Ajker Patrika

নাগরিক দায়: শাসকের সবচেয়ে বড় দায়

মামুনুর রশীদ
আপডেট : ০৯ জুন ২০২২, ০৮: ৪৪
নাগরিক দায়: শাসকের সবচেয়ে বড় দায়

বাজারে দ্রব্যমূল্যের আগুন জ্বলছে বেশ কিছুদিন ধরে। অকারণে এই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস উঠেছে এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে। যেকোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে গেলেই কয়েক দিন আগের দামের সঙ্গে একেবারেই অন্যায়ভাবে শতকরা ২০ থেকে ৫০ ভাগ দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার নানা কথা বললেও কোনো লাভ হচ্ছে না, দাম বেড়েই চলেছে।

এর মধ্যেই চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল। ইতিমধ্যে ৪৪ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এবং অপেক্ষায় আছে মারাত্মকভাবে দগ্ধ আরও কয়েকজন। আগুন নেভাতে গিয়ে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ফায়ার সার্ভিসের নয়জন কর্মী বীরের মৃত্যু আলিঙ্গন করেছেন। এর আগে তাজরীন গার্মেন্টস, নিমতলী ও চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে শত শত প্রাণ হারিয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে মৃত্যু সে এক ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। মৃত্যুগুলোর একটিই কারণ—দায়িত্বহীনতা।

আমরা কারখানা গড়ব, মুনাফা নেব আর যাঁদের কারণে কলকারখানার উৎপাদন হয়, তাঁদের প্রতি চরম অবহেলা দেখাব! রাষ্ট্রে আইনের অভাব নেই, অনেক আইন রাষ্ট্রকে করতেও হয় না। ব্রিটিশ আমল থেকে রয়ে গেছে। কিন্তু সেই আইনের প্রয়োগ নেই এবং না মানলেও কিছু যায়-আসে না। যে সংস্থা এই আইনের যথাযোগ্য প্রয়োগ করবে, সে সক্রিয় নয়, কিছু মাসোহারাতেই তারা সন্তুষ্ট। বহুবার নির্মাণ আইনের কথা বলা হয়েছে এবং বাসভবন বা যেকোনো স্থাপনার নিরাপত্তার জন্য আইন আছে। সেসব আইনেরও বাস্তবিক প্রয়োগ নেই। ৩০-৪০ বছর ধরে যেভাবে ঢাকাসহ সারা দেশে অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের হিড়িক পড়েছে, তাতে যথার্থ অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা আছে কি না, তা কেউ পরীক্ষা করছে না। আগুন ধরে গেলে ওই ভবনের যাঁরা বাসিন্দা তাঁরা কী করে দ্রুত বের হবেন, তার কোনো ব্যবস্থা নেই।

একাধিক তলাবিশিষ্ট দালানে সাধারণত আমরা পেছনের দিকে একটি লোহার সিঁড়ি দেখতে পাই, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফায়ার এক্সিট’। আজকাল কোনো ভবনেই এই লোহার সিঁড়িটি দেখা যায় না। তার বদলে নাকি আরও আধুনিক ব্যবস্থা এসেছে। সেই ব্যবস্থাও দৃশ্যমান হয় না। সব জায়গাতেই কর্তৃপক্ষ রয়েছে, ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত লোক আছে, সিটি করপোরেশনের হাতে ক্ষমতা আছে। আজ অবধি শুধু ট্যাক্স কালেক্টরকে দেখতে পাই আর রাস্তায় আবর্জনার স্তূপ দেখতে পাই। কিন্তু সিটি করপোরেশনের ভবন তদারককারী কোনো বিল্ডিং ইন্সপেক্টরকে দেখতে পাই না।

উন্নত দেশগুলোতে এবং তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশেও এই বিল্ডিং ইন্সপেক্টরের অস্তিত্ব সব সময় পাওয়া যায়। স্বাধীনতার ৫১ বছর হয়ে গেল, অথচ এই সব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার জন্য লোকজনের দেখা মেলে না আমাদের দেশে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা সিটি করপোরেশনের ট্যাক্স কেন দিই? এই ট্যাক্সের টাকা, সরকারের অনুদান—এসব মিলিয়ে বেশ একটা মোটা অঙ্কের টাকা সিটি করপোরেশনের হাতে থাকে। কিন্তু তার বিনিময়ে আমরা নগরবাসী কী সেবাটা পাই?

