শীতের তীব্রতায় যখন অনেকেই ঘরে বসে উষ্ণতা নেন কিংবা ঠান্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে কম্বলে মুড়ি দিয়ে তুলনামূলক কম শীতল কোথাও অবস্থান করেন, তখন রাস্তার পাশে তাল গাছের পরিচর্যা করতে দেখা যায় ৭১ বছর বয়সী বৃদ্ধ খোরশেদ আলীকে। শুধু শীত নয়, গ্রীষ্মের অসহনীয় গরম কিংবা বর্ষাকালের প্রবল বৃষ্টিতেও একই কাজ করেন তিনি।
দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এভাবেই প্রতিদিন খুব ভোরে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ লক্করঝক্কর একটি মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তারপর গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করেন খোরশেদ আলী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পাহাড়ভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা খোরশেদ আলী। পেশায় পল্লি চিকিৎসক। শহীদদের স্মরণে এক লাখ তালগাছ রোপণের প্রতিজ্ঞা করেন তিনি। সম্প্রতি তার গাছ রোপণের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ দশ হাজারে। নিজের জমি বিক্রি করে সে টাকায় রাস্তার ধারে লাগিয়েছেন এ সব গাছ। তার এ কর্মকাণ্ড দেখে এলাকাবাসী এক সময় মানুষটিকে পাগল ভাবলেও এখন তাকে নিয়ে করেন গর্ব।
২০১৪ সাল থেকে রাস্তার ধারে চারা রোপণ করে আসছিলেন খোরশেদ। নিজের গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলার বিভিন্ন রাস্তা ছাড়িয়ে পাশের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলারও বিভিন্ন রাস্তার ধারে তিনি তালগাছ লাগিয়েছেন। শুধু তালগাছই নয়, ফলজ বনজ ও ঔষধি গাছ গাছের চারাও রোপণ করেছেন।
এত গাছ থাকতে তালগাছ লাগানো কেন শুরু করলেন, জানতে চাইলে খোরশেদ আলী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের স্মরণে তিনি তাল গাছ রোপণের কাজটি করছেন। তিনি মনে করেন, তালগাছগুলো একদিকে পরিবেশ বাঁচাবে এবং বজ্রপাত ঠেকাতে সহায়তা করবে। অন্যদিকে এই ১ লাখ গাছ দেখলে মানুষের মনে পড়বে, এ দেশ মুক্ত করতে শহীদ হয়েছিলেন ৩০ লাখ মানুষ।
সত্তরোর্ধ্ব খোরশেদ জানান, তালগাছ ছিল না বলে এত বছর ধরে এলাকায় বাবুই পাখির খুব একটা দেখা মিলত না। এখন সেই পাখিরা আবার ফিরছে। তা দেখে মন ভরে যায়।
৭ ছেলে-মেয়ে ও দুই স্ত্রীকে নিয়ে খোরশেদের সংসার। বৃক্ষপ্রেমী মানুষ হলেও পল্লি চিকিৎসা ও কৃষি কাজে জীবিকার পুরো ব্যবস্থা না হওয়ায় বাড়তি আয়ের জন্য তিনি একটি মসজিদে ইমামতি করেন। অভাব-অনটনের মধ্যেও ১ লাখ ১০ হাজার তালের চারা রোপর করে নিজের স্বপ্ন ।
খোরশেদ আলীর বড় ছেলে মোজাম্মেল ইসলাম বলেন, জমি বিক্রি করে বাবা তাল গাছ লাগাতেন। প্রথমে বাধা দিলেও এখন ভালো লাগে।
রেল গুন্টি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা মোবারক হোসেন, জব্বার আলী, গোরফানসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, খোরশেদ চাচাকে এখন সবাই বৃক্ষপ্রেমী নামে চেনেন। তিনি নিজ উদ্যোগে যে তালগাছ রোপণ করছেন এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। একটা সময় তিনি থাকবেন না, কিন্তু এই তাল গাছের সুফল আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভোগ করবে।
চিলারং ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শোভা আলী বলেন, খোরশেদ আলী দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার পাশে তাল গাছের চারা লাগাতে দেখে আসছি। তার বাড়ির অবস্থা বা আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। তবু তার যে আয় হয় তা দিয়েই তিনি সাংসারিক খরচ চালিয়ে বাকি টাকা বৃক্ষ রোপণে ব্যয় করেন। এ যুগে তার মতো সাদা মনের মানুষ বিরল। অভাবে থাকা এই মানুষটা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ভালো হতো।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, পরিবেশের পরম বন্ধু তাল গাছ। ভূমিক্ষয় ধস যেমন রক্ষা করে তেমনি বাড়ায় ভূগর্ভস্থ পানির মজুত ও মাটির উর্বরতা। তাল গাছের আকর্ষণে বাড়ে মেঘের ঘনঘটা ঘটে বৃষ্টিপাত। বজ্রপাত থেকে রক্ষা করতে তাল গাছের উপকারিতা তো সবার জানা। কৃষি বিভাগ থেকে খোরশেদ আলীকে বিভিন্ন ভাবে উৎসাহ, পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।