সিত্রাং এখন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। দেশের ১৩টি জেলায় আঘাত হানবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও বরিশাল।
এরই মধ্যে এই বিভিন্ন জেলায় ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রস্তুত হচ্ছে আশ্রয় কেন্দ্র। এলাকায় এলাকায মাইকিং করা হচ্ছে।
অস্বাভাবিক বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে বরিশাল নগরের বেশির ভাগ এলাকা। এদিকে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের বড় নদনদী সবগুলোর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বরিশালের জেলা প্রশাসক মো: জসীম উদ্দীন হায়দার জানিয়েছেন, সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা ও ঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বরিশাল জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় জানানো হয়েছে-৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত আছে, যেখানে প্রায় ২ লাখ ৬৯ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। শুকনা খাবার, সুপেয় পানি মোমবাতি, ওষুধপত্রের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উদ্ধার তৎপরতায় প্রয়োজনীয় যানবাহন, সরঞ্জামাদিসহ প্রতিটি ইউনিয়নে ১টি করে মেডিকেল টিমের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর প্রভাবে ঘর বন্দী হয়ে পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চল লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলা মানুষ। সেখানে সাইক্লোন শেল্টারসহ আশ্রয়ণ কেন্দ্রগুলো খোলা হয়েছে। মেঘনা নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৪ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে কিছু চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের মানুষ ও গবাদিপশু রক্ষায় সকল ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দুর্গম এলাকা থেকে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে আসার জন্য নদী এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। যারা নদীতে আছেন তাদেরকে দ্রুত লোকালয়ে আনার জন্য নৌ-পুলিশ ও কোস্টগার্ডকে বলা হয়েছে।
পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এর প্রভাবে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর বেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে। রোববার থেকে উপকূলীয় এলাকায় টানা বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। রোববার থেকে সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় পটুয়াখালী জেলায় ৭৯.৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। পটুয়াখালীতে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। পানি বিশুদ্ধ করণ ট্যাবলেট ও শুকনো খাবার মজুত আছে। জেলার সব উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাইকিং করে জনসাধারণকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় ৬৪২টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে বরগুনা জেলা প্রশাসন। দুপুরে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলা সংক্রান্ত এক প্রস্তুতি সভায় জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান এ তথ্য জানান।
ভোলা জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক-ই-লাহী চৌধুরী জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে সকল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। জেলার সরকারি সব দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ভোলা জেলার ৭৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। জেলায় মোট ৮টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ১৩ হাজার ৬৬০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে। জেলার ৭০ ইউনিয়ন ও জেলার সাত উপজেলায় একটি করে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ মোকাবিলায় খুলনা জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রস্তুতিমূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় জানানো হয়, ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ মোকাবিলায় খুলনা জেলার উপকূলীয় এলাকার পাঁচশত ৪৮টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যার মধ্যে দাকোপে ১১৮টি, বাটিয়াঘাটায় ২৩টি, ডুমুরিয়ায় ২৫টি, কয়রায় ১১৮টি, পাইকগাছায় ১০৮টি, তেরখাদায় ২২টি, রূপসায় ৩৮টি, ফুলতালায় ২৫টি ও দিঘলিয়া উপজেলায় ৭১টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। যে কোন দুর্যোগ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রগুলোয় মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন। জেলার প্রতিটি উপজেলায় ৫টি এবং প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে মোট ১১৬টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে সার্বক্ষণিক সেবা প্রদানের জন্য ডাক্তার, সেবিকা, ওষুধপত্র ও অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
পিরোজপুর জেলায় ২৬০টি সাইক্লোন শেল্টার ও ১৭৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রস্তুত আছে যেখানে আশ্রয় নিতে পারবে তিন লক্ষাধিক মানুষ। তাদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, ২৫০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লক্ষ টাকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়াও ৬৩টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ৭ উপজেলায় ৭টি এবং সদরে ২টি মোট ৮টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও রেডক্রিসেন্ট সহ স্বেচ্ছাসেবক টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান জানান, সাইক্লোন শেল্টার ও প্রাথমিক বিদ্যালয় মিলে মোট ৪ শত ৩৯টি আশ্রয়ণ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের মানুষদের সরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। অনেকেই সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছেন।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ফেনীতে থেমে থেমে ভারীবর্ষন ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত সহ দমকা হাওয়া বইছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় এরই মধ্যে জেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রস্তুতি সভার মাধ্যমে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান জানান, দুর্যোগ মোকাবিলায় সকলকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে হবে। এ জন্য ২৩ হাজার মানুষের ধারণ ক্ষমতা ৪৩টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে এবং ১৪টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও বরিশাল প্রতিনিধিরা)