Ajker Patrika

মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক অবস্থান

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক অবস্থান

রাজনীতিতে মওলানার রাজনৈতিক অবস্থান পেটি বুর্জোয়াদের পক্ষে ছিল অসহ্য, কারণ তিনি যেটা চাইছিলেন, সেটি হলো সামাজিক বিপ্লব, যদিও ওই বিপ্লবের কথা পরিষ্কারভাবে তিনি বলতে পারেননি। বিপ্লবের অত্যাবশ্যকতার ধারণায় পৌঁছাতেও তাঁর সময় লেগেছে। স্থিরভাবে রাজনৈতিক সাহিত্য অধ্যয়ন করার ও লেখার কাজে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ তিনি পাননি। তদুপরি তিনি ছিলেন মাদ্রাসায় শিক্ষিত এবং প্রথম জীবনে লোকে তাঁকে মানত একজন পীর হিসেবে, তিনি তাদের বিশ্বাসকে আঘাত করতেন না, যদিও জানতেন যে তাঁর পানিপড়া ও ঝাড়ফুঁকে কোনো কাজ হবে না। পরামর্শ দিতেন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে, টাকা গুঁজে দিতেন হাতে, প্রয়োজন দেখলে। সে জন্য তাঁর পক্ষে ও সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কাছেও মনে হয়েছে সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁর চিন্তা ছিল অত্যন্ত অস্পষ্ট। যেমনটা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বদরুদ্দীন উমর বলেছেন তাঁর ‘পলিটিকস অ্যান্ড সোসাইটি ইন ইস্ট পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ’ বইয়ে। তা ছাড়া, তাঁর বক্তব্য প্রচারের জন্য পত্রপত্রিকাও ছিল না। ইত্তেফাকের মালিকানা বদল হয়েছিল।

অন্য পত্রিকার সবগুলোই ছিল হয় সরকার-সমর্থক, নয়তো টাকাওয়ালাদের মালিকানার; তারা সবই মওলানার প্রতি বিরূপ ছিল। মওলানার মধ্যে দোদুল্যমানতা ছিল না; তবে একধরনের অস্থিরতা ছিল বলে তাঁর অনুসারীদের কেউ কেউ মনে করেন। সেটা যে অসত্য, তা-ও নয়। যে জন্য দেখা যেত তিনি আচমকা কোনো কোনো সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলছেন, অন্যদের না জানিয়ে। যেন পেটি বুর্জোয়া তৎপরতা। কিন্তু পরে যা প্রমাণিত হয়েছে তা হলো, তাঁর সিদ্ধান্তগুলোর কোনোটাই ভ্রান্ত ছিল না। তাঁর ধীশক্তি ছিল অসাধারণ; তিনি টের পেতেন মানুষ কী চায়, তারা কত দূর যেতে প্রস্তুত এবং প্রতিপক্ষের সবলতা কোথায়, কোথায় দুর্বলতা। কখনো কখনো মনে হতো তিনি তাঁর মতকে জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছেন। আসলে তিনি যা করতেন তা হলো, পাছে বিলম্ব ঘটে তাই সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত নেওয়া এবং তাঁর জন্য খুব বড় রকমের অসুবিধা ছিল এই যে তাঁর রাজনৈতিক সংগঠন সুসংগঠিত ছিল না। সংগঠনের ভেতরে বিভিন্ন মত কাজ করত; কোনো অংশ ছিল ভ্রান্ত আবার কোনো অংশ প্রতিক্রিয়াশীল।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে তিনি মুসলিম লীগে ছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠা পেল, তখন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি টের পেলেন যে এই পাকিস্তান মানুষকে মুক্তি দেবে না; এখানে পুরোনো শাসন-শোষণই আবার নতুন চেহারায় বহাল থাকবে; তাই দ্রুতই তিনি মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলেন এবং তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে তো বটেই, প্রধানত তাঁর চেষ্টাতেই আওয়ামী মুসলিম লীগ একটি শক্তিশালী গণসংগঠন হয়ে উঠল। সংগঠনের অসাম্প্রদায়িকীকরণও তাঁর আগ্রহেই ঘটল। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে সক্ষম হলো, তখন স্বায়ত্তশাসন ও পররাষ্ট্রনীতি—এই দুই মৌলিক প্রশ্নে দলের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন অবস্থানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে চলে যেতে চাইল। ফলে দল দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। এরপর প্রগতিশীল অংশটি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে একত্র হয়ে ন্যাপ গঠন করে।

