হোম > পরিবেশ

জিম করবেট: জাত শিকারি থেকে পশুপ্রেমী এক যাযাবর

ইশতিয়াক হাসান

কালাধুঙ্গির বোর নদীর তীরে বহু পুরনো এক কাঠের সেতু। এর এক কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে গল্প শুনছে আট থেকে আঠারো বছরের চৌদ্দজন ছেলে-মেয়ে। গল্পের বক্তা ড্যানশি নামের এক আইরিশ। সময়টা রাত। তাই চৌহদ্দির জঙ্গল থেকে কাঠকুটো এনে আগুন জ্বেলেছিল খুদে শ্রোতারা।

আগুন নিভে গেছে বহু আগে। সামান্য লালচে আঁচ আছে এখনো। তবে চারধারের ঘন অন্ধকারের ওপর এর কোনো প্রভাবই নেই। এই পরিবেশে যে গল্প জমে, তাই বলছে ড্যানশি। ভূতের গল্প। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যে ভূত থেকে বানশিতে চলে যায় ড্যানশি। আয়ারল্যান্ডের বানশি। ড্যানশির মতে যা ভূত থেকেও ভয়ংকর। যে চৌদ্দটি ছেলে-মেয়ে গল্প শুনছিল, তাদের একজন ছোট্ট করবেট। পুরো নাম জিম করবেট।

কালাধুঙ্গি ছিল জিম করবেটদের শীতকালীন নিবাস। ওখানে রাতে বানশি, ভারতীয় গ্রামের ডাইনি চুরাইলের গল্প শুনে রোমাঞ্চিত হতো বালক করবেট।

করবেটের পরিবারের গ্রীষ্মকালীন নিবাস ছিল নৈনিতাল। কালাধুঙ্গি থেকে দূরত্ব মেরেকেটে পনেরো মাইল। নৈনিতালের কথা বললেই অবধারিতভাবে চলে আসে বিখ্যাত নৈনিতাল বা তাল হ্রদের কথা। হ্রদের পাশেই নৈনী দেবীর মন্দির। করবেট লিখে গেছেন মন্দিরের চার মাইলের মধ্যে বাঘ, চিতা বাঘ, সম্বার, ভাল্লুক সবই দেখেছেন। শুধু তাই নয়, এতটুকুন জায়গার মধ্যে এক শ আটাশ জাতের পাখি চিনেছেন তিনি।

২.
করবটে ও অ্যান্ডারসনের সঙ্গে পরিচয় আমার বলা চলে একইসঙ্গে। ক্লাস থ্রি কিংবা ফোরে পড়ি তখন। আব্বুর আলমারির নিচের অংশটা বইয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল। মানে, আমাদের কোনো বইয়ের আলমারি ছিল না। তো ওই আলমারিতেই খুঁজে পাই সেবা প্রকাশনি থেকে বের হওয়া শিকার ১, শিকার ২, শিকার ৩ ও জঙ্গল বইগুলো। স্বীকার করতেই হবে অদ্ভুত সুন্দর অনুবাদ করেছিলেন রকিব হাসান। সে হিসেবে আমার জঙ্গলপ্রেমের সূচনায় তাঁরও ভূমিকা আছে।

আমার বালক মনে তখনই শিকারিটির পাকাপোক্ত জায়গা হয়ে যায়। এই মুহূর্তে লিখতে বসে, মাথায় টুপি, রাইফেল হাতে সাদা চামড়ার একজন মানুষকে দেখতে পাচ্ছি মনের চোখে হিমালয় অঞ্চলের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে। তবে আশ্চর্য ব্যাপার, বই পড়তে পড়তে মানুষখেকো কিংবা গোখাদক বাঘ-চিতা বাঘগুলোর প্রতিও আশ্চর্য এক মায়া, ভালোবাসা জন্মায়। বলা চলে করবেটের পাশাপাশি তাঁর প্রতিপক্ষ বুনো প্রাণদেরও ভালোবেসে ফেলি।

বিশালাকার ওই বাঘটার কথা মনে পড়ছে সবার আগে। যেটাকে পুরোহিত পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মন্দিরের আশ্রিত বাঘ হিসেবে। করবেট কোনোদিনই ওটাকে মারতে পারবেন না চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন পুরোহিত। সত্যি করবেট ওটাকে মারতে না পারায় যে স্বস্তির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে শরীরে মনে, তা এখনো অনুভব করতে পারছি যেন।

রুদ্রপ্রয়াগের চিতাটার কথা কীভাবে ভুলি! মানুষের আশপাশে থাকতে থাকতে মানুষের মতো কখনো আরও বেশি বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছিল। ধূর্ততা ও ভীতিকর কাহিনি পড়তে পড়তে শিউরে উঠছি বারবার। কিন্তু করবেট যখন সত্যি মেরে ফেললেন চিতাটাকে, মনটা কেঁদে উঠেছিল। কেন কে জানে?

