হোম > সারা দেশ > ঢাকা

‘টাকা না আনলে ঘরে ঢুকতে পারবি না’

মন্টি বৈষ্ণব

‘আমরা চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না। আমাদের ঘরভাড়া জমছে অনেক টাকা। দোকানদারের পাওনাও অনেক। টাকা পাওয়ার আশায় এখানে নয় দিন ধরে আছি। বাচ্চা নিয়ে এখানে অসুস্থ হয়ে গেছি। স্বামী এখন ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। বলছে, টাকা নিয়া না আসলে ঘরে ঢুকতে পারবি না।’ কথাগুলো বলতে বলতে চোখে একরাশ শূন্যতা ভর করল আসমা বেগমের। দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে শ্রম ভবনের সামনে নয় দিন ধরে অবস্থানে আছেন তিনি। 

গাজীপুরের স্টাইল ক্রাফট লিমিটেড এবং ইয়ং ওয়ান লিমিটেডের শ্রমিকেরা ন্যায্য বেতনের দাবিতে গত নয় দিন ধরে শ্রম ভবনের সামনে লাগাতার আন্দোলন করছেন। একবেলা, আধবেলা খেয়ে নিজেদের পাওনা আদায়ের জন্য তাঁরা আন্দোলন করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আশ্বাস ছাড়া আর কিছু মেলেনি। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এ ক্ষেত্রে অনেকটাই নীরব ভূমিকা পালন করছে।

স্টাইল ক্রাফট কারখানায় কাজ করতেন আসমা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি স্টাইল ক্রাফট গার্মেন্টসে ৭ বছর ধরে কাজ করছি। এখন আমরা চার মাস ধরে বেতন পাই না। আমাদের ঘরভাড়া জমছে অনেক টাকা। দোকানদারেরাও পাবে অনেক টাকা। টাকা পাওয়ার আশায় এখানে নয় দিন ধরে আছি। স্বামী এখন ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। স্বামী বলছে, টাকা না আনলে ঘরে ঢুকতে পারবি না।’

একটানা নয় দিন অবস্থানে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আসমা বেগম। কিন্তু তাঁর বড় দুশ্চিন্তার কারণ এখন ঘর ও সঙ্গে থাকা দুই বছরের সন্তান। বললেন, ‘এখানে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নেই। অন্য কারখানার শ্রমিকেরা আমাদের জন্য চাল, ডাল, পেঁয়াজ সংগ্রহ করে পাঠাচ্ছেন। সেটা দিয়ে আমরা একবেলা খাচ্ছি। আর বাকি সময় ধার-দেনা করে খেতে হয়। এই আমার দুই বছরের সন্তান নিয়ে কি একবেলা খাওন সম্ভব? তার এখন ঘরে থাকার সময়। কিন্তু কারখানার মালিকের জন্য আজ আমাদের এই দুরবস্থা। নয় দিন ধরে আছি। মালিকের খোঁজখবর নাই, আর সরকারও কোনো খবর নেয় না।’

এত কিছুর পরও নিজের দাবি ও অধিকার থেকে নড়তে রাজি নন আসমা। তাঁর কথা—‘আমাদের দাবি, মালিক আমাদের বেতনের বিষয়ে ফয়সালা করুক। আমাদের ন্যায্য পাওনা আমাদের ফেরত দিক। আমরা চলে যাব। ঘরে টাকা-পয়সা নিয়ে না গেলে আমাদের কোনো রক্ষা নাই। এমন এক অবস্থায় আছি, টাকার অভাবে এখান থেকে অন্য কোথাও যেতে পারছি না। এখানে খেয়ে আছি কিনা, না খেয়ে আছি এ বিষয়ে কেউ কোনো খোঁজ নেয় না।’ 

শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া শ্রমিকদের মধ্যে এমন আসমা বেগমের সংখ্যা অনেক। কেউ মুখ ফুটে বলছেন, কেউ বলছেন না। এখানেই দেখা হলো স্টাইল ক্রাফট গার্মেন্টসেরই আরেক শ্রমিক রোজিনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি ৫ মাসের গর্ভবতী। বললেন, ‘২০১১ সালে আমি এই কারখানায় চাকরি নেই। গত চার-পাঁচ মাস ধরে আমাদের বেতন দিচ্ছে না। জুলাই মাসে টানা ১৫ দিন কাজ করার পর ৫০০০ টাকা দিছে। এর পর আর কোনো টাকা দেয় নাই। এই চার মাস আমরা বাড়ি ভাড়া দিতে পারছি না। ঘর ভাড়া দিতে পারি নাই। তাই বাড়িওয়ালা আমাদের গাইল পারছে। বাড়িওয়ালা বলে, “তুমরা টাকা দাও। টাকা না দিলে এখানে থাকন যাইব না। ” মুদি দোকানদারেরাও টাকা পাইব। দোকান থেকে জিনিসপাতি কিনতে পারছি না। বহুত কষ্ট করে চলতেছি আমরা।’ 

নিজের অবস্থা সম্পর্কে রোজিনা বলেন, ‘আমার একটা ৪ বছরের মেয়ে আছে। আর আমি এখন ৫ মাসের গর্ভবতী। এখানে একবেলা খাওন দেওয়া হয়। সেটা বিকাল ৪টায়। আর সারা দিন আশপাশের দোকান থেকে কিনা খেতে হয়। যাদের টাকা আছে, তারা খায়। আর যাদের টাকা নাই, তারা কষ্ট করে ধার করে চলতেছে।’

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে বেতন-ভাতা এবং ঈদের বোনাস না দিয়ে শ্রমিকদের বঞ্চিত করে আসছে গাজীপুরের এই কারখানা দুটি। এই দুই কারখানায় শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ৪ হাজার ২৪৩ জন। কারখানা দুটির শ্রমিকদের ৬ মাসের এবং কর্মচারীদের ৯ মাসের বেতন বকেয়া। এ অবস্থায় দুই গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা গত নয় দিন ধরে রাজধানীর শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের দাবি তাঁদের পাওনা বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হোক। কিন্তু এখন পর্যন্ত মালিক পক্ষ আশ্বাস ছাড়া কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শ্রম প্রতিমন্ত্রীও আশ্বাস দিয়েছেন। এর মধ্যে একদিন বৈঠকও হয়েছে। গভীর রাতে শেষ হওয়া সে বৈঠকেও কোনো ফল আসেনি। এ অবস্থায় শ্রমিকেরা অবস্থান ছেড়ে যেতে একদম নারাজ। আজ বৃহস্পতিবার আন্দোলনের দশম দিনে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছেন। 

গতকাল বুধবার বিজয়নগরে শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া শ্রমিকদের মধ্যে পাওয়া গেল শিউলি খাতুনকে। তিনিও এখানে আছেন নয় দিন ধরে। তিনি বলেন, ‘আমি এই কারখানায় কাজ করি প্রায় ৭ থেকে ৮ বছর হবে। এই কারখানা ভালোই চলতেছিল। কিন্তু গত চার মাস ধরে বেতন ভাতা দেয় না। গত ২ বছর ধরে এই কারখানায় বেতনের জন্য প্রতি মাসে আন্দোলন করতে হইছে। রাস্তায় নামছি, তারপর বেতন পাইছি। গত কোরবানি ঈদে ৫০০০ টাকা হাতে দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দিছে মালিক। চার মাস ধরে বেতন বন্ধ। এই ৫০০০ হাজার টাকা দিয়া কি কিছু হয়? বাড়ি যাওয়া হয়, নাকি খাওয়া দাওয়া হয়? আমার একটা ছেলে আছে। এই সন্তান নিয়া আমি এই জায়গায় নয় দিন ধরে আছি। অসুখ হলে ছেলেরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, ওষুধপত্র কেনারও টাকা নাই। আমরা তো মানুষ। এভাবে কি জীবন চলে? না নিতেছে মালিকে খবর, না নিতেছে সরকারে খবর। এখানে থাকা, খাওয়া, বাথরুমের সমস্যা। এত সমস্যা নিয়ে মানুষের জীবন চলে না। আমরা আমাদের পরিশ্রমের টাকা ফেরত চাই।’ 