এবারও নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাসানীই। ন্যাপের মূল শক্তি ছিলেন কমিউনিস্ট কর্মীরা; কিন্তু পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির তখনকার নেতৃত্ব ন্যাপ গঠনে খুব একটা খুশি হননি, তাঁরা আওয়ামী লীগ ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না। কিন্তু ন্যাপ নিজেও ঐক্যবদ্ধ রইল না, ভাগ হয়ে গেল রুশপন্থী ও চীনপন্থী। চীনপন্থীদের বড় অংশটি আবার পরিণত হলো নকশালপন্থীতে। এসবের ফলে ভাসানী অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন 
এবং ন্যাপের ভেতর সুবিধাবাদীরা মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বে দলের নেতৃত্ব পেয়ে গেল। ভাসানী বদলাননি, তিনি তাঁর সমাজবিপ্লবী অবস্থানে অটল ছিলেন, তাঁর অনুসারীরাই বিচ্যুত হয়েছেন এবং বিচ্যুত হয়ে অভিযোগ করেছেন ভাসানীর বিরুদ্ধেই।

আর ওই যে তাঁর বিপ্লবমুখী অবস্থান, এর জন্যই ডানের তো বটেই, আপসপন্থী বামেরাও তাঁর বিরুদ্ধে চলে গেছে। চলে গেছে এমনকি সীমিত বুদ্ধি ও অতিউৎসাহী নকশালপন্থীরা। বিপক্ষের লোকেরা কেউ বলেছে, তিনি ‘রহস্যময়’; কেউ বলেছে, তিনি হঠকারী। উনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময় আমেরিকার ‘টাইম’ পত্রিকা তাদের প্রচ্ছদে ভাসানীর ছবি ছাপিয়ে নিচে লিখে দিয়েছিল, ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’; আর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘নিউ টাইম’ লিখেছে, পূর্ব পাকিস্তানে ‘কিছু চীনপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী নৈরাজ্যজনক কার্যকলাপ শুরু করেছে’। পরস্পরবিরুদ্ধ দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির এই ঐক্যতে অবশ্য বিস্ময়ের কোনো কারণ ছিল না। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন আর আগের অবস্থানে নেই, অপুঁজিবাদী বিকাশ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে আস্থা স্থাপন করে এবং শ্রেণিসংগ্রাম বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সমাজতন্ত্র কায়েম সম্ভব বলে বিশ্বাসী হয়ে রীতিমতো ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ চেহারা নিয়ে ফেলেছে।

শুরু থেকেই পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্টদের মনে করত পয়লা নম্বর দুশমন। ভাসানী কমিউনিস্টদের সঙ্গে আছেন, তাই তিনিও বড় মাপের দুশমন বৈকি। এমন কথা সোহরাওয়ার্দীও বলেছেন, আইয়ুব খান তো বলেছেনই। উনসত্তরের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার সময়ে যে ভাষণ দেন, তার একেবারে শুরুতেই ‘ঘেরাও’-এর বিরুদ্ধে নিজের বিদ্বেষ প্রকাশ করেছিলেন, আর ঘেরাওয়ের উদ্যোক্তা তো ছিলেন মওলানা ভাসানীই। আইয়ুবের এককালীন সহযোগী ইস্কান্দার মির্জা পূর্ববঙ্গের গভর্নর হয়ে প্রথম যে কাজগুলো করেছিলেন, সেগুলোর একটি ছিল মওলানা ভাসানীকে পাওয়া মাত্র গুলি করে হত্যা করার হুমকি দেওয়া। পরে প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভাসানীকে গ্রেপ্তারের। প্রথমে পারেননি, কিন্তু পরে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে একেবারে শুরুতেই যাঁদের কারাবন্দী করেছিলেন, ভাসানী ছিলেন তাঁদেরই একজন। সে সময়ে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আটক করে রাখা হয়েছিল একটানা প্রায় চার বছর।

