রমনার বটমূলে হামলার পর প্রথম আট বছর কিছুটা প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ সময় জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালের পর এই হত্যা মামলায় যখন চারদিকে ধরপাকড় শুরু হয় তখনই প্রথম পুরোপুরি আত্মগোপনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। নরসিংদীর একটি চরে মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে আব্দুল করিম নামে ১৪ বছর কাটিয়ে দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর গোপন করতে পারলেন না। ২১ বছর পর রমনার বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুফতি শফিকুল ইসলামকে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে থেকে গ্রেপ্তার করল র্যাব।
সংস্থাটি বলছে, এই সময়কালে মসজিদে ইমামতি, মহিলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা আর ধর্মের নামে বিভ্রান্তিমূলক অপব্যাখ্যা প্রচার করে সময় কাটিয়েছেন তিনি। আত্মগোপনের কৌশল হিসেবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতেন না।
আজ শুক্রবার কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলন করে এসব কথা জানিয়েছেন র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরে বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় শফিকুল সম্পৃক্ত ছিলেন। রমনার বটমূলে হামলার পর ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এমনকি ঘটনার দিনও তিনি খিলগাঁওয়ে একটি মাদ্রাসায় অবস্থান করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিলেন।
র্যাব বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বোমা হামলার সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন। গ্রেপ্তার আসামি মুফতি শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভৈরব থানায় ছয়টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
গ্রেপ্তার শফিকুল ইসলাম সর্ম্পকে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, তিনি পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। শুরুতেই ১৯৭৫ সালে চকবাজারের একটি মাদ্রাসা থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত হেদায়ায় পড়াশোনা করেন। হেদায়া পাস করার পর ১৯৮৩ সালে পার্শ্ববর্তী দেশে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দাওরায়ে হাদিস (টাইটেল) পাস করে বাংলাদেশে ফেরত আসেন। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে ইউসুফ বিন নুরী মাদ্রাসায় ফতোয়া বিভাগে ভর্তি হয়ে তিন বছরের ইফতা (ফতোয়া) কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানে অবস্থানকালীন তিনি আফগানিস্তানে চলে যান এবং তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করেন। সেখান থেকে ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে আসার পর তিনি ঢাকার খিলগাঁওয়ে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচির নিউ টাউনে পড়াশোনা করার সময় সেই প্রতিষ্ঠানে মুফতি হান্নানও পড়াশোনা করতে গেলে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে ভ্রমণে গেলে আফগানিস্তানে থাকাকালীন জঙ্গি সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদের’ সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি।
১৯৯০ সালে দেশে ফেরত এসে সমমনাদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে এবং দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। তিনি ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ এর প্রচার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি হরকাতুল জিহাদের আমির হন। পরে ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি হরকাতুল জিহাদের সুরা সদস্য ছিলেন।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রেপ্তার শফিকুল ইসলাম নরসিংদী থাকাকালীন নিজের পরিচয় গোপন করে “আব্দুল করিম” ছদ্মনামে পরিচয় দিতেন। এ ছাড়া তিনি আব্দুল করিম নাম ব্যবহার করে ওই এলাকার চরে অবস্থিত একটি মসজিদে মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতনে ইমামতির চাকরি করতেন।’
রমনার বটমূলে হামলার মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আটজনের মধ্যে এখনো তিনজন পলাতক রয়েছেন। তাঁরা হলেন মাওলানা আব্দুল হাই, মাওলানা তাজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর। এ মামলায় দুজন জেলহাজতে মারা গেছেন। একজন মুফতি হান্নান, অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় দণ্ডাদেশ কার্যকর হয়। আর বাকিরা জেলহাজতে রয়েছেন।