শ্রম ভবনে আন্দোলনরত নাজমা বেগম বলেন, ‘আমি এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি ১১ বছর ধরে। ৪ মাস ধরে বেতন পাইতেছি না। পাঁচ বছর ধরে ঈদ, বোনাস ছুটির টাকা দেয় না। আমার মাতৃত্বকালীন টাকা এখনো পেলাম না। আমার সন্তান নিয়ে আমি এখানে অনেক দুঃখে আছি। ঈদে যে ৫ হাজার টাকা দিল, এই দিয়া কী হয় বলেন? এই টাকায় ঈদের সময় না দিতে পারছি সন্তানকে জামা কিনে দিতে, না পারছি ঘর ভাড়া দিতে। মালিকের কথায় আমরা এত দিন অপেক্ষা করছি। মালিক আমাদের বলছিল কারখানা খুলবে। বেতনও দিবে। কিন্তু মালিকপক্ষ কারখানা চালু করে না। চার মাস ধরে আমরা অনেক সমস্যাতে আছি। এখন আমরা আমাদের টাকা ফেরত নিতে আসছি। কিন্তু সরকার বা মালিক কেউ সহযোগিতা করছে না। আমরা এখানে আর কত দিন অপেক্ষা করব? এর মধ্যে আমরা দুইবার বিজিএমইএ অফিসে গেছি। সেখানে গিয়ে ন্যায্য পাওনা না পেয়ে এখন আমরা এখানে অবস্থান করছি।’ 

দুই মাসের সন্তানসহ আন্দোলনে আছেন জান্নাত বেগম। স্টাইল ক্রাফটের অন্য শ্রমিকদের মতোই তাঁর অবস্থা। ঘরে ফিরতে পারছেন না, বাড়িওয়ালা বের করে দেওয়ায়। দোকানদারদের পাওনা টাকা না নিয়ে এলাকায় ফেরার উপায় নেই। বললেন, ‘এখানে আমি আমার দুই মাসের সন্তান নিয়া খুব কষ্টে আছি। আমি নিজেও খাইতে পারছি না। আমার দুধের বাচ্চারে ঠিকমতো খাওন দিতে পারি না। টাকার অভাবে দোকান থেকেও কোনো খাবার কিনতে পারছি না। দোকানিরা বাকিতেও কিছু দিতে চায় না।’ এই অসহায়ত্বের মধ্যেও নিজের অধিকার প্রশ্নে ঠিকই সোচ্চার জান্নাত। বললেন, ‘আমরা প্রাপ্য টাকা চাই। টাকা পাইলে চলে যাব। এই টাকা তো আমার নিজের পরিশ্রমের ঘামের। এই টাকা আমি পাব না কেন? আমরা তো আর ভিক্ষা করতে আসি নাই।’ 

স্টাইল ক্রাফট গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের আন্দোলনের বিষয়ে বিজিএমইএ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা স্টাইল ক্রাফটের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার বিষয়টি সুরাহার চেষ্টা করছি।’ তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা ভালো। ইচ্ছে করলেই কর্তৃপক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিয়ে দিতে পারেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি লিমিটেড কোম্পানির অধীনে। এ কারণে করোনাকালে সরকারের দেওয়া প্রণোদনা এ প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। এ অবস্থায় শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা না দেওয়াকে অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন তিনি।

শহীদ জিয়ার কবরের পূর্ব পাশে খোঁড়া হচ্ছে নতুন কবর

খালেদা জিয়ার জানাজা: যেসব পথে নিয়ন্ত্রিত থাকবে যান চলাচল

রাষ্ট্রীয় শোক: ঢাকায় ৩ দিন আতশবাজি, পটকা ফোটানো নিষিদ্ধ

খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নিতে বাড়ানো হলো মেট্রোরেলের ট্রিপ

হাদি হত্যা মামলা: সিবিউন-সঞ্জয়ের তৃতীয় দফায় রিমান্ড, ফয়সাল নামে আরও একজন রিমান্ডে

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে জাবিতে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরামের কালো ব্যাজ ধারণ

রাজধানীর রামপুরায় অটোরিকশার ধাক্কায় বৃদ্ধের মৃত্যু

গয়েশ্বর চন্দ্রের আসনে বিএনপির বিদ্রোহী তিন বড় নেতাসহ ১৬ প্রার্থী, শক্ত লড়াইয়ের আভাস

খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে এভারকেয়ারের সামনে ভিড়, পুলিশের ব্যারিকেড

হারিয়ে যাওয়া কনাই নদ উদ্ধার উদ্‌যাপন