সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ীর চরদলিকা গ্রামের বাছিরন বেগম (৪২)। নির্বাক তাকিয়ে আছেন পানির দিকে। যমুনা উপচে পানি উঠে এসেছে বাড়িতে। ভিটার মাত্র পাঁচ বর্গফুট একটা স্থান এখনো জেগে আছে। সেখানেই আজ সকালে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। বাড়ির বাকি অংশে পানি উঠেছে। স্বামী আমির শেখ মাথার ওপর জ্বালানি কাঠ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
বাছিরন বলেন, কয়েক দিন ধরেই হামার বাড়ি পানি উঠছে। হামার থাকার ঘরে পানি এক হাঁটুর ওপরে। টিউবওয়েল আগেই ডুবে গেছে। ল্যাট্রিনে এখন একবুক পানি। চৌকিডা দড়ি দিয়ে বাঁশের সাতে বান্দন দিয়ে উচে করে রাখছি। সেটি আত্তিরে থাকি। মুনে হয় দুলনাত আচি। গরু বাছুর আর ছাগলগুলে সারা দিন ম্যা ম্যা করে। প্যাটত খিদে নিয়েই ওরা ঝিম পাড়ে। না খায়া, না খায়া দিনদিন হাড্ডিসার হয়া যাচ্চে। ফসলাদি যা করছিলেম তা তো আগেই ডুবে গেছে। একন হামরা কুন্টি যামু, কী খামু, হামার গরু কী খাবি। ও স্যার, হামাগিরে দুক্কু কি কেউ দেকপের লায়। হামাগিরেক কি কেউ সাহায্য করবিনে।
উপজেলার ৫৬টি গ্রামের ৯ হাজার ৫০০ পরিবারের ৩৮ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দী। অনেকে অবস্থায় বাছিরনের মতো সঙ্গীন। চরদলিকার জালাল শেখ (৪৫) বলেন, নদী ভাঙতে ভাঙতে একন একবারে জামালপুরের ইসলামপুর সীমানার কাছাকাছি আছে, কুনোমতে ঘর তুলে আছি। গত কয়েকদিন ধরে সেই ঘরডাও পানিতে ডুবে গেছে। হামরা একন নৌকাত চরে আছি। খাবার নাই। না খায়া আছি।
কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২৬ আগস্ট দুপুরে সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে। আজ সোমবার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে।
স্থানীয় প্রশাসনের হিসাবে, বন্যায় ৪ হাজার ৫৩২টি টিউবওয়েল তলিয়ে গেছে। ফলে খাওয়ার পানির অভাব দেখা দিয়েছে। ২ হাজার ৪০০ গবাদিপশু পানিবন্দী। সীমাহীন দুর্ভোগে রয়েছে গবাদিপশু।
এছাড়া ৭৪ হেক্টর জমির ফসল এখন নিমজ্জিত। ৫৫ হেক্টরের মধ্যে ৮ হেক্টর মাষকলাই, ৭ হেক্টর এর মধ্যে ৫ হেক্টর সবজি, ১০ হাজার ১২০ হেক্টর এর মধ্যে ৫৫ হেক্টর রোপা আমন, ১৭০ হেক্টরের মধ্যে ৬ হেক্টর নাবি জাতের রোপা আমনের বীজতলা তলিয়ে গেছে। এ হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৭০১ জন।
সারিয়াকান্দিতে দায়িত্বে থাকা গেজ রিডার পরশুরাম জানিয়েছেন, আজ বিকেল ৩টায় পর্যন্ত যমুনা নদীতে পানি বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অপরদিকে বাঙালি নদীতে পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে কয়েকদিন ধরেই বাঙালি নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কাজলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রাসাদ জামান বলেন, আমার ইউনিয়নের সব চরের আমন ধান এবং স্থানীয় জাতের গাইন্জা ধানের বীজতলাগুলো তলিয়ে গেছে। কোথাও বাড়িঘর ডুবে এলাকাবাসী পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত আলী বলেন, আমার ইউনিয়নের ২৭টি চরের অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। এসব এলাকার জনসাধারণ এবং গবাদিপশু সীমাহীন দুর্ভোগে দিনাতিপাত করছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম জানিয়েছেন, উপজেলার চালুয়াবাড়ী, কাজলা, কর্নিবাড়ী এবং বোহাইল ইউনিয়নের চরগুলোর নিচু এলাকার ফসলগুলো নিমজ্জিত হয়েছে। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে কৃষকেরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
যোগাযোগ করা হলে সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাসেল মিয়া তিনি বলেন, দেশের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ এলাকা সারিয়াকান্দি। এখানে প্রতিবছর বন্যা এবং নদীভাঙনের ফলে মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। যমুনা নদীর পানি কয়েকদিন ধরেই বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ অসময়ে বন্যা হলে উপজেলার বাঙালি এবং যমুনা নদী সংলগ্ন চরাঞ্চলের কৃষকেরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ক্ষতিগ্রস্তদের যথেষ্ট সরকারি সহযোগিতা প্রদান করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি।