আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল কুমুদিনী হাজংয়ের কাছে যাওয়ার। বিরিশিরি থেকে খেয়া নৌকায় সোমেশ্বরী নদী পেরিয়ে কিছুটা হেঁটে গেলেই হাজং বিদ্রোহের যে স্মৃতিসৌধ, সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা রাশিমণি হাজংয়ের কথা স্মরণ করেছিলাম। তখনই আমাদের সহযোগী আলতাব বলল, ‘কুমুদিনী হাজংয়ের বাড়িতে যাবেন?’
আরে, যাব না মানে! এরই মধ্যে পরিবারের সবাইকে হাজং বিদ্রোহের কথা বলে রেখেছি। সেই বিদ্রোহে অংশ নেওয়া একজন জলজ্যান্ত মানুষকে চোখের সামনে দেখতে পাবে, এ রকম একটি সুযোগ তৈরি হচ্ছে বলে আমাদের স্কুলপড়ুয়া সন্তানদের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল।
আজ থেকে অনেক দিন আগের কথা বলছি। ২০০৫ সালে বিরিশিরি বেড়াতে গেলে আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। পাহাড়ের কাছে নেত্রকোনার এই অঞ্চলটিকে মনে হয় ছবির মতো। কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহের বাড়িও এখানে।
সোমেশ্বরী নদী পার হতে গিয়ে দেখি, ডানদিকে নদীতে হাঁটুজল। অনেকেই হেঁটে নদী পার হচ্ছে। আর এদিকটায় চলছে খেয়া নৌকা। তাতে পার হতে আমরা প্রত্যেকে ২ টাকা করে দিলাম। সুসং দুর্গাপুরে হাজং আর গারোরা থাকে। গারোদের একটা গুচ্ছগ্রাম আছে পাহাড়ের ওপরে। সেখানেও গিয়েছিলাম আমরা। তবে এখন আমাদের ওপর ভর করেছে হাজং বিদ্রোহ। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এই অঞ্চলের হাজংরা। গন্তব্য কুমুদিনী হাজংয়ের বাড়ি হওয়ায় সে গল্পই আমরা করতে থাকি তখন।
হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ থেকে সোজা একটি রাস্তা চলে গেছে বিজয়পুর পর্যন্ত। বিডিআরের (এখন বিজিবি) একটা চৌকি আছে সেখানে। অত দূর না গিয়েই একটা পাহাড়ের কাছে থেমেছিলাম আমরা। তারপর হেঁটে পাহাড়ের ওপর একটা বাড়িতে যাওয়ার পর আলতাব জানতে চাইল, এখানে কুমুদিনী হাজং আছেন কি না। আমাদের বাইরেই বসতে বললেন একজন এবং কিছুক্ষণ পর একজন হাস্যোজ্জ্বল বর্ষীয়ান নারী বেরিয়ে এলেন, তিনিই কুমুদিনী হাজং।
এ এক দীর্ঘ আলোচনা। তবে কুমুদিনী হাজংয়ের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর মনে হলো, এই সাহসিনী নারীর জন্য রাষ্ট্রের আরও কিছু করার দরকার ছিল। সম্মাননা পেয়েছেন বটে, কিন্তু আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় সম্মান জীবিত অবস্থায় পেলেন না এই বীর নারী।
যোগ্য মানুষকে আমরা সময়মতো সম্মান দিই না কেন, আফসোস কেবল সেটাই।