কলকারখানা নির্মাণের ক্ষেত্রে বহু ধরনের আইন আছে। কোথাও যদি দাহ্য পদার্থ রাখা হয়, তার সুরক্ষার জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থার কথা সেই আইনে উল্লেখ আছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে দেখা যায় না। যদি দেখাই যেত তাহলে তাজরীন বা রানা প্লাজায় এত বড় ঘটনা ঘটত না। পুরান ঢাকায় অনেক দালানকোঠা আছে, যেগুলো বহু বছর যাবৎ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। কোনো কোনো জায়গায় অগ্নিকাণ্ড হলে বা দালান ভেঙে পড়লে সেখানকার মানুষজনকে বাঁচানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে পারবে না। এসব তদারকির জন্য সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন এবং জনবলও আছে।

গত ৫১ বছরে এবং তার সঙ্গে যদি আরও ২৪ বছর যোগ করি তাহলে ৭৫ বছর সিটি করপোরেশনের কোনো লোক শুধু ট্যাক্স গ্রহণের জন্য বাড়িতে আসা ছাড়া তাঁদের কোনো কাজে দেখি না। কাউন্সিলর নির্বাচনের সময় কখনো কখনো খোদ প্রার্থী নন, তাঁর চ্যালাচামুন্ডার দেখা পাওয়া গেছে। সরকার জনগণের ট্যাক্সের অর্থে পরিচালিত হয়। এই ট্যাক্স বিভিন্নভাবে সরকারের কোষাগারে যায়। ফ্যাক্টরি, ব্যবসা-বাণিজ্য এসব থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকে সরকার। এই অর্থ ব্যয়ের জন্য জনবল নিয়োগ করা আছে। এই জনবলের আবার দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণও আছে। কিন্তু কার্যক্রমে একেবারেই অসাড়। কখনো কখনো সিটি করপোরেশন ও কারখানা সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে তাঁর যদি ক্ষমতা বাস্তবায়ন করতে যান, তাহলে তাঁর অসাধু সহকর্মীদের চাপে অসহায় হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রের আইনে মানুষের নিরাপত্তা খুব অল্প দামেই বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু তার খেসারত দিতে হয় শত শত, হাজার হাজার নিরীহ আদম সন্তানকে।

রানা প্লাজায় যা দেখেছি, একই দৃশ্যের অবতারণা চট্টগ্রামের কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিদুর্ঘটনায় মানুষ তাদের স্বজনদের ছবি নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আগুনে এমনভাবে চেহারা বিকৃত হয়েছে যে চেনা যাচ্ছে না। কী মর্মান্তিক! লাশগুলো সারিবদ্ধভাবে পড়ে আছে এবং তাদের কোনো পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে। মৃত্যুর চেয়েও তা নিষ্ঠুর। এই সবকিছু এড়ানোর জন্য শুধু আইন মেনে এবং নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করলেই এ রকম হওয়ার কথা নয়।

বাংলাদেশে মানুষের জীবনের মূল্য খুবই কম। প্রতিদিন ব্যবসায়ীদের চক্করে পড়ে যেভাবে পণ্যের দাম বাড়ে, মানুষের জীবনের দাম তেমন বাড়ে না; বরং নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে, কর্তৃপক্ষের অবহেলা, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি—এসব কারণে এমন একটা দিন যায় না, যেখানে আর কিছু না হলেও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় না। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু সে তো প্রাকৃতিক কারণে হয় না, একেবারেই মানুষের তৈরি। কতগুলো দায়িত্বহীন মানুষের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে আমাদের উন্নয়ন আশীর্বাদের বদলে অভিশাপে পরিণত হয়েছে।

