‘ও সব সময় বলতো মা ওহনে (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) আমারে সবাই ভালো জানে। আমার ছেলে ওহনে ভালোভাবে চলাফেরা করত। চেহারা সুন্দর, মানুষ মনে করছে কতই না কোটিপতির পোলা ও। আমরা যে সরকারি (আবাসনের) ঘরে থাকি তা কেউ মনে অয় জানে না। আমার বাজানরে কী করলোরে..., আমার সব স্বপ্ন শেষ। এসব সাজানো বাবা, সব সাজানো। ও রাজনীতি করত কি না আমরা আগে জানতাম না। আমরা জানতাম ও খালি পড়ে, ও পড়বা লাগছে।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই কথাগুলো বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমানের মা আসমা বেগম। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নাছিরাবাদ ইউনিয়নের বালিয়াহাটি গ্রামে মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়িতে গেলে কথা হয় মোস্তাফিজুর রহমানের মায়ের সঙ্গে।
তবে তাঁর দাদা মরহুম মোমরেজ খান একসময়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছোট চাচা বর্তমান ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান খান। তাঁর চাচা বলেন, ‘ওর বাবা অন্যের দোকানে কাজ করে ও মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় ওর পড়ালেখা চালাইতো। ও কেমনে কী রাজনীতি ঢুকছে আমরা জানি না। এলাকায় কোনো রাজনীতি করত না। সকলেই ওরে ভদ্র হিসেবে জানত।’
মোস্তাফিজুর রহমান নিজ গ্রামে সবার কাছে জয় নামে পরিচিত। স্থানীয় আব্দুল্লাহবাদ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষা শেষে ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে ২০১৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ পান।
নিজ গ্রামের সবাই তাঁকে নিয়ে গৌরব করত। একজন নম্র-ভদ্র ও বিনয়ী ছেলে হিসেবে সবাই তাঁকে জানে। তাঁর বাবাও একজন ভদ্র মানুষ হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তবে তাঁর এমন কর্মকাণ্ডে হতবাক তারা। কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চায় না এলাকাবাসী।
স্থানীয় রাজীব নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘এই এলাকায় ওর মতো নম্র-ভদ্র ছেলে নাই। ও খেলাধুলাও করতে যায়নি কখনো, সব সময় পড়ালেখা করত। কখনো কারও সঙ্গে বেয়াদবি করতে দেখি নাই। কিন্তু কীভাবে এ ঘটনায় জড়ায় গেছে, আল্লাহপাক ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। এ ঘটনা টিভিতে দেখার পর ওদের চোখের পানি কেউ ধরে রাখতে পারতেছে না। আমরা বিশ্বাস করি না ও এমন কাজ করছে। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই।’
আলান খান নামে অপর এক ব্যক্তি বলেন, ‘ওর বাবা ফলের দোকানে কাজ করে। খুব পরিশ্রম করে ছেলে পড়ালেখা করাইছে। ওরা খুবই গরিব, খুব কষ্ট করে ছেলেডারে মানুষ করছিল। ওর ওপরেই ওর বাবা-মায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল। আজ পর্যন্ত শুনি নাই অমুক জায়গা অমুকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে।’
কথা-কাটাকাটির জেরে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মোস্তাফিজকে ফাঁসানো হয়েছে বলে তাঁরা ফুফু সিনহা বেগম দাবি করেন। মোস্তাফিজের বন্ধুদের বরাদ দিয়ে সিনহা বেগম বলেন, ‘আমার ভাতিজারে ক্যাম্পাস থেকে রাজনৈতিক ব্যাপারে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসানো হয়েছে। ও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ করত। ঘটনার আগের দিন শুক্রবার বিকেলে ওর সঙ্গে অন্য এক ছাত্রের কথা-কাটাকাটি হয়েছিল এবং ওরে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে যেতে বলছিল। আমার ভাতিজা বলছিল, ক্যাম্পাসে আপনাদের যেমন আধিকার আছে, আমারও অধিকার আছে। আপনার কথায় আমি বের হব কেন। এ ঘটনার জের ধরে আমার ভাতিজারে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে।’
বাড়িতে তাঁর বাবাকে পাওয়া যায়নি। তিনি ঢাকায় একটি ফলের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছে। বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। কথা হয় তাঁর চাচা মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘এ ঘটনা জানার পর জয়ের বাবা আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে। ওরে কোলে-পিঠে করে বড় করছি, নিজের সন্তানের মতো। আমার বিশ্বাস হয় না ও এ কাজ করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সুষ্ঠু তদন্ত চাই। আমার ভাতিজা জড়িত থাকলে বা দোষী হলে যে শাস্তি দেয় মেনে নেব। কিন্তু এ ঘটনার নেপথ্যে যারা রয়েছে, তাদেরও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. আলমগীর খানও মোস্তাফিজুর রহমানের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘ও মেধাবী একজন ছাত্র ছিল। সবাই তার প্রতি সন্তুষ্ট ছিল। আমার জানামতে এলাকায় কেউ বলতে পারবে না, এলাকায় খারাপ কাজ করছে। কিন্তু ঢাকায় পড়ালেখা করে। অনেকে দেখতে পারে না বা জানতে পারে না যে ও কী করে। হয়তো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিশে খারাপ পথে যেতে পারে।’
আরও পড়ুন: