করোনায় আক্রান্ত হওয়ার তিন দিনের মাথায় শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন মোবারক হোসেন (৫৮)। অবস্থা সংকটাপন্ন হলে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ পাঁচটি হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু মেলেনি একটি আইসিইউ। পরে মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়।
মোবারক হোসেনের ছেলে ইয়াসির আরাফাত আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গত ২৯ জুন আব্বার করোনা শনাক্ত হয়। আগে থেকে ডায়াবেটিস ছিল। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল, শুক্রবার মধ্যরাত থেকে একেবারে খারাপ হতে থাকে। পরে এক পরিচিতের মাধ্যমে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিই। সেখান থেকে বলা হয় আইসিইউ নেই। পরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়েও একটা আইসিইউ পাইনি। তাই আব্বাকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখান থেকেও আমাদের ফেরত দেওয়া হয়েছে। এখন মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে নিয়েছি।’
আইসিইউ না পেয়ে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথের সঙ্গে কথা হলে আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘রোগীদের অনেক চাপ থাকায় গত দুই সপ্তাহ ধরে আমাদের এই হাসপাতালে আইসিইউ খালি থাকছে না। তাই অনেকের আইসিইউ জরুরি হলেও ফেরত দিতে হচ্ছে, আমাদের কিছুই করার নেই। এখনো অনেকে জটিল অবস্থা নিয়ে আছেন, কিন্তু আইসিইউ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে সাধারণ শয্যা পর্যাপ্ত খালি আছে।’
এই হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য ৩৫০টি শয্যার ২১৩ টিতে রোগী আছে। তবে খালি নেই ২৪টি আইসিইউর কোনোটি।
মুগদা হাসপাতালের ওয়ার্ডমাস্টার আনোয়ার হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, আগের তুলনায় রোগীর চাপ বেড়েছে কয়েক গুণ। একটা আইসিইউও ফাঁকা নেই। অনেকে জটিল অবস্থায়ও কিন্তু আইসিইউ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু আজকের পত্রিকাকে বলেন, `আইসিইউর সংকট যে তীব্র আকার ধারণ করবে সেটা তো আমরা আগে থেকেই বলে আসছি। কিন্তু সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সংক্রমণ ও মৃত্যু যেভাবে ঘটছে, তাতে নতুন করে বাংলাদেশেই করোনার নতুন ধরন তৈরি হবে। এর মধ্য দিয়ে আমরা তৃতীয় ঢেউয়ে প্রবেশ করতে পারি, যেখানে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া একেবারে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।'
ঢামেকের এই অধ্যাপক বলেন, `হাসপাতালগুলোতে সেবার মান না বাড়ায় আক্রান্তরা চিকিৎসা না পেয়ে অনেকেই মারা যাচ্ছেন। অনেকে অক্সিজেন কিনে হাসপাতালের বারান্দায় সেবা নিচ্ছেন। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হলে এ রকমটা হতে পারে? যে গতিতে সংক্রমণ ছুটছে, তাতে যেকোনো সময় ভারতের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।'
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে–নজির আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, `ঢাকাসহ সারা দেশে আইসিইউর সংকট অপ্রত্যাশিত নয়, বরং অবধারিত। কারণ রোগী যত বাড়বে, আনুপাতিক হারে হাসপাতালে আগত রোগীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে মৃত্যুও বাড়বে। এজন্য আমাদের প্রতিরোধের মাধ্যমে রোগীর সংখ্যা কমাতে হবে।'
সামনে কী পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অধিক সংক্রমিত এলাকাগুলোতে জোরালো ব্যবস্থা নিতে না পারায় সেগুলো থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। আগে সংক্রমণের তীব্রতা ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক, এখন গ্রাম পর্যায়ে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে লকডাউন শুধু রাজধানীতে নয়, গ্রামেও কঠোরভাবে পালন জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, রাজধানীর ১৬টি সরকারি হাসপাতালে ৩৮৪টি আইসিইউ–সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত খালি ছিল মাত্র ১২৭টি। ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড–১৯ হাসপাতালেই ফাঁকা ১০২টি। এই হাসপাতালে আইসিইউর সংখ্যা ২১২। রোগীর চাপ আগের তুলনায় বেশি হওয়ায় ৩ হাজার ৫৫৭ শয্যার অর্ধেকই পূর্ণ রোগীতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে সংক্রমণের হার উচ্চমুখী এমন ৩০ জেলা জরুরি চিকিৎসা ও রোগী ব্যবস্থাপনায় পিছিয়ে। এসব জেলার রোগীরা নিজ জেলায় চাহিদামতো সেবা পাচ্ছে না। আক্রান্তদের সঠিক ব্যবস্থাপনায়ও রাখা যাচ্ছে না। ফলে তাদের নিয়ে বিভাগীয় শহরে ভিড় করছেন স্বজনেরা।
সংক্রমণের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকায় সংকট দেখা দিয়েছে অধিকাংশ জরুরি চিকিৎসা উপকরণেরও। রাজধানীর কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) অধিকাংশ জরুরি চিকিৎসা উপকরণের মজুত শেষ হয়েছে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে হাসপাতালগুলো থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাহিদাপত্র পাঠালেও পূরণ করতে পারছে না অধিদপ্তর।
বর্তমানে সিএমএসডিতে হাই ফ্লো ন্যাজেল ক্যানোলা, কোভিড–১৯ টেস্টিং কিট, ভেন্টিলেটর, রেমডিসিভির ইনজেকশন ও ভেন্টিলেটর নেই। ৫ হাজারে নেমে এসেছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের মজুত। এ ছাড়া ৭০০ অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও আইসিইউর ১০০ শয্যা রয়েছে বলে জানা গেছে।