আন্তর্জাতিক নারী
৩১ আগস্ট ২০২৫। আফগানিস্তানের কুনার ও নানগারহার প্রদেশে ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প সবকিছু তছনছ করে দেয়। সরকারি তথ্যমতে, সে দেশে ২ হাজার ২০০ জনের বেশি নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার। এ ছাড়া ধ্বংস হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ঘরবাড়ি। ভূমিকম্পে অনেক পরিবার সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়েছে। তবে আমরা অদ্ভুত এক বাস্তবতা দেখতে পেলাম আফগানিস্তানে। এই বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করা হলো শুধু পুরুষদের।
এই বিপর্যয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকেন নারীরা। অবহেলা, নিপীড়ন আর নিষেধাজ্ঞার দুঃসহ বাস্তবতা তো রয়েছেই। এই ভূমিকম্প আমাদের দেখিয়ে দিল, মানুষ হিসেবে তালেবানের কাছে নারীরা কতটা অবহেলার পাত্র।
জাতিসংঘের নারী সংস্থার আফগানিস্তানবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি সুসান ফার্গুসন সতর্ক করেছিলেন, নারী ও শিশুরা এই দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে। ভূমিকম্পের পরপরই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত হওয়া নারী উপেক্ষার করুণ চিত্র যেন সে কথার যথার্থতা প্রমাণ করল। উদ্ধারকাজ শুরুর ৩৬ ঘণ্টা পার হলেও নারীরা সরকারি ত্রাণ বা চিকিৎসা সহায়তা পাননি। তালেবানের ‘নারীদের সঙ্গে অচেনা পুরুষের শারীরিক স্পর্শ নিষিদ্ধ’ নীতির কারণে পুরুষ উদ্ধারকর্মীরা আহত নারীদের সহায়তা করতে পারেননি। এমনকি কেউ কেউ মৃত নারীদের কাপড় ধরে টেনে বের করেছেন, যেন সরাসরি ছোঁয়া না লাগে। এতে বহু নারী ধ্বংসস্তূপে আটকে থেকেও সময়মতো উদ্ধার হননি। কেউ কেউ বাঁচার আশায় অপেক্ষা করে প্রাণ হারিয়েছেন। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো আহ্বান জানায়, দুর্যোগ মোকাবিলায় লৈঙ্গিক সংবেদনশীল পরিকল্পনা ও নীতি থাকা জরুরি, যাতে সবাই সমানভাবে সহায়তা পেতে পারে। কিন্তু তার ফল ছিল শূন্য।
কুনারের আন্দারলুকাক গ্রামে ভূমিকম্পে পরিবার হারিয়েছেন ১৯ বছরের আয়শা। তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের এক কোণে রেখে ভুলে গিয়েছিল। কেউ আমাদের প্রয়োজন জিজ্ঞেস করেনি, কেউ কাছে আসেনি।’ তালেবান এখন পর্যন্ত হতাহতের মধ্যে নারী-পুরুষের সংখ্যা আলাদাভাবে জানায়নি। তবে নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, অর্ধডজনের বেশি চিকিৎসক, উদ্ধারকর্মী ও ভূমিকম্পপীড়িত এলাকার নারী নিশ্চিত করেছেন, নারীদের অবস্থা শোচনীয়। অবহেলা ও একঘরে করে রাখায় তাঁদের দুর্দশা বেড়েছে।
এই পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে আফগানিস্তানে নারীদের ওপর আরোপিত কঠোর সামাজিক ও রাজনৈতিক বিধিনিষেধ। তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর নারীদের শিক্ষা, কর্মজীবন এমনকি চিকিৎসা গ্রহণের অধিকার পর্যন্ত সীমিত করা হয়েছে। গত বছর তালেবান নারীদের মেডিকেল শিক্ষায় ভর্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে দেশটিতে নারী চিকিৎসক বা নার্সের অভাব এমন এক সংকট তৈরি করেছে, যেখানে আহত নারীরা চাইলেও চিকিৎসা পাচ্ছেন না। সোলা নামের এক তরুণী বলেন, ‘আমার এমন জায়গায় আঘাত লেগেছে, যা পুরুষ চিকিৎসককে দেখাতে পারি না। কিন্তু এখানে কোনো নারী চিকিৎসক নেই।’
সুসান ফার্গুসন আরও বলেন, ‘এই দুর্যোগে নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই তাঁদের চাহিদাকে কেন্দ্র করে উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালিত হওয়া উচিত।’ এই ভূমিকম্প যেন আফগানিস্তানের নারীদের জন্য দ্বৈত দুর্যোগ। একদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক নীতির শৃঙ্খলে আবদ্ধ জীবনের নির্মমতা। ধ্বংসস্তূপ থেকে নারীদের শরীর টেনে বের
করা গেলেও তাঁদের কণ্ঠস্বর এখনো চাপা পড়ে রয়েছে নিষেধের ধুলায়।
সূত্র: রেডিও লিবার্ট, এনডিটিভি, ইউএন নিউজ