৩.
কেনেথ অ্যান্ডারসন আমাকে মুগ্ধ করেছেনে অরণ্য ও এর বুনো বাসিন্দাদের অদ্ভুত সুন্দর বর্ণনা দিয়ে। অন্যদিকে জিম করবেটের বইয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল অরণ্য এলাকার মানুষ। ছোট্ট একটি মেয়ের কথা মনে পড়ছে এখন। ওই যে মানুষখেকো বাঘের এলাকায় গরু নিয়ে অবলীলায় হেঁটে চলেছিল। বাবা তাকে একাকী পাঠিয়েছিলেন গরুটা চাচার কাছে দিয়ে আসতে। দুষ্টু গরুটাকে কীভাবে সামলাবে, তাই ছিল মেয়েটার একমাত্র চিন্তা, বাঘ মোটেই ছিল না তার মনে। নিরাপদে পৌঁছে দিতে করবেট ওর সঙ্গী হয়েছিলেন।

কানওয়ার সিং, বালা সিং, মোতির মতো চরিত্রগুলোও যেন করবেটের বর্ণনায় এখনো জীবন্ত আমার কাছে। তাঁর কারণেই গাড়োয়াল, হিমালয় অঞ্চলের মানুষ যেন বড় আপন হয়ে গিয়েছিল আমার।

৪.
পাহাড়ের মধ্যে একটা গভীর গর্ত। ওটায় বসে দুদিন আগে শিকার করা জানোয়ারটার মাংস খাচ্ছে জানোয়ারটা। একটা বাঘিনী। শিকারি বসে আছেন একটা জংলার মধ্যে। বাঘিনীর হাড় চিবোনোর শব্দ শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। তারপরই খাওয়া বন্ধ করল সে। হয়তো শিকারির নড়াচড়া নজর কেড়েছে। তবে তার চেয়ে বেশি সম্ভাবনা—পুরনো মড়িটা আর খেতে ভালো লাগছে না তার। পরের এক মিনিট কোনো নড়াচড়া নেই, নেই শব্দ। তারপরই ওটাকে দেখলেন শিকারি। গুহার পাড় বেয়ে উঠছে পাহাড়ে। কয়েকটি চারা গাছের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তাই শরীর ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। রাইফেল তুলে দুম করে গুলি করলেন। গুলি খেয়েই ঘুরে দাঁড়াল বাঘিনী। পাড় ধরে নেমে গুহা পেরোল। তারপর প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসতে লাগল শিকারির দিকে। গুলিটা গায়ে লাগেনি, লেগেছে একটা চারা গাছে। রাইফেলে আর আছে কেবল একটা বুলেট। তারপর? কাহিনির বাকি অংশটা বললাম না। মুক্তেশ্বরের কুখ্যাত বাঘিনীর সঙ্গে করবেটের দ্বৈরথের কাহিনিটি নিজেই পড়ে দেখুন না।

৫.
ভারতের হিমালয় এলাকার এক শহর নৈনিতাল। শহরের আকাশ সবসময় থাকে মেঘে ঢাকা। জঙ্গলে নানা বন্যপ্রাণীর আনাগোনা। পাখির কিচিরমিচির। নৈনিতালের উত্তরে তাকালে দেখা যায় হিমালয়ের বরফাবৃত চূড়া। এখানেই জন্ম এডওয়ার্ড জেমস করবেট বা জিম করবেটের, ১৮৭৫ সালের ২৫ জুলাই। এমন জঙ্গুলে এলাকায় যাঁর জন্ম, ছোটকাল থেকেই সে বন ভালোবাসবে—তাতে আর অবাক হওয়ার কী?

বড় ভাই টমের উৎসাহে শিকারে আগ্রহ হয় জিম করবেটের। দুই ভাই একসঙ্গে বের হয়ে পড়তেন শিকারে; কালাধুঙ্গির জঙ্গলে। কিশোর বয়সে একাই ফাটা নলের বন্দুক নিয়ে বনে ঘুরে বেড়াতেন জিম। নকল করতেন পশু-পাখির ডাক। আয়া খানসামাদের থেকে শেখেন হিন্দুস্তানি ও স্থানীয় পাহাড়ি ভাষা। এসব করতে করতে একসময় জাত শিকারি বনে গেলেন জিম করবেট।

৬.
ভারতের গাড়োয়াল, আর কুমায়ূন এলাকায় মানুষখেকোর উপদ্রব ছিল তখন খুব সাধারণ ঘটনা। কখনো চিতা বাঘ মানুষখেকো হতো, কখনো–বা বাঘ। কোনো কোনাটার হাতে এমনকি প্রাণ হারাত শত শত মানুষ। এসব মানুষখেকোর পিছু নিতেন জিম করবেট। দিনের পর দিন লেগে থেকে শেষ পর্যন্ত মারতেন মানুষখেকোটাকে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচত গ্রামবাসীরা। তাই কোনো এলাকায় মানুষখেকোর উৎপাত হলে গ্রামের লোকেরা ছুটে আসত করবেটের কাছে।

করবেট ১৯০৭ সালে প্রথম মানুষখেকো বাঘ মারেন। ওটা চম্পাবতের মানুষখেকো। নেপাল ও ভারতের সীমানা ছিল এর রাজত্ব। তারপর মারেন রুদ্রপ্রয়াগের চিতাটাকে। রুদ্রপ্রয়াগ এলাকা হিন্দুদের তীর্থস্থান হিসেবে বিখ্যাত। একজনের পর একজন তীর্থযাত্রী মেরে ভয়ানক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল একটা চিতা বাঘ। ৪০০-এর বেশি মানুষ যায় ওটার পেটে। পানারের মানুষখেকো, মোহন, চুকা ও থকের মানুষখেকো বাঘসহ অনেকগুলো বাঘ, আর চিতা বাঘ মারেন একে একে।

করবেটের কথা গোটা পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে ১৯৪৪ সালের পর, যখন বই লেখা শুরু করেন তিনি। তবে অনেক বাঘ মারলেও নিজে বাঘ ভালোবাসতেন করবেট। শুধু তাই না বাঘকে তিনি বলেছেন, ‘বিশিষ্ট ভদ্রলোক’।

৭.
নভেম্বরের শেষ। নৈনিতালে হিম ঠান্ডা কামড় বসাচ্ছে শরীরে। বহু দিনের সঙ্গী রাম সিংহকে তৈরি থাকতে বলেছিলেন করবেট। সময়মতো হাজির সে। দেখে, সাহেব বারান্দায় পায়চারি করছেন। হাতের টর্চের আলো ফেললেন একটা বস্তার ওপর। ইঙ্গিত পেয়ে রাম সিংহ কাঁধে তুলি নিল ওটা। অবাক হলো রাম সিংহ, বেশ ভারি বস্তা। তবে ওটায় কী আছে জানতে চাইল না একবারও। সঙ্গে আসা একজন লোকসহ অপেক্ষা করতে লাগল, পরের নির্দেশের। জঙ্গলের দিকে ইশারা করলেন সাহেব। তারপর তিন জোড়া পা দ্রুত বেগে চলল বনের গভীরে। সূর্যের আলোয় আকাশ হেসে উঠতে কখনো অনেকই দেরি।
মিনিট চল্লিশেক হাঁটার পর দাঁড়ানোর নির্দেশ এল। বন এখানে অনেক গভীর। আরও ভেতরে একটা ঝোপের মধ্যে আলো ফেললেন। বস্তা খুললেন সাহেব। শাবল, কোদাল, তিনটি রাইফেল, আর দুটো শটগান বেরোল ভেতর থেকে। এরই একটা ১৯২৬ সালে মৃত্যু ডেকে এনেছিল রুদ্রপ্রয়াগের চিতা বাঘটার। তাঁর নির্দেশে রাম সিংহরা গর্ত খুঁড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। বেশ গভীর হলে একটা একটা করে অস্ত্র নামিয়ে রাখতে লাগলেন সেখানে। তবে নামানোর আগে পরম ভালবাসায় চুমু খেলেন প্রতিটি অস্ত্রে। হাউমাউ করে কাঁদছে রাম সিংহ। তার মাথায় হাত রাখলেন সাহেব। সালটা ছিল ১৯৪৭। আর নিজের সব অস্ত্র মাটি চাপা দেওয়ার কয়েক দিন পরই প্রিয় ভারত ছাড়েন করবেট। বড় বোন ম্যাগিসহ চলে যান কেনিয়ায় নিয়েরিতে। সেখানেই মারা যান, ১৯৫৫ সালে।

৮.
জীবনের একপর্যায়ে বন্যপ্রাণী শিকার ছেড়ে আগাগোড়া সংরক্ষক বনে যান করবেট। শেষ মানুষখেকো শিকার করেন ১৯৩৮ সালে, ওটা ছিল থাকের কুখ্যাত বাঘটা। এর পর আর কোনো বাঘ বা চিতা মেরেছেন, তেমন খবর নেই। জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়েছেন বন্যপ্রাণী রক্ষায়। উত্তরাখণ্ডে ভারতের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় বন্যপ্রাণী অভয়ারন্যটির নাম বদলে ১৯৫৭ সালে রাখা হয় জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক। ১৯৩০ সালের দিকে এই অভায়রণ্য স্থাপনে ভূমিকা ছিল করবেটের। ১৯৬৮ সালে বাঘের টিকে থাকা পাঁচটি উপ-প্রজাতির একটির নাম রাখা হয়েছে তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্যানথেরা ট্রাইগ্রেস করবেটি।

আজ থেকে ৬৬ বছর আগে এই দিনে (১৯৫৫ সালের ১৯ এপ্রিল) পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন এই শিকারি ও সংরক্ষক। তাই আজ আমার মনটাও ভার। পুরোনো প্রশ্নটা ঘুরেফিরে আসছে মনে—যে ভারতবর্ষকে এত ভালোবাসতেন করবেট, সেখান থেকে কেন চলে গেলেন বহু দূর দেশ কেনিয়ায়?

এই সুযোগে একটা কথা বলে রাখছি কেনিয়ায় রানি এলিজাবথকে নিয়ে তাঁর চমৎকার একটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আছে। ট্রি টপস নামে প্রকাশিত হয় সেটি। পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেওয়ার অল্প ক’দিন আগেই মাত্র এটি লেখা শেষ করেছিলেন। চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।

৯.
করবেটের শিকার এলাকা হিমালয় অঞ্চল, করবেট ন্যাশনাল পার্ক, কালাধুঙ্গি, নৈনিতাল কোথাও যাওয়া হয়নি। যাওয়া হয়নি করবেট মিউজিয়ামেও। বন্যপ্রাণীদের হাত থেকে গ্রামবাসীদের ফসল বাঁচাতে কালাধুঙ্গিতে সাড়ে চার মাইল লম্বা একটি দেয়াল তুলেছিলেন করবেট। ওটাও যে দেখা হয়নি।
বছর দুয়েক আগে হিমালয়ের ওই দিকটার প্রবেশদ্বার দেরাদুন পর্যন্ত গিয়েই ফিরে এসেছি। হয়তো যাব কখনো। তখনকার অরণ্য পাব না জানি। তারপরও আমাদের দেশের বন-পাহাড় থেকে অনেকই ভালো আছে সেখানকার অরণ্য-বন্যপ্রাণীরা। করবেটের কথা ভাবতে ভাবতে হয়তো ঘুরে বেড়াব হিমালয় অঞ্চলের জঙ্গল-পাহাড়ে।

সূত্র: জিম করবেটের বই, আশাপূর্ণা দেবীর জিম করবেট সমগ্র, আনন্দবাজার পত্রিকা ও ইন্টারনেট।

আরও পড়ুন

দিল্লির বাতাসে দুর্যোগপূর্ণ দূষণ, ঢাকার বায়ুমান সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর

রৌদ্রোজ্জ্বল ঢাকায় তাপমাত্রা ১৬.৫

শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে ‘জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশ ২০২৫’

ফের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল উত্তর-পূর্ব জাপান, সুনামি সতর্কতা জারি

ঢাকার বাতাস সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর, দিল্লির অবস্থা বিপজ্জনক

ঢাকায় জেঁকে বসেছে শীত, তাপমাত্রা ১৫.৫

দূষিত শহরের তালিকায় আবারও শীর্ষে দিল্লি, ঢাকার বাতাস সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর

মধ্যরাতে দেশে দুই দফা ভূমিকম্প, উৎপত্তিস্থল সিলেট ও মৌলভীবাজার

ঢাকায় আজ আরও কমেছে তাপমাত্রা

খনিজের সন্ধানে গভীর সমুদ্রে খনন, দুর্লভ জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির শঙ্কা