ফারুক নাজকি স্বর্গীয় উপত্যকা কাশ্মীরের সন্তান। ভূ-উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি এমন এক সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যধারার মালিকানা লাভ করেন, যা কাশ্মীরের বাইরের কবি-শিল্পীদের ঝুলিতে অনুপস্থিত। এই সাহিত্য পরম্পরা নিজের ভেতরে ধারণের পাশাপাশি নাজকি আধুনিক দর্শন ও কাব্যরীতির গভীর অধ্যয়ন করেছেন। আর নিজেকে আরও শাণিত করেছেন আধুনিক দর্শনের প্রাণকেন্দ্র ইউরোপে পড়াশোনা করে।
জার্মান চিন্তক মার্টিন হাইডেগার লিখেছেন, ‘দার্শনিক বইপুস্তক এ কালের চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির খোরাক নয়। বরং একপলকে স্থান-কালের ঊর্ধ্বে উঠে অসীমে হারিয়ে যেতে চাওয়া কবির কথাই এখানকার তারুণ্যের প্রিয় শিকার।’ ফারুক নাজকির কবিতা আপনাকে সেই অসীমের সঙ্গে জুড়ে দেবে। আপনি বিস্ময়ে অপলক উপভোগ করবেন তাঁর প্রতিটি পঙ্ক্তি।
ভূস্বর্গ কাশ্মীরের প্রকৃতি ও আবহাওয়া এক কথায় অনুপম, সতেজ ও জাদুকরী। পৃথিবীর বুকে সর্বশেষ আবিষ্কৃত শব্দটি দিয়েও কিংবা কালজয়ী সব রূপকের প্রয়োগ করেও এই উপত্যকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৌন্দর্য যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। জীবনঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা ও কাশ্মীর উপত্যকার প্রকৃতি ফারুক নাজকির শিল্পকে দারুণ উষ্ণতা দিয়েছে। তাঁর কবিতার ভাষ্যে আয়নার মতো স্বচ্ছ বরফগলা জলাধার যেমন আছে, পাথুরে ভূমির মতো পাথর-শক্ত মর্মও আছে।
দুই.
গজল উর্দু সাহিত্যের জনপ্রিয় ধারা। দিল্লির মুসলিম সালতানাতের সময় রহস্যবাদী সুফি কবিদের প্রভাবে এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে গজল। তবে মুঘল আমলে এই ধারা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। মির তকি মির, মির্জা গালিব ও ওয়ালি মুহাম্মদ ওয়ালি উর্দু গজল রচনার স্বর্ণযুগের কবি। মুঘল আমলের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরও গজল রচনা করেছেন। ইংরেজ আমলে গজলে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগান মুহাম্মদ ইকবাল, ফিরক গুরকপুরী, আলতাফ হুসাইন হালি, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ প্রমুখ। ফারসিতে রুমি, হাফিজ, শেখ সাদি থেকে শুরু করে বাংলায় আমাদের নজরুলও গজল রচনায় ব্রতী হন। বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় সাহিত্য-উপাদানে পরিণত হয়েছে গজল।
এই ধারার কাশ্মীরি কবি হিসেবে ফারুক নাজকিও বেশ কিছু কালোত্তীর্ণ উর্দু গজল রচনা করেছেন। ফারুক নাজকির গজল আধুনিকতার উপাদানে ঠাসা। তাঁর গজলের শরীর ও মানস বিশ্লেষণের আগে চলুন পড়ে নেওয়া যাক কয়েকটি গজলের খণ্ডাংশ—
তোমার অলক-পাণ্ডুলিপি লিখতে হবে
কত দিনেও হয় না কথা প্রিয়জনে
আজ বাড়িতে ত্বরিত পত্র লিখতে হবে
গভীর সবুজ পাতায় জাগে খুব পিপাসা
মাঠে-মাঠে রক্তসাগর লিখতে হবে।’
অন্যত্র বলেন—
‘কাচের শব্দ রেখো না কাগজে
মর্মপাথর হয়ে ভাঙব তা আমি।’
আবার বলছেন—
‘আমি আছি অস্থির দেহনগরে
আমার ভাগে ছিন্নমূলই রেখো।’
অথবা—
‘স্বপ্নদেয়াল ও হৃদয়ঝরনা অক্ষম
ঘুমদ্বীপ কেন হলো বাধার দেয়াল।’
অন্যত্র বলছেন—
‘ভয়-উৎকণ্ঠার দুর্গে অনুমানের ঘর-বসতি
আমি এখন উত্তরে না দক্ষিণে—জানা নেই।’
ফারুক নাজকির গজলে এমন অসংখ্য পদ আছে, যা পড়ার পর প্রথম অনুভূতি হয় যে, নাজকি আধুনিক গজলকে বিখ্যাত উর্দু গজল রচয়িতা নাসির কাজেমির পর থেকেই শুরু করেন। এ ছাড়া নাজকির গজল কাঠামোয় নতুনত্ব দেখা যায়—দুটি বিপরীত ও না-বলা দৃশ্য, উপাদান ও ভাবের মধ্যে একটি নতুন মর্মের চিত্রায়ণ করতে প্রয়াসী হওয়ার মধ্য দিয়ে। তবে গজলকে সেই রূপে আনতে ধ্রুপদি গজল কিংবা আধুনিক গজলের কাছে হাত পাতেন না। বরং প্রতিটি গজলকে নানা ধাঁচ ও ঢঙে ধ্রুপদি শব্দমালার মশালে পরিণত করেন। যেখানে প্রথম পঙ্ক্তিতে ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচ-রং প্রতিভাত হয়; প্রতিটি শব্দ নিজস্ব আবেদনে আলোকিত। এর পর ভাব ও মর্মের প্যাঁচানো সেই রংগুলোকে একটি সম্মিলিত কাঠামো, স্বতন্ত্র গজলধাঁচ ও অনন্য কাব্যশরীরে রূপ দেন। ফলে দূর থেকে সেই প্যাঁচালো ভাবের মর্মপ্রপাত আবিষ্কার করেন পাঠক। এ ক্ষেত্রে নাজকি অনন্য ও সর্বপ্লাবী কবি হিসেবে আবির্ভূত হন। গজল-কাব্যধারা আধুনিক সাহিত্যে তুলনামূলকভাবে অবহেলিত এবং অনেক ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত হলেও ফারুক সেটিকে নিজস্ব ধাঁচ ও চিন্তার মাধ্যমে নতুন জীবন দেন।
‘যখন চাল-দ্বার জাগে
বসতির বাড়ি জাগে
আপনারই পক্ষ হয়ে
কত কত রাত জাগে
এমন ভূকম্পন এল
ঘুম থেকে গাছ জাগে।’
কিংবা—
‘পত্রিকায় আপনার ছবি ছিল
কী কারণ—ঘরে যান না কেন?’
এসব গজলে নাজকি গদ্যের কথ্য-ভাবের বিপরীতে গিয়ে সংক্ষিপ্ততম ধাঁচে এবং সরলতম উপায়ে বাইরের দুনিয়ার বিশাল বৈপরীত্যের বয়ান দেন। যেমন—প্রথম গজলে ঘরের চাল ও দরজার চৈতন্যের কথা কয়েকটি বিপরীত ভাবের জন্ম দেয়। এর মর্ম হতে পারে—সূর্যের আলো সবার আগে ছাদ ও দরজায় টোকা দিলে বসতিগুলোতে সামাজিক চৈতন্য তৈরি হয়। আবার এও বলা যায়—জাগরণের পদ্ধতিকে কবি শুধু একটি টোকা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছেন। একই গজলের দ্বিতীয় অংশে শাস্ত্রীয় ভাব পরিহার করে নৈকট্যের বার্তাকে তৃপ্তির পরিবর্তে অস্থিরতায় পর্যবসিত করেন। তৃতীয় অংশে আরও একটি পরাবাস্তব দৃশ্যের মাধ্যমে গজলের ছাঁচে ফেলেন। বৃক্ষ নীরব-নিরেট হলেও প্রাণ-মেশানো রূপকের মাধ্যমে সেটিকে প্রকাশ করেন তিনি। একই সঙ্গে ভূমিকম্প প্রাকৃতিক ও অতিপ্রাকৃতিক দ্রোহের মিনার হিসেবে প্রতিভাত হয়। বৈপরীত্যের মাঝে এক নতুন বাস্তবতা আবিষ্কৃত হয় পরের গজলে—যেখানে খবরে প্রকাশিত ছবি এবং ঘরমুখো কবির কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেন তিনি নিজেই।
নাজকির গজলের এমন সব কাল্পনিক সিদ্ধান্ত নতুন মর্ম ও নতুন দৃশ্যকল্পের অবতারণা করে। ফলে গজলের চিরায়ত কাঠামোবদ্ধ রীতিনীতির পরিধি মাড়িয়ে এবং সহস্রাব্দের সীমানা পেরিয়ে তা চলে যায় দূরে, বহুদূরে। এ কয়টি পঙ্ক্তি তা আরও স্পষ্ট করে—
‘আমাকে সাফল্য লিখে দাও
আমাকে ক্ষমতা ও টাকা দাও
অনটনের দাম নেই আজকাল
নাম, যশ, শক্তি, দাপট দাও।’
কিংবা—
‘খোদা, তুমি খামোখা আমাকে ডরাও কেন
যাও রহমের ছায়া মাড়াও, হও কল্যাণকর।’
নাজকির গজল জীবন ও জগতের দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠা সময়ে পৌঁছে যায়। এই দ্বন্দ্ব আধুনিক যুগের সবচেয়ে বড় সংকট। এ যুগের আকাশে শুধু তারাই জ্বলজ্বল করে না, বরং গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি-ছায়াপথও ঘোরে। মানুষের অনুভূতিশক্তি বিজ্ঞানের আবিষ্কারের কারণে আজ বিপন্ন। আকাশচুম্বী দালানের সামনে মানুষের অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। বিজ্ঞান-উৎকর্ষের দৌড় এতই দ্রুতগামী যে, মন-মানসের সুস্থতা ও বলিষ্ঠতা অগুনতি হুমকির সামনে দাঁড়িয়ে। এই ধ্রুপদি উন্নয়নে মানুষের আত্মমর্যাদার সলিলসমাধি হচ্ছে, ভেঙে টুকরো-টুকরো হচ্ছে সংসার, বিশ্ব। শূন্যে সাঁতরানো ধ্বংসাত্মক উপাদান মানুষ ও পৃথিবীর কাছাকাছি আসছে। বিজ্ঞান ভবিষ্যতের যে চিত্র দেখাচ্ছে, তাতে মানুষের অস্তিত্ব একেবারেই অর্থহীন; মর্যাদাহীন। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের এই পৃথিবী অতীতের ছায়াঘেরা বৃক্ষ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ শতকের এই অস্থিরতাকে আধুনিক ইংরেজি কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস তাঁর কবিতা ‘সেকেন্ড কামিং’-এ তুলে ধরেন। ইয়েটস-এর কবিতায় প্রতিশ্রুত ইসা মাসিহের আগমনের সুখবরও আছে। নাজকি একই বিষয় অনুভব করলেও কারও আগমনের সুখবরের আশ্রয় নেননি। বরং নিজের অনুভবের দ্বন্দ্বগুলোকে নিরীক্ষার কষ্টিপাথরে ঘষেই পাঠকের সামনে তা পরিবেশন করেন। নিচের গজলগুলো পড়ুন—
‘ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছি—হে কল্পলোক
নিজের চিন্তাকে ভয় পাচ্ছি আমি
সইতে পারব না এই ভয়াল রাতে
ক্রমেই ভেঙে পড়ছি—হে অপেক্ষাসন্ধ্যা।’
অন্যত্র বলেন—
‘জীবনের তেপান্তরে না হারাতাম যদি
আমার পদচিহ্ন আমার রাহবার হতো।’
আবার লিখছেন—
‘মর্যাদার সংজ্ঞা ভেঙে নতুন সংজ্ঞা দাও
সাহস তোমার থাকেই যদি—বিদ্রোহী হও।
সান্ত্বনার বাণী শোনাও প্রতারিত আত্মাদের
গুম হওয়া মানুষগুলোর বেহেশত হও।’
অন্যত্র বলেন—
‘পাথর-পূজারির বসতিতে সিসা-শিল্পীর ভবিষ্যৎ নেই
যার চোখে আলো নেই, হৃদয়ে তার আগুন-আগুন।’
এসব গজল ফারুক নাজকির মনস্তত্ত্ব ও সৃষ্টিশীলতার আয়নাঘর। সেই আয়নাঘরে ভয়ের ছায়াও আছে, হিংস্র রাতও আছে, আছে অপেক্ষার সন্ধ্যাও। নাজকি তাঁর কবিসত্তার নির্জন প্রান্তরে সেই আয়নাঘরটি নির্মাণ করেন। বিজন বনের সেই আয়নাঘরে বসে ডেকে যান একটানা, ক্ষণে-ক্ষণে যার প্রতিধ্বনি দূরের পাহাড় থেকে মৌসুমের পূর্বাভাস হয়ে ফিরে আসে কাশ্মীরের পথে-প্রান্তরে। তাই নাজকির গজলকে আধুনিকতম উর্দু গজলের সর্বোত্তম নমুনা বললে অত্যুক্তি হবে না মোটেও। ‘যখনই ভেবেছি তোমাকে’ শীর্ষক গজলের একটি ছন্দোবদ্ধ অনুবাদ-চেষ্টার মধ্য দিয়ে নাজকির গজল-পর্বের ইতি টানছি—
‘তোমার কথা ভেবেছি যেই
সকল দৃশ্য পাল্টে গেছে
যেতে-যেতে কে-ই-বা আবার
হাওয়ার ডানায় নাম লিখেছে
অগ্নিগোলার এই ঋতুতে
বসবে মেলা হাজার লাশের
এসেই আমার বসতঘরে
মাতাল নদী থমকে গেছে
খুশি আমার দূরের পথিক
দুঃখ আমার নিত্য ছায়া
জানবে কী-বা হে কাশ্মীরি
দিল্লিতে আজ হচ্ছে কী ফের।
(লফ্জ লফজ নোহা/ফারুক নাজকি)
আরও পড়ুন: