পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে বাবার চায়ের দোকানেই সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন তপন। চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়ার বদলে নেমেছিলেন জীবনের পরীক্ষায়। জীবনের পরীক্ষায় নিজের দৃষ্টিতে সফল তপন চন্দ্র দাস আর বিকল্প কোনো পেশা খোঁজেননি।
কিশোরগঞ্জ হাওরাঞ্চলের অথই জলরাশি চিরে তৈরি পিচঢালা সড়ক দিয়ে যারা হাওরের সৌন্দর্য দেখতে আসেন তাঁরা মিঠামইন সদর ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন পুব দিকে তাকালেই চোখে পড়বে মানুষের ভিড়। ভিড় ঠেলে একটু সামনে গেলেই দেখা মিলবে বিশাল একটি টেবিলের চারপাশ ঘুরে মগে দুধ-চিনি-লিকার ঢেলে চামচের টুং টাং শব্দে চা তৈরি করছেন ২৯ বছরের এক যুবক।
তপনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কম দামে অল্প সময়ে ভালো চা পাওয়া যায় তপনের স্টলে। বিশ বছর ধরে চা বিক্রি করে পরিবারকে আর্থিক সচ্ছলতা এনে দিয়েছেন তপন। বছর দশেক আগে বিয়ে দিয়েছেন এক বড় বোনের। বাকি দুই বোনের একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অন্যজন মাস্টার্স করছেন। কয়েক মাস আগেও নিজেও বিয়ে করছেন।
১০ বছর আগে বাবা মারা গেলে সংসারের দায় এসে পড়ে তাঁর ঘাড়ে। তখন থেকেই কলেজ পড়ুয়া দুই বোন, মা এবং সংসার সামলান তপন। নিজের লেখাপড়ার স্বপ্ন বোনদের মধ্যে দেখে দোকান ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে শুরু করেন দাঁড়িয়ে চা বিক্রি। খুব অল্প দিনেই তপনের হাতে তৈরি গাঢ় লিকার আর গাভির দুধ মেশানো চায়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রামের বহু মানুষ তপনের চায়ের স্বাদ নিতে আসেন নিয়মিত।
তপনের তৈরি রং চায়ের দাম ৫ টাকা। কাপ ভর্তি সর বা মালাই চা বিক্রি করেন ১০ টাকায়। দিনে প্রায় ১০০০ থেকে ১২০০ কাপ চা তৈরি করেন তিনি। ফলে দিনে প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার চা বিক্রি হয়। এতেই চলে বোনদের লেখাপড়া, পরিবারের জীবিকা।
তপনের চায়ের পসার চলে প্রতিদিন সকাল ৮টা হতে ১২টা এবং বিকেল ৩টা হতে রাত ১১টা পর্যন্ত। চা বানাতে দরকার হয় ১০ থেকে ১২ কেজি চিনি, ৩০ / ৩৫ কেজি গরুর দুধ ও ২ কেজি মানসম্মত চা পাতা আর কাঠের লাকড়ি। পরিষ্কার কাপ, সুস্বাদু চা আর তপনের আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ চা প্রেমীরা।
পার্শ্ববর্তী ঢাকি ইউনিয়নের সোহরাব হোসেন বলেন, ‘মিঠামইন এলে তপনের চা না খেয়ে যাই না। অল্প দামে এত ভালো চা আশপাশে কয়েক উপজেলায় মেলে না।’ কলমা ইউনিয়নের সত্যজিৎ দাস বলেন, ‘গরুর খাঁটি দুধে এমন মানসম্পন্ন চা শহরে দশ টাকায়ও মিলবে না। মাঝেমধ্যে একসঙ্গে দুই কাপ খেতে হয়।’
তপন চন্দ্র দাস বলেন, ‘সৎভাবে মান ধরে রাখা আর ভালো আচরণে সফলতা আসবেই। চা তৈরি আমার ধ্যান জ্ঞান। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি চায়ের মান বাড়াতে। মানুষের তৃপ্তিই আমার পরম পাওয়া। এই পেশাই আমার বাকি জীবন চলবে।’