রোববার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪

সেকশন

 

প্রসঙ্গ: পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ

আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১৬

বছরের শুরুর দিন প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর জন্য পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়ে পৌঁছে দেওয়া কঠিন। ছবি: আজকের পত্রিকা ৩১ আগস্ট নিজ বাসভবনে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের কাছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান কর্মযজ্ঞ নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার প্রেক্ষাপট ছিল দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা। তবে আমি এই লেখায় পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের ব্যাপারেই শুধু বলব।

শিক্ষা উপদেষ্টা সেদিন বললেন, ‘আগামী বছরে আবার নতুন পুস্তক দিতে হবে। তার জন্য এক সপ্তাহ বা ১০ দিনের মধ্যে এগুলো প্রেসে না দিই, বাংলাদেশে যত প্রেস আছে, ২৪ ঘণ্টা কাজ করলেও সেগুলো যথাসময়ে পাওয়া যাবে না।’ তাঁর জন্য তখন আমার রীতিমতো খারাপই লাগছিল। সদ্য বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমে কাজ করার সময় দেখেছি প্রতিবছরই আগস্ট মাস হলে সব ধরনের কাজের চাপ রাতারাতি কয়েক গুণ বেড়ে যেত। গত চার বছরের প্রতিটিতেই আমরা বছরের শুরু থেকে কাজ করতাম। তারপরও বছরের শেষের দিকে এসে এর সঙ্গে জড়িতরা ঘুমানোরও সময় পেতেন না। আর এখন তো সরকারকে বেশ বড়সড় নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কাজেই এবার এই কর্মযজ্ঞ অকল্পনীয় রকমের কঠিন হয়ে যাবে। শিক্ষা উপদেষ্টা যে মাত্র ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে পাণ্ডুলিপি প্রেসে পাঠানোর বাধ্যবাধ্যকতার কথা বলেছেন এটি খুবই সত্যি কথা। এত চাপের মধ্যে থেকেও তিনি পাঠ্যপুস্তকের ছাপার মান ভালো করার কথা ভাবছেন দেখে ভালো লাগল।

শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে আমার গত চার বছরের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা বলব। সদ্য বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইগুলোর একটি সমালোচনা ছিল ছাপার মান। আমি লেখক কপি হিসেবে যা পেয়েছি সেটি তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও পরে আমার পরিচিত কিছু শিক্ষকের কাছে যেসব কপি দেখেছি, তাতে ছাপার মান বেশ খারাপ ছিল। আমার এক বন্ধুর মেয়ের বইয়ে সৌরজগতের ছবির প্লেট খুব সম্ভবত নড়ে গিয়েছিল। এ কারণে গ্রহের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল! আনন্দের বিষয় হলো, শিক্ষা উপদেষ্টা এই বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলেছেন—‘জানুয়ারি মাসে সব (বই) দিতে পারব না। চেষ্টা করছি এবং অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, কিছু প্রয়োজনীয় বই দিলে পাঠ্যক্রম শুরু করা যায়। এটা ঠিক যে তাড়াহুড়া করে আমি বইয়ের মান নষ্ট করতে চাই না। এই বিষয়ে যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁদের বলেছি, বইয়ের ছাপা, বইয়ের যে কাগজ—এগুলোর মান আগের থেকে ভালো হতে হবে।’

সিন্ডিকেট করে বই ছাপার বিষয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘বই ছাপার ব্যাপারে যে বড় দুর্নীতি হতো, সেটা সাশ্রয় করলেও আপনারা (মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন) অনেক বেশি অর্থ পেয়ে যেতে পারেন। সেখান থেকেও পাঠ্যপুস্তকের বইয়ের মান বাড়ানো যেত। তারপরও যদি ঘাটতি থাকে, অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে। ভালো পাঠ্যপুস্তক করার চেষ্টা করব।’

এই উদ্যোগের সাফল্যের ব্যাপারে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা শুরু করেছি। একটি লেখায় আমি গত এপ্রিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের একটি কর্মশালার কথা বলেছি। সেখানে বোর্ডের একজন বড় কর্তার সঙ্গে বইয়ের মান নিয়ে আমার কিছু আলাপ হয়েছিল। সেই আলাপ যদি আমি ঠিকমতো বুঝে থাকি, তাহলে পাঠ্যবইয়ের দরপত্র যখন দেওয়া হয়, তখন সর্বনিম্ন দর সরকারের প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে কম থাকে। যেহেতু পাঠ্যবই পণ্য হিসেবে দরপত্র দিয়ে কেনা হয়, সেবা হিসেবে কেনা হয় না, তাই সরকার আইনত সর্বনিম্ন দরদাতাকে দরপত্রটি দিতে বাধ্য। সেই বড়কর্তা বলেছিলেন, তাঁরা এখন চিন্তাভাবনা করছেন—সরকারি ক্রয়বিধি অনুযায়ী কীভাবে পাঠ্যপুস্তকের দরপত্রটিকে সেবা কেনার দরপত্র হিসেবে প্রকাশ করা যায়। খুব সম্ভবত তাঁরা সেবা হিসেবে কিনতে পারলে যিনি সেবাটি সবচেয়ে ভালো দিতে পারবেন তাঁর থেকেই নেবেন, যিনি সবচেয়ে কম খরচে দিচ্ছেন তাঁর থেকে নয়। কারণ, একজন খুব অল্প টাকায় বই ছাপিয়ে দিলে তিনি হয়তো সেই বইয়ের ছাপার মানের ব্যাপারে আপস করতে পারেন।

আমি যেটি ভয় পাচ্ছি সেটি হলো, শিক্ষা উপদেষ্টার পরিস্থিতি ২০০৯ সালের বারাক ওবামার মতো হতে পারে! ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার পড়ে ওবামা ব্যাংকগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন, যাতে ব্যাংকগুলো তাদের মন্দ ঋণগুলোর ক্ষতি সামলে নিতে পারে। এরা ছিল সেই সব ব্যাংকার যাদের অতিরিক্ত লোভ ২০০৮-এর বৈশ্বিক মন্দা সৃষ্টি করেছিল। যদি ওবামা সেটি না করতেন তাহলে ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত না। এর ফলে অনেক লোকের চাকরি চলে যেত। পাশাপাশি বাজারব্যবস্থায় কাঠামোগত ঝুঁকি তৈরি হতো। অন্যদিকে, যেহেতু এই লোভী ব্যাংকারদের কাছেই তিনি মন্দ ঋণ সামলে নেওয়ার আশা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে তিনি শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি।

শিক্ষা উপদেষ্টার এ মুহুর্তে মূল লক্ষ্য হলো জানুয়ারির এক তারিখের মধ্যে অন্তত কিছু পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া। তবে যে সিন্ডিকেটের কথা বলেছেন সেটি যদি দ্রুত ভেঙে দেওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই! কিন্তু যদি সময় সংকটের কারণে সেই সিন্ডিকেটের কাছেই তাঁকে ফিরে যেতে হয়, অন্তত আগামী এক বছরের জন্য, তাহলে কীভাবে পাঠ্যপুস্তকের মান আগের চেয়ে ভালো করা যাবে সেই ব্যাপারটি নিয়ে আশা করি তাঁর সুনির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা আছে।

আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ হলো, যদি কোনো কারণে সিন্ডিকেটের কাছে ফিরে যেতেই হয়, তাহলে অন্তত পাঠ্যপুস্তকের প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেকশন আর পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন—এই দুটি ধাপে যেন আমূল পরিবর্তন করা হয়। এর জন্য এখনো হাতে কিছু সময় আছে, কারণ প্রেস থেকে বই আসার পরেই কেবল প্রথম ইন্সপেকশনটি শুরু হয়। শেষের ইন্সপেকশনটি করা হয় বই বাচ্চাদের হাতে যাওয়ার পড়ে। কাজেই তার জন্য সময় আছে আরও অনেক বেশি। এই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে বোর্ড আগের বছরের ইন্সপেকশনগুলোর একটি ভালো অডিট করিয়ে একটি প্রতিবেদন শিক্ষক আর অভিভাবকদের জন্য প্রকাশ করতে পারে। আর এইবার না হলেও যদি দীর্ঘমেয়াদে এই ইন্সপেকশনের প্রতিবেদনগুলো বিধি তৈরি করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়, তাহলে বইয়ের ছাপার মান কেন ভালো হয় না তার রহস্য অনেকাংশে সমাধান করা যাবে। কেননা কথায় বলে, সূর্যালোক রোগবিনাশী। দীর্ঘমেয়াদে এই কাঠামোগত পরিবর্তন জবাবদিহির একটি ভালো উদাহরণও তৈরি করবে।

আগামী বছরের শুরুতে বই বাচ্চাদের হাতে চলে যাওয়ার পর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কাজের চাপ যখন অনেকাংশে কমে আসবে, তখন আমার পরামর্শ থাকবে সরকারি ক্রয়নীতিটি যেন আরেকবার ভালো করে দেখা হয়। যদি এই নীতির পরিবর্তন করে বই ছাপার মানের অবনয়ন কঠিন করে ফেলা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে কাঠামোগত কারণে শিক্ষার্থীদের শিখনঘাটতি হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে।

প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর জন্য পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়ে জানুয়ারির ১ তারিখে পৌঁছে দেওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। তাই আমি আগের শিক্ষাক্রমের সহকর্মীদের বলতাম, বেশির ভাগ পরামর্শ যাঁরা দিচ্ছেন তাঁরা নিজেরা কোনো দিন এত কঠিন কাজ করেননি। পরামর্শদাতা ভিনদেশি হলে বলতাম আগে জিজ্ঞেস করতে কখনো ১০০ শিক্ষার্থীতে ভর্তি ক্লাসরুমে বসার অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে কি না। নতুন যাঁরা দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁদেরও একই কথা বলব। পৃথিবীর বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রশাসককে এত কঠিন সমস্যার সমাধান করতে হয় না। কাজেই কাজটি ভালো করে করলে কেমন হবে তার কোনো ভালো উদাহরণও নেই! এ ক্ষেত্রে আসলে নিজের বিবেক আর আত্মবিশ্বাসকে ধরে রেখেই কাজ করে যেতে হবে। এই বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সফলতা কামনা করছি।

লেখক: তত্ত্বীয় কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও গবেষক

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    এলাকার খবর

     

    সংলাপে গুরুত্ব পাবে সংস্কার, পোশাকশিল্প ও আইনশৃঙ্খলা

    মাথাপিছু জিডিপির শুভংকরের ফাঁকি, হাসিনার উন্নয়নের গলাবাজি

    সংস্কারের বড় চ্যালেঞ্জ রাজনীতি

    মব জাস্টিস

    ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

    সম্পর্কের গল্প নিয়ে ওয়েব ফিল্ম ‘ত্রিভুজ’

    পানির নিচে দুই শতাধিক গ্রাম

    ‘রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি সমান্তরালে চলবে’

    রিটেইল স্টার্টআপ অ্যাওয়ার্ড পেল ‘ফুডি’

    মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি 

    ৫-৭ আগস্টের মধ্যেই পালিয়েছেন বিগত সরকারের লোকেরা: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

    বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর নামে প্রতারণা, গ্রেপ্তার ২