মামুনুর রশীদরাষ্ট্র নাগরিকের এবং এই নাগরিক নিজেরা তাঁদের শাসক নির্বাচন করে থাকেন। যাঁরা শাসক হন, তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড় দায় হলো—নাগরিক দায়। নাগরিকদের কল্যাণ, তাঁদের জীবনযাপন, শৃঙ্খলা এসবকে দেখভাল করার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করে থাকেন। সরকারের কর্মী বাহিনী রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থেকে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন। এই কর্মী বাহিনী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জাতীয় উন্নয়নে, শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকার কথা। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অবহেলায়, দুর্নীতির বেড়াজালে, স্বজনপ্রীতিতে ক্রমেই প্রশাসন নামে যন্ত্রটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নির্জীব হতে থাকে। নাগরিক সেবার চেয়ে খবরদারি, ক্ষমতার অপব্যবহার—এসবই মুখ্য হয়ে পড়ে। সরকারের যে নাগরিক দায়, বিষয়টা ক্রমাগত আমরা ভুলতে বসেছি। সর্বত্র সেবার বিনিময়ে অর্থ। অর্থ ছাড়া সরকারি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দেয়ালের সঙ্গেও কথা বলেন না। দেয়াল এবং ইট-কাঠও নাকি টাকাখেকো।

আমরা বড় বড় দুর্ঘটনার পর প্রত্যাশা করি, এবারে একটা কিছু হবে। কিন্তু দেখা যায় কিছুই হয় না, আইন-আদালতে সেসব পৌঁছায় না। টাকার অভাবনীয় শক্তিতে সব মিটমাট হয়ে যায়। ৩০ বছর ধরে নির্মাণ, উন্নয়ন, অসংখ্য কলকারখানা স্থাপন হচ্ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিক ব্যবস্থাপনা কত দূর এগিয়েছে, তাতে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। রাষ্ট্রের আয় বেড়েছে, কিন্তু নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি কত দূর এগিয়েছে, তা সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে।

অনেক স্থানেই, বিশেষ করে কারখানাগুলোতে বলা থাকে ‘নিরাপত্তাই প্রথম’। কিন্তু নিরাপত্তা প্রথম তো নয়ই, শেষও নয়। বিপুল বেকারত্বের দেশে মানুষ খুব সহজেই একটা চাকরিতে রাজি হয়ে যান। লাখ টাকা খরচ করে, ঘরবাড়ি বিক্রি করে একটা ছোট্ট পিয়নের চাকরি নিয়ে থাকেন। এরপর বাড়িঘর বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে মধ্যপ্রাচ্য গিয়ে আশার ছলনে ভুলে আবার দেশে ফিরে আসেন। যেসব শ্রমিক ভয়ংকর আগুনে ভস্মীভূত হলেন, তাঁদের জীবনের মূল্য নির্ধারিত হলো কয়েক লাখ টাকায়। আর আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের যে তরুণেরা শহীদ হলেন, তাঁদের জীবনের মূল্য হয়তো সরকারি আইনেই নির্ধারিত হবে। কিন্তু দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হলো, তার মূল্য কে দেবে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডিজির সঙ্গে তর্ক: অব্যাহতির ৪ দিনের মাথায় পুনর্বহাল ময়মনসিংহের চিকিৎসক

রাশেদ খানের পদত্যাগ চেয়ে গণঅধিকারের উচ্চতর পরিষদ সদস্যের অনাস্থা

বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত ৩ গর্ত, শাস্তি চান সাজিদের মা

লটারিতে স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেল ৩ লাখ ৫ হাজার শিক্ষার্থী

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে খুন: গলার পোড়া দাগেই শনাক্ত হন গৃহকর্মী আয়েশা

এলাকার খবর
Loading...