তিন দফা ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদী। ভূমিকম্পের পর সারা দেশের পরিস্থিতি শান্ত হলেও পুরো জেলায় এখনো বিরাজ করছে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা। গত শনিবার রাত থেকে রোববার ভোর পর্যন্ত আতঙ্ক ও গুজবের কারণে জেলার হাজারো মানুষ রাস্তা, মাঠ, খোলা জায়গায় রাতযাপন করেছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গুজবে কান না দিতে বলা হলেও কাটেনি আতঙ্ক।
গত শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এতে জেলায় ৫ জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হন। বিভিন্ন স্থানে ও ভবনে ছোট-বড় ফাটল দেখা দেয়। এরপর শনিবার সকালে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার এবং একই দিন সন্ধ্যায় ৪ দশমিক ৩ মাত্রা ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এই তিনটি ভূমিকম্পে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এখন খোলা আকাশের নিচেই নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন অনেকে। নরসিংদী পৌর এলাকার ব্রাহ্মন্দী, গাবতলী, পশ্চিম ব্রাহ্মন্দী, মাধবদীর এসপি ও গার্লস স্কুল মাঠ, পলাশের পিডিবি ও প্রাণ-আরএফএল মাঠসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে দল বেঁধে শত শত মানুষকে বাইরে অবস্থান করতে দেখা যায়। কেউ কলেজ মাঠে, কেউ বাড়ির আঙিনায়, আবার কেউ সড়কের পাশে রাতযাপন করেছেন।
গতকাল সোমবার সকালেও মানুষের মধ্যে ছিল এমন উদ্বেগ। স্থানীয়দের দাবি, শনিবার সন্ধ্যার কম্পনের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে রাত ১২টার পর বড় আকারের আরেকটি ভূমিকম্প হবে। মুহূর্তেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে শহর ও উপশহরে। এতে ভীত হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ।
শনিবার রাতে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছেন ব্রাহ্মন্দীর বাসিন্দা রাশেদুল করিম। বলেন, ‘ভবন কাঁপতে দেখে ছোট বাচ্চা নিয়ে বাইরে বের হই। গুজব শুনে আর ঘরে ঢুকতে সাহস হয়নি।
রাতটা খোলা জায়গাতেই কাটিয়েছি।’
গাবতলীর মো. কবীর হোসেন বলেন, ‘এবারের ভূমিকম্পে গাবতলীতে বাবা-ছেলের মৃত্যু হয়েছে। সে ভয় মানুষের ভেতরে ঢুকেছে। শনিবার রাতে আমাদের সবাই মাঠে থাকলেও আমি একাই বাড়িতে ছিলাম। অনেকেই রাত আড়াইটায়, কেউ ভোরে বাড়ি ফেরেন।’
শনিবার রাতে খোলা মাঠে ছিলেন সুমন মিয়া। তিনি বলেন, ‘শুনেছি পুরোনো ভবনগুলো ঝুঁকিতে। তাই পরিবার নিয়ে বাইরে থাকাই নিরাপদ মনে হয়েছে।’
পলাশ প্রেসক্লাবের সভাপতি হাজি মো. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘রাত ১১টার পর ওয়াপদা গেট এলাকায় মানুষ কাঁথা-বালিশ নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। পলাশ বাজারেও একই দৃশ্য—অনেকে পিডিবির মাঠে রাত কাটান।’
কলেজপাড়ার গৃহবধূ সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘পরপর তিনবার ভূমিকম্পে মনে হচ্ছিল বড় কিছু হয়ে যাবে। তাই নিচতলায় নেমে থাকি। বাচ্চারা আতঙ্কে কাঁদছিল।’
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কলেজপাড়া ও ব্রাহ্মন্দী বালুরচরে ঘনবসতিতে গড়ে ওঠা অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে আরও বাড়ানো হয় আতঙ্ক। এ পরিস্থিতিতে রোববার দুপুরে ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন পুনরায় বলেন, ‘গুজব ছড়াবেন না, গুজবে বিশ্বাস করবেন না।’
তবে এরপরও উদ্বেগ কমেনি। রোববার রাতেও শহরের গাবতলী এলাকায় অনেকেই খোলা আকাশের নিচে রাত্রীযাপন করেন।
এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে গুজব প্রসঙ্গে সহকারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আকরাম হোসেন বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কোনো নোটিশ পাইনি। সিদ্ধান্ত হলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হবে।’
এ নিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। দ্রুত প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত ও সহায়তা দেওয়া হবে। তবে গুজব ছড়াবেন না, গুজবে বিশ্বাস করবেন না।’