‘আমরা চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না। আমাদের ঘরভাড়া জমছে অনেক টাকা। দোকানদারের পাওনাও অনেক। টাকা পাওয়ার আশায় এখানে নয় দিন ধরে আছি। বাচ্চা নিয়ে এখানে অসুস্থ হয়ে গেছি। স্বামী এখন ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। বলছে, টাকা নিয়া না আসলে ঘরে ঢুকতে পারবি না।’ কথাগুলো বলতে বলতে চোখে একরাশ শূন্যতা ভর করল আসমা বেগমের। দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে শ্রম ভবনের সামনে নয় দিন ধরে অবস্থানে আছেন তিনি।
গাজীপুরের স্টাইল ক্রাফট লিমিটেড এবং ইয়ং ওয়ান লিমিটেডের শ্রমিকেরা ন্যায্য বেতনের দাবিতে গত নয় দিন ধরে শ্রম ভবনের সামনে লাগাতার আন্দোলন করছেন। একবেলা, আধবেলা খেয়ে নিজেদের পাওনা আদায়ের জন্য তাঁরা আন্দোলন করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আশ্বাস ছাড়া আর কিছু মেলেনি। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এ ক্ষেত্রে অনেকটাই নীরব ভূমিকা পালন করছে।
একটানা নয় দিন অবস্থানে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আসমা বেগম। কিন্তু তাঁর বড় দুশ্চিন্তার কারণ এখন ঘর ও সঙ্গে থাকা দুই বছরের সন্তান। বললেন, ‘এখানে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নেই। অন্য কারখানার শ্রমিকেরা আমাদের জন্য চাল, ডাল, পেঁয়াজ সংগ্রহ করে পাঠাচ্ছেন। সেটা দিয়ে আমরা একবেলা খাচ্ছি। আর বাকি সময় ধার-দেনা করে খেতে হয়। এই আমার দুই বছরের সন্তান নিয়ে কি একবেলা খাওন সম্ভব? তার এখন ঘরে থাকার সময়। কিন্তু কারখানার মালিকের জন্য আজ আমাদের এই দুরবস্থা। নয় দিন ধরে আছি। মালিকের খোঁজখবর নাই, আর সরকারও কোনো খবর নেয় না।’
এত কিছুর পরও নিজের দাবি ও অধিকার থেকে নড়তে রাজি নন আসমা। তাঁর কথা—‘আমাদের দাবি, মালিক আমাদের বেতনের বিষয়ে ফয়সালা করুক। আমাদের ন্যায্য পাওনা আমাদের ফেরত দিক। আমরা চলে যাব। ঘরে টাকা-পয়সা নিয়ে না গেলে আমাদের কোনো রক্ষা নাই। এমন এক অবস্থায় আছি, টাকার অভাবে এখান থেকে অন্য কোথাও যেতে পারছি না। এখানে খেয়ে আছি কিনা, না খেয়ে আছি এ বিষয়ে কেউ কোনো খোঁজ নেয় না।’
শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া শ্রমিকদের মধ্যে এমন আসমা বেগমের সংখ্যা অনেক। কেউ মুখ ফুটে বলছেন, কেউ বলছেন না। এখানেই দেখা হলো স্টাইল ক্রাফট গার্মেন্টসেরই আরেক শ্রমিক রোজিনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি ৫ মাসের গর্ভবতী। বললেন, ‘২০১১ সালে আমি এই কারখানায় চাকরি নেই। গত চার-পাঁচ মাস ধরে আমাদের বেতন দিচ্ছে না। জুলাই মাসে টানা ১৫ দিন কাজ করার পর ৫০০০ টাকা দিছে। এর পর আর কোনো টাকা দেয় নাই। এই চার মাস আমরা বাড়ি ভাড়া দিতে পারছি না। ঘর ভাড়া দিতে পারি নাই। তাই বাড়িওয়ালা আমাদের গাইল পারছে। বাড়িওয়ালা বলে, “তুমরা টাকা দাও। টাকা না দিলে এখানে থাকন যাইব না। ” মুদি দোকানদারেরাও টাকা পাইব। দোকান থেকে জিনিসপাতি কিনতে পারছি না। বহুত কষ্ট করে চলতেছি আমরা।’
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে বেতন-ভাতা এবং ঈদের বোনাস না দিয়ে শ্রমিকদের বঞ্চিত করে আসছে গাজীপুরের এই কারখানা দুটি। এই দুই কারখানায় শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ৪ হাজার ২৪৩ জন। কারখানা দুটির শ্রমিকদের ৬ মাসের এবং কর্মচারীদের ৯ মাসের বেতন বকেয়া। এ অবস্থায় দুই গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা গত নয় দিন ধরে রাজধানীর শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের দাবি তাঁদের পাওনা বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হোক। কিন্তু এখন পর্যন্ত মালিক পক্ষ আশ্বাস ছাড়া কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শ্রম প্রতিমন্ত্রীও আশ্বাস দিয়েছেন। এর মধ্যে একদিন বৈঠকও হয়েছে। গভীর রাতে শেষ হওয়া সে বৈঠকেও কোনো ফল আসেনি। এ অবস্থায় শ্রমিকেরা অবস্থান ছেড়ে যেতে একদম নারাজ। আজ বৃহস্পতিবার আন্দোলনের দশম দিনে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছেন।
স্টাইল ক্রাফট গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের আন্দোলনের বিষয়ে বিজিএমইএ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা স্টাইল ক্রাফটের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার বিষয়টি সুরাহার চেষ্টা করছি।’ তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা ভালো। ইচ্ছে করলেই কর্তৃপক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিয়ে দিতে পারেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি লিমিটেড কোম্পানির অধীনে। এ কারণে করোনাকালে সরকারের দেওয়া প্রণোদনা এ প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। এ অবস্থায় শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা না দেওয়াকে অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন তিনি।