‘ক্যামন করি স্কুল যাব, কী দিয়া পড়া পড়ব। অ্যাসেম্বলিত ড্রেস ছাড়া কেমন করি দাঁড়াব। আমার যে সব আগুনে পুড়ে গেল।’ পুড়ে যাওয়া ঘরের বারান্দাতে পোড়া বাইসাইকেল হাতে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিল সানি আহমদ। পঞ্চগড়ের ফুলতলা গ্রামে তার বাড়ি। সে নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
গতকাল শুক্রবার দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পরিবারের সবকিছুর সঙ্গে তার পড়ার বই, স্কুলের পোশাক, একমাত্র বাইসাইকেলসহ সবকিছু পুড়ে গেছে।
সাইফুলের মা সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘সব শ্যাষ। এক পোশাকে আছি। চিন্তাও করির পাওছি না, আইজ হামার কিছু নাই। সউগ ছাই। ছাওয়াটার কান্দোন থাকার পাওছি না। এই সাইকেল কোনাত চড়ি পাঁচ কিলোমিটার দূরত যায় প্রাইভেট পড়িছে। এ্যালা আর তাক পাবার নেয়। ওর বাপের সাইকেল কেনার সমর্থ্য নাই।’
সানির মতো ওই গ্রামের ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া তাসিফা আলী (১২) ও ৩য় শ্রেণিতে পড়ুয়া আলিফ আলীরও (৮) বই, খাতা, কাপড়সহ সবকিছু পুড়ে গেছে। পোড়া ঘরে মায়ের সঙ্গে বসে তাঁরা পুড়ে যাওয়া বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল।
তাসিফা আলী বলে, ‘মায়ের সঙ্গে জলসাত আছনো। আইজ সকালে আসি দেখি সউগ পোড়া গেইছে। তোমরা কন তো এ্যালা কেমন করি পড়া পড়মো। হামার বইগুলো কেনে পুড়ি দেইল কন তো?’
শুধু সানি আহমদ ও তাসিফা আলী নয়, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে শুক্রবার বিক্ষুব্ধ জনতা আহমদনগর, ফুলতলা, সালসিড়ি এলাকার প্রায় ১৬০টি পরিবারের ওপর হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। এতে অর্ধশতাধিক শিশুর বইখাতা পুড়ে গেছে। প্রায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছে পরিবারগুলো।
আজ শনিবার দুপুর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পঞ্চগড় সদরের চৌরঙ্গী মোড়, বকুলতলা, ধাক্কারমাড়ার মোড়, জালাসি মোড় এলাকা ঘুরে অন্তত ৩০ জন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জলসা বন্ধের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসককে যে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল, তা যদি আমলে নিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বসে জলসা বন্ধ করা যেত তাহলে আজ এই পরিস্থিতির হয়তো সৃষ্টি হতো না। প্রশাসনের অবহেলার ফলে এমনটি হয়েছে বলে তাঁরা দাবি করেন।
বকুলতলা মোড়ে কথা হয় ফল ব্যবসায়ী জুলহাস রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পুলিশতো জলসা বন্ধই করিল। তা এই জলসা গন্ডগোলের আগোত বন্ধ করলে কী হইল। এতে সংঘর্ষও হইল না হয়, নিরীহ মানুষগুলার বাড়ি-ঘরও ভাঙিল না হয়। এ্যালা সউগ সময় আতঙ্কে আছি, কখন কী হয়। ব্যবসা করির পাওছি না।’
এই দাবি শুধু শহরের ফল ব্যবসায়ী জুলহাসের নয়; সাধারণ ও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরও। আহমদনগরের বাসিন্দা আপন আহমদ (২৮) বলেন, ‘প্রশাসনের অবহেলার কারণে আজই এই দশা আমাদের। প্রশাসন অনুমতি দিয়েছে বলেই আমরা জলসা করেছি। অথচ পুলিশের সামনেই বাড়িঘর ভাঙল, আগুন লাগাল। ওদের একজন মারা গেছে, আমাদেরও একজন মারা গেছে। এখনো শঙ্কায় আছি কখন জানি হামলা করে।’
গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের (কাদিয়ানি) জলসা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ ও মুসল্লিদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, জুমার নামাজ শেষে বিভিন্ন মসজিদ থেকে মুসল্লিরা চৌরঙ্গী মোড়ে সমবেত হতে থাকেন। এরপর মিছিল বের করা হয়। আকস্মিকভাবে মিছিল থেকে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। এতে দুজন নিহত এবং তিন পুলিশ সদস্য ও দুজন সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হন।
একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা শহরের ধাক্কামারা এলাকায় গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করলে কার্যালয়টি ভস্মীভূত হয়ে যায়। তাঁরা পঞ্চগড় বাজারে আহমদিয়াদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাট করেন এবং প্রতিষ্ঠানের মালামালে আগুন ধরিয়ে দেন।
আরও পড়ুন: