আমাদের একটা ছোট্ট দল ছিল তখন। একজন ছাড়া সবাই ছিলাম বেকার। কারুরই কোনো সংসার ছিল না, মা-বাবার সংসারে দায়িত্ব এড়িয়ে চলতাম সবাই। সকাল হতেই বেরিয়ে পড়তাম, হাজরা রোডের ওপর ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে ভিড় করতাম, আট বাই বারো ফিটের মতো একটা ঘর, ন্যাড়া টেবিল আর ভাঙা চেয়ারে ঠাসা দোকান, নাম প্যারাডাইস কাফে। ঋত্বিক ছিল আমাদের দলের সবচেয়ে লম্বাটে, সবচেয়ে রোগাটে এবং অবশ্যই সবচেয়ে ডাকসাইটে শরিক।
ঋত্বিক, সলিল চৌধুরী, তাপস সেন, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় আর আমি—এই নিয়ে আমাদের দল। কখনো কখনো বিজন ভট্টাচার্য এসে জুটতেন আমাদের আড্ডায়, কখনোবা কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। সকাল আটটা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত চলত একটানা আসর। দোকানি ঝাঁপ বন্ধ করতেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে হত। আবার এসে জড়ো হতাম সূর্য ডোবার আগেই। গুচ্ছের চা গিলতাম, ভাগাভাগি করে এর ওর পকেট হাতড়ে ধার মেটাতাম, অবস্থার ফেরে ধারের অঙ্ক বাড়াতাম। আর কথা, কথা আর বক্তৃতা। যুক্তি তক্কো আর গল্পের ফোয়ারা। অঢেল, অশেষ। এসবের মধ্যমণি ছিল ঋত্বিক।
কী এত কথা বলতাম? দিনের পর দিন? যা কখনও ফুরিয়ে যেত না?
কী বলতাম না? সূর্যের তলায় যা কিছু ছিল সবই তুলে ধরতাম চায়ের টেবিলে, বিচারে আর বিশ্লেষণে মুখর হয়ে উঠতাম প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু বারবার নানা কথার মধ্যেও যে-প্রশ্নে, যে-তর্কে, যে-বিষয়ে ফিরে আসতাম তা হল সিনেমা। সিনেমা, সিনেমা আর সশস্ত্র বিপ্লব।
সিনেমাকে বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে আমরা চলতে শিখেছিলাম সেদিন থেকেই। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অচঞ্চল বিশ্বাস রেখে সেদিন থেকেই আমরা অন্তঃসারশূন্য দেশজ সিনেমাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখেছিলাম, নতুন একটা ফ্রন্ট গড়ার জন্য মুখিয়ে উঠেছিলাম প্যারাডাইস কাফের ভাঙা চেয়ার-টেবিলে ঠাসা ওই ছোট্ট ঘরে, যে-ফ্রন্টে বিপ্লব আর সিনেমা হাত ধরাধরি করে চলবে। এই প্রাণচঞ্চল আসরগুলোয় যার গলা সবচেয়ে উঁচু পর্দায় বাধা ছিল সে হল ঋত্বিক।
সিনেমার রাজ্যে ঢোকা প্রায় যখন অসম্ভব মনে হচ্ছিল তখন আমরা সবাই ঠিক করলাম স্টুডিয়োর অসচ্ছল কর্মী ও কলাকুশলীদের নিয়ে একটি সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়ন দল গড়ে ভুলব। শুরু হল আমাদের অভিযান। দল বেঁধে স্টুডিয়ো স্টুডিয়ো ঘুরতাম, কর্মীদের বাড়ি বাড়ি যেতাম, বলতাম, বোঝাতাম, নিজেদের শক্তি সম্পর্কে ভালোবাসা ও প্রত্যয় জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চালাতাম এবং শেষ পর্যন্ত একদিন স্টুডিয়োর মধ্যে জোরালো আওয়াজ তুললাম। সেই আওয়াজী মিছিলের প্রথম সারির মানুষ রোগাটে লম্বাটে ঋত্বিক।
একদিন, রাতারাতি দেখা গেল, স্টুডিয়ো চত্বরে প্রচণ্ড উত্তেজনা। স্টুডিয়োর কর্মকর্তারা ঋত্বিকের ওপর খড়্গহস্ত হয়ে উঠলেন। কারণ, আগের দিন বিকেলে স্টুডিয়োর কর্মীদের এক সভায় ঋত্বিক বলেছে স্টুডিয়োর ভেতরে মদ্যপান চলবে না। ঋত্বিকের মতে এ এক অসহ্য বেলেল্লাপনা, এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে সংঘবদ্ধভাবে। কর্মকর্তারা খেপে উঠলেন, বললেন, ব্যক্তিগত জীবনে চারিত্রিক শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতার ওপর তাঁদের কোনো হাত নেই, কিন্তু ঋত্বিককথিত এহেন ঢালাও অপবাদ অন্যায় এবং অশালীন। আমাদের বাকিরা সবাই তখন ঋত্বিককে নিয়ে পড়লাম, কী করে ওকে সামলানো যায়। ওকে সামলাই তো কর্তারা বেঁকে বসছেন, কর্তাদের নরম করি তো ঋত্বিক গরম হয়ে উঠছে। শেষ পর্যন্ত অবস্থা আয়ত্তে এল। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হল। কিন্তু মদ সম্পর্কে ঋত্বিকের ঘৃণা তীব্রতর হয়ে উঠল। অথচ এই মদই পরবর্তী জীবনে ওকে গ্রাস করে বসল, মদ থেকে আত্মমর্দন, আত্মমর্দন থেকে আত্মহননের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলল।
তখন গণ-আন্দোলনের জোয়ারে সারা পশ্চিমবঙ্গ তোলপাড়। একদিকে সংগ্রামী জনতা, কৃষক-মজদুর-মধ্যবিত্তের আপসহীন লড়াই, অন্যদিকে শাসকের লাঠি, গুলি আর মারণযজ্ঞের নানা প্রক্রিয়া। কাকদ্বীপে লাল এলাকা তৈরি হয়েছিল সেই সময়ে। সেই সময়েই কৃষকরমণী অহল্যাকে তার পেটের বাচ্চাসমেত খুন করেছিল দেশজ পুলিশ। এবং শহিদ অহল্যাকে স্মরণ করে ও সাধারণ মানুষের সংগ্রামী মননকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সলিল রচনা করেছিল এক মহৎ কবিতা— শপথ।
আমাদের ছোট্ট দলের সবাই ঠিক করলাম আমরা পালিয়ে যাব কাকদ্বীপে। আমরা শপথ নিলাম আমরা ছবি করব, নির্বাক ছবি, ষোলো মিলিমিটারে তুলব, লুকিয়ে লুকিয়ে কলকাতার কোনো ল্যাবরেটরিতে সেই ছবি ধোলাই করব, সম্পাদনা করব। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে গ্রামে গ্রামে দেখিয়ে বেড়াব। আমি চিত্রনাট্য লিখলাম, সলিল নামকরণ করল ‘জমির লড়াই’, ঋত্বিক ভাঙা একটা ক্যামেরা জোগাড় করল। কাকদ্বীপে অবশ্য যাওয়া হল না শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সেই সুযোগে ক্যামেরাটাকে, তা সে যতই প্রাচীন আর ভাঙা হোক না কেন, নাড়াচাড়া করতে পেরে ঋত্বিক ছবি তোলার কলাকৌশলের অনেকটা রপ্ত করে নিল।
আমরা ঝগড়াও করেছি প্রচুর। তখন এবং পরবর্তী জীবনে। ঝগড়া করেছি, মতান্তর ঘটেছে, মনান্তর ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে এক এক সময়ে, আবার সময় আর ঘটনার মধ্য দিয়ে মিশে গিয়েছি আগেকার মতোই, এক সঙ্গে চলেছি।
ছেলেমানুষি করেছি অনেক: আমি, ঋত্বিক, আমরা সবাই। ছেলেমানুষিকে প্রশ্রয়ও দিয়েছি সবাই। অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটিয়েছি একাধিক। পরে বুঝতে পেরেছি, পুরোনো সম্পর্কে ফিরে যেতে চেষ্টা করেছি আপ্রাণ।
ফেব্রুয়ারির ছ-তারিখে রাত এগারোটা পাঁচ মিনিটে ঋত্বিক মরে গেল। ও মরবে আমরা জানতাম। ঋত্বিক নিজেও জানত। চব্বিশে ডিসেম্বর শেষবারের মতো জ্যান্ত অবস্থায় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমাদের বাড়িতে যখন এল, দেখলাম ও ধুঁকছে। ধুঁকতে ধুঁকতে কথা বলছে, হাসছে। অনেক খেল, বলল, মদ আর খাব না। আবার বলল: আর বেশি দিন বাঁচব না। বলল: এ যাত্রায় তো টাঁসলাম না। দেখা যাক।
কে জানে, হয়তো মরেই ঋত্বিক বাঁচল। শেষ কটা বছর ঋত্বিকের বেঁচে থাকাটাই একটা বিরাট অঘটন।