বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা, নির্বেদ ও গ্লানি। যে ঐক্য ও উদ্দীপনা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন একদিন সম্ভব করে তুলেছিল, বাংলাদেশে আবার তার উদ্ভব হতে পারত যদি সূচনা হতো নতুনতর, প্রবলতর কোনো আন্দোলনের। সে-আন্দোলনকে অবশ্যই হতে হতো সমাজতান্ত্রিক। কেননা, অন্য কোনো আন্দোলনের পক্ষে সম্ভব হতো না শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ঐক্য আনয়ন করা। ইংরেজবিরোধিতা বঙ্গভঙ্গ-রদের পরবর্তী সময়ে এক পথে অগ্রসর হয়নি, নানা পথে গিয়েছে—অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রবল হয়নি বাংলাদেশে। হলেও তাতে রবীন্দ্রনাথের থাকবার কথা ছিল না, বিপ্লব-পরবর্তী রুশ দেশ ভ্রমণ সত্ত্বেও নয়। শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছেন মানুষের প্রতি মানুষের অবিচারের বিরুদ্ধে, সভ্যতার গভীরে যে সংকট তাকে প্রকটিত করেছেন লেখার মধ্য দিয়ে, কিন্তু সমস্ত বক্তব্য যে একত্র ও এক হয়ে বৃহৎ কোনো রচনার আকার নেবে, তা আর হয়ে ওঠেনি। 

রবীন্দ্রনাথ যে শ্রেষ্ঠতম বাঙালি সেটা সত্য এই দিক থেকেও যে বাঙালি জীবনের বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতাকে তিনি যেভাবে প্রতীয়মান করে তুলেছেন শুধু লিখে নয়, না-লিখেও—তেমনটি অন্য কেউ পারেননি। পরবর্তীকালে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পেয়েছে আরও, পাবে যে তার লক্ষণ রবীন্দ্রনাথেই ছিল। অন্যদিকে আবার এটাও লক্ষ করা খুব সহজ যে ‘গোরা’র লেখক যখন ‘শেষের কবিতা’ লেখেন তখন যে তাঁর শক্তি বৈচিত্র্য ও সৃজন-বিপুলতাই শুধু প্রকাশ পায় তা-ই নয়, তদ্দ্বারা মহাকাব্যের অপস্রিয়মাণতাও প্রমাণিত হয়। বাক্যবীর অমিত রায় সেই অপস্রিয়মাণতারই প্রতিভূ। 

সাধারণভাবে বলতে গেলে বলা যায়, বড় লেখকেরা দুই শ্রেণির। শেক্‌সপিয়ারের মতো নাটকীয়, অথবা টলস্টয়ের মতো মহাকাব্যিক। রবীন্দ্রনাথ মহাকাব্যের লেখক, তবু তিনি টলস্টয়ের মতো নন, সম্পূর্ণত। রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা টলস্টয়ের নেই। দরিদ্র দেশে আধ্যাত্মিকতা না থাকলেই নয়। জীবনে যে ব্যক্তি স্বপ্নের মতো সমৃদ্ধ তাঁর পক্ষে স্বপ্ন না দেখলেও চলে; কিন্তু যে ব্যক্তি দরিদ্র স্বপ্ন না থাকলে তাঁর জীবন থাকে না। বস্তুর অভাব ঘটলে আধ্যাত্মিকতার সুবিধা হয়, বিশেষ রকমের। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই আধ্যাত্মিক ছিলেন না ওই নোংরা বস্তুতান্ত্রিক অর্থে। তাঁর জীবনে বস্তুর অভাব ছিল না, কিন্তু তাঁর বাঙালি সত্তা, তাঁর সামাজিক ঐতিহাসিক চরিত্র যে তাঁকে অনিবার্য হাতে আধ্যাত্মিকতার পথানুসরণে বাধ্য করছে সে বিষয়ে সন্দেহ কোথায়? সমৃদ্ধ দেশে জন্মগ্রহণ করলে রবীন্দ্রনাথ আধ্যাত্মবাদী হতেন না। হয়তো হতেন বীরত্ববাদী, হয়তো-বা বুদ্ধিবাদের প্রবক্তা। 

বাঙালি জীবনে শ্রেণিভেদ ও সামন্তবাদী সংস্কৃতির অত্যন্ত গভীর অবস্থান জীবনের সব ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে, বলা যায় বীরকে, গুরুত্ব দিয়েছে অত্যধিক এবং সর্বদাই সচেষ্ট থেকেছে সুবিধাভোগী শ্রেণির নেতৃত্বকে অক্ষুণ্ন রাখতে। এই মানসিকতা এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও অব্যাহতি দেয়নি। একদিকে তিনি মহাপুরুষের কথা বারবার বলেছেন, প্রতীক্ষা করেছেন মহামানবের। অন্যদিকে আবার একক উদ্যম নিয়েছেন স্থাপন করবেন আদর্শ খামার, আদর্শ বিদ্যালয়, আদর্শ সমবায় ও গ্রাম। মহামানবিক একক উদ্যমে একাকী হয়ে পড়েছেন, সফলতা আসেনি, নাড়া খায়নি সমাজ। নেতৃত্ব থেকেছে ব্যক্তির হাতে, ব্যক্তি উপচে শ্রেণির হাতে কখনো কখনো হয়তো-বা, কিন্তু তার বাইরে কখনো যায়নি। যায়নি জনসাধারণের কাছে এবং ব্যর্থতার কারণও এইখানেই ছিল, জনসাধারণের এই অংশগ্রহণ না করায়। রবীন্দ্রনাথের পর সামন্তব্যবস্থা ক্রমশ ক্ষীণ হয়েছে। প্রবল হয়েছে মধ্যবিত্ত। 

রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন তিনি রোমান্টিক! আমারে শুধাও যবে, ‘এরে কভু বলে বাস্তবিক’? আমি বলি, ‘কখনো না, আমি রোমান্টিক’ (‘নবজাতক’)। আরও স্পষ্ট কথা আছে ‘সানাই’য়ে: ‘এ গলিতে বাস মোর, তবু আমি জন্ম রোমান্টিক।’ গলিতেই বসবাস বাঙালির, তবু সে জন্ম রোমান্টিক। গলিকে গলি বলে মানে না, থেকে থেকে খোঁজে দক্ষিণের বাতাস, খোঁজে অলক্ষ্য আকাশ। ফলে গলি গলিই থেকে যায়, বদলায় না। বাতাস থাকে অবরুদ্ধ, আকাশ অলক্ষ্য; শুধু হালকা কল্পনা থাকে সজাগ। হরিপদ কেরানিরা আকবর বাদশার সঙ্গে আত্মীয়তা বোধ করে অত্যন্ত সন্তুষ্ট থাকে। ‘ছিন্নপত্র’-এ রবীন্দ্রনাথ পল্লির চিত্র দিয়েছেন এই রকম: ‘যখন গ্রামের চারদিকের জঙ্গলগুলো জলে ডুবে পাতা-লতা-গুল্ম পচতে থাকে, গোয়ালঘর ও লোকালয়ের বিবিধ আবর্জনা চারদিকে ভেসে বেড়ায়, পাট পচানির গন্ধে বাতাস ভারাক্রান্ত, উলঙ্গ পেটমোটা পা-সরু রুগ্‌ণ ছেলেমেয়েরা এখানে-সেখানে জলে-কাদায় মাখামাখি ঝাঁপাঝাঁপি করতে থাকে, মশার ঝাঁক স্থির জলের ওপর একটি বাষ্পস্তরের বাস্পস্তরের মতো ঝাঁক বেঁধে ভেসে বেড়ায়, গৃহস্থের মেয়েরা ভিজে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বাদলার ঠান্ডা হাওয়ায় বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে হাঁটুর ওপরে কাপড় তুলে জল ঠেলে ঠেলে সহিষ্ণু জন্তুর মতো ঘরকন্নার নিত্য কর্ম করে যায়—তখন সে দৃশ্য কোনোমতেই ভালো লাগে না! ঘরে ঘরে বাতে ধরছে, পা ফুলছে, সর্দি হচ্ছে, জ্বরে ধরছে, পিলে-ওয়ালা ছেলেরা অবিশ্রাম কাঁদছে, কিছুতেই কেউ তাদের বাঁচাতে পারছে না—এত অবহেলা, অস্বাস্থ্য, অসৌন্দর্য, দারিদ্র্য, মানুষের বাসস্থানে কি একমুহূর্ত সহ্য হয়?’ কিন্তু এই পল্লি ভিন্নতর হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়, তাঁর বাস্তবতার জায়গায় জেগে উঠেছে কাব্যময়তা। ‘যেতে যেতে পথপাশে/পানা পুকুরের গন্ধ আসে/সেই গন্ধে পায় মন/বহুদিন রজনীর সকরুণ স্নিগ্ধ আলিঙ্গন’—এমন ক্ষেত্রে পানাপুকুরের দুর্গন্ধ সত্য নয়, সত্য অন্য এক অনুভবের আনন্দ। বাস্তববিনাশী এই রোমান্টিসিজমের মধ্যে যে বাঙালিত্ব আছে তা রবীন্দ্রনাথেও ছিল। 

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

তৌহিদুল হক
তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

রক্ত লাল

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে

গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়

ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের

জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।

যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে

রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে

প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা

উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।

কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত

শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।

এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়

দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব

মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।

এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ

ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার

অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে

ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে

বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।

যত দেখি

যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে

জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা

শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।

যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।

হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।

যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।

ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত

করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!

সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।

জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ

আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।

তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে

অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই

কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার

প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।

এ যেন কেমন

গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে

চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে

একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির

মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে

এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ

কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা

আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।

সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে

নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার

অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।

জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?

চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার

যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।

চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?

যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!

চলে আসুন সবজি বাজারে

মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু

যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার

উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে

হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।

প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো

পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?

হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে

যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!

চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা

ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।

যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।

আহা! দেখার কেউ নেই!

এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।

কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ

কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?

কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।

চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।

ইতিহাস

আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই

নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব

ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।

আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---

আমি নই কারও!

সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম

ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে

অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ

ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু

এক মুখচ্ছবি।

আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে

হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার

কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।

কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।

দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!

আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না

হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে

ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে

সবকিছুর-ই সময় থাকে---

এরপর---ইতিহাস!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিদায় নেওয়া হুমায়ূন এখনো আছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’

‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’

হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,

‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।

হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।

তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’

ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘হীরক রাজার দেশে’ মঞ্চস্থ করল স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।

মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।

হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত