Ajker Patrika

ম্রোদের আরও প্রান্তিক হয়ে ওঠা

আবু তাহের খান
ম্রোদের আরও প্রান্তিক হয়ে ওঠা

এ সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা অতীতের স্বাধীনতাবিহীন বিভিন্ন যুগে যে ধরনের নিগৃহীত জনগোষ্ঠী হিসেবে জীবনযাপন করত, স্বাধীনতার এ যুগে এসেও সেই পরিস্থিতির তেমন কোনো ইতরবিশেষ ঘটেনি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে।

খ্রিষ্টীয় নতুন বছরের প্রথম দিনে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ যখন বছরটিকে নানাভাবে আনন্দঘন করে তোলার চেষ্টায় মত্ত ছিল, ঠিক তখনই ১ জানুয়ারি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে বান্দরবানের লামা উপজেলার রেংয়েনপাড়ার ম্রোপল্লিতে। হামলাকারীরা অন্তত চারটি বাড়িতে ভাঙচুর ও তিনটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। আক্রমণের শিকার ম্রোরা ভীত ও আতঙ্কিত অবস্থায় পরপর দুই রাত খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায় এবং ঘটনার পর পর থানায় কোনো মামলা করতে সাহস বা সুযোগ পায়নি। তবে ৭ জানুয়ারি লামা থানায় পাড়ার কার্বারি (পাড়াপ্রধান) রেংয়েন ম্রো বাদী হয়ে মামলা করেন। উল্লেখ্য, একই বাড়িঘরে ২০২২ সালের এপ্রিলেও বাংলা নববর্ষের শুরুতে অনুরূপ আক্রমণ চালানো হয়েছিল। অভিযোগ, উল্লিখিত বাড়িঘর থেকে ম্রোদের উচ্ছেদ করে ওই জায়গা দখল করার জন্যই পার্শ্ববর্তী লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিকপক্ষ লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে উল্লিখিত উভয় হামলা চালিয়েছে।

ভূসম্পত্তি দখল বা দখলীকৃত সম্পত্তি আয়ত্তে রাখার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী ব্যবহার এ দেশের সামন্ত প্রভুদের যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করা বহু শতাব্দীর পুরোনো কৌশল। সামন্তবাদের পুরোনো কাঠামো ইতিমধ্যে ভেঙে গেলেও তার স্থলে নতুন আঙ্গিকের নয়া পুঁজিবাদ যেভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছে, তাতে নয়া পুঁজিবাদের প্রতিনিধি হিসেবে রাবার ইন্ডাস্ট্রির মালিকপক্ষ যে প্রথমে রেংয়েনপাড়ার ম্রোপল্লির অংশবিশেষ এবং ক্রমান্বয়ে পুরোটাই দখল করে নিতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রের কর্মচারীরাও সে দখলকে প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় এবং পরোক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। আর নয়া পুঁজিবাদের যেরূপ লোভী ও আগ্রাসী চরিত্র, তাতে আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে নিকট ভবিষ্যতের দিনগুলোতে উল্লিখিত ম্রোদের ভাগ্যে আরও দুর্ভোগ প্রায় নিশ্চিত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সুবিধাবাদী মুৎসুদ্দি সদস্যরা কেন দখলদারদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন? স্বাধীন রাষ্ট্রে প্রান্তিক ম্রোরা কেন দিনে দিনে আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন? স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও একটি দরিদ্র নিরীহ জনগোষ্ঠীকে কেন বারবার বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্কে ভুগতে হয়? কেন তাদের লাঠিয়ালের আক্রমণের মুখে ঘর ছেড়ে শীতের রাত কাটাতে হয় খোলা আকাশের নিচে? কেন হামলার ঘটনার ছয় দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরে থানায় মামলা হয়? কেন মানবাধিকার কমিশন ছাড়া রাষ্ট্রের আর কোনো কর্তৃপক্ষকে ঘটনার বিষয়ে প্রতিকারমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসতে দেখা গেল না? কেন স্থানীয় প্রশাসন রুটিন পরিদর্শনের বাইরে গিয়ে হামলার শিকার ম্রোদের পক্ষে দাঁড়িয়ে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করল না বা করতে পারল না?

জবাব খুবই স্পষ্ট, পুরোনো ও সর্বজ্ঞাত। স্বাধীনতার পর অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এ রাষ্ট্র এখনো পুরোপুরিভাবে সাধারণ মানুষের রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে ছলে-বলে-কৌশলে এবং নানা অবৈধ ও অনৈতিক পন্থায় যারা সম্পদ আহরণ করেছে ও করছে, রাষ্ট্র এখন বস্তুত তাদেরই করতলগত। রেংয়েনপাড়ার ম্রোপল্লিতে ওই যে হামলা, সে তো আসলে রাষ্ট্রের প্রান্তিক মানুষদের ওপর রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণকারী অবৈধ বিত্তবানদের প্রতিনিধিদেরই হামলা। আপাতদৃষ্টে এ হামলা একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে করা হয়েছে বলে মনে হলেও বাস্তবে হামলাকারীর স্বশ্রেণির সমগোত্রীয়রা সারা দেশেই নানা পরিচয়ে প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গে ছড়িয়ে আছে এবং একইভাবে অন্যান্য পেশা ও এলাকার প্রান্তিক মানুষদের ওপর নানাভাবে পীড়ন ও অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। আর রাষ্ট্রের বিদ্যমান কাঠামোয় শিগগিরই মৌলিক কোনো পরিবর্তন না এলে এ পীড়ন, অত্যাচার ও বঞ্চনা যে দিনে দিনে আরও বাড়তেই থাকবে, তাতে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই এবং এতে করে রেংয়েনপাড়ায় ম্রোদের শীতের রাত খোলা আকাশের নিচে কাটানোর আশঙ্কা যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়তে থাকবে চা-শ্রমিকদের মজুরি-বঞ্চনা, সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যা, উপকূলীয় জেলেদের সমুদ্রে নিখোঁজ হওয়া, পোশাকশ্রমিকের অমানবিক পরিবেশ ও শর্তে কাজ করা, গ্রামীণ ব্যাপারী কিংবা নাগরিক মহাজনের কাছে কৃষকের অগ্রিম ফসল কিংবা পণ্য পানির দরে বিক্রি করে দেওয়ার প্রবণতাও।

এ অবস্থায় তাই এটি বলা যেতেই পারে, এ সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা অতীতের স্বাধীনতাবিহীন বিভিন্ন যুগে যে ধরনের নিগৃহীত জনগোষ্ঠী হিসেবে জীবনযাপন করত, স্বাধীনতার এ যুগে এসেও সেই পরিস্থিতির তেমন কোনো ইতরবিশেষ ঘটেনি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। কিন্তু তারপরও এই ভেবে আশাবাদী হতে চাই যে এ দেশের মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যেহেতু যেকোনো ধরনের চতুরতা ও দখলদারি প্রতিষ্ঠার মতো হীন সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, সেহেতু চতুর দখলদার ও হিংস্র হামলাকারীরা যত শক্তিশালীই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত মূলধারার মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। কিন্তু শিগগিরই তেমনটি হবে কি না, তার একটি ইঙ্গিত খোঁজার চেষ্টা করা যেতে পারে লামায় রাবারিদের লাঠি-আক্রমণের শিকার ম্রোদের প্রতি রাষ্ট্র কী আচরণ করে, তা দেখে। রাষ্ট্র কি আসলেই ম্রোদের তথা সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়াবে, নাকি রাষ্ট্রযন্ত্রকে চারদিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে থাকা সুবিধাবাদীদের স্বার্থকেই তারা বরাবরের মতো পাহারা দিয়ে যাবে—আমরা সেটিই দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