মওলানা ভাসানীকে বলা হয় কৃষকনেতা। এক অর্থে সেটা তিনি ছিলেন বৈকি। কিন্তু কেবল কৃষকের নয়, নেতা ছিলেন তিনি মৎস্যজীবী, বিড়িশ্রমিক, কারখানার শ্রমিক, চা-শ্রমিক, রিকশাশ্রমিক, পাটচাষিসহ সব মেহনতি মানুষের। তাঁদের মুক্তির জন্য তিনি লড়াই করেছেন। তাঁর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা ছিল অনমনীয়। গ্রামের মানুষ তিনি, গ্রামেই থাকতে পছন্দ করতেন, কিন্তু যোগ দিয়েছেন পৃথিবীর নানা দেশে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সম্মেলনে। ওদিকে পুঁজিবাদকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন পুরোপুরি। তাঁর বক্তৃতায়, বিবৃতিতে তো অবশ্যই, জীবনযাপনে, বসবাসে, জামাকাপড়েও উচ্চারণ ছিল সেই প্রত্যাখ্যানের। ইংরেজি ভাষা তিনি ভালোই জানতেন, ওই ভাষায় ব্যক্ত বক্তব্য বুঝতে তাঁর বিন্দুমাত্র অসুবিধা হতো না; নিজের বক্তব্য ইংরেজিতে প্রকাশও করতে পারতেন ইচ্ছা করলে; কিন্তু বিদেশিদের সঙ্গে আলাপে সব সময় দোভাষীর সাহায্য নিতেন; সেটি ছিল তাঁর পুঁজিবাদকে পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যানেরই নিদর্শন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীতাঁর ভরসা ছিল জনগণের ওপরই। শ্রেণিচ্যুত মধ্যবিত্তকে তিনি সঙ্গে পেয়েছেন এবং সাদরে কাছে টেনে নিয়েছেন, কিন্তু তিনি জানতেন যে মেহনতি মানুষের জাগরণ ভিন্ন মুক্তি আসবে না; সে জন্য তিনি মেহনতিদের সংগঠন গড়ে তুলেছেন, কৃষক সমিতিতে ছিল তাঁর বিশেষ রকমের আগ্রহ; তিনি লাল টুপি বাহিনী প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, ঘেরাও ও হাট হরতালের প্রবর্তন করেছেন। গ্রামে গ্রামে তিনি ঘুরে বেড়াতেন মানুষকে সচেতন করার জন্য। জনমুক্তির জন্য সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিকেও তিনি অপরিহার্য বলে জানতেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পরে তাঁর একেবারে প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল বক্তব্য ও সংবাদ প্রচারের জন্য একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করা। কাগমারীতে তিনি যে আন্তর্জাতিক ধরনের একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন, সেটা কোনো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার ছিল না, ছিল একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে রেডিওতে যখন রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করেছেন। মওলানাও সাড়া দিয়েছিলেন সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু তাঁর প্রতিবাদের ধরনটা ছিল ভিন্ন রকমের। অন্যদের মতো তাঁর আবেদন সরকারের কাছে ছিল না। ছিল জনগণের কাছে। জনগণকে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। দৃষ্টিভঙ্গির এই বৈশিষ্ট্যটি খেয়াল না করলে তাঁকে বুঝে ওঠা কঠিন, বিশেষ করে এলিট শ্রেণিভুক্তদের পক্ষে।

মওলানা ভাসানী বর্তমানকে জানতেন এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যৎকেও দেখতে পেতেন। অনেক বড় মাপের একজন কবির মতো ছিল তাঁর দেখার ক্ষমতা। তাঁর বক্তৃতাতে কেবল আগুনই থাকত না, থাকত কবিতাও। তাঁর ছিল কবির কল্পনাশক্তি। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের যে স্থান, বাংলার রাজনীতিতে মওলানা ভাসানীর স্থানও সে রকমেরই। মৌলিক ও বিপ্লবী। নজরুল শেষ পর্যন্ত নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলেন; সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাহায্য না পেয়ে। মওলানা ভাসানীও শেষ জীবনে যথার্থ সঙ্গীসাথি পাননি; কিন্তু তিনি নিশ্চুপ হয়ে যাননি, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সজীব ও সক্রিয় ছিলেন আন্দোলনে। ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে যেহেতু বিশ্বাস করতেন না, তাঁর জন্য তাই হারানোর কোনো ভয় ছিল না। জয় করার ছিল মেহনতিদের মুক্তি।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করে যা বলল ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

দুই মামলা থেকে মির্জা আব্বাস-আমান-গয়েশ্বরসহ ৪৫ জনকে অব্যাহতি

ওসমান হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন

হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, হেলমেট ও ভুয়া নম্বরপ্লেট উদ্ধার

বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