হোম > নারী

সাক্ষাৎকারে অপ্রতিরোধ্য বারবারা 

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা

-আমরা খুব সাধারণ শিশু আর ১০ জন যেমন হয়। 
-তোমরা তোমাদের বাবা মাকে খুন করেছ আর নিজেদের সাধারণ শিশু বলে মনে করছ? 

প্রশ্নগুলো করা হচ্ছিল বাবা মাকে খুনের দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত দুই ভাইকে। প্রশ্নকর্তার নাম বারবারা ওয়াল্টার্স। শেষ লাইনটি বলার সময় বারবারার মুখের অভিব্যক্তি ছিল দেখার মতো। এমন নৃশংসতা যারা করেছেন শুধু তারাই নন বারবারার মুখোমুখি হয়েছেন মডেল অভিনেত্রী থেকে শুরু করে স্বৈরশাসক পর্যন্ত। বারবারার সাংবাদিকতার বয়স পঞ্চাশ বছর। এই বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য একজন। 

বারবারার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল তাঁর কথা বলার ধরণ। তিনি যখন প্রশ্ন করতেন তখন সেই প্রশ্ন যেন দর্শক তার নিজের বলে মনে করতে বাধ্য হবেন।

বারবারা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি সাক্ষাৎকার নিতে ভয় পাই না।’ তার এই কথার প্রমাণ মেলে যখন তিনি ট্রাম্প, পুতিন, বাশার আল আসাদের মতো মানুষদের এমনসব প্রশ্ন করেন যা সচরাচর কেউ করার সাহস পায় না। তবে প্রশ্নগুলো কখনই আক্রমণাত্মক ছিল না। ছিল খুবই সরল আর সাবলীল। ২০০১ সালে নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভ্লাদিমির পুতিনকে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি চান কাউকে হত্যা করা হোক?’ 

পারমাণবিক অস্ত্র থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র, স্বাস্থ্যসহ সকল ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য প্রশ্ন তৈরি থাকত বারবারার সাক্ষাৎকারে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের চোখে চোখ রেখে বারবারার প্রশ্ন ছিল, ‘আপনার কি কখনো নিজের ওপর সন্দেহ হয়েছিল?’ পপস্টার থেকে শুরু করে স্বৈরশাসক, রাজপরিবারের সদস্য পর্যন্ত বারবারার প্রশ্নের ছুরির নিচে এসেছেন অনেকেই। শুধু পুতিন বা ট্রাম্প নন, রিচার্ড নিক্সন, ফিদেল কাস্ত্রো, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশারের মতো রাজনীতিকেরাও সাক্ষাৎকার দিতে বসেছিলেন বারবারার সামনে।

জিমি কার্টার, রোজালিন কার্টারের যৌথ সাক্ষাৎকার, মিসরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার আল সাদাত এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের যৌথ সাক্ষাৎকার নেন বারবারা। বারবারা ইরানের শাহ, মোহাম্মদ রেজা পাহলভি এবং তার স্ত্রী সম্রাজ্ঞী ফারাহ পাহলভিসহ রাশিয়ার বরিস ইয়েলৎসিন, চীনের জিয়াং জেমিন, যুক্তরাজ্যের মার্গারেট থ্যাচার, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, চেকোস্লোভাকিয়ার ভ্যাক্লাভ হ্যাভেল, লিবিয়ার মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফি, জর্ডানের রাজা হুসেন, সৌদি আরবের বাদশাহ আবদুল্লাহ, ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজসহ আরও অনেকের সাক্ষাৎকার নেন তিনি।

বারবারা পপ আইকন মাইকেল জ্যাকসন, গায়ক-অভিনেত্রী বারব্রা স্ট্রিস্যান্ড, ক্যাথরিন হেপবার্নসহ জনপ্রিয় বিভিন্ন গায়ক, অভিনেত্রী, মডেলদের দারুণ সব সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।

এ ছাড়া ভোগ সম্পাদক আনা উইন্টুর, স্যার লরেন্স অলিভিয়ার সহ অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বারবারা। 

বারবারা তাঁর কাজ ও অবস্থানকে ব্যবহার করতেন সমাজের কাজে, মানুষের উপকারের জন্য। তার পরিচালিত অনুষ্ঠানগুলোর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এই অনুষ্ঠানগুলোতে কখনো বারবারা করেছেন মারাত্মক প্রশ্ন, কখনো বের করে এনেছেন সমাজের কিছু অপ্রিয় সত্য কথা। তিনি বেছে নিতেন বিতর্কিত বিষয়গুলো। যখন এইডস নিয়ে মানুষের মনে অসম্ভব ভয় আর আতঙ্ক বিরাজ করত সেই সময়ে বারবারা তার অনুষ্ঠানে এইডসে আক্রান্ত একটি শিশুকে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠানে টিভির পর্দায় দেখানো হয় বারবারা একটি এইডস আক্রান্ত শিশুর সঙ্গে খেলছেন। সেখানে তিনি বলছিলেন, আপনি কিংবা আমি কখনই এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে চুমু খেলে কিংবা তাঁকে ছুলে রোগটিতে আক্রান্ত হব না। এমনকি, পার্কিনসন নিয়েও তিনি কথা বলেন তার অনুষ্ঠানে।

সেখানে তার প্রশ্নের প্রেক্ষিতে যে উত্তরগুলো আসে সেখান থেকে মানুষ বুঝতে পারেন এই রোগে আক্রান্ত একজন মানুষ তার অসুস্থতার কাছে অসহায়। তাই তার আশপাশের মানুষের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো।

বারবারা প্রথম মানুষ যিনি ট্রান্সজেন্ডারদের টেলিভিশনের পর্দায় এনেছেন তার দেশের মানুষদের সামনে। বারবারার দর্শকেরা তাঁকে বিশ্বাস করতেন আর এই বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই তিনি প্রতিনিয়ত ভেঙেছেন সবকিছু, আলোকিত করেছেন সমাজের অন্ধকার দিকগুলোকে।

যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এবিসি নিউজে দীর্ঘদিন সংবাদ উপস্থাপক এবং প্রাইমটাইম শো ‘২০ / ২০’ উপস্থাপনা করেছিলেন বারবারা। ডলি রেবেকা পার্টন থেকে শুরু করে টেইলর সুইফটের প্রজন্ম পর্যন্ত তারকারা এসেছেন তার অনুষ্ঠানে। সুপারম্যান চলচ্চিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয়কারী ক্রিস্টোফার ডি‘অলিয়ের রিভ একটি দুর্ঘটনায় প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ার পর এসেছিলেন বারবারার অনুষ্ঠানে। যেখানে তিনি তুলে ধরেছিলেন তার প্রতিবন্ধকতা ও জীবনের কথা।

নারীদের নিয়ে ১৯৯৭ সালে ‘দ্য ভিউ’ নামের একটি শো উপস্থাপনা করেন তিনি। সেখানে মনিকা লিউনস্কি, যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি, ক্যাথরিন হেপবার্ন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের মতো মানুষদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। দ্য ভিউ’ র উপস্থাপক হিসেবে বারবারা কাজ করেছেন ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত।

তিনি চলচ্চিত্র তারকা, রাষ্ট্রপ্রধান এবং অন্য ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত জীবন এবং আবেগময় অবস্থার তথ্য অত্যন্ত ভদ্রতার সঙ্গে তুলে আনতে দক্ষ ছিলেন। বারবারা ২০০০ সালে এনএটিএএস থেকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পান। সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারে ১২ বার এমি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।

বারবারা ওয়াল্টার্সের পুরো নাম বারবারা জিল ওয়াল্টার্স। ১৯২৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বোস্টনে জন্মেছিলেন তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। ছোটবেলা থেকেই অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বারবারা। তাই কারও সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় ভয় কিংবা সংশয় কখনোই কাজ করেনি তাঁর চোখমুখে। প্রায় এক বছর নিউ ইয়র্ক সিটিতে একটি ছোট বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করেছিলেন তিনি।

বারবারা ১৯৬১ সালে লেখক ও গবেষক হিসেবে এনবিসি এর দ্য টুডে শো-তে যোগ দেন। টুকটাক অ্যাসাইনমেন্ট এবং আবহাওয়ার সংবাদ পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপরে। এক বছরের মধ্যে, তিনি একজন রিপোর্টার হয়ে ওঠেন। তখন তিনি তাঁর নিজস্ব প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, লেখা এবং সম্পাদনা শুরু করেন।

বারবারা তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন যখন তিনি এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তখন এটি বিশ্বাস করা হতো যে 'কঠিন সংবাদ' রিপোর্ট করা একজন নারীকে কেউ গুরুত্ব সহকারে নেবে না। ১৯৭১ সালের শুরুতে, ওয়াল্টার্স তার নিজের স্থানীয় এনবিসি অ্যাফিলিয়েট শো, নট ফর উইমেন-এর হোস্ট করেন।

এরপর ১৯৭৪ সালে এনবিসির একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী সহ-উপস্থাপক হিসেবে নাম লেখান তিনি। ওয়াল্টারস এবিসি এর সঙ্গে একটি পাঁচ বছরের জন্য পাঁচ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সেই সময়ে এই অঙ্কের বেতন কোনো পুরুষ বা নারী সংবাদ উপস্থাপক নিতেন না। বারবারা ওয়াল্টার্স ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ৯৩ বছর বয়সে মারা যান।

বড়দিনের বিখ্যাত গানগুলোর নেপথ্যের নারীরা

উদ্যোক্তা মেলা: সংখ্যা কমলেও আশাবাদী নারী উদ্যোক্তারা

রোজের ফুটে ওঠার গল্প

আন্তর্জাতিক নারী: অন্ধকার আকাশ যাঁর ল্যাবরেটরি

অধিকারের পক্ষে মার্থার লড়াই

‘মেয়েদের ফুটবলে বাধা দিতে খোঁড়া হয়েছিল মাঠ’

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য মন্ত্রণালয় ও সংসদে আসনের দাবি

জটিল প্রক্রিয়ার কারণে অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েও অভিযোগ করতে পারেন না নারীরা

ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে শাহেলীর লড়াই

১১ মাসে নির্যাতনের শিকার ২,৫৪৯ নারী ও কন্যাশিশু