Ajker Patrika

‘বাঙালি মানুষ যদি…’

চিররঞ্জন সরকার
‘বাঙালি মানুষ যদি…’

প্রথমেই একটি পুরোনো গল্প দিয়ে শুরু করা যাক।

বহু বছর আগের কথা। একবার এক বড়লোক বাবা ছেলেকে নিয়ে ভ্রমণে বের হয়েছেন। একটা সরু রাস্তায় বাবা ঘোড়ার পিঠে আর ছেলে ঘোড়ার দড়ি ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে লোকজন বলাবলি করতে লাগল, কেমন পাষাণ বাবা! নাবালক ছেলেকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আর নিজে শাহেনশাহের মতো ঘোড়ার পিঠে আরাম করে যাচ্ছেন।

এ কথা শুনে বাবা ছেলেকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দড়ি ধরে হাঁটতে লাগলেন। তখন লোকেরা বলাবলি শুরু করল, কেমন বেয়াদব ছেলেরে বাবা! বুড়ো বাপটা হেঁটে যাচ্ছেন আর জোয়ান ছেলে নবাবের মতো ঘোড়ার পিঠে বসে আছে।

লোকেদের কথা শুনে বাপ-ছেলে একত্রে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলেন। তখন লোকেরা বলতে লাগল, মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কী করে! একটি অবোধ প্রাণীর পিঠে দুজন উঠে বসেছে! আরেকটু হলে তো বেচারা ঘোড়াটা অক্কা পাবে।

তখন রেগে গিয়ে বাপ-ছেলে দুজনই ঘোড়ার দড়ি ধরে হাঁটতে লাগলেন। তখন লোকে বলাবলি করতে লাগল, মানুষ এত বোকা হয় কী করে! সঙ্গে ঘোড়া থাকতে কেউ হেঁটে যায় নাকি? এমন আহাম্মকের সংখ্যা বাড়লে দুনিয়াটাই অচল হয়ে যাবে।

মানুষের স্বভাবই আসলে খুঁত ধরা, সমালোচনা করা। আপনি যে কাজই করুন, যত সততা, নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা দিয়ে করুন, কিছু মানুষ ভুল ধরবেই। সমালোচনা করবেই। তবে বাঙালি হলে সেই সমালোচনা, হিংসা, ঈর্ষা হয়ে আপনার সর্বনাশ কামনার মধ্য দিয়ে শেষ হবে।

বাঙালির স্বভাব বড়ই বিচিত্র। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বভাব সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো “আমরা মুসলমান, আরেকটা হলো, আমরা বাঙালি।” পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, “পরশ্রীকাতরতা”। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয় তাকে “পরশ্রীকাতর” বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাইয়ের উন্নতি দেখলে ভাই খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ার খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যত দিন চিনবে না এবং বুঝবে না, তত দিন এদের মুক্তি আসবে না। অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভালো দাড়ি, সামান্য আরবি-ফারসি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভালো করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।’

শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, বাংলা সাহিত্যে স্বভাবকবি নামে পরিচিত গোবিন্দ চন্দ্র দাস এক কবিতায় বাঙালির ‘স্বভাব’ নিয়ে একটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটির একটি অংশ হচ্ছে: 
‘‘যত মুসলমান হিন্দু, 
পতনের মহাসিন্ধু, 
নাহিধর্ম এক বিন্দু অতি নীচাশয়! 
বৃথা ও তিলক ফোটা, 
পাঁচ-ওক্ত মাথা কোটা, 
ধূর্ত্তমি ভণ্ডামি ওটা নিশ্চয় নিশ্চয়! 
একমেবাদ্বিতীয়ং, 
সেও থিয়েটারি সং, 
কলেজি নলেজি ঢং আর কিছু নয়। 
শত ভাল কীট কৃমি, 
এরা নরকের তিমি, 
ইহাদের আদি অন্ত অনন্ত নিরয়! 
অধম পিশাচগুলি, 
গর্দ্দভের পদধূলি, 
মাথায় মাখিয়া ছি ছি বড়লোক হয়!
বাঙালী মানুষ যদি, প্রেত কারে কয়?’’
(বাঙালী) 
পদস্থ মানুষকে অপদস্থ করায় বাঙালির জুড়ি নেই। টেনে নামানোর খেলায় সে ওপরে উঠেছে অনেক। যুগ যুগ ধরেই তার এক হাতে কাঠি, অন্য হাতে চুনকালির ভাঁড়। বাঙালির হতাশা আছে, নিরাপত্তাহীনতা-অনিশ্চয়তা আছে, কিন্তু সেসব ছাপিয়ে আছে অপরকে হেয় করার মজ্জাগত স্বভাব। বাঙালি কেউ কারও ভালো দেখতে পারে না। সারাক্ষণ চলে যে এগিয়ে গেছে তাকে পেছনে টেনে ধরার বিদ্যার চর্চা। একই সঙ্গে চলে ঠেলা, ধাক্কা, গুঁতো, ল্যাং। যে একটু ওপরে উঠে গিয়েছে, অথবা তাকে ছাপিয়ে ওপরে উঠতে পারে, তার ব্যাপারে বাঙালি অতিশয় সংবেদনশীল। চিন্তাশীলও। এক প্ল্যাটফর্মে থেকেও ওই ব্যাটা ওপরে উঠে গেল কেমনে? এ কি কপাল-জোর না ব্যাকডোর! আমি অধম মানছি। কিন্তু ও ব্যাটা উত্তম সাজবে কেন? অতএব, টেনে নামাও। পেছনে লাগো। হ্যারাস করো। অপমান করো। বদনাম করো। কলঙ্ক রটাও। পারলে বাসার সামনে নর্দমার ময়লা ঢেলে এসো। 
রবীন্দ্রনাথকেও বাঙালি ছেড়ে কথা বলেনি। ‘পায়রা কবি’ অভিধা জুড়েছে তাঁর সঙ্গে—

‘‘উড়িস নে রে পায়রা কবি
খোপের ভিতর থাক ঢাকা।
তোর বকবকম আর ফোঁসফোঁসানি
তাও কবিত্বের ভাব মাখা!’’
(কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, রাহু)

নজরুলকেও বাঙালি কখনো কাফের বানিয়েছে, কখনো প্যারোডি বানিয়ে তীব্র অপমান করেছে। নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের পর সেই সময়ের অন্য কবিরা যারপরনাই ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠে। নজরুলের ‘বল বীর-/বল উন্নত মম শির,/ শির নেহারি আমারি নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!/বল বীর-/বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!/ মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/বল বীর-/আমি চির উন্নত শির...’। কবিতার বিপরীতে ‘ভবকুমার প্রধান’ নামে ব্যঙ্গ করে লেখা হয় ‘অসমছন্দ’ কবিতাটি—

‘‘আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং
ভৈরব রভসে বর্ষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাং। 
আমি ব্যাঙ
আমি পথ হতে পথে দিয়ে চলি লাফ; 
শ্রাবণ নিশায় পরশে আমার সাহসিকা
অভিসারিকা
ডেকে ওঠে, বাপ বাপ।’’

বাঙালি নেতা মানে না। মনীষী-মহাপুরুষ কাউকেই ছাড় দেয় না। বিবেকানন্দ, রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বেগম রোকেয়া সবার নামেই বাঙালি কলঙ্ক দিয়েছে। শেরেবাংলা-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী সবার বিরুদ্ধেই নানা কুৎসা ও অপপ্রচার চালিয়েছে। এমনকি সুযোগ দেওয়া হলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও বাঙালি প্রতিদিন পাঁচ শ পৃষ্ঠার গিবত রচনা করবে।

চিররঞ্জন সরকারএখানে ‘সর্বজনমান্য’ বলে কেউ নেই। থাকার কারণও নেই। সবাইকে একটা ট্যাগ দিয়ে দেওয়া হয়। এ নতজানু, ও মেরুদণ্ডহীন, সে সুবিধাবাদী, ওরা দলদাস। এখানে কেউ সাচ্চা নয়। সব ঝুটা, সব নষ্ট। হলেও নষ্ট। না হলেও। হিংসা, ঈর্ষা সারাক্ষণ শিকারি কুকুরের মতো একে-ওকে ধাওয়া করছে।
কেউ নিজের মতো, স্বাধীন মতো চলতে পারবে না, চলতে দেওয়া হবে না। স্বাধীন জীবনযাপন করতে গিয়ে বাঙালির হাতে ‘জিনা-হারাম’ হওয়ার আরেক উদাহরণ সৈয়দ মুজতবা আলী। ষাটের দশকের শুরুর দিকে মুজতবা আলী দ্বিতীয় দফায় গেছেন শান্তিনিকেতনে, তখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে। স্বভাবতই বেরিয়ে পড়ল ঈর্ষার ঝুলি। ঠিকমতো ক্লাসে না যাওয়া, গবেষণার কাজ না করা, অনিয়মিত জীবনযাপন, মদ্যপান এসবের অভিযোগ উঠতে লাগল। একেবারে কোণঠাসা করে দেওয়া হলো তাঁকে। মুজতবা আলী এ সময় কাউকে চিঠি লিখলে, চিঠির মাথায় লিখতেন: ‘শ্মশান, শান্তিনিকেতন’! অন্নদাশঙ্কর রায় মুজতবা আলীকে উদ্ধৃত করেছেন: ‘যত দিন আমার চাকরি ছিল না সকলে আমার বন্ধু ছিল, এখন আমি সকলের ঈর্ষার পাত্র।’ তিনি পাকিস্তানের গুপ্তচর এমন কথাও রটে। শেষে গোয়েন্দা পুলিশের জেরার মুখোমুখিও হতে হয় তাঁকে।

এখনো বাঙালির তির কখনো তসলিমা নাসরিন, কখনো মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবিরকে বিদ্ধ করে। একটু কেউ প্রতিবাদী হলেই, উচিত কথা বললেই তাঁকে নিশানা করা হয়।

আমরা আসলে সেই বাঙালি, যারা সামনে আসার মুরোদ নেই বলে ‘পেছনে’ লাগি। ‘ঘুঘু দেখানো’ ও ‘বাঁশ দেওয়া’ যাদের প্রিয় শখ!  সত্যিই ‘বাঙালী মানুষ যদি, প্রেত কারে কয়!’

লেখক: চিররঞ্জন সরকার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